ডাইনিং টেবিলে তখন পিনপতন নীরবতা। কাটা চামচের শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘনঘন। অরিন দেখে যাচ্ছে তার মা বাবাকে। কথা হচ্ছে— সে কিছু বলবে। তার কথাগুলো তার মা বাবা কিভাবে নিবে সে জানে না। তবুও সে বলবে। অরিন দ্বিধাহীন বলল, “বাবা।”
অরিনের বাবা আবুল হোসেন ঘুরে তাকালেন। বললেন,
“হুম।”
“আমার কিছু বলার আছে?”
“বলো।”
অরিন সরাসরি বলে দিল,
“আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করতে চাই।”
মুহুর্তের মধ্যে চারপাশ কেমন যেন করে উঠল। অরিনের মায়ের গলায় খাবার আঁটকে গেল। তিনি কাশতে শুরু করলেন। আবুল হোসেন বললেন,
“এসব তুমি কি বলছ?”
“না বোঝার মতো তো কিছু বলিনি বাবা। তুমি আর মাও তো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে।”
আবুল হোসেন দমে গেলেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। কিছু সময় চুপচাপ থেকে বললেন,
“ছেলেটা কি করে?”
“জানি না।”
“জানো না?”
“না কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“বাড়ি কোথায়?”
“কোথায় যেন বলেছিল মনে পড়ছে না।”
“তোমার মেয়ের কথা শুনেছ সাথী।”
সাথী বেগম কিছু বললেন না। আবুল হোসেন আবার বললেন,
“ছেলেটার নাম কি?”
“তোমরা চেনো বাবা আহির ভাইয়ার বিয়ের সময় দেখা হয়েছিল।”
“নাম বলো?”
“শান্ত।”
এবার যেন আরো বিস্মিত হলেন আবুল হোসেন আর সাথী বেগম। সাথী বেগম বললেন,
“কোন শান্তর কথা বলছ?”
“তুমি যাকে মনে করেছ।”
আবুল হোসেন রেগে গেলেন। জানালেন,
“ওই যে তিনটে ব্যাচেলার ছেলে তার মধ্যে যে ছেলেটা কথা বলতে পারে না। তুমি তার কথা বলছ?”
“এই তো মনে পড়েছে।”
“তোমার মাথা ঠিক আছে?”
“আমাকে দেখে কি মনে হয় আমার মাথা খারাপ হয়েছে?”
“ছেলেটাও ভালোবাসে তোমায়?”
“আমি এখনও কিছু বলিনি।”
“সাথী তোমার মেয়ের মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে।”
“দেখো বাবা তুমি কিন্তু আমায় চেনো, দরকার পড়লে ওই ছেলেকে তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করে ফেলব যেভাবে তুমি মাকে করেছিলে।”
কাশি উঠে গেল আবুল হোসেনের। এই মেয়ে পুরোপুরি তার মতো হয়েছে। সাথী বেগমের দিকে কড়া দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন আবুল হোসেন। এই তুলে নিয়ে আসার ব্যাপারও মেয়েকে জানানো লাগে। সে কি জানে না তার মেয়েটা কেমন! জনসম্মুখেও এই কথা বলতে তার দ্বিধা কাজ করবে না। সাথী বেগম স্বামীর দৃষ্টি দেখে বুঝতে পেরে মৃদু হাসলেন। অরিন বলল,
“দেখো বাবা, আমি এক কথার মানুষ। জীবনে কোনো ছেলেকে ভালোবাসিনি কিন্তু ওই চাশমিশকে কি দেখে ভালোবেসে ফেললাম বুঝতে পারছি না। ওই ছ্যামড়ারে আমার চাই।”
“ভদ্রভাবে কথা বলো অরিন।”
“দেখো বাবা, তুমি জানো আমি যথেষ্ট অভদ্র। আহির ভাইয়ার বিয়ের সময়ও তুমি আমাকে বলেছিলে আমি যেন ভদ্রভাবে থাকি আমি থেকেছি। আমি আধতেও কেমন চরিত্র কাউকে বুঝতে দেইনি। তাই আর ভদ্র হতে বলবে না। ভদ্র হওয়ার চক্করে বিনাদোষে শান্তর গালে থাপ্পড় মেরেছিলাম। যদিও মেরেছিলাম বলেই হয়তো আজ তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।”
“তোমার কি লজ্জা করছে না বাবার সামনে এইভাবে কথা বলতে?”
