প্রাণোদাহ - পর্ব ০১ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


প্রাক্তনের বাসরের খাটের নিচে ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রীতি। তার কাজ হলো একটু পর পর নিচ থেকে খটখটে শব্দ করা। তাকে দায়িত্বে রেখেছে তার নিজেরই ভাগ্নি, যে বয়সে তার চেয়ে গুণে গুণে তিনদিনের বড়ো। প্রীতি বিরবির করল, 
-“হ্যাংমারা লাইফ! রাগের ঠেলায় দুঃখ করতে পারি না, দুঃখের চিপায় রাগ আসে না।”

এ কথা বলে প্রীতি আবারও খাটে খটখটে শব্দ করল। টনক নড়ল রাকিবের। নববধুকে চুমু খেতে যেই না এগিয়েছিল সে, ওমনিই থেমে যেতে হলো। তানিশা হকচকিয়ে উঠল,
-“কী হয়েছে? সবকিছু ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছো?”

মনে মনে মুখ ভেঙচালো প্রীতি, 
-“কচু ঠিক আছে, তোমার বরের চরিত্রে সমস্যা। যত্রতত্র যারে-তারে দেখলেই যৌবনের পীড়া ওঠে।”

রাকিব মনের ভুল ভেবে সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে আবারও এগিয়ে গেল মুখে ইয়া বড়ো এক হাসি টেনে। লাজুক হেসে তানিশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে সাউন্ডবক্সে বেজে উঠল এই গানটা, “তুমি দিও না গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া, আমি অন্ধকারে বন্ধ ঘরে যাব মরিয়া...”

ছিটকে দুইজন একে-অপরের বিপরীতে শুয়ে পড়ল ঠিক এমনভাবে, যেন তারা কোনো চিপায় চাপাচাপি করছিল আর ওই মুহূর্তে কেউ একজন বলেছে, “এই কে? কে ওখানে? আইতেসি খাড়া।”

তখনই আলমারি খুলে সাব্বির, ওয়াশরুম থেকে রাতুল, পর্দার আড়াল থেকে বাহা আর খাটের নিচে থেকে প্রীতি বেরিয়ে এলো। গানটা সিগন্যাল ছিল ওদের বেরিয়ে আসার। রাকিব হাতের উলটো পিঠ কপালে ঠেকিয়ে সোজা বিছানায় পড়ে গেল, মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, 
-“ওহ গড!”

জাতিগুষ্টির এহেন শত্রুতা সে মানতে পারছে না। কী দোষ করেছিল সে? কয়টা প্রেম আর একটা বিয়েই তো? আড়ে তাকাল রাকিব, প্রীতিলতা নামের মেয়েটা বড়োবড়ো চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, তবু তার দিকে তাকাচ্ছে না। মনে মনে বলল সে, 
-“খচ্চন্নি মহিলামানুষ, দুনিয়াতে আর কারোর বিয়ে পাস নাই? আমার বাসরের এখানে তোর কী কাজ? কোথায় গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করবি, তা না করে আমারই বিয়েতে হাড্ডি চাবাস! আদপের ব্যাদপ। সভ্যের অসভ্য।”

মনের কথা মনেই রয়ে গেল রাকিবের। চাহনি সরে এলো অন্যদিকে। প্রীতি একবার রাকিবের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে গেল ওখান থেকে। তন্মধ্যে বাকি কাজিনেরাও হৈহৈ করে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। একজন তো বলেই বসল, 
-“এত কষ্ট করে বাসর সাজালাম, আর তুমি কিপটা আমাদের হক মেরে পয়সা বের করলে না। এখনো বাসরের আশা দেখো?”

রাকিব মাথা নাড়ল,
-“হ, দেখি।”
-“আশায় এক খাবলা গোবর ফেলে বলছি, আমরা কেউ রুম থেকে বেরোব না।”

তারপর গিয়ে সবাই বেডে-সোফায়, ফ্লোরে শুয়ে পড়ল যে-যার মতো। সমস্বরে বলল,
-“গুড নাইট!”

প্রীতি ফিক করে হেসে উঠতেই খেয়াল করল, অহনা ওদিকে না গিয়ে তার পিছে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রীতি জিজ্ঞেস করল,
-“কী?”
-“আপা, তোর মন খারাপ হচ্ছে না।”
-“তোর কী মনে হয়?”
-“আমার মনে হয়, তোর ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে।”
-“তাহলে তাই।”
-“তবে কেন বিয়েতে এলি? না এলেই হতো।”
-“হতো না। পাশের গলিতেই থাকি, আর সে আমার নানির পেটের আপন খালাতো ভাই লাগে।”

অহনা কপাল কুঁচকে ফেলল,
-“এলে এসেছিস, তাহলে শুধু খেয়ে মাইগ্রেনের দোহাই দিয়ে চলে যেতে পারতিস।”
-“তা পারতাম।”
-“তাহলে এদের এত রঙঢঙে কেন এড হলি?”
-“মনের ইচ্ছে হয়েছে তাই।”
-“সবসময় মনের ইচ্ছের কথা শুনতে হয় না, প্রীতি আপা। এখন যে মনটা খারাপ হলো। সে বেলায়?”

প্রীতি হেসে তাকাল অহনার দিকে,
-“যদি বলি মন খারাপ না?”
-“বিশ্বাস করব না।”
-“বিশ্বাস কর, আমার আসলেই মন খারাপ না।”

এ কথা বলে প্রীতি অহনার গাল টেনে দিলো৷ এরপর বলল,
-“দুনিয়ার সবকিছু আমাদের প্রতি পদে পদে শিক্ষা দেবে। আমাদের উচিত শিক্ষা নেওয়া। নিশ্চয়ই আমাদের সাথে তা-ই হবে, যার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি আমরা। যা পাইনি, তা নিয়ে কীসের আফসোস, বল? যা পাব, তা কি কম সুন্দর হবে?”

অহনা মুগ্ধ চোখে হাসল,
-“আপা, তুমি সবসময় ভালো থাকো।”
-“আমি জানি, আমি ভালো থাকব। এবার যা। ওদের কাছে যা।”
-“আচ্ছা, আপা।”

আড়াই বছর আগের কথা, তখন সে ক্লাস এইটে পড়ত। খালাতো ভাই রাকিবের ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি, হাসি, কাছাকাছি থাকা, আড্ডাস্থলে তাকে গুরুত্ব দেওয়া, নিজ প্লেটের খাবার উঠিয়ে তার প্লেটে দেওয়া, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার হলে ওর পছন্দমতো জায়গা নির্ধারণ করা—এসব কিছু চম্বুকের মতো টানতে থাকে। বুকের ভেতর হাঁসফাঁস লাগতে লাগে, অস্থিরতা অনুভব হয়, সেই এক পুরুষের নাম শোনামাত্র অনুভূতি সব একস্বরে তাণ্ডব ঘটায়। সরাসরি রাকিবের থেকে প্রপোজাল না পেলেও, প্রেম বেশ এগোচ্ছিল। তাদের প্রেম ছিল চোখাচোখিতে, বড়োজোর হাতে-হাত ছোঁয়া অবধি। আর তারপর কী থেকে কী হয়ে গেল, প্রীতি হিসেব মেলাতে পারে না। 

নতমুখী হয়ে হাসতেই তার কল এলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে কলার আইডি, “বাবা”।

প্রীতি কল রিসিভ করে বলল,
-“বাবা, বলো।”
-“তুমি নিতে আসতে বলেছিলে। আমি গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে। ভেতরে গেলে আপা ফিরতে দেবেন না। তুমি একটু বাইরে আসো, মামনি।”
-“আচ্ছা, বাবা। ওখানেই থাকো। আসছি।”

প্রীতি কল কেটে সামনের পথে হাঁটা ধরল। মাঝেমধ্যে এমন হয় যে নিঃশ্বাস আটকে আসে, অস্থিরতা মেরে দেয়, বুকেতে বিষ আর মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণাগুলো সবকিছু অসাড় করে দেয়। সেই অনুভূতি প্রীতি খুব করে টের পেতে লাগল। আচমকা চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। প্রেমে সে পড়েনি, তবে স্বপ্ন দেখেছিল বেশ। আজ তার এত সাধের স্বপ্নগুলো কেমন যেন উড়ে গেল, বিলীন হলো অনুভূতিদের নিয়ে।

কিশোরী হৃদয় খুব সহজেই বাজে পুরুষদের আকর্ষণ করে ফেলে। এটা ভালো কথা নয়, তবে সত্য কথা। এই সত্যের প্রমাণস্বরূপ অধিকাংশ মেয়েই প্রথম প্রেমে হেরে যায়, ভেঙে যায়, মিশে যায় গুড়োমাটিতে। আচ্ছা.. ভঙ্গুরতা থেকে ইস্পাত-হৃদয়া হতে এক নারীর ঠিক কতটা সময় লাগে? 

ভরা যৌবনে পা ফেলা নারীটি গুটি কয়েক কদমে অন্য কারো হয়ে যাওয়া লোকটাকে পিছে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। শেষবিন্দু অশ্রু গড়ানো চোখে হেসে সে বলল, “মাত্র সাত কদম। পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে আমার জন্য যে আছে, সে যেন দ্রুত আসে। আমার আগ্রাসী অপেক্ষাগুলো আমি তাকেই উৎসর্গ করলাম। নষ্ট পুরুষ, আমি সুখে উড়ি আর তুমি জ্বলে মরো।”

গেইটের সামনে দাঁড়াতেই প্রীতি শামীম সাহেবকে দেখে এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে বলল, 
-“বাবা, আমার মনে হচ্ছে আজ ভালো কিছু হতে চলেছে। তোমার মনে হচ্ছে না?”
-“যেহেতু আজ আমার আম্মাজানের মন ভালো, তার মানে নিশ্চয়ই ভালো কিছু হতে হতে চলেছে।”

মন কি আদৌও ভালো? হয়তো না, কিংবা হ্যাঁ। কিছু দ্বিধা আদতে সুন্দর হয়, বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। এদিকে সপ্তাদশী প্রীতিলতার তো গোটা জীবনটাই সামনে পড়ে আছে। তার এখনো অনেক অনেক স্বপ্ন দেখা বাকি। স্বপ্ন-পূরণের চূড়ায় উঠে চিৎকার করে নিজেকে ভালোবাসি বলা বাকি। 

প্রীতি শামীম সাহেবের সাথে হাঁটা ধরল। দু'গলি সামনেই তাদের বাড়ি। বিয়েতে তার আসার ইচ্ছে ছিল না বললে ভুল হবে। নিজের ওপর জেদ করেই প্রাক্তনের বিয়ে খেতে এসেছে সে, সেই সাথে সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে নেচেছেও বটে। এরপর কী যে হলো... স্বল্পদিনের পোষা প্রাণিটার শোকেও মানুষ কেঁদে বন্যা বানায়, আর সে তো ছিল রাত জেগে দেখা বার্ধক্যের স্বপ্ন! 

________

তারপরের ঘটনাটা ঘটল তিনমাস পর। কলেজে ভর্তি হওয়ার এক সপ্তাহের ভেতর কোত্থেকে যেন এক টিউটর রাখা হলো তাকে পড়ানোর জন্য। বরাবরই সব পরীক্ষায় টপ করে আসা প্রীতি, পড়াশোনার প্রতি ভালোই আগ্রহী ছিল। তবে সমস্যা হলো, এখন তার পড়তে ইচ্ছে করে না। এখন তার ঘুমাতে ইচ্ছে করে, গালে হাত দিয়ে বসে বসে কল্পনা করতে ইচ্ছে করে। 

এমনই এক বিকেলে সে কল্পনায় ভীষণ ব্যস্ত ছিল, তখন কোত্থেকে যেন পৌলি এসে তার কল্পনার আলপনায় পায়ের ধূলো ফেলে বলে উঠলেন, 
-“প্রীতি, শোনো৷ স্যার এসেছেন। মুখে পানি দিয়ে এসো। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ কাল থেকে আমার সাথে ঘুমোবে।”

প্রীতি মরা মানুষের মতো হাঁটতে হাঁটতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। এরপর মুখ ধুয়ে রুমে আসতেই লোকটা বসে আছে দেখে সালাম দিলো, 
-“আসসালামু আলাইকুম।” 

সামনে বসে থাকা এক অতিমাত্রিক অভদ্রলোক সময় নিয়ে বইয়ের পেইজ ওলটানোতে মনোযোগ রেখে বলল, 
-“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোন সাবজেক্টের কোন কোন চ্যাপ্টার কম্পলিট হয়েছে?”

প্রীতির ঠোঁট-মুখের আকৃতি বেঁকে এলো। সে কোনোমতে চেয়ার টেনে বসে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সামনে বসা লোকটার দিকে। লোকটা এখনো চোখ তুলে তার দিকে তাকাচ্ছে না। অন্তত নামটা তো জিজ্ঞেস করবে! এত সুন্দর নাম তার.. প্রী-তি-ল-তা! লোকটা আগ্রহও দেখাল না! এমন আজব বস্তুকে তার সহ্য হলো না একদমই। চুপ রইল। 

বিপরীতের লোকটা তখন তাকাল। অফ হোয়াইট টি-শার্ট, চুলগুলো এলোমেলো ও বড়ো, চোখে মোটা ফ্রেমের গ্লাস, তাকানোর ধরনটা... প্রীতির স্তব্ধ হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে অভদ্রলোকটা বলল, 
-“ইট'স নক্ষত্র, প্রীতিলতা। তহমিদ আবরার নক্ষত্র। মনে থাকবে তো? হুহ?”

প্রীতি গলে গেল। এ লোক অন্তর্যামী নাকি?
.
.
.
চলবে...........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন