তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ২৯ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


খাবার খাওয়ার মাঝখানে আমার কাশি উঠলো। আমি গ্লাস ধরবার আগেই রৈনীল নিজের হাতে পানির গ্লাসটা আমার মুখে তুলে ধরলো। পানি খাওয়ার পরিবর্তে আমি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। রৈনীল বলল, খাও। পানিটা খেয়ে নাও..

সে আমার মুখে গ্লাস ধরে রেখেছে আর আমি ঢকঢক করে পানি খেলাম। এরকম দৃশ্য আমি কখনো কল্পনাও করিনি। আমার আশ্চর্য হওয়া চোখ দুটো দেখে রৈনীল বলল,এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? 

আমি ঢোক গিলে বললাম, ভাত খেয়ে উঠে বাসায় চলে যাবেন। 
'বাসা? এখানে আমি বাসা কোথায় পাবো?'
'আপনি যেখানে উঠেছেন সেখানে চলে যাবেন।'
'কেন? আমি থেকে গেলে কি সমস্যা?'

আমার আবারও কাশি উঠে গেল। রৈনীল বললো, সরি সরি। নাও আর একটু পানি খাও। 
'আপনি কিভাবে জানলেন আমি এখানে আছি?'
'একটু ধৈর্য ধরো তো বাবু। এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?'
'আমার ধৈর্যের কি দেখেছেন আপনি? পাঁচ বছর পর এসে আপনি আমাকে ধৈর্য শিখাচ্ছেন?'

শব্দ করে হেসে উঠলো রৈনীল। আমার গলা দিয়ে আর খাবার নামছে না। বিষয়টা বুঝতে পেরে ও আমার সামনে গিয়ে বসলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যেভাবে খাবার খাচ্ছিল সেভাবে খাবার খেতে লাগলো। ধীরে ধীরে পরিবেশটা স্বাভাবিক হয়ে উঠল আমার কাছে। আমিও আবার খাবার খেতে লাগলাম। আর কোনো কথা তুললাম না। 

খাওয়া শেষ করে প্লেটটা আমি একটা সাইডে রেখে দিলাম। অথচ রৈনীল উঠে গিয়ে প্লেট দুটো ধুতে শুরু করে দিলো। লজ্জা পেয়ে আমি বললাম, 'এসব কি শুরু করেছেন? আপনাকে প্লেট ধুতে বলল কে?'
'খাবারের প্লেটটা ধুয়ে রাখবো না?'
'আপনি নিশ্চয়ই এখানে প্লেট ভুতে আসেন নি?'
'আমি এখানে ভাত খেতেও আসিনি। যেহেতু ভাত খেয়ে ফেলেছি সেহেতু প্লেটটা ধুয়ে রাখা আমার কর্তব্য।'
'আপনি দেখছি আমার মাথাটা খারাপ করে ছাড়বেন।'

রৈনীল হেসে বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে। দুইটা মাত্র প্লেট ই তো। ধুয়ে ফেললেই তো শেষ। 
- ঠিক আছে। এরপরে সোজা বের হয়ে যাবেন। 
- সেটা তো তুমি না বললেও যাব। ভবিষ্যতে আমাকে এসে এসব কাজ তো করতেই হবে। এখন থেকে কাজ করলে প্র্যাকটিস হবে।
- মানে কি? আপনি আমার এখানে রোজ থালাবাসন ধুতে আসবেন?
- সব কাজই। তাছাড়া আর কে করবে এগুলো। তুমি কি অন্য কাউকে বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছো? 

চমকে উঠলাম আমি। আমার সমস্ত শরীর যেন ঝনঝন করে উঠলো। এক অন্যরকম শিহরণ। যে অনুভূতির সঙ্গে পূর্বে কখনো আমার পরিচয় হয়নি। সে অনুভূতিরা আমার পুরো শরীরকে মুহূর্তেই এমন ভাবে আন্দোলিত করল যে আমি চোখের পলক ফেলতে পারছিলাম না। 

রৈনীল ভেজা হাত দুটো মুছে কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, 'আই এম সরি। পাঁচ বছর ধরে তোমাকে অপেক্ষায় রাখার জন্য।'
আমি ছোট্ট করে ঢোক গিলে বললাম, কে বলেছে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি? আমি কারো জন্য অপেক্ষা করিনি। 
- করোনি?
- না, 
- ভালও বাসোনি ?

