শহরের থেকে কত কত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঘন এক জঙ্গল, যেখানে নেই কোনো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, রয়েছে শুধু সারির পর সারি লম্বা খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছ। শুকনো মাটির তলে ফরফর করে পড়তে থাকে শুকনো পাতারা, রোদের নাম করে হুর হুর করে বাতাস ছড়িয়ে দেয় সেই জঙ্গলে। তার-ই ঠিক মাঝখানে অবস্থিত দুই তলা বাড়ি। উপস্থিত লোকজন ছাড়া কারো কোনো ইয়ত্তা নেই যে এই স্থানেও একটা বিলাসবহুল বাড়ি হতে পারে। শুধু তাই নয়, বাড়ির একপাশে বিরাট বড় একটা গ্যারেজ ও আছে। যদি এই বিষয়ে কেউ জেনে যেত তখন কী পূর্বের মতোই শান্তিপূর্ণভাবে থাকা যেতো?
জঙ্গলের শিকারি প্রাণীদের চোখ সর্বদা শিকারের খোঁজে ধারালো আলোর মতো ঘুরতে থাকে। তাদের দৃষ্টি যখন কোনো লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে, তখন তারা এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকে না। পেশিবহুল পায়ে ভর দিয়ে নিঃশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের দিকে। এই প্রাণীদের সামনে দাঁড়ানো মানে মৃত্যুর সামনে নিজের নাম লিখে দেওয়া।
হলুদ খয়েরী রঙের ডোরাকাটা বাঘটির চোখ ও অনন্যার দিকে স্থির হয়ে গেছে। তার লম্বা, ধারালো নখ মাটি আঁচড়াতে আঁচড়াতে সামনে এগিয়ে আসছে। চারপাশ যেন মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। অনন্যা দরজার হাতলে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে একবার পেছনে তাকাল। বাঘটি তখন লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার নড়াচড়ার শব্দ যেন আশেপাশে তরতর করে বয়ে চলা বাতাসকেও থমকে দিচ্ছে। অনন্যা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে চিৎকার করে নিজের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করলো,
"ওই ইশতেহারের বাচ্চা! দরজা খোল ব্যাটা হাদারাম, রাসকেল! তুই ইচ্ছে করে এই বাথরুমে পাঠাইছিস তাই না? যাতে আমি বাঘের কবলে পড়ে মা/রা পড়ি? আজকে তোর একদিন কী আমার একদিন! এই দরজার আবার কি সমস্যা হইছে। নিশ্চয়ই তোর কারবার। তুই কিছু করছিস বলেই দরজা খুলছে না আমি শিওর। ইঁদুরের বাচ্চা তোকে কাঁটা চামচ দিয়ে কুঁচি কুঁচি করবো আমি বলে রাখলাম।"
অনন্যা বলতে বলতে কেঁদে দিয়েছে, ওর নাক মুখ থেকে পানি বের হয়ে একাকার অবস্থা। পরক্ষণেই আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেলো। অনন্যা তৎক্ষণাৎ দরজার শব্দে ঘুরে দাঁড়াল। বাঘকে উপেক্ষা করে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিলেও হঠাৎ তার পা যেন শিকড় গেঁথে গেল মাটিতে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে দেখে মুহূর্তেই তার শ্বাস আটকে এল। হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির চোখে এমন এক শীতলতা, যা যেন হিমালয়ের বরফকেও হার মানাতে পারে। বাঘের দৃষ্টি তো শ হাত দূরে থাক।
চোখ দুটি গভীর, সেখানে একটা শিকারির নির্লিপ্ত দৃষ্টি, যা শুধু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। তার ঠোঁটের কোণে সামান্য কড়া রেখা, যেন কোনো ধরনের আবেগ সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, অথচ সেই নিরুত্তাপ মুখই মনে করিয়ে দেয় ভয়াবহ ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতাকে।
লোকটি ধীর পায়ে এগিয়ে এল অনন্যার দিকে যা দেখে মেয়েটার বুকের পানি শুকিয়ে গেলো ইতিমধ্যে। অনন্যা এক হাত দিয়ে নাক মুখ মুছে নিলো। লোকটার পায়ের ভারী বুট মেঝেতে পড়ে ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলছে। অনন্যার বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগল। মাথা সামান্য উঁচু করে তাকাতেই মনে হলো, লোকটির চোখের দৃষ্টি যেন তাকে ছেঁদা করে দিয়ে পড়ে নিচ্ছে তার সমস্ত দুর্বলতা। বাঘটি, যেটা এতক্ষণ শিকারি ছিল, সেটাই যেন লোকটির উপস্থিতিতে পিছিয়ে গেছে। তার গর্জন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, আর সেও লোকটির দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটি কোনো কথা না বলে এক ঝলক বাঘের দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে ছিল নিঃশব্দ হুমকি। হলুদ খয়েরী রঙের ডোরাকাটা বাঘটি কুঁকড়ে গেল, তার লেজ গুটিয়ে ধীরে ধীরে পেছনে সরে যেতে শুরু করল। অনন্যা লোকটির প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছিল, আর প্রচন্ড ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। লোকটা যতোই এগোতে থাকলো, অনন্যা ততোই পেছাতে থাকলো। শেষ মুহূর্তে অনন্যার স্থান হলো পরিষ্কার দেয়ালের টাইলসের পিঠে। তার সম্মুখে তাকেই ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক, যার চাহনি তীব্রভাবে চাবুক চালাচ্ছে অনন্যার শরীরে। অনন্যা ঢোক গিললো , লোকটাকে এতো ভয় তো আগেও লাগেনি।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে লোকটার থেকে হিংস্রতর কোনো পশু এই দুনিয়ায় হতেই পারে না।
ইশতেহার কৌশিকের গরম নিঃশ্বাস অনন্যার চোখে মুখে তীব্র ভাবে আঁছড়ে পড়ছে আর তার-ই মধ্যে প্রচন্ড শীতল কণ্ঠ অনন্যার কানে ঢেউয়ের মতো পৌঁছালো।
"ওয়াট ডিড ইউ সে?"
অনন্যার চোখে মুখে আতংক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। সে তুতলিয়ে বললো,
"ক....কী?"
"একটু আগে আমাকে উদ্দেশ্য করে কী বলছিলেন?"
অনন্যা হাসার চেষ্টা করে বললো,
" কই কিছু না তো!"
ইশতেহার কৌশিক হাত দিয়ে বাথরুমের দেয়ালে জোরে আঘাত করতেই দেয়াল কেঁপে উঠলো। তার কণ্ঠে যেন বজ্রপাত হলো, "রিডো! তুমি এখানে কী করছিলে?"
বাঘটি, যেটির নাম সম্ভবত রিডো, কাঁচুমাচু মুখে সামান্য গর্জন করলো, যেন নিজের ভুল স্বীকার করছে। কিন্তু কৌশিক স্যারের চোখের শীতলতা তার সব সাহস গলিয়ে দিল। তিনি অনন্যার দুই পাশে হাত রেখে দেয়ালের সঙ্গে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখ মন্ডল নিচু হয়ে অনন্যার দিকে রয়েছে। কৌশিকের চোখ তীক্ষ্ণ ও হিমশীতল। সেই দৃষ্টি বাঘটির দিকে ফেরাতেই বাঘটি আরও সংকুচিত হয়ে গেল।
কৌশিক দাঁতে দাঁত পিষে কঠোর গলায় বললেন, "বাথরুম কোনো আরাম করার জায়গা নয়! মাইন্ড ইট,রিডো। আরেকবার যদি ভুল করেছো আই সুয়ার এই বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না।"
বাঘটি মাথা হেলিয়ে চুপটি মেরে বসে থাকলো। কৌশিক ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি অনন্যার দিকে ফেরালো। অনন্যা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে রইলো, যেন কোনো চাপে জর্জরিত হয়ে গেছে। দীর্ঘক্ষণ চারপাশে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। অবশেষে, সাহস সঞ্চয় করে অনন্যা মুখ তুলে তাকাতেই আবারো দুটো চোখ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।
অনন্যা চোখ পিটপিট করে বললো,
"স্যরি! আর কখনো এমন হবে না। স্যরি!"
কৌশিক শীতল কণ্ঠে বললো,
"অতিরিক্ত কথাবার্তা আমি পছন্দ করি না। তাই আমাকে বাধ্য করবেন না। এন্ড ....এন্ড আই লাইক দ্যাট 'তুই' ওয়ার্ড!"
অনন্যা এক মুহূর্তের জন্য নিঃশেষ হয়ে গেলো। তুই? তুই বলে ডেকেছে বলে কী লোকটা খুশি হয়ে গেছে নাকি? ইশতেহার কৌশিক তাকে ছেড়ে দিলো, ঠিক তখনই লারা বাথরুমের দরজার সামনে কফি নিয়ে হাজির। লারা গলা উঁচু করে বললো,
"সাব! আপনার কফি!"
চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো কৌশিক। লারার দিকে তাকিয়ে বললো,
"বাথরুমে বসে কফি খাওয়াবে আমাকে?"
"না না, সাব! আপনে তো বেশি কোল্ড-কোল্ড করেন। তাই তাড়াতাড়ি আনলাম এই কফি। পরে যদি ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব কম যায়!"
ইশতেহার কৌশিক চিন্তিত হয়ে লারার কাছ থেকে কফি নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে স্থান ত্যাগ করলো।
যাওয়ার আগে বাঘটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
"রিডো! কাম বেইবি!"
অনন্যা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো। বেইবি? বাঘকে বেইবি কে বলে, ভাই? এটা কোন ধরনের ডাকা? তাছাড়া এতো ভয়ংকর একটা বাঘ লোকটার সামনে এসে চুপসে গেলো কী করে? অনন্যার তো জান যায় যায় অবস্থা হয়ে যাচ্ছিলো অথচ এই রিডো না ফিডো স্যারের কাছে দাঁড়িয়ে ছোট্ট শিশুর ন্যায় আচরণ করছিল। বেশ সিনেমাটিক ব্যাপার তো!
ভয়ংকর বাঘটাও চুপসে যাওয়া অবস্থায় স্যারের পিছু পিছু চলে গেলো।
•
অনন্যা ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করল। প্রথমেই চোখে পড়ল মাঝখানে সাজানো চমৎকার বিছানাটি। বিছানার চাদরটি যেন মেঘের মতো নরম, রেশমের মতো মসৃণ। সাদা আর হালকা ধূসর রঙের কম্বিনেশনটি রুমের প্রশান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিছানার উপর রাখা আরামদায়ক দুটি বড় সাদা বালিশ, আর দু'পাশে ছোট ছোট কুশন।
চারপাশের দেয়ালে হালকা নীলাভ আলো প্রতিফলিত হচ্ছে, যেন সমুদ্রের নিচে থাকার অনুভূতি দেয়। রুমের একটি দিক সম্পূর্ণ কাঁচের গ্লাসে আবৃত। কাঁচের গ্লাসের বাইরে দেখা যায় দূরের সবুজাভ গাছপালা আর ঝিরঝিরে বাতাসে দোলানো লতাপাতা। গ্লাসটি এতই স্বচ্ছ যে মনে হয় প্রকৃতি যেন রুমেরই অংশ।
রুমের বাকি অংশ আধুনিক মিনিমালিস্ট ডিজাইনে সাজানো। এক কোণে একটি ছোট সাইড টেবিল, যেখানে রাখা একটি হালকা সুবাস ছড়ানো মোমবাতি এবং আধা খোলা একটি বই। দেয়ালের অন্য পাশে টাঙানো রয়েছে একটি রঙিন চিত্রকর্ম, যা পুরো রুমকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
অনন্যা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো সে যেন কোনো স্বপ্নরাজ্যে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু তারপরই বাইরের দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইল। কাঁচের বাইরে পৃথিবী যতই দুঃখ-কষ্টে ভরা হোক, এই রুম যেন শান্তির এক নিখুঁত আশ্রয়।
লারার সাথে কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। লারা তাকে খাবার সার্ভ করছিলো। কেমন বিদেশি ডিস সব! নিশ্চয়ই কৌশিক স্যারের কারণে। অনন্যা বুঝতে পারছে না লোকটা ওর মুখে এতো খারাপ খারাপ কথা শুনেও বেশি প্রতিক্রিয়া কেনো দেখাচ্ছে না? অনন্যা ভেবেছিল এসব শোনার পর হয়তো স্যার তাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেবে কিন্তু অদ্ভুতভাবে তা কিছুই হয়নি।
অনন্যা খাবার মুখে দিতে দিতে লারার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেছিলো,
"আচ্ছা, স্যার কী খুব মাল্টি ট্যালেন্টেড?"
লারার মুখে এক গাল রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। সে একটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
"ওগা মাল্টি ট্যালেন্টেড মানে? হুম হুম, খুব ট্যালেন্টেড। স্যার রাইতবিরাইত গাড়ি রেস করে। তীর মারে, তলোয়ার চালায়। বন্দুক তো আঙ্গুলের খেলায় উড়াইতে পারে। আর, আর স্যার জঙ্গলির জানোয়ারগুলা...উগো একডা চোখে চুপ করাইয়া দেয়।"
অনন্যা থমকে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো।
"সত্যি বলছেন? জানোয়ারও স্যারের কথা শোনে?"
"হু! দেখলা না বাঘডা কেমনে চুপসায় গেলো?" লারা বলল, চোখে মজা নিয়ে।
"হুম বুঝেছি।" অনন্যা একটু অবাক হয়ে বলল।
"সাবের একটা মুখের আওয়াজে কত কত পাখি ঘরের মধ্যে জড়ো হয়ে যায়। সাবের শরীরের সাথে ঘষাঘষি করে আর সাব সবার সাথে কীভাবে যেন কথা বলে ফেলে।" লারা আরো যোগ করলো, তার মুখে এমনভাবে কথাগুলো আসছিল যেন সে নিজেই কিছুটা অবাক।
"আর কী কী করতে পারে, স্যার?"
"অতো কিছু তো আমি জানি না। তবে সাব যখন আদেশ দেয়, একডা জানোয়ারও আর নড়ে না। কিন্তু..."
"কিন্তু কী?" অনন্যা তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো।
লারার গলায় আরো রহস্য জমে উঠলো।
"কিন্তু সাবের ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। উনি রাগ করলে...আসমান গড়াইয়া পড়বে!"
অনন্যা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বললো,
"কি হাস্যকর!"
"আরে, তুমি তো নতুন আস্তে আস্তে বুঝবা সব। কিন্তু সাবের সাথে তোমার কী সম্পর্ক?" লারা হেসে প্রশ্ন করলো।
"আমি.... আমি!" অনন্যা বলতে গিয়েও থেমে গেলো, কিছু বলতে পারলো না।
এমন সময় কৌশিক স্যারের উপস্থিতি অনুভব করে অনন্যা চুপ হয়ে গেলো। কৌশিক শান্ত কণ্ঠে বললেন, "নো ওয়ান! বাট ইউ ক্যান থিংক হার এজ মাই স্টুডেন্ট।"
লারার ঢোক গিলে মাথা নাড়ালো, তার মনে একটা অজানা চিন্তা উঁকি দিলো। এদিকে অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো স্যারের দিকে। মনে মনে একটু রাগ লাগছে ঠিকই। কৌশিক স্যার রিডোকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে না যেতেই অনন্যা লারার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনি এই লোকটার জালে কীভাবে ফেঁসে গেলেন?"
লারা হেসে মাথা নাড়লো, যেন প্রশ্নটা খুবই অবাক করা।
"ফেঁসে গেলাম মানে? সাব তো খুব ভালো লোক! ভেরি ভালো!"
"কিন্তু এত অদ্ভুত লোকের সাথে কাজ করা তো সহজ নয়, তাই না? আপনি এখানে কীভাবে আসলেন?" অনন্যা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
লারা এবার একটু থেমে স্মৃতি হাতড়াতে লাগলো। তারপর মোলায়েম গলায় বললো,
"আমাদের কথা শুনবা? খুব বেশি ইন্টারেস্টিং কিছু না। আমি আর আমার হাসবেন্ড চাকমা। চাকমা পাহাড়েই তো থাকতাম। পাহাড়ের জুম চাষ আর বন থেকে ফল টেনে এনে দিন চলে যেত। আমার হাসবেন্ড, ও খুব ভালো কাঠের কাজ পারে। ঘর বানায়, আসবাব বানায়। একদিন হঠাৎ সাব সেইদিকে আসলো, কি জানি বলছিলো, বাড়ি বানানোর জন্য কাঠের জিনিসপত্র দরকার ছিল। আমার হাসবেন্ডের কাজ দেখে সাব বললো, 'ক্যাম কাজ করবা?' আমরা তখন কি আর ভাবছিলাম যে সাব আমাদের এখানে নিয়ে আসবে?"
অনন্যার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, মনোযোগ দিয়ে শোনাচ্ছিল।
"তারপর?"
লারা হাসলো, এক কাতর হাসি, "তারপর সাব আমাদের অনেক টাকা দিলেন। বললেন, 'তোমাদের কাজ আমায় পছন্দ। কিন্তু তোমরা এখানেই থাকবা।' আমার হাসবেন্ড তো একটু ভাবছিল। কিন্তু সাবের মতো লোকের প্রস্তাব তো আর সহজে আসে না। তারপর আমরা আসলাম। এই বাড়ি, এই জীবন। খুব ভালোই তো কাটতেছে।"
"আপনার হাসবেন্ড কী কাজ করে?" অনন্যা জানতে চাইলো।
লারা এক মুহূর্ত থেমে, আসল কথা বললো, "সাব যা বলে তাই করে! যেমুন সকাল সকাল কোন দূরের শহর থেকে রেসের ট্রফি নিয়ে আসলো। তারপর গেছে বাজার করতে। এছাড়া আমারে সাহায্য করে। ড্রাইভারের কাজ করে। স্যারের গাড়িটাড়ি পরিষ্কার করে। মুছে দেয়। আর আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে, আমরা একসাথে পাশের ফুল দেখি, পাখি পশুদের খাবার দেই। রান্না বানাই, ঘর পরিষ্কার করি। এই তো।"
অনন্যার চোখে বিস্ময়।
"আপনারা সাবকে ভয় পান না?" অনন্যা কিছুক্ষণ পর চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো।
লারা মুচকি হেসে বললো,
"ভয় পাই কেন? সাব খুব রাগী, কিন্তু খুব ন্যায্য। ঠিকঠাক কাজ করবা, তো সাবের সাথে কোনো সমস্যা নাই। সাবের একটাই কথা, তার নিয়ম মানবা। আর নিয়ম তো ঠিকই আছে, মানতে অসুবিধা হয় না।"
অনন্যা কৌতূহলী হয়ে রইলো। বেডরুমে শুয়ে থেকেও লারার কথাগুলো তাকে বেশ ভাবিয়ে তুললো।
.
.
.
চলবে..................................................