“উফ বাবা। ওসব বাদ দেও। বিয়ে কবে করব যেটা বলো?”
“কোনো বোবা ছেলের সঙ্গে আমি তোমার বিয়ে দিব না।”
“কেন দিবে না?”
“ওই ছেলেটা কথা বলতে পারে না। আমি সমাজের কাছে কিভাবে মুখ দেখাব?”
“দরকার পড়লে মুখে মাস্ক পড়ে ঘুরবে।”
“অরিন।”
“যে বাবা নিজের বউকে তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করতে পারে সে নাকি সমাজের ভয় দেখাচ্ছে।”
আবারও দমে গেলেন আবুল হোসেন। অসহায় কণ্ঠে আওড়ালেন,
“তুমি ওর সাথে থাকবে কি করে?”
অরিনের সাবলীল উত্তর,
“বাকশক্তিহীন হলেও শান্ত মানুষটা খুব ভালো।”
•••••••••••••
“ফাবিহার সাথে আমার যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল তপ্ত দুপুরের ঘর্মাক্ত মুখশ্রীর সঙ্গে। আমি সেদিনই ওর প্রেমে পড়ে যাই। আমি কিছুতেই সেটা বুঝতে দেইনি। আজও না। কারণ আমি শুরু থেকেই জানতাম ফাবিহাকে দেখার আগেই সে আমার জন্য নিষিদ্ধ। ঘটনাটা হলো— বিথীর বাবার অপমানের পর আমি হন্তদন্ত হয়ে যখন বাড়ি খুঁজছিলাম সেই মুহূর্তে রাস্তায় মাসুদ আঙ্কেলের সাথে সাক্ষাৎ। তিনি আমায় দেখেই চিনে ফেলেছিলেন। যেমনটা আমি চিনেছিলাম। হাসি মুখে জানালেন, “কি ব্যাপার আরহান, কেমন আছো তুমি?”
স্যারের কথায় আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
“আপনি আমায় চিনেছেন স্যার?”
তিনি হেঁসে জানালেন,
“তোমাকে আমি ভুলিই নি। আসো চায়ের দোকানে বসি।”
মোড়ের দোকানেই চা খেতে বসলাম। প্রায় মিনিট বিশ সময় ছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কিছু হয়েছে?”
শুরুতে বলতে চাইনি। পরবর্তীতে স্যার জোর করায়— বলে ফেলি সবটা। স্যার আমায় বুঝলেন। এবং ভেবে বললেন,
“তোমার সমস্যার সমাধান আমি করতে পারি। আমার নিজেও একটা বাড়ি আছে তার নাম অতিথি নিবাস। তুমি চাইলে তোমার বন্ধুদের নিয়ে সেখানে উঠতে পারো।”
“ধন্যবাদ স্যার।”
এরপরই স্যার আকার ইঙ্গিতে বোঝালেন,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি আরহান। আশা রাখি তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে। বাড়িতে আমারও একটা যুবতী মেয়ে আছে।”
“এক্ষেত্রে আপনি ভরসা রাখতে পারেন স্যার। আমি এমন কোনো কাজ করব না যাতে আপনার সম্মানহানি হয়।”
"অথচ সেই কথার ফাটল ধরেছিল প্রথমদিনই। আমি ভেবেছিলাম মায়া কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু ফাবিহাও আমায় ভালোবেসে ফেলবে এটা আমি বুঝতে পারিনি। আমার কষ্ট হচ্ছে তৌহিদ। আমার কষ্ট হচ্ছে।"
বলতে বলতে আর্তনাদে ফেটে পড়ল আরহান। তৌহিদ তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“মন খারাপ করিস না দোস্ত। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”
“এক্ষেত্রে আমি কোনো ঠিক চাই না। তাই আমি দূরে সরে যেতে চাচ্ছি। তোরাও যাবি তো আমার সঙ্গে?”
মাথা নাড়ায় তৌহিদ। যার অর্থ, 'যাবে।'
মেঝেতে বসে কথা বলছিল দুজন। হঠাৎই দরজায় কারো পায়ের ধ্বনি পেতেই নিজেদের স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল তৌহিদ আর আরহান। সামনে তাকিয়ে দেখল। শান্ত দাঁড়িয়ে। শান্ত একটু বেরিয়েছিল। তৌহিদ আর আরহানের অস্বাভাবিক হাবভাব দেখে সে দ্রুত এগিয়ে আসলো। চিন্তিত স্বরে হাত ইশারায় বোঝাল,
“কি হয়েছে?”