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। স্তব্ধ হয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইলাম। রৈনীল পিছন দিক থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আরো একবার শিহরিত হলাম আমি। সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি জানি তুমি আমাকে মনে মনে ঠিক কতটা চাইতে। তুমি না চাইলে আজ আমি এখানে আসতাম না। তুমি চেয়েছো বলেই পাঁচ বছর পরে হলেও আমি তোমার কাছে এসেছি। তোমার জীবনে আর কখনো দুঃখ আসবে না। আমি কোনো দুঃখকে ছুঁতে দেবোনা তোমায়। এভাবেই আগলে ধরে রাখবো। এখন থেকে সামনে তোমার শুধু সুন্দর দিন। গেট রেডি ফর ইট। 

আমি আশ্চর্য হয়ে আছি। কোনো কিছু বলার মত শক্তি নেই আমার। রৈনীল থামতেই যেন রাতের নিস্তব্ধতা আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠলো। আমি নড়াচড়া করার শক্তি পাচ্ছি না। আমাকে ছেড়ে দিয়ে রৈনীল টেবিলের উপরে থাকা তার চশমাটা তুলে নিলো। এরপর দুহাতে পকেট চেক করতে দেখে বুঝে ফেললাম সে এখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বস্তি পেলাম যেন। বের হলে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নেব। তার প্রত্যেকটা আচরণে আমার শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। 

রৈনীল এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। বলল, রাতে ভালোমতো ঘুমাবে নয়তো সকালে অফিস করতে পারবে না। যদিও আজ রাতে ঘুমাতে তোমার অনেক অসুবিধা হবে। এ কারণে রিকোয়েস্ট করছি ভালো করে ঘুম দেয়ার চেষ্টা করো। সকালে দেখা হবে। 

আমি বলতে যাচ্ছিলাম মানে কি? আপনি আবার সকালে আসবেন নাকি। কিন্তু টের পেলাম আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। সে বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে এগিয়ে গেল। তারপর আবার পিছন ফিরে এসে আমার দিকে ঝুঁকে বলল, তোমার সমস্ত কনফিউশন আমি দূর করে দিব। সবকিছুর উত্তর পাবে। একটু ধৈর্য ধরো। আর আমার উপর বিশ্বাস রাখ। রাখবে তো?

আমি কি উত্তর দিব ভেবে পেলাম না। রৈনীল আর একটু ঝুঁকে এসে আমার কপালে আলতো করে চুমু দিতেই চমকে উঠলাম। ফ্যালফ্যাল করা চোখ দুটো তুলে তাকালাম ওর মুখের দিকে। সে মুচকি হেসে বললো, ফাইনালি! আহ কত বছর ধরে এই জিনিসটার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম..

আমি দাঁড়িয়ে আছি মূর্তির মত। সে খুব সুন্দর করে হাত উপরে তুলে বাই বাই বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দরজার বাইরে গিয়ে বলল, ভালো করে দরজা আটকাবে। সাবধানে থেকো।

এরপর গেট পর্যন্ত রৈনীলের পায়ের শব্দ শোনা গেল। গেট খোলার আওয়াজ পেলাম। তারপর বন্ধ হয়ে গেল গেট। পায়ের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগলো। একসময় আর শোনা গেল না। এখন শুধুই রাতের নিস্তব্ধতা। আমি এখনো থমকে দাঁড়িয়ে আছি। বাস্তবে ফিরে আসার চেষ্টা করছি। 

কয়েকবার বড় বড় শ্বাস নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। জোরে জোরে বললাম, আহ এসব কি হলো? এত বছর পর হুট করে এসে এসব কেন সে করছে আমি বুঝলাম না। বিশ্বাস তো হচ্ছে। আবার সংশয় লাগছে। আমার খুশি হওয়া উচিত নাকি দুঃখ পাওয়া উচিৎ আমি বুঝতে পারছি না। 

এমন সময় শুনতে পেলাম বৃদ্ধা দাদিমনির গলা। উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি শান্ত হয়ে বসলাম। দাদিমনি এসে বললেন, কিলো একা একা কার লগে কথা কইতাছো?
কেউ না। নিজের সঙ্গে। 
ও আচ্ছা। আমি আবার ভাবলাম ভূতের লগে। 
ভূত আছে নাকি?

দাদিমনি হেসে বললেন, অনেক বছর তো একলা একলা আছি। কোনদিন চক্ষে দেখি নাই। 

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। দাদুমনি একটা গল্প বলা শুরু করলেন। কথায় আমার একদম মন বসছে না। আমি আশ্চর্য হয়ে শুধু রৈনীলের আচরণ গুলোর স্মৃতিচারণ করছি। তার নিজস্ব ঘ্রাণ, হাঁটার ধরন, গলার স্বর, চাহনি সবকিছুই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। বিস্ময়কর একটা সন্ধ্যা কাটল। সে ঠিকই আন্দাজ করেছে, আজ রাতে আমার মোটেও ঘুম আসবে না। 

দাদিমনিকে বিদায় জানিয়ে রুমে এসে আমি সব কিছুর হিসাব মেলাতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পর হাসি ফুটল অজান্তেই। তবে আমি যে তাকে মনে মনে চেয়েছি সেটা সে কিভাবে জানলো এটার উত্তর খুঁজে পেলাম না। চোখ বড় বড় করে সিলিং এর দিকে চেয়ে কেবলই ভাবতে লাগলাম। 

সকালে অফিসের জন্য বের হতে হতে আমার চোখ দুটো শুধু তাকে খুঁজছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আশেপাশে কোথাও তাকে দেখতে পাবো। যেকোনো সময় হয়তো হুট করে সামনে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। আমি অফিসে কাজ শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর ফোনে মেসেজ এলো টুং করে,
"সরি সরণী। ঘুম থেকে উঠতে লেট করে ফেললাম। তুমি উঠতে পেরেছো? "

প্রথমে ইচ্ছে করলো মেসেজটা রিপ্লাই করি। কিন্তু কেন যেন করলাম না। ফোনটা রেখে দিলাম। মন দিলাম নিজের কাজে। আমার সহকর্মীরা সকলেই বেশ আন্তরিক। নতুন জয়েন করার পরেও তাদের আচরণে সব সময় মনে হয় আমি যেন অনেক বছর ধরে তাদের সঙ্গে কাজ করছি। সকাল সকাল কাজের চাপ খুব কম থাকে। দু তিনজন এসে আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ১০ থেকে ১৫ মিনিট আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। তারপর যে যার ডেস্কে ফিরে যায়।

কিছুক্ষণ পর সকালের প্রথম চা টা দিয়ে গেল পিয়ন। চায়ের কাপ তুলে মাত্র ঠোঁটে ছুইয়েছি, ঠিক এমন সময় দেখলাম হেলেদুলে রৈনীল এদিকেই আসছে। আমার অফিসে রৈনীলকে দেখে এত বেশি আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে কাশির সঙ্গে সঙ্গে পুরো ডেস্কে চা ছিটিয়ে পড়ল। 

রৈনীল দ্রুত ছুটে এলো আমার ডেস্কের দিকে। উৎসুক চোখে জানতে চাইলো, তুমি ঠিক আছো তো?
আমি নিজের জামা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, সামান্য একটু চা পড়েছে কাপড়ের উপর। তবে তেমন কিছু হয়নি। 
মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ঠিক আছি। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? 
'চা খেতে আসলাম।'
'আমার অফিসে?'
'উঠতে দেরি হয়ে গেছে। না হলে তো বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতাম। খেয়ে বলতে নিজেই তোমাকে বানিয়ে খাওয়াতাম।'
'মানে কি!'
'এত বছর অপেক্ষার পর এইটুকু কেয়ারনেস তো তুমি অবশ্যই ডিজার্ভ করো।'

আমি কপালে হাত দিয়ে অন্য দিকে তাকালাম। এটা কি কোনো সিনেমা? এসব কি ধরনের আচরণ? অন্যদিকে তাকিয়ে আমি বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে চেষ্টা করছি। এমন সময় দেখলাম আমার একজন কলিগ এগিয়ে এসে রৈনীলের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, গুড মর্নিং ভাই। কি অবস্থা? ভালো আছেন?
'জি ভাইয়া। গুড মর্নিং। আপনি কেমন আছেন?'
'ভালো আছি। আসুন আমার রুমে। আপনি এত সকাল সকাল আসবেন এটা তো আমি ভাবি নি। আমি খুবই সারপ্রাইজ হয়েছি।'

আমার কলিগ নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। রৈনীল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। কলিগ রেজওয়ান ভাই পিছন ফিরে রৈনীলকে বলল, আসুন ভাই। এইদিকে..
'কিন্তু আমি তো ভাবলাম মিস সরণীর সঙ্গে এক কাপ চা খাব।'

আমার রেজওয়ান ভাই মুচকি হেসে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন, অবশ্যই। কিন্তু আপনি মিস সরণীকে আগে থেকেই চিনতেন নাকি?
রৈনীল উত্তর দিল, 'অবশ্যই। আমার উচিত আপনার সঙ্গে ওকে পরিচয় করিয়ে দেয়া। সি ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড।'

আমি ড্যাবড্যাব করা চোখে রৈনীলের দিকে তাকালাম। রেজওয়ান ভাই ভীষণ সুন্দর এক গাল হাসি দিয়ে বললেন, ওয়াও! তাই নাকি। জানতামই না। ভালো লাগলো পরিচিত হয়ে। তাহলে আপনারা চা খান। আমি আসছি। 

রেজওয়ান ভাই নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি রৈনীল কে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলাম, আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড হই?
'আমার তো সেটাই মনে হচ্ছে। তুমি কি এই পরিচয়ে প্রাউড ফিল করছো না? না করলে বলো। তাহলে রেজওয়ান মিয়াকে গিয়ে বলি সরি ভাই উনি আমার গার্লফ্রেন্ড না।

আমি হেসে বললাম, বসুন। এখানে কি কোন কাজের জন্য আসা?
'গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। খুব ছোট্ট একটা কাজ। করার প্রয়োজন ছিল না। মনে হল এই অজুহাতে তোমার সঙ্গে দেখা হবে। আরেকটু বেশি সময় আমরা একসঙ্গে থাকতে পারবো। তাই ভাবলাম কাজটা করা যেতেই পারে।'
'ভালো তো। তা আপনার এই প্রেমটা কেন পাঁচ বছর আগে দেখাননি আমাকে?'
'দেখালে কি আজকে তুমি এখানে বসে কাজ করতে পারতা?' 
'যা ধারণা করেছিলাম তাই। আমি যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি সে কারণে আপনি তখন আমার সাথে ওরকম আচরণ করেছিলেন তাই তো?'
'উত্তর সঠিক হয়নি।'
'সঠিক হয়নি! আপনি আমার সঙ্গে ভরপুর রহস্য করছেন।অবশ্য আপনার সঙ্গে এরকম রহস্য যায়। পরিচয়ের শুরু থেকেই আপনাকে আমার খুব রহস্যময় মনে হতো। খুব কমপ্লেক্স একটা পারসন আপনি।'
'তোমার পিয়নকে ডাকো। চা দিতে বলো আমার জন্য।'

আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হাসলাম। তারপর উঠে এলাম চেয়ার ছেড়ে। অফিসে চা বানানোর সরঞ্জাম সবই আছে। খুব ইচ্ছে করছে রৈনীলের জন্য নিজের হাতে চা বানাতে। 
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp