অনন্যার মা-বাবা বছর চারেক আগে অনন্যার ছোট ভাইকে নিয়ে কিছু কাজের অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। প্রথমে অনন্যা ভেবেছিল, হয়তো আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। কিন্তু কয়েকদিন পর সে জানতে পারলো, তারা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা করছে। মা-বাবার ইচ্ছা ছিল সেখানকার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে অনন্যাকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। এটি নাকি অনন্যার জন্য বড়সড় একটি সারপ্রাইজ ছিল।কিন্তু এই "সারপ্রাইজ" অনন্যার জন্য ছিল পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ও অপছন্দনীয়। তার মনে হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তার সাথে প্রথমে আলোচনা করা উচিত ছিল। তখন নিজেকে পরিবারের এক সদস্য নয়, বরং বাইরের কেউ মনে হতে লাগলো অনন্যার।
তার ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমে গেল। মা-বাবার প্রতি সেই অভিমান ও রাগ তার মনে গভীর ক্ষতের মতো দাগ কেটে গেল। তার মনে হলো, এই সিদ্ধান্ত শুধু তার মতামতকে উপেক্ষা নয়, বরং তাকে তাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার একটি ইঙ্গিত। সেই দিন থেকেই পরিবারের প্রতি অনন্যার অনুভূতিগুলো ক্রমশ বদলে যেতে লাগলো। মা-বাবার সঙ্গে দরকার ছাড়া আর কোনো অতিরিক্ত কথা হয় না তার। তাদের সঙ্গে সংযোগটা যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেছে। কোনো বড় ঘটনা বা সিদ্ধান্তের সময়ও অনন্যা আর তাদের কথা ভাবার প্রয়োজন বোধ করে না।
আজকের বিয়ের ব্যাপারটাও অনন্যার মা-বাবাকে জানানো হয়নি। অনন্যা নিজেই জানতে পেরেছে কাল রাতের দিকে। আর মামা-মামী সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছিল, "এ ব্যাপারে তোর বাবা-মাকে কিছু জানাতে হবে না। আমরা যে দায়িত্ব নিয়ে তোকে এত বছর রেখেছি, লালন পালন করেছি, সেটা আরেকটু এগিয়ে তোর বিয়ে দিয়েই শেষ করবো। এটা আমাদের কর্তব্য।"
মামা-মামীর এই কথায় অনন্যার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। সে জানে, তার জীবনের অনেক সিদ্ধান্তই যেন তার হাতের বাইরে চলে গেছে। তাই আজকের এই বিয়ের ঘটনাও একপ্রকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারপাশে তাকিয়ে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে মনে পড়লো ফোনটা গাড়িতেই রয়ে গেছে, সে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ওড়নাটা কুড়িয়ে নিল। খয়েরি রঙের কারুকাজ করা ওড়নাটাকে ঝাড়তে ঝাড়তে সে নিঃশব্দে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা পথ এগিয়ে চোখে পড়লো তার জুতো দুটো। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলো, এক জুতোর নিচের অংশ ছিঁড়ে গেছে। হয়তো কোনো গাড়ি বা রিকশার নিচে পড়ে গিয়েছিল বেচারা। অনন্যা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জুতো হাতে তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো।
ইশতেহার কৌশিক তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল ব্রিজের মাঝখানে। নিচে বিশাল নদী, যার পানির স্রোত দূর থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি হুশ হুশ করে ছুটে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যও কোনো গাড়ি আস্তে যাচ্ছে না। চারদিকে যেন কোলাহলের মাঝেও একাকিত্বের শীতল ছোঁয়া।
অনন্যা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে। রাস্তায় দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটে চলেছে। কারো কাছ থেকে লিফট চাইতে গিয়ে আবার দ্বিধায় পড়ে যায় অনন্যা। নিজের মনে সে বিরবির করে বলল, "লিফট চাওয়া মানেই আবার নতুন কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া। কিন্তু যাবো কোথায়? বাসায়? সবাই হাসবে, মজা করবে। আমার পুরো জীবনটাই যেন একটা রসিকতা হয়ে গেছে। পদে পদে কেবল সারপ্রাইজ!"
অনন্যা ব্রিজের রেলিংয়ের পাশে বসে তার চারপাশের দৃশ্যগুলো শেষবারের মতো গভীরভাবে দেখল। রাতের অন্ধকারে নদীর পানির প্রবাহ যেন একটি বিশাল কালো চাদরের মতো বিস্তৃত। তার চোখে ঝাপসা হয়ে আসা পানির আভায় আলোর ছটা ঝিকিমিকি করছে। নিজেকে হালকা করার মতো একটি শ্বাস ফেলে সে গলার হার খুলে ওড়নার মধ্যে রাখল। একে একে কানের দুল, হাতের চুড়ি, আঙুলের আংটি, সব খুলে গুছিয়ে রাখল।
গয়নার পোঁটলাটা সামনে রেখে অনন্যা হেসে বলল, "জীবনের থেকে গয়নার দাম বেশি। তাই না বস? মামী যদি জানে আমি তার গয়না নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি, খুব রাগ করবে। এর চেয়ে এদিকেই থাকুক পড়ে।"
তার কথার শেষে হালকা হাসির আভাস থাকলেও, সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল গভীর বেদনা।
অতঃপর, উঁচু স্থানে উঠে দাঁড়ালো অনন্যা। নিচে তাকিয়ে দেখলো গভীর নদী, অনেক নিচে। এত ওপরে থেকে পড়লে সত্যিই সে মারা যাবে কি না, এমন ভাবনাই ঘুরছিল মাথায়। ধীরে ধীরে সে কাপড় ধরে রেলিংয়ের আরও দুই ধাপ ওপরে উঠলো। ঠাণ্ডা বাতাস তার শরীরে লাগছিল, কিন্তু তার ভেতরের কষ্ট যেন সেই ঠাণ্ডার থেকেও তীব্র।
হঠাৎ সে খুব জোরে চিৎকার করলো, চিৎকারের মধ্যে মিশে ছিল তার অপ্রকাশিত কষ্ট আর চাপা কান্নার সুর।
সে বলতে লাগলো,
"স্যার! যদি অনন্যা বেঁচে থাকে প্রতিদিন থাপ্পড় খেতে খেতে আপনার জীবন যাবে। বুঝলেন? অসভ্য লোক! বিয়ে করে ছেড়ে চলে যাওয়ার শাস্তি দাবি করছি আমি। ঘোর শাস্তি হবে আপনার। আপনি কিন্তু বেঁচে থেকে শান্তি পাবেন না!"
অনন্যা আবারো হাসতে লাগলো। মনে হচ্ছিল, সে যেন এই পৃথিবীর সব কিছু থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চায়। আর এক ধাপ ওপরে উঠতে গিয়েই হঠাৎ পিছন থেকে কারো আওয়াজ শোনা গেলো।
"অনন্যা! থামো!"
অচেনা আওয়াজ শুনে সে পেছনে ঘুরতে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তেই পা ফসকে গেল তার। ভারসাম্য হারিয়ে রেলিং থেকে সরাসরি নিচে পড়ে যেতে লাগলো। তীব্র ঠান্ডা বাতাস তার চুল আর শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছিল, যেন প্রতিটি মুহূর্ত এক অনন্ত সময়ের মতো দীর্ঘ। পড়তে পড়তে তার মনে পড়ে গেল জীবনের ছড়ানো ছিটানো স্মৃতিগুলো,মা-বাবা আর ছোট ভাইয়ের হাসি-মাখা মুখ, ঈরার উচ্ছ্বাস আর স্নেহের আলিঙ্গন, বেস্ট ফ্রেন্ড নোহারা আর তাদের হাসিখুশি দিনগুলোর কথা। একটার পর একটা স্মৃতি ঝড়ের মতো তার মনে ভেসে উঠলো।
শেষ মুহূর্তে, যখন মনে হলো সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার মনের গহীনে উদয় হলো কৌশিক স্যারের স্মৃতি। তার কঠিন মুখের সেই নরম অভিব্যক্তি, সেই নির্ভীক উচ্চারণ "এই বিয়ে হবে না" সেই জেদি মানুষটা! হঠাৎ করে উদয় হওয়া সেই ফেইরি টেইলের প্রিন্সটা!
নিজের অজান্তেই অনন্যার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। "আচ্ছা, স্যার আমাকে বিয়ে করলেন কেনো? আর ছেড়েই বা গেলেন কেনো?"
ধস করে আওয়াজ তুললো ব্রিজের নিচে থাকা নদীটি। নদীর অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকলো অনন্যা। আশেপাশে কিছু স্রোতের চিহ্ন দেখা গেলো। পরক্ষণেই থেমে গেলো আর আবারো আগের মতো বইতে লাগলো নদীটা।
বেশ অনেকক্ষণ পরে নদীর শান্ত জলধারায় অস্থিরতা শুরু হলো। স্রোতের মধ্যে হঠাৎ এক ভয়ংকর আলোড়ন দেখা দিলো। নদীর বুক যেন প্রাণ ফিরে পেলো, জলের ঢেউগুলো হঠাৎ আকাশ ছুঁতে চাইল। দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসা জাহাজগুলোও সেই ঝড়ো স্রোতের ধাক্কায় টলতে শুরু করলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে, অন্ধকার জলের গভীর থেকে এক রহস্যময় নরমানবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলো। তার আকাশি রঙের দৃষ্টি অন্ধকার কালো টলটল পানিকেও হার মানিয়ে যাচ্ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে সেই নরমানবের, তাও কোনো লুকায়িত শক্তি তাকে আবারো টেনে নিয়েছে এই স্থানে।
•
অনন্যা পিটপিট করে চোখ খুলে কাশতে শুরু করলো। হঠাৎ খুব ঠান্ডা লাগছে, শীত ধরেছে তাকে। অনেক সময় পর চোখ খুলতেই চোখে সাদা আলো পড়ায় তাকাতে পারছে না সে। বেশ খানিকটা সময় পর ঠিকমত চোখ খুলতে পারলো অনন্যা। চারপাশে ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলো সে হসপিটালে রয়েছে। কিন্তু কীভাবে? সে তো মারা গিয়েছিল না?
আশেপাশে অনেক রোগী শুয়ে আছে। সাদা পর্দার দিকে চোখ গেল অনন্যার। পর্দার ওপারে একজন নার্স আর ডাক্তারের কথোপকথন চলছে। অনন্যা কৌতূহলী হয়ে তাদের কথায় কান পেতে রইল।
নার্স বলছে,
"স্যার, লোকটার শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গিয়েছে, ফোসকা উঠেছে! আমরা সার্জারির ব্যবস্থা করার কথা বলেছিলাম, কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনলেন না।"
"রোগী না মানলে আমাদের তো কিছু করার নেই। বাদ দিন! অন্য রোগীদের দেখুন।"
"কিন্তু স্যার লোকটা তো বিদেশি। আমাদের হসপিটালের উপর খারাপ ইমপ্রেশন পড়লে?"
"আরে এতো ভাবছেন কেনো? তেমন কিছু হবে না। আমার মনে হচ্ছে লোকটার চেহারা দেখে গলে গিয়েছেন আপনি।"
"ধুর কী যে বলেন না!"
মুচকি মুচকি হাসছে নার্স। বেশ লজ্জা পেয়েছে সে, হাসিতে বোঝাই যাচ্ছে। অনন্যা একটু উঠতে গিয়ে আহ্ শব্দ করে ফেললো। পিঠটা ব্যথা করছে খুব। ততক্ষণে ডাক্তার, নার্স পর্দা সরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ডাক্তার বলা শুরু করেছে,
"আর ইউ ওকে, মিস?"
অনন্যা উঁকি মেরে পাশের বেডে তাকাল, কে এই লোকটা? ডাক্তারের কথায় সে বুঝতে পেরেছিল লোকটি বিদেশি। কিন্তু কৌশিক স্যার এখানে আসবেন কেন? কৌতূহল তাকে কাবু করল, মাথা হেলিয়ে দেখতে হলো। পাশের বেডের মানুষটিকে দেখে মুহূর্তে তার শরীর কেঁপে উঠল।
লোকটার হালকা ফর্সা হলুদ চেহারা কেমন যেন চুপসে গেছে। চেনা মুখটিকে এমন অবস্থায় দেখে গা শিউরে উঠল তার।
ইশতেহার কৌশিক স্যার-ই শুয়ে আছেন বেডে! তার দুই হাত ছিলে গেছে, শরীরের বেশ কিছু জায়গায় বড় বড় ফোসকা।
"কিন্তু কীভাবে? কার এক্সিডেন্ট হয়েছিল? আর... আমাকে কে বাঁচাল?" নিজেকেই প্রশ্ন করল অনন্যা, কিন্তু উত্তর মিলল না।
অনন্যা নিশ্চল, নিস্তেজ হয়ে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। নার্স ডাক্তার বেশ কিছু কথা বলে ফেলেছে সেসবে মেয়েটার কোনো হুঁশ নেই।
নার্স হঠাৎ অনন্যার কাঁধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললো,
"ম্যাম!"
"জ্বি? জ্বি...!"
অনন্যা থতমত খেয়ে গেছে।
"আপনার শরীর কেমন লাগছে? ব্যথা করছে এখনো?"
"না অল্প!"
"হুম, বেশি সিরিয়াস কিছু হয়নি। তাও রেস্ট নিন ভালো করে। আর হ্যাঁ সুইমিংপুলে নামবেন না আর! সাঁতার জানেন না, নেমে শুধু শুধুই জানের ঝুঁকি!"
ডাক্তার হেসে বললো শেষের কথা।
চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো অনন্যা।সে কী সুইমিংপুলে নেমেছিল? সে তো কার কথা শুনতে গিয়ে নদীতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কে ছিল সেই লোকটা?
অনন্যা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাশের বেডের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, "ওই লোকটা কী.... এই ব্যাটাই ছিল? স্যার-ই কী বাঁচালো আমাকে?"
.
.
.
চলবে...............................................