শান্তর থেকে লুকানোর মতো কিছু নেই। অতঃপর তৌহিদ আকার ইঙ্গিতে শান্তকে বুঝিয়ে দিল সবটা। কথা শুনে শান্তও জড়িয়ে ধরল আরহানকে। 'আ' 'আ' জাতীয় দুটো শব্দ করল। তাতেই আরহান বুঝল। শান্ত তাকে বলছে, “সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আছি তো।”
••••••••••••
মাঝরাতে পড়ার টেবিলে বসে বই পড়ছিল মোহনা। এমন সময় তার কক্ষের কপাট আঘাত হানলেন তার বাবা। বললেন,
“মৌ ঘুমিয়েছিস?”
মোহনার বাবা মোহনাকে 'মৌ' বলে ডাকে। মোহনা জেগে থাকায় উত্তর দিল, “না বাবা।”
মোহনার বাবা ভিতরে ঢুকলেন। বললেন,
“এখনও ঘুমাসনি?”
“ঘুম আসে না বাবা।”
“কেন?”
“জানি না।”
“তাই পড়তে বসেছিলি?”
“হ্যাঁ তেমনটাই।”
“বাহিরে যাবি?”
“শীত পড়ছে না বাবা?”
“তাতে কি চাদর মুড়ি দিয়ে চল। চা খেয়ে আসি।”
“এত রাতে চায়ের দোকান খোলা থাকবে?”
“না থাকলে বাড়ি থেকে বানিয়ে নিয়ে যাব।”
হাসল মোহনা। বলল,
“তুমি কিছু বলতে চাও— তাই তো বাবা?”
মৃদু হাসলেন মোহনার বাবা। জানতেন মেয়েটা বুঝে যাবে। মোহনা আর বসে রইল না। উঠে দাঁড়াল। বলল,
“আচ্ছা চলো।”
“তুই চাদর মুড়ি দিয়ে আয়। আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি।”
“আহ্ বাবা! মোড়ের মাথার দোকানটা খোলা থাকতে পারে চলো।”
“আচ্ছা আয়। চুপিচুপি আসিস তোর মা দেখলে যেতে দিবে না।”
“ঠিক আছে।”
মোহনার বাবা চলে গেলেন। তিনি একটু পাগলাটে ধরনের মানুষ। মেয়েদের সাথে সববসময় ফ্রি! আহিরের ব্যাপারটা তাকেই প্রথম উর্মি বলেছিল। ছেলেটা ভালো। বংশও ভালো তাই আর দ্বিধা করেননি।
•••••••••••••
জোনাক রাত্র। শহরের পরিবেশে খুব একটা জোনাকি পোকার আগমন দেখা যায় না। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে। কোথা থেকে এলো কে জানে। মোহনা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে বলল,
“দেখো বাবা কি সুন্দর?”
মোহনার বাবা দেখলেন। একঝাঁক জোনাক পোঁকা বাড়ির উঠোনের বেলগাছটা ঝিঁকে ধরেছে। অদ্ভুত ব্যাপার এসব আসলো কোথা থেকে! তবে ভালো লাগছে বাড়ির উঠোনটা কি সুন্দর আলোকিত হয়ে আছে।'
শহরের রাস্তা তখন প্রায় জনমানবশূন্য। খানিকটা শীত শীত পড়েছে। নভেম্বরের শেষ দিক চলছে। আগামীতেই কঠিন শীত এলো বলে। মোহনা আর তার বাবা বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। মোহনা বলল,
“কি বলবে বলে ফেলো বাবা?”
মোহনার বাবা বললেন না। তবে জানালেন,
“চা খেতে খেতে বলব।”
“তুমিও না বাবা খুবই পাগলাটে ধরনের মানুষ।”
উত্তরে হাসলেন মোহনার বাবা। চায়ের দোকান খোলাই ছিল। এটা অনেক রাত অবধি খোলা থাকে। বাপ ছেলে করে। বাবা অনেক রাত অবধি থাকে আর সকালে ছেলে বসে। মোহনার বাবা ভিতরে ঢুকেই দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। সঙ্গে বসলেন সামনের বেঞ্চিতে। মিনিট পাঁচেক পরই চা দেয়া হলো। মোহনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, “এবার বলো বাবা কি বলবে?”
মোহনার বাবা কিছুক্ষণ সময় নিলেন। এরপর বললেন, “তোর বিয়ে দিতে চাচ্ছি?”
.
.
.
চলবে....................................................................