অতিথি নিবাস - পর্ব ২৯ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


দিন পনের পরের কথা। আজকালকার সময়গুলো কেমন যেন পানশে কাটে। মনে হয় বাতাসে বাতাসে শোকের ছায়া। মনমরা ভাব থাকে চারিপাশে। বিষণ্ণতায় আঁটকে আছে পুরো অতিথি নিবাস, মায়াকুঞ্জ, এমনকি তৌহিদের ভার্সিটিও। মোহনার চঞ্চলতা এখন আর দেখা যায় না। ক্লাসরুমে গভীর দৃষ্টি নিয়ে সে আর তাকায় না তৌহিদের দিকে। চুপচাপ বসে থাকে। আগে ক্লাসরুম জুড়ে একটা হট্টগোল ভাব থাকত। মোহনা একের পর এক প্রশ্ন করত তৌহিদকে। এখন আর করে না। মনে হয় সে যেন সব পারে। তৌহিদ একবার পরীক্ষা করতে কি যেন জিজ্ঞেস করছিল মোহনাকে। অদ্ভুত ব্যাপার সে সেটা জানে। অথচ আগে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কি পরিমান তোতলাতো মেয়েটা। এর অর্থ কি— মেয়েটা সব জেনেও এতদিন না জানার ভান করত। নাকি প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে। বিষয়টা একদিক দিয়ে যেমন ভালো। অন্যদিক দিয়ে মোহনার চঞ্চলতা কমে যাওয়ায় বড্ড খারাপ লাগে তৌহিদদের। তার জন্যই মেয়েটা এমন চুপচাপ হয়ে গেছে। বাড়ির বাহিরে মোহনার জন্য খারাপ লাগে। আবার বাড়ি ফিরলে আরহানের জন্য চিন্তা তার।

 আরহানটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। আগের চেয়ে বদলেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে। এফএম রেডিওতে তেমন উল্লাস নিয়ে কথা বলে না। তৌহিদ শুনেছে বিথী এখন আর আরহানকে জ্বালাতন করে না। সেদিনের ছাঁদে বসে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার হৃদয়ে কঠিন দাগ কেটেছে। বিথী সেই দাগ ঘোচাতে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে আরহানের বদলে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছে। আরহানকে সরি বলতে বলেছে। সেও বলেছে। আরহানের ভারাক্রান্ত দেখা যায়নি কোনো। তৌহিদের ধারণা আরহান তাদের কাছ থেকে কিছু একটা লুকিয়েছে। কিন্তু সেটা কি তা এখনও ধরতে পারেনি।

অন্যদিকে মায়াকুঞ্জের ফাবিহা। দিনরাত সে মনমরা হয়ে থাকে। আরহান তাকে ফিরিয়ে দিবে এটা ভাবেনি আবার গ্রহণ করবে তাও ভাবেনি। কিন্তু সরাসরি আরহান না করে দিবে বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল আরহান সময় নিবে। কিন্তু নিল না। চট করেই বলে দিল সম্ভব নয়, পছন্দ নয়। কথাটা শোনার পর ভেবেছিলাম নিজেকে সামলে নিবে। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখা গেল নিজেকে সামলাল যাচ্ছে না। ভালোবাসা বিষাদের এত তীক্ষ্ণ তেজ, এত ব্যাথা দেয়ার ক্ষমতা, নিজেকে শূন্যতায় গুটিয়ে ফেলা এত সহজ বুঝতে পারেনি ফাবিহা। তবুও আরহানের মুখোমুখি সে হচ্ছে না। সে ফিরিয়ে দেয় তার কাছে কি নিয়ে যাওয়া যায় আর।

  অরিন আর শান্ত। তাদের দিনকাল চলে অদ্ভুতভাবে। দেখা সাক্ষাৎ হয় না। মাঝে মধ্যে টুকটাক টেক্সটে কথা হয়। শান্ত ব্যস্ত মানুষ। নগদে সে একটা বই লিখছে। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের ওপর। এর জন্য পড়াশোনাও করছে। তাই মূলত ব্যস্ততা। কিন্তু অরিন সে তো আর এসব বুঝে না, জানে না। ভাবছে শীঘ্রই মায়াকুঞ্জে পা রাখবে।

••••••••••••

সকাল দশটা। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল ফাবিহা। মনমরা হয়ে কতকাল বসে থাকবে ঘরে। অন্যদিকে তার এক্সাম অতি নিকটে। ফাবিহা কোনোরকম সকালের নাস্তাটুকু করে বলল,
 “যাচ্ছি মা।”

পিছন থেকে ফাবিহার মা বললেন, “পুরোটা তো খেলি না।”

ফাবিহা যেতে যেতে জবাব দিল, “ফিরে এসে খাব।”

ফাবিহা চলে গেল। রাহেলা দূর থেকে তাকিয়ে। উর্মি গেছে তার বাপের বাড়ি। ফিরবে নাকি দুদিন পর। উর্মির বাবার শরীরটা আচমকা খারাপ হয়েছে। যার দরুনই এমন হুট করে যাওয়া। আহিরও অফিস শেষে শশুর বাড়িই যাচ্ছে। বউহীন থাকতে কষ্ট কি না।

••••••••••••

বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে আরহান। শান্ত টেবিলে বসে বই পড়ছে। তৌহিদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে কিছুক্ষণ পর পর আরহানের দিকে তাকাচ্ছে। আরহানের চোখ লাল। বোধহয় সারারাত ঘুমায়নি। এখনও শুয়ে আছে। পলকহীন তাকান জানালার তরে। তৌহিদ পরিধিত শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে ডাকল, “আরহান।”

আরহানের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বোধহয় শুনতে পায়নি। তৌহিদ আবার ডাকল, “আরহান।”

আরহান নিরুত্তর। এবার তৌহিদ চিন্তিত হলো। মথাটা আঁচড়ে এগিয়ে এসে আরহানের গাঁ স্পর্শ করল। আরহান চমকে উঠল তখন। তাকিয়ে তৌহিদকে দেখে বলল, “তুই, কিছু বলবি?”

তৌহিদ উত্তর দেয় না। চুপটি করে বসে খাটে। আরহানও শোয়া থেকে উঠে বসল। চোখ মুখ চেপে বলল, “কিছু কি হয়েছে?”

শান্তর দৃষ্টি এলো তখন আরহান আর তৌহিদের দিকে। তৌহিদের সাথে তার কথা হয়েছে। শান্তও আরহানের জন্য চিন্তিত। আরহান বেশ বিস্মিত হলো। বলল, “কি হলো কথা বলিস না ক্যান?”

তৌহিদ মুখ খুলল। শান্ত স্বরে বলল,
 “কি হয়েছে তোর?”

আরহান অবাক না হয়ে পারে না। অদ্ভুত কণ্ঠে আওড়ায়, “আমার কি হবে?”

বিতৃষ্ণা ধরল তৌহিদের। চোখ বুজে আবার মেলে উত্তর দিল, “কথা লুকাস না আরহান?”

আরহান কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কথা আঁটকে গেছে। তবুও শুধায়,
 “আশ্চর্য! কি লুকাব আমি?”
 “কিছু যে লুকাচ্ছিস তা কিন্তু বুঝতে পারছি।”
 “তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”
 “আমাকে বোকা মনে হয়।”
 “সত্যিই তেমন কিছু নেই।”
 “তুই নিজেও জানিস তুই মিথ্যে বলছিস।”
 “আমি একটা নতুন বাসা দেখেছি আগামী মাসে আমরা সেখানে যাব।”

এবার যেন আরো বিস্মিত হলো তৌহিদ। অবাক হয়ে বলল, 
 “নতুন বাসা মানে?”
 “আমি কিন্তু অবুঝের মতো কিছু বলিনি।”
 “হঠাৎ বাসা পাল্টাব কেন?”
 “এমনি। এক জায়গায় কতদিন থাকব?”
 “বোকার মতো কথা বলিস না।”
 “আঙ্কেল তোর বিয়ে ঠিক করেছে তাই না?”

