প্রাণোদাহ - পর্ব ০২ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


অফ হোয়াইট টি-শার্ট, চুলগুলো এলোমেলো ও বড়ো, চোখে মোটা ফ্রেমের গ্লাস, তাকানোর ধরন... প্রীতির স্তব্ধ হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে অভদ্রলোকটা বলল, 
-“ইট'স নক্ষত্র, প্রীতিলতা। তহমিদ আবরার নক্ষত্র। মনে থাকবে তো? হুহ?”

প্রীতি গলে গেল। এ লোক অন্তর্যামী নাকি? প্রীতির স্থিরতায় নক্ষত্র চোখ সরিয়ে নিল। নিজ থেকেই উচ্চতর গণিতের একটা বই বের করে প্রথম চ্যাপ্টার থেকে পড়ানো শুরু করল। প্রীতি আর তাকাল না তার দিকে। 
দেড় ঘন্টা পড়িয়ে নক্ষত্র উঠে দাঁড়াল। কোনো বাক্য ব্যয় না করে সোজা বরাবর রাস্তা ধরে রুম থেকে বেরোতে লাগল।

প্রীতি এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা দম ছাড়তেই কেমন একটা সুরেলা আওয়াজ শুনতে পেল। চকিতে তাকাল নক্ষত্রের দিকে। সে হুইসলিং করতে করতে হাঁটছে, দু-হাত পকেটে গোঁজা, পেছন থেকে তার চওড়া পিঠ দেখা যাচ্ছে। প্রীতি হেলান দিয়ে পড়ে গেল চেয়ারের ওপর, গলে গেল আরও এক দফা। বোধহয় মরে যেতে আর দু'কদম মাত্র বাকি। 

টাটকা বাতাস খেতে কিছুক্ষণ পর প্রীতি বারান্দায় গেল। গা মোচড়াচ্ছে ভীষণ। চুলগুলো হাতখোঁপা করে মাথার ওপরে বেঁধে ফেলল সে। বড়ো করে একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতেই তার চোখ গেল বাড়ির সামনের ওই টঙের দোকানে। এক অত্যন্ত সুন্দর চেহারার লোক হাতের দুই আঙ্গুলের ভাঁজে সিগারেট গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটা তার টিউটর, নাম নক্ষত্র। তহমিদ আবরার নক্ষত্র। এভাবেই তো মনে রাখতে বলেছিল। ঠিক না? 

নক্ষত্র নামের এই লোকটা নিজের মানিব্যাগ প্যান্টের পেছনের পকেটে গুঁজে ফের হাঁটা ধরল। হাঁটতে হাঁটতে হাতের সিগারেটটা ঠোঁটে গুঁজল, ধোঁয়াটে হলো শূন্যতা। 
প্রীতি ঠাস করে পড়ে গেল বারান্দার মেঝেতে। হাত দুটো এখনো ধরে আছে গ্রিল। মুখটা লেগে আছে গ্রিলের ফাঁকে। এবার সে তৃতীয় দফায় গলে পড়েছে, বোধহয় মরেও গেছে। কে জানে কী! 

______

নক্ষত্র বাড়ি ফিরে রুমে প্রবেশ করতেই কিছু একটা দেখল, তারপর চমকে উঠল। তার চমক বহিঃপ্রকাশের ধরনটা কিঞ্চিৎ অদ্ভুত। কেবল ভ্রু উঁচু করা আর তাকিয়ে থাকা। এটুকু। এটুকু দেখে তার সামনে দাঁড়ানো জলজ্যান্ত চমক একই ভঙ্গিতে বাঁ-ভ্রুটা উঁচুতে তুলে জিজ্ঞেস করল,
-“কী অবস্থা?”

নক্ষত্রের কোঁচকানো কপাল শিথিল হলো। জবাবে ছোট্ট করে বলল,
-“ওহ, তারমানে তুই-ই।”
-“হু।”

নক্ষত্র তাকাল ভদ্রলোকের হাতে ধরে রাখা একটা ফোটোফ্রেমে। সেখানে এই দুইজন ব্যক্তির কৈশোর ও তারুণ্যের ছবি আছে। একজন হচ্ছে স্বয়ং নক্ষত্র আর দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তার ছয় বছরের বড়ো ভাই। যিনি বর্তমানে এই ফ্রেমটা ধরে আছেন, তিনি। তার নাম তানজিদ আবরার স্মরণ। তো জনাব চাকরির সুবাদে অন্য এলাকায় থাকেন। আজ এমন অদিনে, অর্থাৎ কর্মদিবসে তিনি এই ভিটায় করছেনটা কী। প্রশ্ন এটাই৷ জবাব দ্রুত মিলল। স্মরণ বলল,
-“আই জাস্ট ট্রান্সফার্ড। এখন থেকে এখানেই থাকব। মাল নিয়ে খালাস হ আমার রুম থেকে।”

বড়ো ভাই গৃহত্যাগী হতেই, নক্ষত্র তার রুম দখল করে নিয়েছিল। আচমকা উড়ে এসে এভাবে বললেই তো হয় না! নক্ষত্র শক্ত গলায় বলল,
-“এটা এখন আমার রুম। তুই চাইলেই একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে পারিস না।”
-“পারি।”
-“না।”
-“আব্বাকে ডাকব?”
-“আম্মুকে ডাকব?”
-“বের হ।”
-“তুই লাথি খাবি?”
-“আর তোকে স্বর্গের আঙ্গুর খাওয়াব, ভেবেছিস?”

নক্ষত্র অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় দু-ধারে মাথা নাড়ল। তারপর একটা টিশার্ট, আরেকটা ট্রাউজার, একটা টাওয়াল আর হাবিজাবি দু-চারটে জিনিস নিয়ে নক্ষত্র এটা-সেটা বিরবির করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে স্মরণের ফোনে একটা টেক্সট এলো। অনুধাবনমাত্রই সে নতমুখী হয়ে হেসে ফেলল। পকেট থেকে ফোন বের করে চলে এলো নক্ষত্রের ইনবক্সে। সেখানে সদ্য আসা টেক্সটটা হলো, “আই মিসড ইউ, ভাইয়া।”

স্মরণের হাসি প্রশস্ত হলো, রিপ্লাইয়ে লিখল, “আই ফিল দ্য সেইম, কিডো।”

তাদের সম্পর্ক এমন যে, মুখোমুখি প্রকাশ্যে অনুভূতির সর্বোচ্চ তাচ্ছিল্য তারা করে। অথচ ভেতরের সত্য এটুকুই, একে-অন্যের জন্য জান দিতে তারা দু-বার ভাববে না।

যতবার স্মরণ নিজের ফোন হাতে তোলে ততবারই তার কাজ হলো নির্দিষ্ট একটা আইডির আশপাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে আসা। বরাবরের মতো স্মরণ 'aafrahhh_nee' নামের ইনস্টাগ্রাম একাউন্টটিতে স্ক্রল করতে লাগল। একটা স্টোরি এলো মাত্র। স্মরণ দেখতে পেল, নির্দিষ্ট মেয়েটা কিছু বইছবি তুলেছে। সাইকোলজি সম্পর্কিত কিছু ইংরেজি বই। 
স্মরণ দ্রুততার সাথে কোনো এক ওয়েবসাইট থেকে বইগুলো অর্ডার করে, মেয়েটার ফেইসবুক একাউন্টে চলে গেল। টাইমলাইনে কিছুক্ষণ আগে পোস্ট করা হয়েছে ইনস্টা স্টোরির ওই বইছবি। যেখানে মেয়েটা কোনো এক পাহাড়ি কটেজে বসে আছে, হাতে ধরে রেখেছে বই, সাথে কিছু জঙলি ফুল। এত শান্ত ও শান্তি শান্তি ছবিটা, তবু কেন যে স্মরণ সাহেব অশান্ত হয়ে উঠল! 

কমেন্টবক্সে 'কাওসার' নামের এই একাউন্ট থেকে একটা কমেন্ট এসেছে, 
-“যার ছবি তোলার হাত এত সুন্দর, আল্লাহ তারে কত সুন্দর বানাইসে, ভাবতেই ভাল্লাগতেসে।”

স্মরণ আইডির লিংক কপি করল। এরপর আবারও কমেন্টটা দেখতে আসতেই আফরাহ্‌ নীহম আইডি থেকে কমেন্টের রিপ্লাই এলো,
-“ব্লকের আগে জানিয়ে দিই—আপনার কমেন্ট আর চেহারা, দুইটাই বিষ্ঠার মতো।”

আর তারপর দুটো কমেন্টই অদৃশ্য হয়ে গেল। স্মরণ কপি করে রাখা আইডির লিংকটা এক বন্ধুকে দিয়ে বলল, 
-“ওর বায়োডাটা লাগবে।”
-“এক ঘন্টা দে।”

স্মরণ শান্তি শান্তি অনুভবের জন্য পুনরায় নীহমের ছবিগুলো দেখতে লাগল। 

_______

প্রতিদিনের মতো আজ সন্ধ্যাতেও প্রীতি শহরের মধ্যের এক পুরোনো পুকুরের ধারে এলো। পুকুরটার নাম আশকোনা, বেশ সাজানো ও চৌকোনা পুকুর, চারপাশে অনেকগুলো করে সিঁড়ি। আর দু-পাশে বিভিন্ন ফাস্টফুডের স্টল। বাকি দুইপাশ বরাবরের মতো খালি। 

তারমধ্যে একদিকটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে, গন্ধরাজ ফুলের তীব্র, মিষ্টি ও স্নিগ্ধ সুবাসে সে এক অন্য জগৎ যেন। সোডিয়ামের মেটে রঙা আলো মোহাচ্ছন্ন করে তোলে। প্রীতি মাঝের দিকের এক সিঁড়িতে গিয়ে বসল। তার ঠিক চার সিঁড়ি সামনে বসে আছে এক ভদ্রলোক। কোঁকড়ানোচুল তার। হাতে বাঁশি। সন্ধ্যে থেকে বেশ রাত অবধিই সে এখানে বসে থাকে, বাঁশির সুর তুলে সবকিছুতে অদ্ভুত শান্তি এনে দেয়। এই সুর, এই শান্তির লোভেই প্রীতি দু'দিন পর পর আশকোনাতে আসে, লোকটাও তাই।

সে প্রতিদিনের মতো সুর তুলছে। প্রীতি সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই বাঁশির সাথে গান মিলিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল, 

কইয়ো কইয়ো কইয়ো রে ভ্রমর, কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
মুই রাধা, মইরা যামু রে...
কৃষ্ণহারা হইয়্যারে ভ্রমর, কইয়ো গিয়া...

বাঁশিতে চেপে রাখা ঠোঁটদুটো কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলো। প্রতিদিনই এই মেয়েটা আসে। তার বাঁশির সাথে গলা মেলায়। এত মিষ্টি আওয়াজ মেয়েটার! তার মনে হয়, একটা জাদুর পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য তার বাঁশি আর এই অপরিচিতার গলাই যথেষ্ট। 

একসময় গিয়ে লোকটা থেমে গেল। পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেট বের করল। ধোঁয়া পেতেই উঠে গেল প্রীতি। উলটো দিকে একটা চায়ের দোকান আছে। এখানে যেই মটকা চা পাওয়া যায়, তাতে বাদাম দেওয়া হয়। প্রীতির কী যে ভালো লাগে! সে চা নিয়ে এসে আবারও নিজের জায়গায় বসল। লোকটা সামনে বসে সিগারেট ফুঁকছে, প্রীতি তার পিছে চা খাচ্ছে। 

কিছুক্ষণ পর আবারও বাঁশি বাজানো শুরু হলো। প্রীতিও গান ধরার চেষ্টা করল। এবার যে কী গান গাইছে... বুঝতে পারছে না প্রীতি। তাই জিজ্ঞেস করেই বসল,
-“স্যরি ফর ইন্টারাপ্ট, গানের নামটা একটু বলবেন, ভাইয়া?”

ভদ্রলোক বোধহয় একটু থমকাল, সময় নিল। খানিকটা পরে গম্ভীর ও কর্কশ আওয়াজে বলল, “প্রাণ চায় চক্ষু না চায়।”

আওয়াজটা তার পরিচিত ঠেকল। কিন্তু কিছু বলল না। আনমনে মাথা নেড়ে গুগল সার্চ করল। ঘড়িতে তখন দশটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি আছে, এটুকু নোটিফাই হতেই সে উঠে পড়ল। একটা রিকশা ডাক দিয়ে বলল,
-“মামা, যাবেন?”

তারপর উঠে পড়ল ওই রিকশায়। পুকুরের জলে পড়ে থাকা অর্ধাকৃতির চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে লোকটা ফের বাঁশিতে সুর তুলল, ভ্রমর রে...

প্রীতির বাড়ি ফিরতে বাজল রাত নয়টা আটান্ন। দশটা বাজতে এখনো দু'মিনিট বাকি আছে দেখে হাঁফ ছাড়ল, মায়ের বকুনি থেকে বেঁচে যাবে। অথচ বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল আরেকই কাণ্ড। বাবা বাড়িতে আছে, মা নেই। কেন নেই? এত রাত! বসার ঘরে বাবাকে দেখতে পেয়েই প্রীতি এগিয়ে গেল। দ্বিধান্বিত গলায় শুধাল,
-“আম্মাজান কই?”

শামীম সাহেব বললেন,
-“নাইয়র।”
-“ওমা, এতরাতে?”
-“ঝামেলা হয়েছে।”
-“কী ঝামেলা, বাবা?”
-“তোমার রাকিব ভাই, সে তো কাহিনি করেছে।”
-“আশ্চর্য! কী কাহিনি?” 

শামীম সাহেব থামলেন, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্রীতির দিকে। তারপর গম্ভীরমুখে বললেন,
-“তোমাকে বিয়ে করবে।”

প্রীতি অবাক হলো,
-“আল্লাহ! ও না বিয়াত্যা? কয়দিন আগে বিয়ে করল?”
-“দ্বিতীয় বিয়ে করবে। চার বিয়ের হাদিস গায়।”
-“বাবা, বুকে ব্যথা করছে। মা রাকিব বলতে পাগল, আবার বোলো না সে রাজি....”
-“সে রাজি। তোমার নাকি তার সাথে সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক। তুমি নাকি তার জন্য হাত কেটেছ, ফাঁস নিতে গিয়েছ? এখন নাকি মরেই যাবা?”
.
.
.
চলবে.............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন