"তুই এই ছেলেকে কেন বিয়ে করতে যাচ্ছিস? তুই সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট মেয়ে। তুই আরও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করিস।"
শায়লা ওর সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর মুখে এমন কথা শুনে খুবই হতাশ হলো। দুদিন আগেই ছেলেপক্ষ এসে ওকে দেখে গেছে। শায়লাকে যখন বাড়ি থেকে জিজ্ঞেস করেছে ছেলেকে ওর পছন্দ কিনা? শায়লা বিনাবাক্যে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছে, তোমরা যা ভালো মনে করো।
বাড়ি থেকে মোটামুটি সবাই রাজি। আজকেই প্রথম ওরা আলাদাভাবে দেখা করতে এসেছে। সঙ্গে এসেছে শ্রাবণী। যার সঙ্গে শায়লার দশ বছরের বন্ধুত্ব। এই বান্ধবী কোনো কোরবানীর ঈদে ওকে ছাড়া এক টুকরো মাংস খায় না। আগে শায়লার বাসায় গোশত নিয়ে হাজির হবে, শায়লার মা মজা করে গোশত রাঁধবেন, তারপর সে খাবে। শ্রাবণী ওর জীবন মরণের বন্ধু। সে যখন এভাবে না করেছে, তখন নিশ্চয়ই তা যৌক্তিক। ওর জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব যে মানুষটার সে হচ্ছে শ্রাবণী।
শায়লা খুব ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরলো। কিন্তু মাকে কিভাবে জানাবে সে কথাটা। সে নিজেই বিয়ের সিদ্ধান্তটা বাড়ির ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এখন কোন মুখে সেখানে নেগেটিভ কথা বলবে! শায়লা ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না।
মোবাইলে টুং করে মেসেজ এলো, "পৌঁছেছেন?"
ছেলেটা মেসেজ দিয়েছে। শায়লা সিন অবধি করলো না। কয়েক মিনিটের মাথায় কল এলো। শায়লা চিন্তিত মুখে ঘরময় পায়চারি করছে।
কল রিসিভ করে বললো, হুম শ্রাবণী বল।
"তুই বাসায় জানিয়েছিস?"
"কি জানাবো?"
"পাত্রকে তোর পছন্দ হয়নি সেটা?"
শায়লা চুপ করে রইলো। শ্রাবণী বললো, "তুই সরাসরি বল সামনাসামনি কথা বলে ছেলেটাকে ভালো লাগেনি। বিয়ের আলাপ এখানেই সমাপ্ত করতে বল। হয়তো দু একদিন সবাই রেগে থাকবে। সারাজীবন আনহ্যাপি থাকার চাইতেও এটা ভালো।"
শায়লা কয়েক সেকেণ্ড চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, "তুই কি শিওর?"
"দ্যাখ আমার যা মনে হয়েছে আমি বলেছি। এখন ডিসিশন তোর।"
"এভাবে বললে তো আর ডিসিশন নেয়া যায় না।"
"তাহলে কি ডিসিশন আমিই নিয়ে দিবো? সেটা তো দিলামই। তুইই তো মানতে পারছিস না। আচ্ছা বল তো ওই ছেলেকে তোর কি দেখে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে?"
শায়লা চুপ করে রইলো। শ্রাবণী আবারও প্রশ্ন করাতে শায়লা বললো, "কিছু দেখে তো কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করবে না। ছেলের সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানিও না। ফ্যামিলি থেকে দেখেছে। সবাই যখন রাজি, আমিও আর অমত করিনি। আমি মত দিলে সবাই খুশি হবে তাই..."
"সবাইকে খুশি করতে গিয়ে নিজে অখুশি হওয়ার তো কারণ দেখি না।"
"আমি অখুশি না। ছেলেটাকে ভালোই তো মনে হচ্ছে। একটু ব্যাকডেটেড। এখনকার ছেলেদের মতো প্লেবয় টাইপের না। এটাই তো ভালো। কম কথা বলে। ঠাণ্ডা মেজাজের। এরকম লোকেরা স্বামী হিসেবে ভালো হয়।"
শ্রাবণী চেঁচিয়ে উঠলো, "ব্যস এতটুকুই? তোর মতো স্মার্ট একটা মেয়ে এতটুকু কোয়ালিফিকেশন দেখেই ফিদা হয়ে গেলো? ঠাণ্ডা মেজাজ ধুয়ে কি পানি খাবি? চেহারা সুন্দর হলে একটা ব্যাপার ছিলো। তোর জন্য লাগবে একদম সবকিছুতে পারফেক্ট একটা ছেলে। যার চেহারা হ্যান্ডসাম, ক্যারিয়ারে অনেক বেটার, প্রচুর ইন্টেলিজেন্ট টাইপের ছেলে। তাহলে তোর পারসোনালিটির সঙ্গে যাবে। তুই একটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, যেকোনো ছেলের ক্রাশ। তোর জন্য এই ছেলেকে কিভাবে আমি মেনে নিবো?"
শায়লা চুপ করে রইলো। শ্রাবণী রেগে গেছে। ওকে রাগাতে চায় নি শায়লা। তাই একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো, "আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।"
"তোর যা মন চায় তুই কর ভাই।"
শ্রাবণী কল কেটে দিলো। আবার ঠিকই একটা মেসেজ দিলো মেসেঞ্জারে, "দেশে কি ছেলের আকাল পড়ছে? পাত্র লাগলে আমি খুঁজে দিবো।"
শায়লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে রইলো। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। শ্রাবণীর একটু মেজাজটা কড়া তবে ও সবসময় শায়লার ভালো চায়। কিন্তু তাই বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে গেলে তো পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে হবে। যেটা এইমুহুর্তে একেবারেই করতে ইচ্ছে করছে না।
কয়েক মাস আগেই আড়াই বছরের সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে শায়লার প্রাক্তন প্রেমিক অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। শায়লা তারপর থেকে খুবই মনোঃকষ্টে ছিলো। পরিবারের দেখা অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব সে ভেঙে দিয়েছে অতীতে। শুধুমাত্র তার প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধবে বলে। কিন্তু সেই ছেলেটাই "ফ্যামিলি মানবে না" বলে ব্রেকআপ করে দিয়ে হুট করে বিয়ে করে ফেললো। তারপর থেকে বিয়ে, সংসার এসব নিয়ে একেবারেই ভাবতে ইচ্ছে করে না শায়লার। কিন্তু বয়স হচ্ছে, পরিবার তো এভাবে বসে থাকবে না। তারা নিজেদের পছন্দমতো পাত্র ঠিক করেছে। পাত্র'র সঙ্গে কথা বলার আগেই শায়লা বাড়িতে বলেছে, "তোমরা যা ভালো মনে করো।" এইমুহুর্তে আরেকবার বিয়ে ভেঙে দিলে বাবা মা হয়তো খুবই রেগে যাবেন। এরপর ওনারা আর বিয়ের সম্বন্ধই আনবেন না। পুরনো প্রেমিকের অপরাধ ঘিরে সকাল সন্ধ্যা কথাও শোনাবেন। এতকিছুর ঝামেলায় কার পড়তে ইচ্ছে করে? তাছাড়া নিজেরও তো গাঁটছড়া বাঁধতে হবে।
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলেন শায়লার মা। জিজ্ঞেস করলেন, "পাত্রকে তোর কেমন লাগলো রে মা?"
শায়লা চমকে উঠলো। পছন্দ হয়নি বলা সম্ভব নয়। তাহলে! কী বলবে সে?
••••••••••••
"পাত্রকে তোর কেমন লাগলো রে মা?"
শায়লা চমকে উঠলো। পছন্দ হয়নি বলা সম্ভব নয়। তাহলে! কী বলবে সে?
শুকনো মুখে শুধু উত্তর দিলো, "ভালোই।"
"কথা বার্তা কেমন ছেলেটার? ফোন টোন দেয়?"
"মা, আমি এখন একটু ঘুমাবো। মাথা ধরেছে।"
"ঠিক আছে ঘুমা। ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতেছি। এখনও খারাপ কোনো রিপোর্ট পাই নাই। ভালোই বলতেছে সবাই।"
শায়লা আর কথা বাড়ালো না। গায়ের ওপর কাঁথা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো। ভীষণ দোলাচলের মাঝেই পাত্রের একটা মেসেজে ওর চোখ আটকে গেলো।
"আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি তাইনা?"
শায়লা কি রিপ্লাই করবে ভেবে পেলো না। ছেলেটা আবারও লিখলো, "আমি জানি পছন্দ হয়নি। ঠিক আছে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ এগোতে নিষেধ করে দিচ্ছি। আপনাকে আর এ নিয়ে ভাবতে হবে না। ভালো থাকবেন।"
শায়লা হতবাক হয়ে রইলো। এ বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা হলো না। দুদিন পরে মা হতাশ কণ্ঠে জানালেন, "বিয়ের আলাপটা আর এগোয় নি। পাত্রপক্ষ পিছু হটেছে।"
শায়লা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এমনটাই চেয়েছিলো ও। সে আবেগময় একটা টেক্সট পাঠালো শ্রাবণীকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা করতে এলো শ্রাবণী। আবারও আগের মতো সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
বেশ কিছুদিন পর শ্রাবণী একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো শায়লার জন্য। ছেলেটা দেখতে সুন্দর, ক্যারিয়ার অনেক গোছানো। প্রথমবার দেখেই শায়লার পছন্দ হয়ে গেলো। ছেলেটাও বেশ পজিটিভ আচরণ করলো শায়লার প্রতি।
দিন কয়েক পর ছেলেটার সঙ্গে টুকিটাকি কথাবার্তা শুরু হলো। মেসেজ আদানপ্রদান, মাঝেমাঝে দু একবার দেখা করা। শায়লা খেয়াল করলো ছেলেটা জামাকাপড়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন। তবে এটাকে সচেতন না বলে খুঁতখুঁতে বলাই শ্রেয়।
শায়লার যেকোনো পোশাক দেখে সরাসরি বলবে, এরকম ড্রেস তোমাকে মানায় না। তুমি এই ধরনের ড্রেস পরবে না। ওরকম পরো।
শায়লা বিরক্ত বোধ করলো। তবে মুখে তা প্রকাশ করলো না। কিন্তু ধীরেধীরে আরও অনেক কিছুর বিষয়েই ছেলেটার এমন আচরণ প্রকাশ পেতে লাগলো। কখনো জামাকাপড়, কখনও ফ্যাশন সেন্স, কখনো মেকআপ। সবকিছু নিয়েই ওনার সমস্যা। শায়লার একসময় মনে হলো, ওনাকে বিয়ে করলে সবসময় ওনার কথামতো চলতে হবে। তার নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না।
ভেতরে ভেতরে শায়লা খুবই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণী শায়লার মাকেও জানিয়েছে ছেলেটার ব্যাপারে। মা বলেছেন ওনার বাসা থেকে প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু শায়লার মনে হচ্ছে এই ছেলের সঙ্গে সে সুখী হতে পারবে না। ছেলেটা সবসময় মানসিক চাপের ওপর রাখে, ছোটখাটো অপমান করে। মন থেকে ওনার জন্য অনুভূতি আসছে না।
কয়েকদিন আগেই একটা বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেলো। বাবা মা অনেকটা হতাশ। এরমধ্যে শায়লা কীভাবে এই বিয়েটাও ভেঙে দেবে! নিজের ভেতর আবারও এক কঠিন দোলাচল..
••••••••••••
এবার ছেলে পক্ষের বাড়ি থেকে যেদিন দেখতে আসবে শায়লাকে, সেদিন শায়লার ভেতর প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলতে লাগলো। ছেলেটাকে ওর ঠিক মন মত লাগছে না। এই ছেলেকে বিয়ে করতে ওর মন সায় দিচ্ছে না।
বিকেল ঘনিয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণ পরেই পাত্রপক্ষ চলে আসবে। শায়লা অস্থিরভাবে এদিক সেদিক পায়চারি করছে। যেহেতু ছেলে আর মেয়ে আগে থেকেই একে অপরকে পছন্দ করে রেখেছে তার মানে আজকে ফ্যামিলি থেকে সোজা বিয়ের দিন তারিখ পাকা করে ফেলবে। কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিয়ে সে সাহস সঞ্চার করল। শ্রাবণী চলে এসেছে ওদের বাসায়। শায়লা ওর হাত টেনে এনে বলল , একটা কথা বলব কিছু মনে করবি না। আশা করি তুই আমাকে বুঝবি।
- কি সমস্যা?
- আমার মন চাচ্ছে না এই ছেলেকে বিয়ে করতে।
- মানে? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আজকে একটু পরে বাসায় ওদের বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। সব ঠিক থাকলে হয়তো আজকেই বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে। আর তুই এখন বলছিস তোর মন চাচ্ছে না?
শায়লা কী বলবে ভেবে পেলো না। খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে বললো, দ্যাট এর আগের বেলায় কিন্তু পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করে গিয়েছিল। শুধুমাত্র তোর কথায় বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছি। আর এখন তুই আমাকে হেল্প করবি না?
- এই ছেলেটাকে তো আমি ঠিক করে দিয়েছি তাই না? ওয়েট, তুই কি আমার উপর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছিস?
- শ্রাবণী এত দিনে তুই আমাকে এই চিনলি?
- তাহলে তুই কেন এরকম করছিস? ভালো না লাগলে এতদূর অব্দি এগোতে দিয়েছিস কেন?
- আমি তো বুঝিনি আগে। ছেলেটা সবসময় আমার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করে। আমার পারসোনালিটি বলে কিছু থাকবে না ওকে বিয়ে করলে। তুই প্লিজ যেভাবে পারিস আমার বিয়েটা ভেঙে দে।
- সিরিয়াসলি? ওরা তোর জন্য আংটি বানিয়েছে।
- সমস্যা কি? আংটি পরিয়ে তো আর দেয় নি। তাছাড়া কত মেয়েরই তো বিয়ের লগ্নে এসে বিয়ে ভাঙে।
- কিসের সঙ্গে কি মেলাচ্ছিস? আমার মনে হচ্ছে তুই ইচ্ছে করেই আমার সঙ্গে এরকম রিভেঞ্জ নিলি। যদি তাই হয় তাহলে বলব কাজটা ভালো হলো না।
শ্রাবণী আর কোন কিছু শোনার চেষ্টা করল না। হনহন করে বের হয়ে গেল বাসা থেকে। কিছুক্ষণ পর কল এলো ছেলেটার। রিসিভ করতেই শোনা গেল রাগত কণ্ঠস্বর, এভাবে অপমান করার কি মানে হয় শায়লা? নিজেকে তুমি কি মনে করো? আমি বাড়িতে মুখ দেখাবো কি করে?
- আমি তো আপনার প্রেমিকা নই। আমাদের মাত্র অল্প দিনের পরিচয়। আপনি ফ্যামিলিকে বলুন আমাকে বিয়ে করতে চান না।
- শাট আপ। পাগল ছাগল কোথাকার। মানুষের লাইফ থেকে মূল্যবান সময়গুলো খালি নষ্ট করো তোমরা। খেলা পাইছো না এগুলারে?
শায়লা মুখ বুঝে অপমান গুলো সহ্য করল। সারা জীবন ধরে অপমানিত হওয়ার চেয়ে আজকেই শেষবারের মতো কয়েকটা কথা শোনাও ভালো।
শ্রাবণী পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আর বাড়িতেও কেউ ভালো করে কথা বলছে না। সবাই মিলে যেন একঘরে করে দিয়েছে শায়লাকে। তবে এতে শায়লার মনে কোন কষ্ট নেই। যে শ্রাবণের কথায় নিজের পরিবারের পছন্দ করা ছেলেটাকে সে বিয়ে করতে চায়নি, সেই শ্রাবণী কিনা তাকে ভুল বুঝল! শায়লার মোটেও ইচ্ছে করছে না শ্রাবনীর ভুল ভাঙাতে।
কয়েকটা দিন ভীষণ একাকিত্ব নিয়ে কাটার পর একদিন শায়লা একটা কান্ড করে বসলো। মেসেঞ্জারে ঢুকতেই দেখল আগের পাত্রটির নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে। যে ছেলেটাকে শ্রাবণীর কথায় বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ছেলেটা নিজে থেকেই মেসেজ দিয়ে বলেছিল আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি তাই না?
শায়লা ইনবক্সে ঢুকে ওই মেসেজটা রিপ্লাই করল, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। একটা ঝামেলার কারণে তখন আমি ওরকম আচরণ করেছিলাম।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটা রিপ্লাই করল, তাই বলে এতদিন পর! আমি আরো ভাবলাম আপনার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে। যাই হোক আমাকে পছন্দ হয়েছে শুনে খুশি হলাম। ভেবেছিলাম সত্যিই আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি। সেদিন আমার মেসেজের পর আপনি কোন রেসপন্স করেননি। তাই আমি পরিবারের কাছে আপত্তি জানিয়েছিলাম।
একটু একটু করে মেসেজ বাড়তে থাকে। চলতে থাকে কথা। কথা বলতে বলতে এক সময় শায়লার মনে হলো, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সবাই তাকে পর করে দিয়েছে। কাছের বন্ধু কিংবা আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে সে একটা বোঝা। কেউ তার কথা শুনতে চায় না। কেবলমাত্র এই মানুষটাই ওর কথা মন দিয়ে শোনে। এবং কথার বিপরীতে খুব সুন্দর কথা বলে ওকে সান্ত্বনা দেয়। এমন যান্ত্রিক পৃথিবীতে কেউ একজন তাকে বোঝার চেষ্টা করছে এটাই বা কম কিসে!
এভাবেই কথা চলতে চলতে একদিন লোকটা ফুল নিয়ে এলো। শায়লার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল চলুন আমরা বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু লজ্জায় সেটা বলতে পারল না। তাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি নিজেই বলল, আমি কি বাড়িতে বলব আমাদের বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে আবারও কথা বলার জন্য?
শায়লার ভীষণ আনন্দ হলো। এই প্রথম মনে হলো সে বোধহয় খুব দামি কিছু পেয়ে গেছে। খুশিতেও অপ্রকাশ্য রেখেই ছেলেটার হাত চেপে ধরে সে বলল, আপনি আমাকে কখনো ভুল বুঝবেন না। প্লিজ।
- বুঝবো না। বুঝলেও ভুলটা ভাঙিয়ে দিবেন। আপনি যা বলবেন আমি তাই বিশ্বাস করব। কথা দিচ্ছি। আপনি শুধু আমার বিশ্বাসটা রাখবেন।
এক ভরা পূর্ণিমার রাতে বেশ আয়োজন করেই বিয়ে হয়ে গেল শায়লার। তবে শ্রাবণী যখন জানতে পেরেছে আগের ছেলেটার সঙ্গেই শায়লার বিয়ে হচ্ছে, প্রচন্ড রাগ করেছে সে। শ্রাবণী এই বিয়েতে আসেনি। শায়লা তাঁকে সরি জানিয়ে টেক্সট পাঠালে সে বললো, তোর আসলে এই ছেলেকেই পছন্দ ছিল। আমি বাঁধ সেধেছিলাম সেজন্য তুই আমার সঙ্গে এভাবে প্রতিশোধ নিলি?
শায়লা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বোধহয় সারা জীবনের জন্য ফাটল ধরে গেল!
তার কিছুদিন পরেই শ্রাবণী সেই ছেলেটাকে বিয়ে করলো রিজেক্ট করে দিয়েছে। শায়লার খুব দুঃখ হতে লাগল শ্রাবনের জন্য। কারণ ছেলেটা সুবিধার নয়। সব সময় ওর কথা মতোই চলতে হবে। বোধহয় ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেও ওর পারমিশন নিয়ে যেতে হবে। বেশি আপডেট খুঁজতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলো না তো!
শায়লা নিজের সংসার বেশ ভালই গুছিয়ে নিয়েছে। ওর বর ওকে অসম্ভব ভালোবাসে। মানুষটা একটু ব্যাকডেটেড হলেও প্রতিদিন বাসায় ফেরার সময় ওর জন্য ফুল নিয়ে আসে। খুব একটা মেসেজ আদান-প্রদান হয় না সত্যি তবে কাজের ফাঁকে লোকটা যখন কল দেয় তখন তার কন্ঠ শুনেই শায়লার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। কারণ ওনার কন্ঠস্বরই বলে দেয় উনি শায়লাকে কতটা মিস করছে।
বিয়ের চার মাসের মাথায় একদিন শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা। শায়লা কে দেখেই আবেগ আপ্লুত হয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল শ্রাবণী। শায়লা বেশ অবাক হয়ে গেল। শ্রাবণী এরকম মেয়ে নয় যে দেখা হলে কেঁদে ফেলবে। শ্রাবণীকে এত বছরে সে কোনদিন কান্না করতে দেখেনি।
কথা বলতে বলতে জানা গেল শ্রাবণী এই সংসারে মোটেও সুখী নয়। শায়লা ই সঠিক ছিলো। প্রত্যেকদিন সকাল-সন্ধ্যা দুজনের ঝগড়া হয়। ছেলেটা এত বেশি খুঁতখুঁতে যে ছোটখাটো সব বিষয়েই ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। কথায় কথায় অপমান করে। সহ্য করতে না পেরে শ্রাবণী বেশ কিছুদিন যাবত আলাদা থাকছে। আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও শ্রাবণীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা না করে যোগাযোগ হলেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, অপমান করে কথা শোনায়। শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে শায়লার হাত ধরে বলল, এভাবে কতদিন আমাদের ঘরটা টিকবে আমি জানিনা। সম্ভবত বিচ্ছেদ হয়ে যাবে।
শায়লা শ্রাবণীকে চেপে ধরে রইল। জেদের বসে শ্রাবণী বিয়েটা করেছিল সত্যি। তখনই শায়লার মনে হয়েছিল এই ছেলের সঙ্গে শ্রাবণী ভালো থাকবে না। মানুষ সব সময় কেন আপডেটেড খুঁজতে যায়? বেশি আধুনিক আর ফ্যাশনেবল মানুষ খুঁজতে গিয়ে ভেতরের আর দায়িত্বশীল মানুষটাকেই কি আমরা কম প্রাধান্য দিয়ে ফেলি? ভাগ্যিস শায়লা ভেতরের সত্তাটাকে খুঁজেছিলো। তাই তো সাধাসিধা মানুষটার সঙ্গে প্রত্যেকটা দিন ওর নিজেকে বড্ড সুখী মনে হয়!
.
.
.
সমাপ্ত.....................................................................