বধূবেশে বসে আছে অনন্যা। সাজগোজ খুব বেশি নয়, তবে যতটুকু হয়েছে, সেটাতেই তাকে অপূর্ব লাগছে। তার শ্যামলা রঙ যেন একধরনের অনন্য দীপ্তি ছড়াচ্ছে। মখমলের মতো মসৃণ গালের ঠিক নাকের পাশের ছোট্ট তিলটি মেকআপের সৌজন্যে আরও স্পষ্ট হয়েছে, ফুটিয়ে তুলছে তাকে। হালকা গয়নার আভায় তার ব্যক্তিত্বের মাধুর্য যেন আরও ফুটে উঠেছে।
রুমের সামনে দিয়ে বাচ্চাদের ছোটাছুটি, আত্মীয়স্বজনের হুটোপুটি, খাবার-দাবার আনা-নেওয়ার তোড়জোড়, আর লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচির মিলিত এক জটলা অনন্যার চারপাশকে ঢেকে রেখেছে। বাইরে সবকিছুই আনন্দের ভান করে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু ভেতরে অনন্যার হৃদয় নিঃশব্দে ভেঙে পড়ছে। তার ভেতরের কষ্টগুলো এক অদৃশ্য শিকলে বন্দী, যেগুলোকে কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কেনই বা শুনবে? কখনো কি কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করেছে? একসময় যে ভালোবাসার মানুষ তার পৃথিবী ছিল, সেও তো হাত ছেড়ে অন্য কারও হাত ধরেছে। এই শূন্যতা, এই বেদনা আজ শুধু তার একার।
অনন্যা বড় বড় শ্বাস নিয়ে চোখ দুটি ফ্যানের ঘূর্ণায়মান পাতায় স্থির রাখলো। তার ভাবনার গভীরতায় বারবার ভেসে উঠছে সেই মুখ! আরণ্যক! বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ব্যাচ সিনিয়র, যার কঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোমলতায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল অনন্যা। অনন্যার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে, বড় বটতলার নিচে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা আরণ্যকের সেই দৃশ্য। কড়া রৌদ্রের মধ্যেও তার ফর্সা চেহারা যেন আলো ছড়াত, অনন্যার হৃদয় জুড়ে এক অবর্ণনীয় উষ্ণতা এনে দিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের মধ্যে আরণ্যক ছিল এক বিরল প্রতিভার অধিকারী। নাচ, গান, মডেলিং কিংবা আবৃত্তি যে কোনো প্রতিযোগিতায় তার অংশগ্রহণ ছিল একটি নিশ্চিত আকর্ষণ। আর তার এই বহুমুখী প্রতিভা সহজেই জিতে নিতো সকলের মন। আরণ্যকের নামডাক ছিল পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে, আর সেই আলোতেই অনন্যার হৃদয় প্রথমবারের মতো জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু তাদের পরিচয়টা খুব ই সাধারণ ছিল। ইংরেজি ক্লাবে নাম দেওয়ার জন্য ফর্ম খুঁজছিলো অনন্যা। সেই ক্ষেত্রে তাকে সামনাসামনি আরণ্যকের মুখদর্শন করতে হয়েছিল, আর প্রথমবারের মতো কথাও সেদিনই হয়েছিল। অনন্যা তো আগে থেকেই পছন্দ করতো আরণ্যককে কিন্তু বুঝতে দেয়নি কখনো। ধীরে ধীরে সাহায্য অদল বদল করতে করতে বন্ধুত্ব হয়, বন্ধুত্ব থেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে যায় দুজন।
অনন্যা আবারো বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। মনকে শান্ত করার চেষ্টা করেও তার ভিতরের অস্থিরতা থামলো না। ভাবলো, হয়তো আরণ্যক তাকে কোনোদিনই ভালোবাসেনি। হয়তো তার অনুভূতিগুলো একতরফা ছিল, আরণ্যকের জীবনে সে হয়তো ছিল শুধুই একজন সাধারণ পরিচিত। এসব ভেবে তার মন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।
ঠিক তখনই ঈরা প্রবেশ করলো রুমে। মামার মেয়ে ঈরা, অনন্যার সমবয়সী। দুজনের মধ্যে বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু আজ ঈরার উপস্থিতিও অনন্যার মনে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারলো না। ঈরা মুখটা যেন কিছুটা লজ্জিত। কারণ, এত ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সে এই বিয়ে আটকাতে কোনো সাহায্য করতে পারেনি।
অনন্যার মামা-মামীর জোরজবরদস্তিতে ঠিক হয়ে গেছে এই বিয়ে। আর এমন একজন পুরুষের সঙ্গে, যার বয়স অনন্যার দ্বিগুণ।
ঈরা নিচু স্বরে বললো,
"ফোন এসেছে, পাত্রপক্ষ এসে পড়ছে!"
"আচ্ছা!"
"স্যরি রে!"
"হুম!"
"পাথর হয়ে গেছিস?"
"ভালো লাগছে না।"
ঈরা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অনন্যা হঠাৎ বলে উঠে,
"ফিল্মগুলোতে কত সুন্দর দেখায়, নায়িকার অন্যজনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেই পর্যায়ে নায়ক আসে আর নায়িকাকে তুলে নিয়ে যায়। আমার সাথে কী এরকম হতে পারে না? হ্যাঁ, কেন হবে? এটা তো আর ফিল্ম না! আর না আমি কোনো নায়িকা! এটা তো আমার ফাটা কপাল।"
ঈরা অনন্যাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
"শান্ত থাক! আমাদের হাতে এখন কিছু নেই, অনু। মা-কে তো চিনিসই , আমি কথা তুলতেই দুই দুটো থাপ্পড় মেরেছে আমাকে। আর কিছু বলতে পারিনি।"
অনন্যার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো, ঈরা বিষয়টা আরশিতে দেখতে পেলো। সামনে থেকে একটা টিস্যু নিয়ে অনন্যার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
"কাঁদিস না! কান্না কোনো সমাধান নয়।"
ঈরার হঠাৎই বাইরে ডাক পড়লো। যাওয়ার আগে সে অনন্যার কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঈরার কথাগুলো যেন অনন্যার কানে পৌঁছালো না। সে নির্বাক দৃষ্টিতে ঈরাকে বিদায় জানালো, যেন তার ভেতরে কোনো অনুভূতি নেই। ঈরা চলে যাওয়ার পর, অনন্যা নিস্প্রভ চোখে আয়নার দিকে তাকালো। নিজেকে দেখতে থাকলো। মুখের মেকআপ, গয়নাগুলো, শাড়ির চাকচিক্য, সবই তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছিল। হঠাৎ কী মনে করে, সে ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিজের কক্ষের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। একাকিত্বের ভার যেন আরও গভীর হলো।
তারপর শুরু হলো খোঁজ। ড্রয়ারের পর ড্রয়ার খুলতে লাগলো কিছু একটা খুঁজে পেতে। অবশেষে, একটি পুরনো ড্রয়ারে মোমবাতি খুঁজে পেলো। ধীর পায়ে মোমবাতিটি নিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। ম্যাচ দিয়ে জ্বালিয়ে সেটাকে মেঝের ঠিক মাঝখানে রাখলো। মোমবাতির আলো ঝিলমিল করতে শুরু করলো। সে ধীর পায়ে রুমের বাল্বটা বন্ধ করে দিলো আর মোমবাতিটার সামনে বসলো। গভীর ধ্যানে তাকিয়ে থাকলো জ্বলতে থাকা, ধীরে ধীরে গলতে থাকা মোমবাতির দিকে। অনন্যা চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করলো। ধীরে ধীরে তার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করলো, আর গভীর অন্তঃস্থল থেকে বের হলো কিছু কথা:
"এই দুনিয়ায় যদি এখনো কোনো চমৎকার থেকে থাকে, যদি ফেইরি টেইলের গল্পগুলো সত্যি হয়, তাহলে আমি চাই... আমার জন্যও একজন প্রিন্স আসুক। হ্যাঁ! প্রিন্স...এমন একজন, যে আমাকে এই বিয়ে করা থেকে রক্ষা করবে। যে আমার জন্য সাহস দেখাবে, সকলের মুখে চুনকালি মাখিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। দরকার হলে সেই রাজকুমার আমাকে বিয়ে করুক। তবুও আমি ওই বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে করবো না। না! না! নাআআআ....."
অনন্যার কথাগুলো শেষ হতেই যেন এক দমকা বাতাস এসে মোমের শিখাটিকে দুলিয়ে দিলো। সে দ্রুত চোখ খুললো, আর ঠিক তখনই ভার্সিটির নতুন প্রফেসর ইশতেহার কৌশিক স্যারের মুখ তার মনের গভীরে ভেসে উঠলো। কেন? এই সময়, এই দুর্ভোগে, তার মাথায় এই মানুষটা কেন এল? অনন্যা নিজেই বুঝতে পারলো না।
সে বিরক্ত হয়ে নিজের দুই গালে আলতো করে চাপড় দিলো। "কী হচ্ছে এসব? এতো বড় সমস্যার মাঝে কীভাবে ওই লোকটা মাথায় আসলো?" অনন্যা ঠোঁট উল্টে রাগে বসে থাকলো। নিজের উপরই বিরক্তি হতে লাগলো তার।
কোনো একটা মুভির গল্প দেখে এমন অদ্ভুত কাজ করতে গিয়েছিল অনন্যা! মোমবাতির আলোয় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই একপ্রকার অবাক হয়ে গেল। নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললো,
"আমি কী মুভির নায়িকা নাকি যে প্রিন্স এসে উদ্ধার করবে আমাকে? এভাবে কেউ আসে কখনো? কী সব আজেবাজে কাজ করছি আমি!"
অনন্যা হতাশ হয়ে বসে রইলো। সে জানতো, এমন কিছুই হবে না। তার জন্য কেউ আসবে না। কোনো প্রিন্স তো দূরের কথা! তারপরও মনের গভীরে সুপ্ত বাসনা বলে একটা অনুভুতি আছে যাকে দমানো যায় না! অনন্যার মনের অন্তরে বইতে থাকা সেই সুপ্ত বাসনাকেও দমানো গেলো না।
_________
এক দূরের শহরের ধুলোয় ঢাকা খোলা রাস্তায় চলছিল ভয়াবহ কার রেস। আকাশে মেঘ জমে যেন প্রতিযোগিতার উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। আইকে১০, রেসিং দুনিয়ার এক দুর্নিবার নাম। তার গাড়ির গর্জন যেন বজ্রপাতের মতো, তার গতিতে রাস্তার চারপাশ কাঁপছিল।
তার ঠিক পেছনেই আরজে৭। একজন ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী। তার একমাত্র লক্ষ্য, আইকে১০ কে রাস্তার বাইরে ঠেলে দিয়ে জয়লাভ করা। তবে আইকে১০-এর গাড়ি ছিল নিখুঁত প্রযুক্তির এক আশ্চর্য সীমা অতিক্রমকারী। এর ইঞ্জিনের শক্তি আর স্পিড এমন ছিল যে, যেন বাতাসকেও ছাড়িয়ে যায়।
আরজে৭ বারবার চেষ্টা করছিলো আইকে১০-কে হারানোর। হঠাৎ সে ডান পাশ থেকে কাট করে সামনে আসতে চাইল। কিন্তু আইকে১০-এর চালক নিখুঁতভাবে এক মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দিলো। আরজে৭ বুঝলো, যতই চেষ্টা করুক, এই গাড়িকে হারানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রতিযোগিতার উত্তেজনা তুঙ্গে। আর মাত্র দশ সেকেন্ড! মাইকে চিৎকার করে বলা হচ্ছে ৯...৮....৭....! বিজয় ঠিক সামনেই। আরজে৭ অনেকটা এগিয়ে এসেছে কিন্তু ১ বলার সাথে সাথেই বিজয়ের ফিতা উড়িয়েছে আরকে১০!
গাড়ি থেকে বেরিয়েই মাথার হেলমেট খুললো আইকে১০। সকলে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে, যেন পুরো রেসের উত্তেজনা সেই এক মুহূর্তে জমে গিয়েছে। আকাশী-কালো মেশানো চকচকে রেসিং স্যুটে সজ্জিত আইকে১০-এর পেছনে বড় অক্ষরে লেখা তার নাম,"আইকে১০"।
তার মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা, যেন পৃথিবীর কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারবে না। স্টেজ থেকে তার নাম ঘোষণা করা হলো। হাতের হেলমেট রেখে খোলা সিল্কি চুলগুলো একবার হাত দিয়ে ব্রাশ করে নিলো সে, তার সেই সিল্কি চুলগুলো অবান্তর বাতাসে উড়তে থাকলো। দৃঢ় পদক্ষেপে ধীরে ধীরে স্টেজের দিকে এগোতে লাগলো সে।
তবে তখনি একটা শব্দ! শুধু একটা শব্দ তার বুকে তীব্র আন্দোলন ঘটালো। শব্দটি যেন সমস্ত স্মৃতি, অনুভূতি আর লুকানো যন্ত্রণাগুলোকে জাগিয়ে তুললো। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বুক চেপে ধরলো সে।
স্টেজ থেকে বারবার তার নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল,
"আইকে১০! মিস্টার ইশতেহার কৌশিক? প্লিজ কাম অন দ্য স্টেজ!"
কিন্তু ইশতেহার কৌশিকের কানে আবারো সেই শব্দ ভেসে উঠলো,
"প্রিন্স....!"
ইশতেহার কৌশিক যেন এক মুহূর্তে আশপাশের পুরো দুনিয়াকে ভুলে গেল। স্টেজে ওঠার বদলে সে দ্রুত পা বাড়ালো নিজের রেসিং কারের দিকে। চারপাশের কোলাহল, করতালি আর উল্লাসধ্বনি যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল তার কানে।
এক পলকেই গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো কৌশিক। কোনো দ্বিধা নেই, কোনো দোটানা নেই। ঝড়ের গতিতে স্টার্ট দিলো ইঞ্জিন আর মুহূর্তেই গাড়িটি ছুটে চললো খোলা রাস্তা ধরে। গন্তব্য? সেটা জানা জরুরি নয়। তার হৃদয়ই যেন তাকে দিশা দেখিয়ে দিচ্ছে।
বাতাসের গর্জন আর ইঞ্জিনের গর্জন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ইশতেহার শুধু অনুভব করলো এক গভীর টান, যেন কোথাও কেউ তার অপেক্ষায় আছে। কোথাও একটা আশ্রয়, একটা উত্তর, যা তার মন চায়, যা তার হৃদয় তাকে টেনে নিয়ে চলেছে।
গাড়ি ছুটে চললো, গন্তব্যের দিকে নয়,বরং সেই অনুভূতির দিকে, যা সবকিছুকে ছাপিয়ে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূরে।
.
.
.
চলবে..................................................