তৌহিদের বিস্ময়ের শেষ থাকে না। এ কথা আরহান জানল কি করে! এটা সত্য তৌহিদের বাবা চাচ্ছে তৌহিদের বিয়ে দিতে। ব্যাচেলার লাইফ আর কতকাল চলবে। এখন তো তৌহিদ শিক্ষকতাও করছে। কয়েকদিন আগেই তৌহিদের বাবা ফোন করে বলেছেন তৌহিদের শিক্ষকতা নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। এবার অন্তত ছেলেটা যেন বিয়ে করে। তার একটা ইচ্ছে হলো ছেলেটা যেন তার পছন্দের একটা মেয়েকে বিয়ে করে। প্রতি উত্তরে তৌহিদ জানিয়েছে, “সে এখন বিয়ে করবে না।”

আরহান বলল,
 “কি হলো কথা বলছিস না কেন?”
 “তুই জানলি কি করে?”
 “আঙ্কেল ফোন করেছিল।”
 “কিন্তু তার সাথে এই বাড়িটা বদলানোর কি আছে?”
 
আরহান বিছানা থেকে নামল। দেয়াল ঘড়িটা দেখে বলল,
 “তোর দেরি হচ্ছে যা।”
 “কিন্তু আরহান?”
 “এ বিষয় নিয়ে আমরা পরে কথা বলব।”

আরহান ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। পিছনে তৌহিদ বিস্ময় নিয়ে বসে। শান্ত এগিয়ে এলো তখন। প্রশ্ন করল, “কি বলল?”

তৌহিদের হাত ইশারার উত্তর, 
 “অতিথি নিবাস ছাড়তে চাইছে।”
 “কেন?”
 “জানি না।”

••••••••••••••

চিরচেনা ভার্সিটিটা আজ বড্ড অচেনা ঠেকছে। বহুদিন পর ফাবিহা ভার্সিটির মাঠে পা রেখেছে। তার বন্ধুবান্ধবরাও বোধহয় তাকেহীন সময় কাটানো শিখে গেছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল ফাবিহা। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলমনিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে। ফাবিহা বাংলা ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাকল। পুরুষ কণ্ঠ। সে বলল,
 “ফাবিহা দাঁড়াও।”

ফাবিহা দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরতেই দেখল তার ক্লাসমেট সোহান দাঁড়িয়ে। ছেলেটা ফাবিহাকে পছন্দ করে ফাস্ট ইয়ার থেকে। এখন থার্ড ইয়ার চলছে। এখনও পছন্দ করে কিন্তু ফাবিহার তাকে ভালো লাগে না। কি অদ্ভুত না। এমন কতশত মানুষ ফাবিহার প্রেমে পড়েছে। অথচ..! ফাবিহা মনে মনে আওড়ায়,
  “এ জীবনে বহু মানুষ প্রেমে পড়ল আমার, অথচ প্রেমে পড়ল না সে যার প্রেমে আমি পড়লাম।”

সোহান এগিয়ে আসলো। মিষ্টি মুখে জানাল,
 “এতদিন কোথায় ছিলে?”
 “একটু অসুস্থ ছিলাম।”
 “ওহ, ক্লাসে যাচ্ছো তো?”
 “হুম।”
 “চলো একসাথে যাই।”

ফাবিহার দ্বিধাহীন উত্তর, “আচ্ছা।”
হাঁটা ধরল দুজন। সোহান ছেলেটা ফাবিহাকে প্রপোজ করেছিল মেসেজের মাধ্যমে। ফাবিহা দুদিন পর জানায়, 'সে সোহানের প্রতি সেই ধরনের কোনোকিছু অনুভব করে না।' সোহানও মেনে নেয় সে দূর থেকেই ফাবিহাকে পছন্দ করে। কখনোই উত্ত্যক্ত করে না। তবে ফাবিহা সোহানের চোখ দেখে। সে বুঝে ছেলেটা এখনও তাকে পছন্দ করে। দুনিয়ার নিয়ম বড় অদ্ভুত। 'যাদের পছন্দ করি তারা ভালোবাসে না, আবার যাদের প্রতি কোনোরূপ অনুভূতি কাজ করে না তারা ভালোবেসে বসে থাকে।'

•••••••••••••

“ভাবছি আজ নিখোঁজ হব। দূর সীমানায় মন হারাব। কি অদ্ভুত কথা না। মাঝে মাঝে আমার বড্ড নিখোঁজ হতে ইচ্ছে করে। দূরে কোথাও নিখোঁজ হব। কেউ খোঁজ পাবে না, জানবে না আমি কোথায়। আমার সাগরপাড় বড্ড পছন্দ, শহরতলির নির্ঘুম রাস্তা, পাহাড়ের উঁচু জমি, ল্যামপোস্টের ভীড়ে চুপচাপ বসে থাকা, আকাশপানে তাকিয়ে চন্দ্র দেখা। এগুলোর শখ আমার বহুকালের। অনেকটা দেখা হয়েছে অনেকটা দেখা এখনও বাকি। ভাবছি হারাব। কেমন হবে বলুন তো! আপনারা কেউ হারিয়েছেন কখনো! হ্যালো গাইস। আসসালামু আলাইকুম। আমি আরজে আরহান। বহুদিন পর মনে হলো মাইক্রোফোনে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। অথচ কালও কথা হয়েছে আমাদের। ইদানীংয়ের সময়গুলো বড্ড কেমন যেন! ভুলে ভুলে যাই। নিঃস্বতায় দিন ফুরাই। আপনারা তো শুনেছিলেন আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। এক্সিডেন্টের পর থেকেই একটু কেমন কেমন হয়ে গেছি কিছুই ভালো লাগে। যাইহোক। আপনারা চাইলে আমাকে কথা পাঠাতে পারেন, গান শোনার আবদার করতে পারেন। আমাকে ফোন করতে পারেন 82904 এই নম্বরে এছাড়া ফেসবুক লাইভেও কমেন্ট করতে পারেন। এখন আমরা শুনব একটা সুন্দর গান। ফিরে আসছি গানটা শেষ হওয়ার পরে।"

কান থেকে হেডফোন সরিয়ে ফেলল আরহান। এরপরই গান শোনা গেল,
 ❝মেয়ে তুমি কি দুঃখ চেনো চেনো না।❞

আরহান দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার নিশ্বাস আটকে আসছে। আচমকা এমন কেন লাগছে বুঝতে পারছে না। পাশে থাকা পানির বোতলটা নিয়ে দ্রুত পানি খেল। ততক্ষণে তার দিকে ছুটে এসেছে স্টুডিওর একটা ছেলে। নাম সফিন। সে আতঙ্কিত স্বরে বলল,
 “আপনি ঠিক আছেন তো ভাই?”

আরহান কিছুসময় চুপচাপ থেকে জানাল, “হুম। তুমি যাও।”

ছেলেটা গেল না। পাঁচ মিনিটের মাথায় আরহান স্বাভাবিক হলো। এরপর বলল,
 “এবার যাও। আমি ঠিক আছি। মাথাটা আচমকা চক্কর মেরেছে।”
 “ডাক্তার ডাকব ভাই?”
 “না। আমি ঠিক আছি।”

ছেলেটা চলে গেল। গানটা ততক্ষণে থেমেছে। আরহানের কল আসা শুরু হয়েছে। আরহান নিজেকে স্বাভাবিক করে চেয়ারে বসল। কানে হেডফোন গুজিয়ে কলটা ধরে স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিল,
 “আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”

••••••••••••••

রাত তখন আটটা। সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন মাসুদ উদ্দিন। সেই মুহূর্তে বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠল। মাসুদ উদ্দিন রাহেলাকে ডাকলেন। এবং বললেন দরজাটা খুলতে। রাহেলাও বিনাবাক্যে এগিয়ে এসে দরজাটা খুলল। দেখল আরহান দাঁড়িয়ে। রাহেলা একগাল হেঁসে বলল, “ভাইজান, ভালা আছেন?”

আরহান জানায়,
 “হুম। তুমি কেমন আছো?”
 “জি ভালা।”
 “মাসুদ আঙ্কেল আছেন ঘরে?”
 “জে।”

এর মধ্যে মাসুদ উদ্দিন আওয়াজ করে বললেন,
 "কে এসেছে রাহেলা?”

