পাত্র বদলানোর ঘটনাটা পাত্রীর বাবা-মা জানলেও, পাত্রীর আর জানা হলো না। বিষণ্ণ মনে বসে রইল আশকোনায়। গানের সুরে উদাসীনতা। সে এক পর্যায়ে গিয়ে থেমে গেল। গানের মাঝামাঝিতে শুধাল,
-“আচ্ছা, আমাদের কখন কী করা উচিত—তা বুঝব কী করে?”
বাঁশীওয়ালা স্মিত হাসল,
-“মন যা বলবে, সেটুকু বাদ দিয়ে সব করা উচিত।”
-“মনের কথা শুনব না বলছেন?”
-“শুনবে না। মন কখনো তোমার কথা ভাববে না। মন তারই চিন্তা করে আসবে, যে ব্যক্তিটা তোমার মনের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে আয়েশ করছে।”
প্রীতি ঠোঁট ওলটাল,
-“এখন কী হবে?”
বাঁশিওয়ালা বাঁশিতে ঠোঁট গুঁজল, সুর তুলল বেশ প্রশান্তভাবে। প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গান ধরল,
-“সখী তোরা প্রেম করিয়ো না, পিরিত ভালা না।
প্রেম করছে যে জন, জানে সে যন, পিরিতের কী যাতনা...”
বাঁশিওয়ালা এ গানের মাঝেতে আবারও বলে উঠল,
-“যতটা যাতনা ভাবছ, অতটাও নয়। ইটস লাইক আ ফায়ার; দ্যাট বার্নস, বাট মেল্টস অ্যাট দ্য সেইম টাইম।”
প্রীতি বড়ো বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
-“আপনাকে আমি চিনি”
-“প্রশ্নটা হয়নি, এটা নিজেকে জিজ্ঞেস করো।”
-“আপনি আমাকে চেনেন?”
বাঁশিওয়ালা হেসে উঠল,
-“এবার ঠিক প্রশ্ন করেছ। কিন্তু আমি উত্তর দেবো না।”
-“কেন?”
বাঁশির সুরে প্রীতির প্রশ্ন এড়িয়ে গেল সে। সময় হয়ে যেতেই প্রীতির উঠে পড়া লাগল। ফিরে তাকাল বাঁশিওয়ালা। সূক্ষ্ণ চাহনি তার। -২.৭৫ পাওয়ার গ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল রিকশাতে ওঠা প্রীতিলতার দিকে। আকাশের শুক্লা একাদশীর বাঁকানো চাঁদের মতো এক হাসি তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। বিরবির করে সে বলল,
-“প্রীতিলতা, তোমায় আমি চিনি? মেইবি ইয়েস, মেইবি...”
পরের বাক্যটা সম্পূর্ণ করার ইচ্ছে দেখাল না সে। উঠে চলে গেল এপাশের প্রথম স্টলটায়। আবদুল চাচা তাকে দেখেই হেসে বললেন,
-“কী অবস্থা?”
প্রত্যুত্তরে সে-ও হাসল,
-“এই তো, যাচ্ছে দিনকাল। সিগারেট হবে?”
-“এত ঘন ঘন স্মোকিংয়ে কলিজা কালো হয়ে যাবে।”
আবদুল চাচা সিগারেট আর লাইটার এগিয়ে দিলেন। অদ্ভুত লোকটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেটে প্রথম টান দিলো। আনমনে বলে উঠল,
-“আজকালকার মেয়েদের ফেভারিট কালার নাকি ব্ল্যাক। ব্যাপার না, চাচা। কলিজা কালো হোক বা ঠোঁট, কারো অপছন্দ হবে না।”
আবদুল চাচা শব্দ করে হেসে উঠলেন। বাঁশিওয়ালা ওদিকে তাকিয়ে বলল,
-“চাচা, তোমার এই স্টলের পেছনের গল্প বলো তো।”
-“তেমন কিছু না। রিটায়ার্ড হয়েছি বছরখানেক আগে। সারাজীবন খেটে এসেছি, এখন বসে থাকতে ভালো লাগে না। যৌবনে রান্না-বান্নায় ঝোঁক ছিল। তো দিয়ে বসলাম এই ফুডকোর্ট।”
-“তুমি একটা থ্যাংকস পাও, চাচা।”
বাঁশিওয়ালার অপ্রশস্ত হাসিতে কপাল কোঁচকাল আবদুল চাচা,
-“কী উপলক্ষে?”
-“এত সুস্বাদু চায়ের লোভে ভাতিঝি প্রায় সন্ধ্যারাতে এখানে আসে।”
আবদুল চাচা হো হো করে হাসলেন,
-“ভাতিঝি তো তোমার বাঁশির মোহতে আসে।”
-“চাচা, তোমার কি মনে হয়, সামনে কী হবে?”
-“যা হবার হবে। যা হচ্ছে, তা উপভোগ করো।”
-“আমার যে এখন গালে হাত দিয়ে মেয়েটার সামনে বসে তার দিকে তাকিয়ে থেকে গান শুনতে ইচ্ছে করছে?”
-“সবুর করো। যা হওয়ার, তা ঠিকই হবে।”
-“সবুর? কী বিশ্রী শব্দ!”
_____
স্মরণ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রথম যেটা ভাবল, সেটা হচ্ছে নীহম কোথায়! আদৌও এখানে আছে কি? এসব ভাবতে ভাবতে লাইব্রেরিতে ঢুকল। হিস্ট্রির সাইড থেকে মোটা একটা বই বের করতেই ঠিক ওপর পাশে নীহমকে দেখতে পেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই ওলটাচ্ছে। নীহম যখন এদিকে ফিরল, সাথে সাথে স্মরণ বইটা তার পূর্বের জায়গায় রেখে দিলো।
কিন্তু মুখোমুখি তো হওয়া দরকার! আবারও যখন বইটা বের করে নিল, অপরপাশে নীহমকে দেখা গেল না। সেকেন্ডে গায়েব হয়ে যাওয়ার বিশেষ গুনাবলি নিয়ে জন্মেছে নাকি? স্মরণ ডানপাশ দিয়ে শেলফের অন্যপাশে চলে এলো। এটা সাইকোলজির কর্নার। নীহম এখানেও নেই। স্মরণের ঘাড় ব্যথা করছে। একহাত দিয়ে কাঁধের একপাশে মালিশ করতে লাগল।
ঠিক এরপরের শেলফের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে নীহম। সে হাসছে। লাইব্রেরিতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই তো নীহম টের পেয়েছে। পাবে না? তার প্রিয় পুরুষের সুগন্ধি এই পুরো ইউনিভার্সিটি দ্বিতীয় কেউ ব্যবহার করে না। তাছাড়া তার হাঁটার ধরন, জুতো খটখটে শব্দ... এসব ভাবতে ভাবতে নীহম আচমকা স্মরণের পিছে এসে দাঁড়াল।
স্মরণ এবার ঘুরতেই নীহমকে দেখতে পেল। তার একমাত্র সুন্দরী সমস্যাটা! স্মরণের চাহনি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। সাদা শার্টের স্লিভস ফোল্ড করতে করতে বলল,
-“কী অবস্থা?”
নীহম স্মরণের চোখে চোখ রেখে ঘাড় ডানে কাত করল। শান্ত গলায় বলল,
-“খুব বিয়ের শখ জেগেছে? মেটাব?”
_________
রাতে ফেরার পর প্রীতির ভীষণ জ্বর এলো। সে কাউকে জানাল না তা। রাতে খেতেও নিচে গেল না। সকালের দিকে একটু কমলেও, সে নিজের রুমে রইল। কলেজে গেল না। বাড়ি থেকেও বেরোল না। অদ্ভুত বিষয় হলো, বাড়ির কেউ জানল না পর্যন্ত যে প্রীতিলতা একশত তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সারারাত গুঙিয়ে কেঁদেছে।
নক্ষত্র পড়াতে এলো সন্ধ্যে নাগাদ। জ্বর তখন কমের দিকেই। নক্ষত্র খেয়াল করল প্রীতির লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটো। নিশ্চিত হতে শুধাল,
-“অল ওকে?”
প্রীতি ওপর-নিচ মাথা নাড়ল। এত শান্ত তো মেয়েটা ইহজনমে ছিল না। নক্ষত্র ভেতরে ভেতর অস্থির হতে লাগল। বাইরে থেকে নিজেকে ভীষণ শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টাও একপর্যায়ে মরি মরি করে মরে গেল। সে বেশ অধৈর্য হয়েই শুধাল,
-“ঠিক আছো, প্রীতিলতা?”
প্রীতি বলল,
-“ঘুম কম হয়েছে রাতে, তাই আর কী।”
-“তাহলে তোমার ঘুমানো উচিত।”
-“আচ্ছা।”
নক্ষত্র ডাকল,
-“প্রীতিলতা?”
এত গম্ভীরভাবে কেউ ডাকে? তার নামটা কত সুন্দর! এত সুন্দর নামটা সুন্দরভাবে, হাসিহাসি মুখে ডাকতে হয়। লোকটাকে কেউ সুন্দর করে ডাকতে শেখায়নি? প্রীতিলতার বেশ মন খারাপ হতে লাগল। জ্বর তো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। চোখ-মুখ কুঁচকে ডাকশোনা জবাবে বলল,
-“কী?”
-“অসুস্থ?”
-“না।”
-“জ্বর এসেছে?”
-“হ্যাঁ।”
-“তাহলে সুস্থ কীভাবে?”
-“কারণ আমি বলেছি তাই।”
-“থার্মোমিটার কই?”
প্রীতি হাতের ইশারায় বেডসাইড টেবিলের প্রথম ড্রয়ারটা দেখিয়ে বলল,
-“ওটার সাদা বক্সে।”
নক্ষত্র থার্মোমিটার নিয়ে এসে প্রীতিকে বলল,
-“হা করো।”
-“পারব না।”
-“করো।”
নক্ষত্রের রূঢ় আওয়াজ আর শক্ত চাহনিতে প্রীতি বিরক্ত হয়ে বেশ বড়োসড়ো আকৃতির হা করল। নক্ষত্র থার্মোমিটারটা জিভের নিচে রেখে বলল,
-“মুখ বন্ধ করো।”
প্রীতি মুখ বন্ধ করতেই নক্ষত্র সামনে এসে বসল। টেবিলের বই-খাতাগুলো গোছাতে গোছাতে আড়চোখে তাকাল প্রীতির দিকে। প্রীতি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছে। এমনিতেই তার চোখ দুটো বেশ বড়ো। এভাবে তাকানোতে কেমন অদ্ভুত রকমের মায়াবি লাগছে।
নক্ষত্র চোখ সরিয়ে নিল। ওর মুখ থেকে থার্মোমিটার নিয়ে দেখল একশত দুই ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর। জিজ্ঞেস করল,
-“কবে থেকে? গতকালও ঠিক ছিলে!”
-“গতকাল ঠিক ছিলাম আপনাকে কে বলল? আপনি তো একদিন পর পর পড়াতে আসেন।”
নক্ষত্র কপালে আঙ্গুল চালিয়ে বিরবির করল,
-“জ্বরের ঘোরে লোকের মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়, আর প্রীতিলতার বুদ্ধির বাল্ব জ্বলে। ইন্ট্রেস্টিং!”
প্রীতি আবার বলল,
-“উম্ম, গতকাল রাত থেকেই।”
-“মেডিসিন নিয়েছ?”
-“নাহ। আমার ওষুধ লাগে না। কালো মেয়েদের গায়ের চামড়া এতটাই মোটা যে তারা সহজে অসুস্থ হয় না। অসুস্থ হলেও বেশিদিন লাগে না সুস্থ হতে। দেখবেন আপনার নেক্সট ডেতেই আমি ফিট অ্যান্ড ফাইন!”
-“কেউ কিছু বলেছে?”
-“হু, মা।”
-“কী বলেছে?”
প্রীতি বেশ উদাসীন হয়ে বলল,
-“বলেছে, আমাকে নাকি বিয়ে দিতে পারছে এই সাতজন্মের ভাগ্য আমার। আজকাল নাকি কালো মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায় না। আমার বিয়ে নিয়ে তার অনেক দুশ্চিন্তা ছিল। এখন চিন্তামুক্ত সে।”
-“এসব বলেছে?”
-“হু, আরও অনেক কিছু বলেছে।”
-“কী?”
-“বলব না।”
নক্ষত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
-“তুমি যে অসুস্থ এটা তারা জানেন?”
-“নাহ।”
-“আশ্চর্য!”
নক্ষত্রের আওয়াজ বেশ জোরেশোরে শোনাল। প্রীতি বলল,
-“মাকে আর চিন্তায় ফেলতে চাইনি। বাবা রাতে দ্রুত ঘুমায় আর সকালে অফিসে চলে যায় বলে জানে না। এলে জেনে যাবে।”
-“খেয়েছ কিছু?”
-“উহু।”
-“সকালে?”
-“না।”
-“বোলো না গতরাত থেকেই না খাওয়া!”
প্রীতি হাসল। সে হাসিতে অতিষ্ঠ হয়ে নক্ষত্র বেরিয়ে গেল রুম থেকে। বাড়ির সবাই শুরু থেকেই জানে, নক্ষত্র নুরনাহারের আরেক ছেলে। ব্যাপারটা অনেকটা ঘোলাটে। কেউ টিউটর খুঁজেছে, নাকি টিউটর নিজ থেকেই টিউশনির জন্য এ বাড়িতে হাজির হয়েছে—তা জটিল বেশ। জটিলতায় না যাওয়াই ভালো। আমেনার মা জানেন, নক্ষত্রের সাথে প্রীতির বিয়ে ঠিক হয়েছে। তিনি তাই নক্ষত্রকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
-“বাবা, ভালো আছো?”
-“ভালো আছি। আন্টি কোথায়?”
-“বাপের বাড়ি গেছে সে। তুমি কও, কিছু লাগবে?”
নক্ষত্র কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,
-“কিচেনটা দেখিয়ে দিন, খালা।”
.
.
.
চলবে.............................................................