দীপশিখা মলিন হাসলো। আপুকে কি করে বুঝাবে, এই মানুষটি তার প্রথম প্রেম ছিলো! দীপশিখার এখনো মনে আছে সেদিনের কথা, যেদিন মানুষটি রুক্ষ্ণভাবে বলেছিলো,
“তোমার কি মনে হয় তোমার লাভলেটারে আমি গদগদ মনে হ্যা বলে দিবো? এমন লাভ লেটার আমি দিনে দশটা পাই।”
কথা খানা এখনো মনে গভীর ক্ষত করে রয়েছে। প্রথম প্রেম বৃষ্টিস্নাত আকাশের সেই আবছা রঙধনু যার আবেশ চিরটাকাল থেকে যায়। দীপশিখার জীবনে কখনো প্রেম আসবে ব্যাপারটি অকল্পনীয় ছিলো। পরিবার ব্যতীত কোনো মানুষের প্রতি সে আসক্ত হবে সেটাই অবিশ্বাস্য ছিলো। ছোটকাল থেকেই বড্ড অমিশুক মেয়ে দীপশিখা। বন্ধুবান্ধবের বালাই নেই। পরিবারের পরিধি ব্যতীত কোনো মানুষকেই তার পছন্দ নয়। তার ব্যক্তিগত বৃত্তে কারোর প্রবেশ অনুমতি ছিলো না। তার অবশ্য একটি বিশেষ কারণ আছে।
তরঙ্গিনী এবং দীপশিখা দুবোন হলেও তাদের চেহারা, বর্ণ, গড়ণে বিস্তর পার্থক্যা। তরঙ্গিনী মায়ের মতো সুন্দরী। শুভ্র বদন, মসৃণ ত্বক, ঐশ্বরিক সৌন্দর্য্যের প্রতীমা। অন্যদিকে, দীপশিখা দেখতে একেবারেই বাবার মতো। বাবার মত রঙ, বাবার মতো মুখাবয়ব, বাবার মতোই সামনের দাঁতের মাঝে ফাঁক। যে কেউ দেখলেই বললো, "এ তো বাবার মেয়ে"। বাবার মেয়ে সে ব্যাপারটিতে দীপশিখার বেশ গর্ববোধ হত। মায়ের রাখা সুন্দর নামের থেকে বাবার রাখা চিংকি তার বেশ পছন্দ। বাবার আদুরে ডাক “চিংকিমা” তার বড্ড প্রিয়। কিন্তু শৈশব পার হতেই বুঝলো সমাজের কাঠামো ধারায় সে বেমানান। তার গড়ন, চেহারা, বর্ণ সবকিছুই প্রশ্নের মুখে পড়লো। আত্নীয়স্বজন রসিকতা করে খোঁচা দিয়ে বলতো,
"চিংকির রঙটাতো দিন দিন চাঁপাই হচ্ছে! নীরু এককাজ কর, ওকে বেশি বের হতে দিস না। বাহিরে খেলাধুলা করলে রঙ আরোও কালো হয়ে যাবে। হলুদ দুধে মিলিয়ে খাওয়া, রঙ পরিষ্কার হবে।"
চাঁপা রঙ্গের সাথে জুটলো তার মোটা হওয়ার খোঁটা। মোস্তফা সাহেব খেতে পছন্দ করেন। বাবার মেয়ে দীপশিখা, তাই সেও খাওয়াদাওয়ায় শৌখিন। ফলে বাবার মতোই স্বাস্থ্যবান সে। এটাও চোখে পড়লো। এমনকি তার সামনের দুটো দাঁতে ফাঁক নিয়েও আপত্তি। শুধু তাই নয়। স্কুলে তাকে নানা রকম ঠাট্টার সম্মুখীন হতে হলো। চিংকি মোটা, চিংকি ফোকলা.. ইত্যাদি উপাধি তাকে মাথা পেতে নিতে হলো। যেকারণে তার বন্ধু জুটলো না।