রাহেলার তক্ষৎণাৎ উত্তর,
 “আরহান ভাইজানে।”

আরহান ভিতরে ঢুকল। যেতে যেতে বলল,
 “আপনার সাথে কিছু কথা ছিল আঙ্কেল?”

মাসুদ উদ্দিন টিভিটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। আরহানকে ধরে বসালেন সোফায়। বললেন,
 “বসো। কি খাবে বলো?”
 “আমি কিছু খাব না আঙ্কেল।”
 “চুপ করো। রাহেলা যা চা বিস্কুট নিয়ে আয়।”

রাহেলা দৌড়ে গেল। আরহান এসেছে শুনতে পেয়ে দূর থেকে আড়াল দাঁড়িয়েছে ফাবিহা। তার বুক ধকধক করছে। মনে হচ্ছে কত বছর পর যেন আরহানকে দেখছে।

আরহান মুখ খুলল। মাথা নুইয়ে বলল,
 “আমি সত্যিই কিছু খাব না আঙ্কেল।”
 “আচ্ছা ঠিক আছে বলো কি বলবে?”

আরহান কিছু সময় নিয়ে বলল,
 “আমরা অতিথি নিবাসটা ছাড়তে চাচ্ছি আঙ্কেল।”
 “মানে?”
 “বাসা ছাড়ব।”
 “হঠাৎ! বিশেষ কারণ আছে নাকি অতিথি নিবাসটা তোমাদের ভালো লাগছে না।”
 “না না তেমন কোনো ব্যাপার নেই।”
 “তাহলে?”
 “তৌহিদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। শান্তও তার গ্রামের বাড়ি থাকবে বলে ভাবছে। আমাকে স্টুডিও থেকে একটা বাড়ি দেয়া হচ্ছে। ওই স্টুডির মালিক দেশে থাকবেন না। তাই আমাদের কয়েকজনকে বাড়িতে রাখতে চাইছে। আমার স্টুডিও থেকে খুব কাছে। তাই আরকি।”
 “বুঝতে পেরেছি। ব্যাচেলার জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছো তোমরা তাই তো।”
 “হ্যাঁ তেমনটাই।”

মাসুদ উদ্দিন কিছু সময় ভেবে বললেন,
 “ঠিক আছে। কবে যাচ্ছো?”
 “সামনের মাসের এক তারিখ।”
 “আজ কত তারিখ?”
 “আঙ্কেল বিশ।”
 “আর দশ দিন আছো?”
 “জি।”
 “ঠিক আছে।”

মাসুদ উদ্দিনের চোখ ভিজে এলো। আরহান বলল,
 “আপনাদের কথা খুব মনে পড়বে স্যার।”

মাসুদ উদ্দিন তার চোখ মুছে জানালেন,
 “আমাদেরও।”

আরহান উঠে দাঁড়াল। রাহেলা তখন চা বিস্কুট নিয়ে কেবল এসেছে। আরহান বলল,
 “আজ খেতে ইচ্ছে করছে না, অন্যদিন খাব।”

চলে গেল আরহান। অন্যদিকে দূরে দাঁড়ানো ফাবিহার সবটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। তার জন্যই আরহান চলে যেতে চাইছে। অতিথি নিবাস ছাড়তে চাইছে। ফাবিহা হঠাৎই আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চলে গেল বাহিরের দিকে।

••••••••••••

মায়াকুঞ্জের সিঁড়ি পেরিয়ে কেবল মাত্র হেঁটে যাচ্ছিল আরহান। সেই মুহূর্তে তাকে ডাকল ফাবিহা। বলল,
 “দাঁড়ান আরহান।”

আরহান দাঁড়িয়ে পড়ল। ফাবিহা এগিয়ে এসে বলল, 
 “আপনি আমার জন্যই বাড়িটা ছাড়ছেন তাই না?”
 “না। আপনার জন্য কেন ছাড়তে যাব?”
 “মিথ্যে বলবেন না।”
 “এটাই সত্য।”
 “আমি তো আপনায় জ্বালাতন করছি না তবুও এমন কেন করছেন?”
 “বিষয়টা তেমন নয়।”
 “তাহলে কেমন বুঝিয়ে বলুন?”
 “আমি তো শিক্ষক নই যে বুঝিয়ে বলব।”
 “কথা ঘুরাবেন না।”
 “আমার অস্বস্তি হয়।”
 “আমি তো আপনার সামনে যাই না।”
 “তবুও আমার খারাপ লাগে।”
 “আপনি খুব খারাপ আরহান।”

কথাটা শুনে কেমন ঠেঁকল আরহানের। এই কথাটা এর আগেও শুনেছে সে। স্টুডিওতে কেউ একজন কল করে এই কথাটা বলেছিল তাকে। তবে কি সেই মানুষটা ফাবিহা ছিল। ফাবিহার শক্ত মন আচমকা ভেঙে গেল। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আরহান এমনটা কেন করল তার সাথে। আরহান বলল,
 “আপনি কাঁদবেন না প্লিজ।”
 “এমনটা কেন করলেন আপনি?”
 “কতকাল আর ব্যাচেলার জীবনে থাকব বলুন।”
 “আমাকে কি সত্যিই ভালোবাসা যায় না আরহান?”

অসহায়ত্বের কণ্ঠ ফাবিহার। তার বুক ব্যাথা করছে, এত কষ্ট হচ্ছে যা বোঝানো যাচ্ছে না। আরহানের সাবলীল উত্তর,
 “আপনায় তো বলেছি ভালোবাসার জন্য একটা মানুষের মধ্যে বিশেষ গুন থাকার প্রয়োজন যেটা আমার নেই।”
 “অদ্ভুত কথা বলবেন না।”
 “আপনি বাড়ি যান। আপনি আমার চেয়েও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন।”

আরহান আর কথা বাড়াল না। চলে গেল অতিথি নিবাসের দিকে। ঘুরেও তাকাল না সে। আর ফাবিহা দিকবেদিক হারিয়ে ছুটে গেল নিজের ঘরে।

•••••••••••

“তোকে ফাবিহা ভালোবাসে আরহান?”

ঘরের ভিতর ঢুকতে না ঢুকতেই তৌহিদের এমন প্রশ্নে থমকে গেল আরহান। কিছু বলবে তার আগেই তৌহিদ বলল, “অবশ্যই বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলবি না যেমনটা মাসুদ আঙ্কেলকে বলে এসেছিস।”

এবার যেন আরো চমকে উঠল আরহান। এসব কথা তৌহিদ জানল কি করে! আরহান বিস্ময়কর চাহনি নিয়ে তাকায় তৌহিদের দিকে। তৌহিদ বলে,
 “কি করে জানলাম সেটা পড়ে বলছি, আগে বল ফাবিহার জন্যই তাহলে বাড়ি ছাড়তে চাচ্ছিস?”
 
মাথা নাড়াল আরহান। যার অর্থ, “হ্যাঁ।”
তৌহিদ কিছু সময় চুপ করে রইল। আরহান সরে যেতে লাগল। আচমকাই প্রশ্ন করল তৌহিদ,
 “তুইও ফাবিহাকে ভালোবাসিস তাই না?”

আরহানের পা থেমে গেল। তবে উত্তর দিল না। তৌহিদ এগিয়ে এলো। আরহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। তৌহিদ বলল, “উত্তর দে বাসিস ভালো?”

আরহান উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করেই রয়। তৌহিদ বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে আওড়ায়,
 “কথা বল আরহান?”

এবার আরহান তাকায় তৌহিদের দিকে। তার চোখ বিষণ্ণ। চোখের পাতায় অশ্রু। তৌহিদ থমকে যায়। বোধহয় বুঝতে পারে। বলে,
 “ভালো যখন বাসিস তাহলে ফিরিয়ে দিলি কেন?”

আরহানের নিষ্পলক চাহনি। থমথমে কণ্ঠস্বর। সে শুধায়, “ভেবেছিলাম নিজেকে সামলে নিতে পারব। পরে দেখি ভিতরটা ছারখার হয়ে যায়।” 
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp