কনকনে শীতল হাওয়ার স্পর্শও দেহের এহেন উদ্যম উষ্ণতা সরাতে ব্যর্থ। ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুকের ভেতরের তৃষ্ণার্ততা —এই নিবিড় রাত্তিরে প্রবল হয়ে ধরা দিলো যেন। চাঁদের জ্যোৎস্না পৃথিবীতে অবস্থিত অন্যতম সুন্দর দৃশ্য বলেই মনে হচ্ছে। যেই দৃশ্যের বর্ণনা ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব প্রায়। অজস্র লেখক উপন্যাসের একেকটি মিষ্টি প্রেমের মধুরতা বাড়াতে—কতশত ভাবেই না জ্যোৎস্নার উত্তম বর্ণনা করার প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু আসলেই কী জ্যোৎস্নার গভীরতা শব্দে ব্যক্ত করা গিয়েছে? আর সেই অপরূপ জ্যোৎস্নার দীপ্তি যদি প্রিয়তমার মুখে এসে ভিড়ে —সেই দৃশ্যের বর্ণনা কীভাবে ব্যক্ত করবে? কীভাবে ভাষায় জাহির করবে এই সৌন্দর্য? অদৃশ্যের মতো জ্যোৎস্না, চাঁদ, বৃষ্টি সহ প্রাকৃতিক যেকোনো কিছুর সৌন্দর্যের বর্ণনা শব্দে অনুভব করানো সম্ভব হয় না। উর্ধ্বে গেলে একটুকরো অনুভূতি শব্দতে বয়া করতে পারি। বাকিটা মুগ্ধ চোখে শুধু উপভোগ করা যায় একন্তই। গভীরভাবে মেখে নেয়া যায় শরীর সহ মনেপ্রাণে। এইযে, অরুর লজ্জায় কাতর হলুদ মাখানো মুখপানে যখন জোছনা এসে ছুঁলো এতো চমৎকার দেখাল যে তন্ময় কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে বসল। নিগূঢ় দৃষ্টিতে দেখল একচিত্তে। একজনের ওপর কি হাজার বার প্রেমে পড়া যায়? সহস্রাধিক, সহস্ররূপে সে প্রেমে পড়ে এই একজনের ওপর। মুগ্ধ হয় এই একজনেতেই। অরু মিটিমিটি চোখে আড়ে আড়ে কেমন বিচিত্র ভাবে চাইছে। কী সামান্য একটা বিষয়, আড়ে-আড়ে চাওয়া! অথচ এই সামান্যতেই তন্ময় বারবার মুগ্ধ হয়। বারবার দগ্ধ হয়। বারবার তার মনে হয়, এই প্রথম দেখছে সে। সমস্ত অরুটাই যেন তার কাছে এক অন্যতম চরিত্র—-যাকে সে সবসময়, সব ভাবেই ভালোবেসে বসে। ভালোবেসে চলে। এসময়ে অরু খুব মিহি কণ্ঠে কাশল। বাচ্চাদের মতো জড়সড়ভাব ধরল তার বাহুতে। বলাবাহুল্য, ওকে ধরতেও তন্ময়ের ভালো লাগে। নরমটরম, ছোটোখাটো শরীরটা তার বাহুতে একদম বিড়ালছানার মতন এইটুকুন দেখায়। অরু হাঁসফাঁস করল তন্ময়ের হলদেটে গাল দুটো দেখে। চকিতে বড়ো বড়ো চোখে অপ্রস্তুত গলায় বলল,
‘সবাই বসার ঘরে। আপনার গালে তো হলুদ ছিলো না। যদি জিজ্ঞেস করে কই থেকে এলো?’
এহেন প্রশ্নের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তন্ময় বুঝে পেলো না। তারা সম্পর্কে একসময় শুধুমাত্র কাজিন হলেও, এখন স্বামী-স্ত্রীও। সবাই তা জানে। মানছে না সেটা ভিন্ন চ্যাপ্টার। মিয়াঁয়াবিবি ছাঁদের আঁধারে ছিল এতক্ষণ ধরে। মিয়াঁ গালে হলুদ মেখে নামছে, এই দৃশ্য দেখে কোন বেআক্কেল প্রশ্ন করবে, হলুদ কোথা থেকে এলো?
নিশ্চয়ই তাদের মস্তিষ্ক অরুর মতন একটুখানি নয়। মুখে এই কথাটুকু বলে ফেললেই এক কেলেংকারি নিশ্চিত ঘটে যাবে। অরু চটে যাবে। কথাবার্তা বন্ধ করবে। আর ওর সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার, এভয়েড করা তাকে। সেটিও করবে। অগত্যা মনের কথাটুকু মুখে বলার প্রশ্ন আসছেই না। তাই দুর্দান্ত নির্বিকার কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল,
‘বলবি– আমি ভালোবেসে, অনেক আদর করে, খুব যত্নের সাথে তন্ময় ভাইয়ের গালে-গাল ঘষে হলুদ মাখিয়ে দিয়েছি।’
অরু হতবিহ্বল হলো বোধহয়। নিথর হয়ে এলো শরীর। আশ্চর্যে সপ্তম আকাশে উঠে গিয়েছে যেন। নীরব, নিশ্চল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে একটি শব্দ দু'বার করে আওড়াল,
‘ছি্হ…ছি্হ।’
বলেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো অরু। তন্ময়কে দুর্বলজনক কঠিন দৃষ্টি দেখিয়ে —এক দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। হলুদের ডালাপালা তখনো পড়ে রইল ছাদের ফ্লোরে। হলুদে মেখে গেছে ছাদের অনেকাংশ। তন্ময় দু'হাঁটু ভেঙে বসল। ডালা তুলে নিয়ে একে-একে তুলল হলুদের বাটি। সেটি হাতে নিয়ে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। নিজেকে আয়নায় একবার দেখে নেয়া দরকার। অরু লিপস্টিক পরা ছিল। ঠোঁটে লেগেছে কী-না! সে কয়েকবার রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিয়েছে। তারপরও নিশ্বাসের বিশ্বাস নেই। এবং আসলেই নেই। দীপ্ত দোতলার সিঁড়ির মাথাতেই দাঁড়িয়ে। তন্ময়কে দেখছে ফ্যালফ্যাল চোখে। হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল বাচ্চাদের মতন। হেসে হেসেই উচ্চস্বরে শুধাল,
‘ভাইয়া, তুমি লিপস্টিক লাগিয়েছ কেনো? আল্লাহ্! লিপস্টিকস আর ফর গার্লস। জানো না?’
তন্ময় হতাশ হয়। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই কেন যে সন্ধ্যে হয়। আশ্চর্য! রুবি অদূরেই ছিল। তার হাতে জুসের ট্রে। সেও থমকে দাঁড়িয়েছে। বসবার ঘরেও একটা আগ্রহ জন্মেছে দীপ্তর প্রশ্নের সত্যতা জানার। তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে আঙুলে চুটকি বাজিয়ে দীপ্তকে কাছে ডাকল। দীপ্ত সতর্ক চোখে বড়ো ভাইয়ের গম্ভীর মুখ খানা দেখতে দেখতে এগুচ্ছে। তন্ময়ের গম্ভীর দু'গালে হলুদ। ঠোঁট জুড়ে এবড়োখেবড়ো লিপস্টিপ স্টেইন —অথচ তাতেও গাম্ভীর্যতা ফিকে হতে পারল না। দীপ্ত ভীত ভাবে কাছাকাছি আসতেই, তন্ময় ওকে একহাতে কব্জিতে তুলে ফেলল অবলীলায়। রওনা দিলো নিজের ঘরের দিকে। যেতে নিয়েই হুকুম করল,
‘তুই পড়তে বসবি এক্ষণ। গত টেস্টে ম্যাথম্যাটিকসে আউট অভ থার্টিতে টুয়েলভ পেয়েছিস।’
দীপ্ত মুহূর্তেই মিইয়ে গেল আতঙ্কে,
‘ভাইয়া আমি একদম লক্ষ্মী বাচ্চা হয়ে থাকব। কিচ্ছু বলব না। আমাকে অনুষ্ঠানে যেতে দাও, প্লিজ? আমি কিছুই দেখিনি, আমিইইই কিচ্ছু জানি না। সত্যি!’
তন্ময় নিজের ঘরের দুয়ার সামনে এসে ওকে নামাল। ভ্র নাচিয়ে জিজ্ঞাবাদ চালাল,
‘ইউ শিয়র?’
