বিষণ্ণ মেঘ পেরিয়ে নীল আকাশজুড়ে সাদা মেঘের এলোমেলো বর্ণিল আনাগোনা। আকাশের নীল ছুঁয়ে তুলার মতো ভেসে চলা সাদা মেঘের ভেলা, নদীতীরে নিশ্চল পায়ে হাঁটছে জুবিয়া। প্রকৃতির মাঝে তার মনের সুপ্ত আকাঙ্খাকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে সে। বিকেলের এই সময়টায় নদীর কুল ঘেঁষে থাকা কাঠের বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসল জুবিয়া। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আকাশটা একটু দেখল সে, এ যেন প্রকৃতির রঙে মন রাঙানোর পালা বদল চলছে। নীল আকাশটা মিশে আছে সবুজের শেষ তেপান্তরে। দৃষ্টি জুড়ানো প্রকৃতিজুড়ে শরতের এ বৈচিত্র্যময় রূপ। গাছের তলায় ঝরে পড়া শুঁকনো মর্মরে পাতা। নদীর জলে অসংখ্য হাঁসের ঝাঁক- এসব কিছুই জুবিয়ার অশান্ত মনে শান্তি এনে দিতে পারছে না। তার বুকের ভেতর ছোট্ট মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছে দূর শহরের মানুষটার কাছে। সে কোথায় আছে? কি করছে? সে কী তাকে ভুলে গেছে? বারংবার এইসব প্রশ্ন গুলো জুবিয়ার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মেঘের ফাঁকে সূর্যের রৌদ্রকরোজ্জ্বল হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল হঠাৎ, সে আলো চোখে পড়তে দৃষ্টি নামিয়ে নিল জুবিয়া। মেঠোপথের দু'ধারে বিশাল বড়বড় তালগাছ এর পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো আলতোভাবে মাটি ছুঁয়ে দিচ্ছে, সে আলোছায়া পথ ধরে হেঁটে আসছে একজন সুঠাম দেহি পুরুষ। লোকটাকে খানিকটা চেনা পরিচিত মনে হওয়ার কারণে ভ্রুকুটি করল জুবিয়া। লোকটা খানিক কাছে এগিয়ে আসতে তাত্ক্ষণিক বসা থেকে উঠে দাঁড়াল জুবিয়া। বুকের ভেতরটা কেমন ধুকধুক-ধড়ফড় করছে। জুবিয়া চোখের ভুল ভেবে দু'দিকে মাথা ঝাঁকাল। একটু পর চোখ খুললো মিষ্টি একটা ডাকে- তূর্ণ! যে মানুষটার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য সে পাগলের মতো দু'টো সপ্তাহ ছটফট করেছে আজ সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জুবিয়া ভীরু চোখে তাকিয়ে রইল। বুকের মধ্যে এখনও মৃদু কম্পন হচ্ছে, জুবিয়া এলোমেলো চোখে আশপাশে তাকাল৷ গ্রামের প্রায় লোকের কাছে শুনেছে এই নদীর ঘাটে জ্বীন-পেত্নীর বাস রয়েছে। জুবিয়া একটু পিছিয়ে গেল, ওর মনে হচ্ছে এটা তার তূর্ণ নয় বরং তেনারা ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে তূর্ণর রূপ ধারণ করে এসেছে।
তূর্ণ কোমল গলায় বলল,
'বউ!'
জুবিয়ার গলা শুকিয়ে এলো যেন। পিছনে ঘুরে দৌঁড়ে পালাতে যাবে সে সময় দেখল রাস্তার ওপাশে অনেকগুলো লোক কালো পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুবিয়া হাফ ছাড়ল। তূর্ণর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'আপনি ভূত নন?'
তূর্ণ অমায়িক ভাবে হেসে বলল,
'আমাকে দেখতে কি ভূতের মতো?'
জুবিয়া ছোট্ট করে বলল,
'আপনি এত স্বার্থপর কেনো? এতোগুলা দিন পেরিয়ে গেল অথচ আমাকে একটা কল ও দেননি। একবারও কী আমার কথা আপনার মনে পড়েনি?'
তূর্ণ দু'পা এগিয়ে এলো। জুবিয়ার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
'যে মানুষ মনে থাকে তাকে কী আর আলাদা করে মনে করতে হয়? তুমি আমার মনের মানুষ! সারাক্ষণ মনেই থাকো। তাছাড়া আমি ইচ্ছে করেই যোগাযোগ রাখিনি হুট করে এসে তোমাকে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল খুব।'
জুবিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
'আপনি ভীষণ খারাপ।'
তূর্ণ অট্টহাসি দিয়ে বলল,
'যেমনই হই শুধুই তোমার।'
এইটুকু বলে থামল তূর্ণ। জুবিয়ার হাতটা ধরে হেঁটে পথের দিকে যেতে যেতে বলল,
'তোমাকে সঙ্গে করে নিতেই আমার ছুটে আসা। কাল সকালের ফ্লাইটে আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাব।'
জুবিয়া চমকাল; বলল,
'কাল-ই?'
'কেনো? তোমার আমার সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে নেই?'
জুবিয়া কিছুক্ষণ চুপ থাকল তারপর বলল,
'আপনি এত দিন পর এলেন কিছুদিন থাকবেন না? আপনি থাকলে সবারই অনেক ভালো লাগবে।'
তূর্ণ বলল,
'সময় হবে না। সেহরিশ কড়াকড়ি ভাবে বলেছে একদিনের মধ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য।'
জুবিয়া প্রশ্ন করলো,
'এত তাড়া কিসের?'
তূর্ণ দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
'আমি জানি না। চলো, এখন বাড়ি যাই।'
জুবিয়া ভাঙাচোরা পথের দিকে একপলক তাকালো তারপর আবার তূর্ণর দিকে তাকিয়ে বলল,
'এই ছোট্ট পথ দিয়ে আপনার গাড়ি যাবে না। গাড়ির জন্য অন্য পথ দিয়ে ঘুরে যেতে হবে।'
'তোমার সঙ্গে ঘুরতে আমার কোনো সমস্যা নেই।' বলল তূর্ণ। দুজন বডিগার্ড এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়িতে বসে তূর্ণ ভ্রুযুগল কুঁচকে জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
'তুমি তখন আমাকে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিলে?'
জুবিয়া লজ্জা লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করে বলল,
'কই? না তো।'
তূর্ণ সশব্দে হেসে উঠল। তারপর রয়েসয়ে বলল,
'ঠিকমতো মিথ্যাটাও বলতে পারছ না। তোমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছ।'
জুবিয়া রাগান্বিত হয়ে বলল,
'বুঝতেই যেহেতু পেরেছেন তাহলে বারবার বলে লজ্জা দিচ্ছেন কেন?'
তূর্ণ হাসতে হাসতে বলল,
'ভবিষ্যতে যখন বুড়ো হব তখন আমার নাতি-নাতনিদের এই গল্প শোনাবো। তুমি আমায় দেখে কি ভয়টাই না পেয়েছ এটা ওদের ও জানার অধিকার আছে।'
জুবিয়া খানিক উঁচু গলায় বলল,
'আমি আপনার সাথে যাব না। গাড়ি থামান, আমি নামব।'
তূর্ণ জুবিয়ার দিকে একটু ঝুঁকে এলো। তারপর শ্লেষের স্বরে বলল,
'এই গাড়ি এখন থামবে না জান।'
জুবিয়া কাতর গলায় বলল,
'কি করছেন? ড্রাইভার দেখবেন।'
তূর্ণ ঘাড় কাত করে ড্রাইভারের দিকে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'সাদিক, এক ঘণ্টার জন্য পেছনে তাকাবে না।'
সাদিক ডান বামে মাথা নেড়ে বলল,
'ওকে, স্যার! পেছনে যদি ঝড়-তুফান কিংবা বন্যা ও হয়ে যায় আমি পেছনে তাকাব না।'
জুবিয়া ঠোঁট উল্টালো তারপর হুট করে গাড়ির কাচ গলিয়ে একবার বাইরে তাকাতেই তড়িঘড়ি করে বলল, 'এদিকে কেন যাচ্ছি? আমরা বাড়ি যাব না?'
তূর্ণ গভীর আবেশে জুবিয়ার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করল একটু পর নেশালো কণ্ঠে বলল,
'চুপ, কিছু বলবে না! তুমি এখন শুধু আমার দিকে মনোযোগ দাও। বাসায় গিয়ে বাবা আর মায়ের সাথে আমি আগেই দেখা করেছি।'
তূর্ণ জুবিয়ার হাতখানা চেপে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
'মাঝে মাঝে সব ভুলে তোমার মাঝে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। এই ব্যস্ততা, আমার আর ভালো লাগছে না। আমার শান্তি দরকার যা কেবল তোমার মধ্যে পাই।'
তূর্ণর ফোনটা হুট করে বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল হোয়াটসঅ্যাপে কল এসেছে। কল করেছে সাদাফ! তূর্ণ কল রিসিভ করল না। ফোনটা গাড়ির সিটে অবহেলায় ফেলে রাখল। দুবার কল করার পরও রিসিভ করেনি দেখে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে সেহরিশের দিকে তাকাল সাদাফ তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল,
'ফোন ধরছে না। দুদিন ধরে কোনো খবর নেই হুট করে কোথায় গেল ও?'
সেহরিশ মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা ঝুঁকে টেবিলের উপর থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা নিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েক কদম পা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাজপাখির দৃষ্টিতে নির্জন পথের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
'তূর্ণ বাংলাদেশে আছে। ওকে নিয়ে টেনশন করার কোনো কারণ নেই।'
সাদাফ অবাক গলায় বলল,
'ও দেশে গেল আর আমি জানি না। তাছাড়া আমি এতক্ষণ ধরে ওকে নিয়ে টেনশন করছি দেখেও তুই কিছু বললি না কেন?'
সেহরিশ নির্বিকার চূড়ান্তে; বলল,
'বলার মুড হয়নি।'
সাদাফ দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে সেহরিশের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে তারপর বলল,
'তূর্ণ ওখানে একা গেছে। ওর সেফটি নিয়ে তোর কী কোনো চিন্তা নেই?'
সেহরিশ চোয়ালদ্বয় শক্ত করে বলল,
'স্টিফেন আছে ওর সঙ্গে। স্টিফেন নিজের জীবন দিয়ে হলেও তূর্ণকে রক্ষা করবে। তাছাড়া তূর্ণ এখন আর ছোট নেই। নিজের রক্ষা সে নিজেই করতে পারে।'
সাদাফ অস্ফুটস্বরে বলল,
'তারপরও ওখানে তোর উপর একবার অ্যাটাক হয়েছিল। আর তূর্ণ সেখানে একা গেছে।'
সেহরিশ হেঁটে চলে যেতে লাগল। সে মূহুর্তে সাদাফ উচ্চস্বরে আওয়াজ দিল,
'আমার কথা শেষ হয় নাই। তুই কোথায় যাচ্ছিস?'
সেহরিশ মধ্যমা আঙুল ও বৃদ্ধ আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
'আমার ঘরে বউ আছে। বিরক্ত করিস না।'
সাদাফ দাঁত কটমট করে বলল,
'সালা হারামি।'
.
.
.
চলবে...........................................