বুকখানা কেমন যেন ধকধক করছে। অনুভূতিরা অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে। ফাবিহা অধিম আগ্রহে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া পলকহীন। কালো গেটটা খুলে কাঙ্ক্ষিত মানুষটা তখন ঢুকল। কাঁধে কালো ব্যাগ, গায়ে সবুজরঙা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিধিত আরহান হাজির। তাকে দেখা মাত্রই ফাবিহার ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা মিললো। রাহেলা লক্ষ্য করল সেটা। তবে কিছু বলল না। সে তাকিয়ে রইল আরহানের পানে। আরহান শুরুতে এদের কাউকেই লক্ষ্য করল না। তবে যে মুহুর্তে সে অতিথি নিবাসের ছোট্ট গেটটার নিকট পৌঁছাল সেই সময় নজর পড়ল তার। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। উল্টো চোখের নীরব দৃষ্টি সরিয়ে চলে গেল ভিতরে। আরহানের চোখদুটো দূর থেকেও বেশ লক্ষ্য করল ফাবিহা। কেমন যেন ঠেঁকল তার। কিছু কি হয়েছে আরহানের! আগের চঞ্চলতা দেখা গেল না। গম্ভীর মুখদ্বয় ছিল। হয়তো যাত্রাপথের ক্লান্তি!
••••••••••••
বিস্মিত নজরে তৌহিদের দিকে তাকিয়ে আছে মোহনা। বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। হাত-পা কাঁপছে। অস্থিরতায় চারপাশ কেমন লাগছে। মোহনা তার হাতখানা চেপে ধরল শক্ত করে। তৌহিদ বলল, “কি হলো কথা বলছো না কেন?”
মোহনা কি বলবে বুঝতে পারে না। তৌহিদ আবারও বলে, “আমাকে কি অবুঝ মনে হয় মোহনা?”
ঠোঁট জোড়ায় কথার রেখা দেখা না গেলেও মাথা নাড়াল মোহনা। যার অর্থ, 'না।'
তৌহিদ নিজেকে ধাতস্থ করতে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। এরপর বলল,
“হুম! আমি অবুঝ নই। আমি তোমার চোখ দেখি। চোখ দিয়ে মানুষ অনেক কিছু বলতে পারে। আমি তোমার সেই চোখ পড়েছি। অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছি। তবে এগুলো ঠিক নয়।”
মোহনার মন ভেঙে গেল। সে বুঝতে পারল অনুভূতিগুলো ভুল জায়গায় বাসা বেঁধেছিল। মোহনা মাথা নুইয়ে ফেলল,
“কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়?”
“ভালোবাসায় কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু ভুল মানুষকে মন দিয়ে ফেলা অন্যায়। তুমি তো জানো আমি তোমার কি হই?”
“স্যারদের কি ভালোবাসা যায় না?”
“না যায় না।”
স্পষ্ট উত্তর তৌহিদের। মোহনা আবার প্রশ্ন করে,
“আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন তাই না?”
“ধরে নেও তাই।”
“ধরে নিব?”
বিস্ময়কর প্রশ্ন মোহনার। তৌহিদের তড়িৎ উত্তর,
“হ্যাঁ ধরে নিবে।”
“আপনাকে ভুলে যেতে হবে?”
“অনুভূতি দমানো শিখতে হবে।”
“অনুভূতি কি দমানো যায়?”
“আমি জানি তুমি পারবে।”
মোহনা চুপ করে রইল। তৌহিদ লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার ভালোবাসাকে আমি সম্মান করছি, কিন্তু তোমার ভালোবাসা গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“কারণটা কি শুধুই আমাদের সম্পর্ক শিক্ষক-ছাত্রীর।”
“পুরোপুরি নয় তবে কিছুটা।”
“ভালো থাকবেন।”
“আশা রাখি পুরো বিষয়টা তোমার আর আমার মাঝেই থাকবে।”
“জি স্যার।”
চলে গেল মোহনা। পরিধিত প্যান্টের পকেটে গুছিয়ে রাখা চিঠিপত্রটা তখনও নিরালায় ঘুমিয়ে। তৌহিদ কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দার কার্নিশ ছুঁয়ে মৃদু বাতাসের ছড়াছড়ি। তৌহিদের ফোন বাজল। সে দেখল। ছোট্ট একটা শব্দ, “বাবা।”
ফোনটা তোলা হলো না। দেখতে দেখতেই কেটে গেল। পুনরায় কল আসতেই তৌহিদ কলটা রিসিভ করল। হেঁটে যেতে যেতে বলল,
“আমি একটু ব্যস্ত আছি বাসায় গিয়ে কল করি।”
••••••••••••
শান্তর পাশ দিয়ে কে যেন এসে বসেছে। শান্ত নজরে নিলো না। অরিনের খাবছাড়া চাহনি। লোকটা পড়তে বসলে কি এদিক সেদিক কোথাও তাকায় না। অরিন কিছু সময় চুপ থেকে উঠে দাঁড়াল। কারণ বই আনা হয়নি। সে লাইব্রেরির তাকগুলোতে সাজিয়ে রাখা সকল বইগুলোতে চোখ বুলাচ্ছে আর মাঝে মাঝে শান্তকেও দেখছে। কিন্তু শান্ত তো শান্ত। তার কোনো আগ্রহই নেই আশেপাশে কি হচ্ছে! অরিন দৃষ্টি সরিয়ে নিল। রোমান্টিক বই অনেকগুলো পড়া হয়েছে শেষ ক'দিন। এবার কিছু রহস্যময় পড়লে কেমন হয়। গোয়েন্দা সিরিজ কখনো ধরা হয়নি অরিনের। সে শার্লক হোমসের বাংলা অনুবাদের একটা বই ধরল। এরপর পুনরায় গিয়ে বসল শান্তর পাশ দিয়ে। এবার শান্ত একটু নড়েচড়ে উঠল। অরিনের চোখদুটো ঝলমল করে উঠল আচমকা। কিন্তু পরক্ষণেই নিভে গেল তা। কারণ শান্ত নড়েচড়ে আবার সোজা হয়ে বসেছে তার দিকে তাকায়নি। অরিন হতাশ মনে বইয়ের পাতায় মুখ চুবাল। মনে মনে ভাবল, চাশমিশ ছেলেটা এমন কেন!
•••••••••••
নিস্তব্ধতায় মোড়ানো সময়। পরন্ত বিকেল। বাড়ির পিছনের বারান্দাটা তখন ভেজালহীন শুয়ে। ঘাসের ডগাগুলো মৃদু বাতাসে ওড়ে। মাঠঘাট শুঁকনো। আকাশটাও বেশ পরিষ্কার। আরহান চুপচাপ গিটার হাতে পিছনের বারান্দায় বসে। বাড়িতে সে ছাড়া কেউ নেই। শান্ত বেরিয়েছে। তৌহিদ এখনও ভার্সিটি থেকে আসেনি। আরহানের মনটা বেশ খারাপ। মন খারাপে কারণটা তার অজানা। তবে পুরোপুরি অজানা বললেও ভুল হবে। মন খারাপের কারণটা সে মানতে নারাজ। গ্রামে বসেও বিগত কয়েকদিন যাবৎই তার মন খারাপ। মায়ের হাতের রান্নাটা বড্ড মিস করছে। কাল থেকে আবার আরজে জীবন শুরু করবে আরহান। সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। আগের চেয়ে স্বাস্থ্যটাও খানিকটা বেড়েছে। চুলগুলোও বড়সড় হয়েছে। দাঁড়ি বেড়েছে। গ্রামে থাকায় এসবের দিকে তেমন একটা নজর দেয়া হয়নি। আজকাল নিজের যত্ন নিতে ইচ্ছে করে না।
আরহান আবেশে সকল ভাবনা বাদ দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিল। অনুভব করল তার আশপাশে থাকা পরিবেশটা। বিশাল ওই আকাশটা। কয়েক হাত দূরে অবস্থান করা বড় গাছটা। আর গাছের ডগায় বসে থাকা দুটো পাখির কিচির মিচির শব্দটা। আরহান তার হাতে থাকা গিটারে শব্দ করল। এর কিছু সময় পরই চোখ খুলে নিরিবিলি কণ্ঠে গান ধরল—
❝পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে
Satellite আর cable এর হাতে
Drawing room-এ রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি
আ-হা-হা-হা, আ হা, আ-হা-হা-হা
আ হা, আ-হা-হা
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি
আ-হা-হা-হা, আ হা, আ-হা-হা-হা
আ হা, আ-হা-হা-হা
ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে (২)❞
•••••••••••••
মায়াকুঞ্জের বারান্দায় দৌড়ে এসে দাঁড়াল ফাবিহা। যদিও বা অতিথি নিবাসের পিছনটা দেখা যাচ্ছে না। তবে আরহানের গানের গলাটা শোনা যাচ্ছে মৃদু মৃদু। ফাবিহার ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে আরহানকে মনের কথা বলে দিতে। কিন্তু সাহসে হচ্ছে না। বাড়িতে খুব সম্ভবত আরহান একাই আছে। শান্তকে সে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। তৌহিদ এখনও হয়তো ভার্সিটি থেকে আসেনি। এটাই বোধহয় সঠিক সময় আরহানকে মনের কথা বলে দেয়ার। ফাবিহার সমস্ত শরীর ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। বলে দিবে কি? এ জীবনের সর্বপ্রথম প্রেমে পড়ার ব্যক্তিটির নাম আরহান। ফাবিহার জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষ সে। বলে দিবে কি! যা হয় পরে দেখা যাবে। ফাবিহা অনেক ভেবেচিন্তে বারান্দায় থেকে সরে আসলো। আরহানের গানটাও তখন শেষ হতে চললো প্রায়।
❝তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে❞
গান থেমে গেল। গিটারের শব্দ থেমে গেল। আর ভালো লাগছে না। আরহান গিটার সরিয়ে চুপচাপ বসে রইল অনেকক্ষণ। এ কেমন বিষণ্ণ! বারান্দার দরজায় টোকা পড়ল তখন। আরহান না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ফাবিহার শরীর মন ভীষণভাবে কাঁপে। নিজেকে ধাতস্থ করে শুধায়, “আমি।”
আরহান চমকে উঠল। বিস্মিত হলো। এটা তো ফাবিহার কণ্ঠ। সে তক্ষৎণাৎ ঘুরে তাকাল। মাথা নুইয়ে ফাবিহা দাঁড়িয়ে। আরহান দ্রুত উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি এখানে?”
চোখ তুলে তাকায় ফাবিহা। কেমন যেন ঠেকছে। চলে যাবে নাকি। আরহান প্রশ্ন করে আবার,
“কি হলো কথা বলছেন না যে?”
ফাবিহা অনেকটা সাহস জুগিয়ে বলে,
“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল আরহান?”
আরহান দু'পা এগিয়ে গেল। মুখোমুখি দাঁড়াল ফাবিহার। শান্ত স্বরে আওড়াল,
“জি বলুন।”
ফাবিহা বলে না। ভয় লাগছে। যদি কিছু হয়। এভাবে হুট করে এসে মনের কথা বলাটা কি আধতেও মানানসই। আরহান ফাবিহার চোখ মুখ লক্ষ্য করল। মেয়েটার মন অস্থির। হাত পা কাঁপছে। চোখের পলকও ঘনঘন ফেলছে। আরহান বলে,
“রৌদ্রময়ী।”
বড়ই শ্রুতিমধুর কণ্ঠ আরহানের। যতবার শোনে ততবারই প্রেমে পড়ে যায় ফাবিহা। ফাবিহা বার কয়েক নিশ্বাস ফেলে বলে,
“আমি একটু ভয় পাচ্ছি কথাটা বলতে?”
“ভয় পাওয়ার কি আধতেও কিছু আছে।”
“আমার জন্য আছে।”
“বোধহয়।”
“বলব?”
“বলুন।”
“আপনি কি রাগ করবেন?”
“রাগ করার মতো নিশ্চয়ই কিছু বলবেন না।”
“আমার জীবনের এই পর্যন্ত সময়ে কাউকে এই কথা বলিনি।”
আরহান কি কিছু আঁচ করতে পারল। তার মুখমণ্ডলের ধরন খানিকটা বদলে গেল। ছোট্ট করে বলল, “ভয় না পেয়ে বলে ফেলুন?”
ফাবিহা ভিতরে ভিতরে অনেকটা সাহস জোগাল। এরপর বলল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি আরহান।”
সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেল আরহান। ফাবিহা বিস্মিত হলো। কথাটা বলা কি ঠিক হলো না। আরহান বলে,
“এসব আপনি কি বলছেন?”
ফাবিহা কিছুই বলল না। আরহান বলে,
“এসব সম্ভব নয়।”
“কারণটা কি বলা যায়?”
“আপনি বাড়ি যান।”
ফাবিহা গেল না। কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল। আরহান বলল,
“কি হলো?”
“আমাকে আপনার পছন্দ নয়?”
শক্ত কণ্ঠে শুধায় আরহান, “না।”
আর কোনো কথা হলো না। ফাবিহা ছোট্ট শব্দে জানাল, “ঠিক আছে।”
অতঃপর বেরিয়ে গেল। আরহান তার পানে তাকিয়ে রইল। নিঃস্ব লাগছে চারপাশ। আরহান মনে মনে বলে,
“মানুষের মন ভাঙার শহরে আজ আমি বড্ড ক্লান্ত রৌদ্রময়ী।”
.
.
.
চলবে.......................................................................