রিক্সা ছুটে চলেছে। আমি বসে আছি রিক্সার হুড উঠিয়ে। রোদ লাগছে না কিন্তু প্রচন্ড গরমে ঘেমে নেয়ে উঠেছি। বিকেলবেলায় আমি সাধারণত টিউশনিতে থাকি। কিন্তু আজ যাইনি, কেন শুনুন। আফতাব সাহেবকে বিদায় করতে পেরেছি, এটা আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য। কিন্তু ওইযে অভদ্র লোকটাকে সরানোর জন্য বাবাকে বলেছি, বিয়ে দিতে চাইলে অন্য ছেলে দেখো। এরপর থেকে আয়োজন করে আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু হয়েছে। আমিও আপত্তি করলাম না। কারণ জীবনে যখন একটা অঘটন ঘটে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে যায়, তখন আরেকটা অঘটন ঘটিয়ে সেই জীবনে পরিবর্তন আনা অতি জরুরি হয়ে পড়ে। হ্যাঁ আদনানের সাথে আমার পরিচয়, কথা বলা, নামহীন এক সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের সমাপ্তি সবকিছুই আমার জন্য অঘটন ছিল। যে অঘটন সম্পূর্ণ আমাকে বদলে দিয়েছে। আপনাদেরকে বলতে দ্বিধা নেই এখনো প্রতিটা দিন আমি আদনানের কথা ভাবি। আমি জানি এত অল্প সময়ে এত দূরে থেকে আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি যে আমি ওকে ভুলতে পারব না। ওকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যতটা তারচেয়েও বেশি ওর সম্পর্কে না জেনে ওকে ভালোবাসার লজ্জা। তারপরও আমি বুঝি কিছু একটা আছে। যেই কিছু একটার বলে আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। প্রতিদিন আমি অসংখ্যবার ফোন হাতে নেই, আবার রেখে দেই। সোস্যাল মিডিয়ার অ্যাপগুলো আমি ইন্সটল করি, আবার আনইন্সটল করে দেই। এই অস্থিতিশীলতা হয়তো বিয়ে নামক অঘটনই ঠিক করতে পারবে। হয়তো আমি একদিন স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করব। আজকের দিনগুলোর কথা ভেবে হাসব! কিন্তু তবুও আজকের দিনগুলো আমাকে পার করে যেতে হবে। আর এই দিনগুলো পার করা প্রশান্ত মহাসাগর সাঁতরে পার করার সমান। যাই হোক, এই ছেলে দেখা প্রক্রিয়া চলছে প্রায় ৪/৫ মাস যাবৎ। তবে ব্যাপারটা এতদিন ছবি দেখা এবং খোঁজ খবর করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। আমার পরিবারের সকলের পছন্দ না হলে আমাকে পাত্রের ছবি দেখানো হয় না। আবার তাদের পছন্দ হলে যখন আমাকে দেখানো হয় তখন আমার পছন্দ হয় না। এসব করে করে অবশেষে আমার একজনের ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে। তাদেরও নাকি আমার ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে। ছেলে প্রথমেই বাসায় এসে আয়োজন করে দেখতে চায় না। সে চায় বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে দেখা করবে। যদি আমরা পরস্পরকে পছন্দ করি তারপর বাসায় আয়োজন করা হবে সমস্যা নেই। তার এই কথাতেই ছোট চাচ্ছু তাকে পছন্দ করে ফেলেছে। বাবা এবং দাদাজানেরও ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি। কিন্তু খারাপ লাগলো আমার মায়ের। তার খুব ইচ্ছে তার মেয়েকে যারা দেখতে আসবে তাদেরকে খুব আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াবেন, ছেলের কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার ভালো করে দেখবেন তবেই না মেয়ে দেবেন!
তখন বাবা বললেন,
"ছেলে-মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করলে এসব পরেও করা যাবে। আমরা আগেই এসব করে ফেলব তারপর ছেলেমেয়ে বাগড়া দিয়ে বসবে, সেটা ভালো হয় না আসলে।"
অবশেষে আজ সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। তার সম্পর্কে আপনাদেরকে কিছু বলে রাখা ভালো। অন্তত আমি যতটুকু জানি। তার নাম কমল। কমল মানে পদ্মফুল। ফুলের নাম ছেলেদের মানায় না। ফুলের নামে নাম হবে মেয়েদের। যেমন বকুল, শিউলি, শেফালি, জবা, হেনা, চম্পা, জুঁই, পদ্ম। কিন্তু আমার পছন্দে অপছন্দে তো আর কারও নাম বদলে যাবে না, দরকারও নেই। কমল সাহেব পেশায় একজন এডভোকেট। বয়স ২৮। বাড়ির বড় ছেলে। গায়ের রঙ শ্যামলা বলে মনে হয়। ছবি দেখে বোঝা সম্ভব না, যদিও তবুও এটা আমার অনুমান। হাইট ওয়েটের দিকে খেয়াল করিনি। ছবি দেখে এক দেখায় তাকে ভালো লাগার কারণ তার চেহারাতে একটা পরিপক্ব ভাব আছে। এই ভাবটা যদি সামনাসামনি না থাকে তবে তিনি রিজেক্টেড হতে চলেছেন। যদি থাকে তবে বাকিটা ভাবা যাবে। রিক্সা উক্ত রেস্টুরেন্টের সামনে থামতেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলাম।
ভেতরে ঢুকে কমল সাহেবকে কল করতেই তিনি ফোন না ধরে এগিয়ে এলেন,
"তিন্নি আসুন।"
সামনাসামনি প্রথম দেখাটাও আমার ভালো লাগলো। কারণ তিনি ক্যাবলার মত হাসলেন না। খুব স্বাভাবিক মুখেই তিনি যে টেবিলে বসেছেন সেই টেবিলের দিকে ডাকলেন আমাকে। এবং বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট হওয়া স্বত্তেও আপনি করে বললেন। এবং হ্যাঁ যে পরিপক্ব ভাবটা তার ছবিতে দেখেছিলাম সেটা সামনাসামনিও আছে। একজনের সব দেখে পছন্দ করতে হয়, আরেকজনের কিছুই না দেখে ভালোবেসে বসে ছিলাম! কী অদ্ভুত আমাদের এই মনস্তাত্ত্বিক খেলা তাই না?
কথায় কথায় কমল সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, "তিন্নি আপনি কি কথা কম বলেন?"
আমি হ্যাঁ বললাম। বলতে পারলাম না বলার মত মানুষ পেলে আমিও অনেক কথা বলতে পারি। পাত্র-পাত্রী দেখা হওয়াতে যে ধরনের কথা হয় আমাদের তেমন কোনো কথাই হলো না। আমি ভেবে গিয়েছিলাম তাকে খুব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখব। কিন্তু তা হলো না কারণ তিনিই আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন। এবং তার যে আমাকে পছন্দ হলো না, সেটা বুঝতেও আমার বাকি রইলো না। পছন্দ হওয়ার অবশ্য কথাও না। আমি টিউশনিতে যেভাবে যাই সেভাবেই জামাটা পালটে চলে এসেছি। একটা সুতির জামা ইস্ত্রী করে পরে নিয়েছি। সাজগোজ করিনি। সজাগোজে আমার বড় আলসেমি। আমি আসলে চেয়েছিলাম সত্যিকার অর্থে তিন্নি যেমন, কমল সাহেব তেমন তিন্নিকেই দেখুক। আমরা বেশি সময় বসলাম না। শুধু এক কাপ কফি খেতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকুই। কমল সাহেব এর বেশি আগ্রহ দেখালেন না। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আমার সামান্য মন খারাপ হলো, এত দেখে যাকে একটু পছন্দ হলো তার কিনা আমাকে পছন্দই হলো না। আচ্ছা আদনান যদি আমাকে এভাবে সামনাসামনি দেখতো তাহলে কি পছন্দ করতো? পরক্ষণেই নিজের উপর নিজে বিরক্ত হলাম। এখানেও আদনানের কথা কেন ভাবছি আমি? অহেতুক সব ভাবনা!
.
.
.
চলবে..............................................