চিংকির বয়স তখন চৌদ্দ, কেবল ক্লাস নাইনে উঠলো। বিরাট এক কান্ড ঘটিয়েছিলো চিংকি। রাগে ক্লাসের একমেয়ের চুল টেনে ধরেছিলো সে। কারণ মেয়েটি দীপশিখাকে দিয়ে বাজে একটি ছবি এঁকেছিলো৷ তারপর সেটা নিয়ে ক্লাসে হাসাহাসিও হয়েছে। ম্যাডামের কানে যেতেই ঘটনাটির পর নীরুপমা এবং মোস্তফাকে স্কুল থেলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
এরপর থেকে নীরুপমা মেয়ের প্রতি প্রচুর যত্নশীল হলেন। তার খাওয়া পরিমিত করে দিলেন। কড়াভাবে বাসায় বললেন,
"কেউ ওকে চিংকি বলবে না।"
মিষ্টি আনা বন্ধ হয়ে গেলো। দাঁতে ব্রেস লাগানো হলো। সপ্তাহে দুদিন রুপচর্চা করার জন্য বরাদ্দ করা হলো। অবশ্য এসব কড়াকড়িতে মোস্তফা বা দীপশিখার খুব যায় আসে না। মোস্তফা তার মেয়েকে আড়ালে চিংকি বলেই ডাকে। স্ত্রী থেকে লুকিয়ে এখনো মেয়ের জন্য ছানার মিষ্টি নিয়ে আসে। তবে এসবে মানুষের সাথে মেশার ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলো চিংকির। নিজের আশেপাশে এক কঠিন দেওয়াল গড়ে তুললো যেনো কেউ তার পরিসরে প্রবেশ না করতে পারে। কিন্তু সেই কঠিন দেওয়ালের মাঝেও কিভাবে যেনো জাওয়াদ তার বৃত্তে কোনে প্রবেশ করলো।
জাওয়াদ হামিদ স্কুলে থাকতেই বেশ জনপ্রিয় ছিলো। সোশ্যাল বাটারফ্লাই ট্যাগটা তার জন্য একেবারে খাপেখাপ। তার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী কোনোকিছুর অভাব ছিলো না। লম্বা, সুদর্শন কিশোর সে, স্কুলের স্পোর্টস ক্লাবের সদস্য, গান গায়, লেখাপড়ায় ভালো-- সব মিলিয়েই ছেলেটি সবার কেন্দ্রবিন্দু।
কিন্তু কিশোরী দীপশিখার এসব কারণে তাকে ভালো লাগে নি। ভালোলাগার কারণটি ছিলো ভিন্ন। চুলটানাটানির ঘটনার জন্য ক্লাসের মেয়েদের চক্ষুশূল হলো দীপশিখা৷ দীপশিখাকে খুব একটা বকুনি খেতে হয় নি। কিন্তু যে বেঁচারির চুল সে টেনেছিলো তাকে ম্যাডাম বকেছিলেন। ফলে দীপশিখার উপর প্রচন্ড রাগ ছিলো মেয়েটির। রাগ জাহির করতে সে দীপশিখার বেঞ্চে সুপারগ্লু আঠা লাগিয়ে দিলো। পরিণামে সে যখন বেঞ্চ থেকে উঠতে গেলো তার জামা ছিড়ে গেলো। ক্লাসে আবার হাসির পাত্র হলো সে। কিন্তু এবার আর ম্যাডাম দীপশিখার কথা শুনলেন না। তাকেই বকাঝকা করলেন৷ ঘটনার তীক্ততায় ঝাঝরা হলো কিশোরী হৃদয়। ক্লাস শেষে ক্লাসরুমেই বসে রইলো সে। বাসায় যেতেও ইচ্ছে হলো না। ব্যাগের উপর দুহাতে মাথা নত করে বসে রইলো সে। চোখ থেকে অঝরধারায় জল গড়ালো। হঠাৎ একটি পুরুষালি স্বর কানে এলো,
"তোমার কি শরীর খারাপ?"
দীপশিখা মুখ তুলে চাইতে শুভ্র, সৌম্য মুখখানার দর্শন পেলো। গাঢ় কালো চোখ দুটি গভীর এবং শান্ত, যেন কোনো বিরাট হ্রদের শান্তজল। সেই চোখে নিজের মায়াময় প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো যেনো দীপশিখা। অম্লান হাসিখানায় ভুলে গেলো কাঁদতে। সুঠাম দেহী কিশোর শুধালো,
“শরীর খারাপ তোমার? কাঁদছো কেনো?”
স্বম্বিৎ ফিরলো দীপশিখার। টলমলে চোখজোড়া মুছতে মুছতে ধরা স্বরে বললো,
“আমার জামা ছিঁড়ে গেছে।”
“ছিড়লে কি করে?”
দীপশিখা মাথা নত করে ফেললো, চিবুক মিশে গেলো বুকের কাছে। ছেলেটা কিছু একটা ভেবে নিজের জ্যাকেটটা খুলে এগিয়ে দিলো। হাসি মুখে বললো,
“এটা মাজায় বেধে নাও। কালকে ফেরত দিয়ে দিও।”
“আপনাকে পাবো কোথায়?”
“কলেজ বিল্ডিং এ। আমি সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।”
“এখানে কি করেন?”
“সিক্রেট, বলা যাবে না।”
বলতে না বলতেই শোনা গেলো,
“জাওয়াদ, আয়।”
ছেলেটি হাসিমুখে তার জ্যাকেটটা রেখেই দৌড় দিলো। দীপশিখার স্তব্ধ জীবনে চরম চাঞ্চল্যকর ঘটনার সূত্রপাত হলো। সূত্রপাত হলো এক অব্যক্ত অনুভূতি। অগোচরে, মনবাগিচায় একটা প্রেমপুষ্প রোপন করে গেলো। যা যত্ন করে লালন করতে লাগলো কিশোরী। ভেবেছিলো নিঃশব্দেই তার প্রেমপুষ্পের যত্ন করবে সে। কিন্তু দেখতে দেখতে জাওয়াদের বিদায়ক্ষণ চলে এলো। মানুষটিকে আর দেখা হবে না। জীবনের মোড় কোথায় নিয়ে ঠেকবে জানা নেই। বাবা একটা কথা সবসময় বলে,
“মনের কথা মনে রেখো না। বলে দাও। জমিয়ে রেখে কি লাভ, জীবন তো ক্ষণিকের।”
তাই মনে সাহস সঞ্চয় করলো সে। পরিকল্পনা করলো জ্যাকেট ফেরত দেওয়ার বাহানায় প্রেমপত্র দিবে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গেলো কলেজ ভবনে। ফেয়ারওয়েলের অনুষ্ঠান চলছে তখন। এর মাঝে জাওয়াদকে খোঁজা একটা মিশন। কিন্তু মিশন ইম্পোসিবল তো পসিবল করতেই হবে। প্রায় একঘন্টা ঘোরাঘুরির পর অবশেষে পেলো জাওয়াদকে। তাও একগুচ্ছ মেয়ের মাঝে। দীপশিখা অপেক্ষা করতে লাগল কখন ফাঁকা হবে জাওয়াদ। অনেক অপেক্ষার পর যখন অবশেষে মৌমাছির চাক থেকে মুক্ত হলো জাওয়াদ, তখনই দীপশিখা খপ করে তার হাত ধরলো। এমন কাজে চমকালো জাওয়াদ। কিন্তু সেই বিস্ময়কে “টাইম প্লিজ” বলে তার হাত টেনে এক ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো দীপশিখা। জাওয়াদের বিহ্বল মুখখানা দেখে বুঝতে পারলো খুব সাহসিকতা দেখিয়েছে। কিন্তু সময় নেই। তাই চট করে জ্যাকেটটা এগিয়ে বললো,
“আমি চিংকি, মনে আছে আপনার?”
জাওয়াদ এখনো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। দীপশিখা বুঝলো মানুষটি তাকে চিনে নি। তাই হতাশ স্বরে বললো,
“আমার জামা ছিড়ে যাওয়ায় জ্যাকেটটা দিয়েছিলেন। আমি ফেরত দিতে এসেছি। যদিও ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু রেখে দিলে তো চোর বনে যেতাম।”
জাওয়াদ অপ্রস্তুত হাসলো। জ্যাকেটটা নিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“থ্যাংক ইউ।”
জাওয়াদ যেতে নিলে দীপশিখা পিছু ডাকলো,
“জাওয়াদ ভাই?”
“কিছু বলবে?”
“হ্যা, বলবো।”
বলেই মাথা নিচু করে একটা খাম এগিয়ে দিলো। দীপশিখার মুখখানা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। শব্দগুলো হাওয়া হয়ে গেছে লজ্জায়। জাওয়াদ দ্বিধাগ্রস্থ স্বরে শুধালো,
“এটা কি?”
“যখন ফ্রি হবেন, পড়বেন। উত্তর দিতে হবে না। তবে পড়বেন প্লিজ।”
জাওয়াদ অপ্রস্তুত হলো। শঙ্কিত মনে খামটি নিতেই একছুটে পালালো দীপশিখা। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। সে জাওয়াদের মুখখানা দেখার সাহস পেলো না। সে জাওয়াদের উত্তর চায় না। শুধু চায় জাওয়াদ জানুক সে তাকে পছন্দ করে। ভেবেছিলো জাওয়াদের সাথে দেখা হবে না। কিন্তু স্কুল শেষেই জাওয়াদের সাথে দেখা হলো। তার অবস্থা বিধ্বস্ত ছিলো। ঠোঁট কেটে রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে আছে। চোখের নিচে কালচে দাগ। শার্টে ময়লা লাগা। চুল অবিন্যস্ত। পরিপাটি ছেলেটিকে একেবারেই এলোমেলো লাগছে। জাওয়াদ দাঁড়িয়ে ছিলো স্কুলের বাহিরের বাসের ছাউনির নিচে। তার সাথে কেউ ছিলো না। দীপশিখা তার পাশে দাঁড়ালো। স্বচ্ছ মনে শুধালো,
“আপনি কি মারপিট করেছেন জাওয়াদ ভাই?”
জাওয়াদ চমকে তাকালো। খানিকটা অপ্রস্তুত হলো যেনো সে। উত্তর দিলো না অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। দীপশিখা বুঝলো সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। সে চুপ করে রইলো। তবে কেনো যেনো জাওয়াদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। এমন ইচ্ছে খুব বেমানান দীপশিখার সাথে। সে মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করে না। অথচ জাওয়াদের সাথে কথা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করছে মন। হয়তো আর কখনো কথা বলতে পারবে কি না সেজন্যই এই ব্যকুল ইচ্ছে। ফলে নিজ থেকেই বললো,
“আপনি কি চিঠিটা পড়েছিলেন?”
জাওয়াদ এবারো উত্তর দিলো না। দীপশিখা নিজ থেকেই বললো,
“আমি আসলে কখনো ভাবিনি আপনি চিঠিটা নিবেন। আমি ভেবেছিলাম আপনার হয়তো প্রেমিকা আছে। তবুও আমি চিঠিটা লিখেছি। কারণ আমি আক্ষেপ রাখতে চাই না। হয়তো আজকের পরে আপনার সাথে আমার দেখা হবে না। আপনি হয়তো আমাকে মনেও রাখবেন না। কিন্তু এই মুহূর্তটা আমার কাছে খুব মূল্যবান হয়ে থাকবে। কারণ আপনি আমার স্কুলজীবনের সবচেয়ে স্নিগ্ধ স্মৃতি। আপনি আমার চিঠিটা পড়ে বলেন কেমন লেগেছে, তাহলে সত্যি আমার ভালো লাগবে।”
“তুমি সত্যি শুনতে চাও আমার কেমন লেগেছে?”
জাওয়াদের শীতল কণ্ঠে ধাক্কা খেলো দীপশিখা। চুপ হয়ে তার দিকে একরাশ কৌতুহল নিয়ে তাকালো। জাওয়াদ তার চশমার আড়ালের অসহায় চাহনীকে উপেক্ষা করে রুক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“আমার মোটেই ভালো লাগেনি। আমি চিঠিটা খুলেও দেখিনি। কোথায় পড়ে গেছে জানিও না। তোমার মতো মেয়েদের আমার চেনা। একটু ভালো ব্যবহার করলেই তোমরা মাথায় উঠে নৃত্য করো। অপর মানুষটি যে বিরুক্ত হতে পারে সেই ধারণাও তোমাদের নেই। আমার ডিসগাস্টিং লাগে এমন প্রেমপত্র। প্রেম কি এতো সস্তা? তুমিও নিশ্চয়ই আর দশটা মেয়ের মতো আমার উপর ক্রাস খেয়েছো। খুব নরমাল। বাট, তোমার কি মনে হয় তোমার লাভ লেটারে আমি গদগদ মনে হ্যা বলে দিবো? এমন লাভ লেটার আমি দিনে দশটা পাই। আমি ত্যক্ত, বিরক্ত…”
বলতে বলতেই থেমে গেলো জাওয়াদ। তার মুখশ্রীতে অনুতাপ ফুটে উঠলো। সে কিছু বলতে নিলো,
“দেখো, চিংকি………”
জাওয়াদ কথাটা শেষ করার আগেই দীপশিখা উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলো। সে আর দাঁড়ালো না। দাঁড়ানোর সাহস হলো না। তার কান ঝা ঝা করছে। এতোটা রুক্ষ্ণ প্রত্যাখ্যান তার জন্য অপেক্ষা করছে কল্পনাতীত ছিলো। পা জোড়া ভারী হয়ে এলো। হৃদয় ভার হলো। চোখজোড়া বিষাদঢেউ তুললো। কিন্তু থামলো না দীপশিখা। একপ্রকার পালিয়ে গেলো জাওয়াদের সামনে থেকে। সেই হৃদয়ভাঙ্গন তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। এক সপ্তাহ ঘর থেকেই বের হয় নি। এতটা যন্ত্রণা প্রেমে কিশোরীর জানা ছিলো। বাবা ছাড়া ঘরের কেউ জানে না, চুপচাপ, শান্ত, স্বল্পভাষী মেয়েটাও কখনো প্রেমে পড়েছিলো আর তীব্র আঘাতে তার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিলো।
*****
চিংকির সাথে দেখা হবার রাতে জাওয়াদ কোনো স্বপ্ন দেখলো না। পরদিন আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। অফিসে ইনক্রিমেন্ট ঘোষণা হলো। জাওয়াদের বেতন দুহাজার টাকা বেড়েছে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। জাওয়াদ ভেবেছিলো বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু পরদিন রাতে আবার চিংকির সাথে বিয়ের স্বপ্নটা দেখলো। এবং নিয়মমাফিক তার দূর্ভাগ্য শুরু হলো। গুলিস্তানে গিয়েছিলো, সেখানে পকেটমারে পাল্লায় পড়লো। চারহাজার টাকা সহ মানিব্যাগ হাওয়া। তার পরের দিনের স্বপ্নের বদৌলতে তার রিকশার দূর্ঘটনা ঘটলো। পা মচকে গেলো। ফলে জরুরি তলব পড়লো পাভেলের। পাভেল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এলো। এখন জাওয়াদের পাশে সে বসে আছে। জাওয়াদের কপালে তীব্র ভাঁজ। চিন্তিত স্বরে বললো,
"জাদু টোনায় বিশ্বাস করিস তুই?"
"না। তুই চাকরি ছাড়ার পর ডুগডুগি হাতে জাদু করে বেড়াবি নাকি?"
জাওয়াদের মাথা গরম হয়ে গেলো। পাভেলের কথায় তার পিঠে জোরে কি'ল বসালো সে। গাল ফুলিয়ে কি’ল সহ্য করলো পাভেল। পিঠ টানটান করলো যাতে ব্যাথা উপশম হয়। মুখের ভাব বদলে গেলো। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেলো না। জাওয়াদ হিনহিনে স্বরে বললো,
"এবার আমার কথা শুনবি?"
"আর উপায় কি!"
স্বর খাঁদে নিয়ে মিনমিনিয়ে বললো পাভেল যেন জাওয়াদ না শুনে। জাওয়াদ খুব বিজ্ঞভাব টেনে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বললো,
"আমার সাথে যা হচ্ছে তা নরমাল না। আমার মনে হয় চিংকি আমার উপর জাদু করেছে। ও আমার রিজেকশন সহ্য করতে পারে নি। এভাবে আমার জীবনে আগুণ জ্বালায়ে ও বদলা নিতে চায়। স্বপ্নেও বলেছিলো সুদে আসলে বদলা নিবে।"
জাওয়াদের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো পাভেল। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
"তোর উপর? জাদু? চিংকি করবে? তাও ছয় বছর পর? দোস্ত সত্যি করে বল, তোকে কে গাঞ্জা সাপ্লাই দিচ্ছে। না মানে! এমন কথা নেশাখোরদেরও বলতে শুনিনি আমি। যদি কখনো রাস্তায় গণপিটুনি খাস, খবরদার আমার নাম নিবি না। আমি তোকে চিনি না, তুই আমাকে চিনিস না।"
জাওয়াদ চোয়াল শক্ত করে আবার মারতে তৎপর হলে পাভেল তাকে শান্ত করার জন্য বললো,
“তুই নিজেই ভাব কি বলছিস? মানে যে শুনবে সেই বলবে তোর টপ ফ্লোরের কলকব্জা ঢিলে।”
“অসম্ভব তো কিছু নয়, মনে নেই তানিয়া আমার চুল কেটে নিয়ে গেছিলো তাবিজ করবে বলে।”
“ওই মেয়ের মাথায় সমস্যা ছিলো। চিংকি ইজ ফিট এন্ড ফাইন।”
“আই ন, ইট ডাজ নট মেক মাচ সেন্স।”
“মাচ সেন্স? দোস্ত ইট ডাজ নট মেক ইনি সেন্স।”
“কিন্তু তুই নিজেই ভাব, এসব কেনো হচ্ছে। ওর সাথে দেখা হওয়ার দিন আমি স্বপ্ন দেখলাম না। আর আমার সাথে পরদিন কিছুই ঘটলো না। তারপর আবার আগের মত সব এলোমেলো হচ্ছে। দুই এ দুই মেলা। যা হচ্ছে সব ওর জন্য। ওর মুখ দেখলে আমার জীবন শর্টেড।”
পাভেল অধৈর্য্য গলায় বললো,
“তাইলে বিয়ে করে ফেল। তারপর সামনে বসিয়ে ওর মুখ দেখ। ঝামেলা চুকে যাক।”
“ও তো এটাই চায়।”
পাভেলের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“তাইলে শার্লক হোমস তুমি কি চাও?”
জাওয়াদ দৃঢ় স্বরে বললো,
“আমি ওকে হাতে নাতে ধরবো। আর ওকে দিয়েই এই স্বপ্নকান্ডের ইতি ঘটাবো।”
“কেমনে?”
জাওয়াদের ঠোঁট চিরে দূর্বোধ্য হাসি উন্মোচিত হলো। প্রফুল্ল স্বরে বললো,
“বাবা বলেছে চিংকির সাথে যোগাযোগ বাড়াতে। আমি ভেবেছি প্রতিদিন ওর সাথে দেখা করবো।”
.
.
.
চলবে.................................................