দীপ্ত পিছুতে শুরু করেছে, ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট।’ বলেই ঘুরে দৌড় দিয়েছে। তন্ময় ভেতরে ঢুকল। সর্বপ্রথম আয়নায় মুখটা দেখে নিলো। কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। বিভ্রান্ত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পূর্বেই বন্ধুরা একেকটা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। আজকে কি তন্ময়ের খারাপ দিনের মধ্যেকার একদিন? নাইলে এইসময়ে হাতেনাতে —প্রমাণ সহ এই জাহি লদের হাতে পড়বে কেনো সে? ঘরে ঢুকেই মাহিন তন্ময়ের মুখ দেখে আশ্চর্য হয়। থমকে রয় তার দেহখানা। রিয়ান থরথর করে কেঁপে বিছানায় পড়ে গিয়েছে। একেবারে জলসার বাংলা সিরিয়ালের একটি সুপরিচিত দৃশ্য এই যেন। সৈয়দ বিড়বিড় শুরু করল,
‘ধুম তানা না না না…ধুম তানা না না না…’
সবগুলো শুরু করেছে ইচ্ছেরকমের অযথার্থ লেগ পুলিং। এরা কতক্ষণ এমন করবে কে জানে! তার বাড়ির কেউ না শুনলেই হয়। তন্ময় উদাস চোখে বন্ধুদের একপলক দেখে নিলো। ওদের অগ্রাহ্য করে টিস্যু বক্স হাতে তুলে নিলো। মুছতে শুরু করল মুখমণ্ডল। ভাবসাব একইরকম তার। উৎসাহের সহিত তখন রিয়ান বিবৃতি চেয়ে চলেছে জ্যোৎস্নাময়ী রাতের। সে শুনতে ব্যাকুল। তন্ময়ের ইচ্ছে করছে সবগুলোকে লাথি দিয়ে বের করে দিতে। এইগুলো কীভাবে যে তার বন্ধু হলো!
———
ভোরের কুয়াশাচ্ছন মিষ্টি রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছে বাগানের ঘাসপাতা। শিশিরজলে ভেজা ঘাস গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে রোদের সস্পর্শে এসে। প্রজাপতিরা উড়ছে ফুলগুলোর ভেতরে-ওপরে। বাতাসের ‘ব’ টুকুও নেই প্রকৃতিতে। বাগানে গতকাল রাতের আনুষ্ঠানিক আয়োজনের চিহ্ন মাত্র আর নেই। রাতের মধ্যেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়ে গিয়েছে। জগিং শেষ করে মাত্রই ফিরেছেন মোস্তফা সাহেব। বাগানের মধ্যিখানে সাজানো চেয়ারের একটিতে এসে বসেছেন। উপভোগ করছেন আরামদায়ক স্নিগ্ধ রোদ। শীতকালীন সকালের রোদ্দুর অনেকটাই— তপ্ত গরমের একপশলা মিষ্টি বৃষ্টির মতন, চোখবুজে অনুভব করার মতন। আজকাল তিনি একাই জগিং এর জন্য বেরুচ্ছেন। এমনিতে আগে ছেলেকে নিয়ে বেরুতেন। ইদানীং ছেলেটা বেরুচ্ছে না। কিন্তু কেনো? আজ অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন। সকাল করে হাঁটতে বেরুনো তো ছেলেটাই শেখালো তাকে। মাঝরাস্তায় এখন ছেড়ে দেবে কেনো? একা জগিং করতে তার ভালো লাগে না। অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস, আজ আবারও প্রমাণিত হলো। কেডস এর ফিতে খুলতে নিয়ে হাঁক ছাড়লেন স্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে। এক কাপ চা আর আজকের নিউজপেপার এখন তার প্রয়োজন। বাজারসদাইয়ের কী অবস্থা দেখা দরকার। গতকাল দেখাল স্বর্ণের দাম কমেছে। আজকে আবার কেমন হালচাল কে জানে! জবেদা বেগম এগিয়ে আসছেন এক কাপ চা আর নিউজপেপার নিয়ে। স্বামীর হাতে চা-টা ধরিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন নিউজপেপার। মোস্তফা সাহেব চায়ে এক চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলেন ভোঁতা গলায়,
‘তোমার রাজপুত্র কি উঠেছে?
জবেদা বেগম হাসলেন মিহি স্বরে, ‘ঘুমোলোই তো ভোরে। আজ কী আর সকাল-সকাল উঠতে পারবে? দুপুর হবে।’
মোস্তফা সাহেব মাথা দোলালেন। দুলিয়েই থামলেন না। আওড়ালেনও,
‘আচ্ছা ওকে ডেকো না। কাউকে ডাকতেও দিও না। ঘুমুতে দাও। এভাবেও কাজের চাপ নিয়ে রেখেছে বড্ড।’
এবারেও ভদ্রমহিলা নিঃশব্দে হাসলেন। কিছুক্ষণ বসে উপভোগ করলেন সোনালী রোদের স্পর্শ। শুনলেন মিষ্টি পাখিদের কোলাহল। দেখলেন স্নিগ্ধ প্রজাপতিদের উড়োউড়ি।
তন্ময়ের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ঘরের ভেতরটা রোদে ঝলমল করছে। জানালা খোলা। পর্দা সরানো। জোড়া পাখি এসে বসেছে জানালায়। তন্ময় ঘুমঘুম চোখে একবার তাকাল সেদিকে। রাতে তো সব লাগানো ছিলো। কোন পণ্ডিত এসেছিল ঘরে? নিশ্চিত তার পণ্ডিতই এসছিল পাকামি করতে। গতকাল সে বন্ধুদের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসেছি রাত চারটা পয়ত্রিশে। ঘুমুতে ঘুমুতে আজান পড়ে গিয়েছিল। অরু অবশ্য তিনটার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বসার ঘরের সোফায়—- আনোয়ার সাহেবের কোলে মাথা রেখে। পরে সেই ওকে কোলে করে ঘরে দিয়ে এসেছিল। উঠে বসতে না বসতেই অরু ঢুকল ভেতরে। তন্ময়কে জাগিত দেখে হুড়মুড়িয়ে কাছে এলো। কণ্ঠে জুড়ে বিষাদের আবির্ভাব,
‘আপনি নাকি শাবিহা আপুর বিয়ের দিন রাতেই দিনাজপুর যাবেন? বিজনেসের জন্যে? সত্যিই?’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গায়ে শার্ট নেই। সে সচরাচর উদোম দেহেই ঘুমোতে অভ্যস্ত। আজ অরুর আর তার দেহতে ইন্টারেস্ট নেই। গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। বিছানা ছাড়তে ছাড়তে তন্ময় শুধালো,
‘কে বলেছে?’
অরু একরোখা গলায় বলেই গেল, ‘তা তো ইম্পর্ট্যান্ট না। আপনি বলুন না, সত্যি বলেছে?’
তন্ময় মৃদু হাসল। তার সবেমাত্র ঘুম ভাঙা স্বর চূড়ান্ত হাসকি শোনাল,
‘যাব আর আসব। মাত্র দু'দিন। হুঁ? যা নাস্তা লাগাতে বল। আমি আসছি।’
অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকল। এক পাও নড়ল না। তন্ময় নিজের কাছেই হার মানল। অরুকে দুঃখী সে দেখতেই পারে না। অস্থির অনুভব করে। আর ওর এমন ভোঁতা মুখ দেখে সে কীভাবে যেতে পারবে? তন্ময় এগুলো ওর দিকে। উদোম বুকেই জড়িয়ে নিলো শক্ত করে। আনমনা ভেবে উঠল সে, —কী করতে হবে ওকে বুঝিয়েশুনিয়ে দিনাজপুর যেতে হলে? অরু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে দ্রুত পায়ে। তন্ময় বাথরুম ঢুকল। গোসল নিয়ে বেরিয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো। সে এই বেলা করেই অফিস যাবে। এমনিতেই বিয়েশাদি নিয়ে সে কাজের পাহাড় জমিয়েছে। ঘড়ি পরতে নিতেই দেখা গেল অরু আবার এসেছে। ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে। তন্ময় অসহায় অনুভব করল। এগুতে নিতেই অরু ফের চলে যেতে উতলা হলো। মেয়েটা এতো অবুঝ! তন্ময় আলগোছে হাত টেনে ধরল।
.
.
.
চলবে............................................