আমাদের প্রায় প্রতিদিন রাতেই কথা হতে লাগল। দুই মাসে কমলের সাথে যত কথা হয়েছে, ৫ মাসেও আদনানের সাথে তা হয়নি। জীবনে কখনো কোনো ছেলের সাথেই এত কথা বলা হয়নি আসলে আমার।
একদিন কমল আমাকে জিজ্ঞেস করল,
"আচ্ছা তিন্নি বলো তো আমাদের প্রথম দেখার দিন কেন আমি অত তাড়াতাড়ি চলে গেলাম?"
আমি নির্বিকারভাবে বললাম,
"ব্যস্ত ছিলে সম্ভবত। এমনটাই বলেছিলে।"
"ব্যস্ততার কথা বলেছি। কিন্তু অতটাও ব্যস্ত ছিলাম না আসলে। প্রধান কারণ ছিল ভিন্ন।"
"কী কারণ?"
"আমার মনে হয়েছিল, আমার তো তোমাকে পছন্দ হয়েছে কিন্তু যদি তোমার আমাকে পছন্দ না হয় তবে আজকের বলা কথাগুলো বৃথা যাবে। খারাপও লাগতে পারে। তাই যতটা কম জেনে যাওয়া যায় ততই ভালো। তাই কথাবার্তা শুরু করার আগে জানতে চাচ্ছিলাম আমাকে তোমার কেমন লাগলো।"
আমি হেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার এই ভাবনাটাই মানুষ কমলের জন্য আমার প্রথমবার ভালো লাগা সৃষ্টি করলো। কিছু দিন আগে কমলের বাসার সবাই আমাদের বাসায় এসেছিল। ঘরোয়া ভাবে আংটি বদল হয়েছে। বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে মাস তিনেক পরে আমার সেমিস্টার ব্রেকের সময়। দুই ফ্যামিলির এত সুন্দর মিল হয়েছে দেখে মনে হয় কত বছরের যেন চেনা। কমলের জন্য আমারও একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে, এটাকে অবশ্যই ভালোবাসা বলা চলে না। এতদিন তার সাথে মিশে মনে হয়েছে, সে আমার ভালোলাগা, নির্ভ রতা, স্বস্তি এবং নিরাপত্তার জায়গা। আমি নতুন একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলেছি ভিন্ন নামে। আমার কোনো ছবিও পোস্ট করিনি। সেই একাউন্টটার প্রথম ব্যবহার ছিল আদনানের প্রোফাইল সার্চ করা। প্রতিদিন আদনানের প্রোফাইলে ঢুকে ওর ছবি দেখতাম। পাবলিক পোস্টগুলো হাজারবার করে পড়তাম। তারপর আবার নিজেকে বেহায়া উপাধি দিয়ে নিজের উপরেই বিরক্ত হতাম। কিন্তু আংটিবদলের কয়েক দিন আগে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটলো। আমি আর কমল মালিবাগ থেকে সুদুর মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের বাজার গেলাম গরুর চাপ খেতে। ওখানকার গরুর চাপ, মগজ ফ্রাই খুবই বিখ্যাত এবং আমার পছন্দের। এখানে বসার ব্যবস্থা শুধু খারাপ নয় বরং জঘণ্য। প্রতিটি দোকানের সামনে রাস্তায়ও বসার ব্যবস্থা আছে। তবে ধুলোবালির কারণে আমরা একটা দোকানের ভেতরেই বসেছি। ভেতরটা লোকজনে ঠাসা। দুজনে পাশাপাশি বসেছি একটা টেবিলের একপাশে। অন্যপাশে অন্য লোকজন বসেছে। আমার পাশে আরেকটা টেবিল। সেই টেবিলেও লোকজন আছে। ওই টেবিল আর এই টেবিলও একসাথে লাগানো। প্রাইভেসির বালাই নেই। আমার অন্যপাশে কমল। সিলিং ফ্যান ঘটর ঘটর শব্দ করছে। আমি বললাম, ফ্যানটা খুলে পড়ে যাবে না তো আবার?
আমার কথায় কমল হেসে বলল,
"হ্যাঁ ভূতে এসে তো ফ্যান আলগা করে রেখে গেছে। আজ তিন্নি আসলেই তার গায়ের উপর পড়তে বলে গেছে।"
আমি ওকে একটা ভেংচি দিলাম। আমাদের খাবার এসে গেল। স্যুপ, বিফ চাপ, চিকেন চাপ এবং ব্রেইন ফ্রাই। ব্রেইন ফ্রাইটা অসাধারণ কিন্তু পরিমাণে খুবই কম দেয়। আমি একটা খেয়ে আরেকটা অর্ডার করলাম। কমল একটা ইন্টারেস্টিং কেসের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলছে। আমি স্যুপ খেতে খেতে ওর কথা শুনছি। এর মাঝে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা কমল আমার দিকে ফিরে দুহাতে বেড়ি দিয়ে আমাকে ঢেকে ফেলল। সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়েছে আমাদের টেবিলের উপর। চলন্ত পাখাটা কমলের পিঠে লেগে বাহু পর্যন্ত এসে থেমে গেল। কমলের পিঠ থেকে হাত পর্যন্ত কেটে গেল। যদি সে নিজেকে দিয়ে আমাকে আড়াল না করত তাহলে আমার পেট সোজা কেটে যেত। ছোট্ট দোকানটার মধ্যে হুলুস্থুল কান্ড ঘটে গেল। কমলের শার্ট খানা রক্তে ভিজে গেছে।
আমি আচমকা চিৎকার করে বললাম ,
"এই অবস্থা কেন আপনাদের ফ্যানের? লোকজনকে মেরে ফেলবেন না কি?"
আমার কথায় অবশ্য কেউ প্রতিবাদ করলো না। আমি দ্রুত কমলকে নিয়ে বের হচ্ছিলাম। ওকে এক্ষুণি হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন।
কমল বলল,
"দাঁড়াও তিন্নি। বিলটা দিয়ে নেই।"
আমি রেগে গেলাম,
"তুমি এখনো বিলের কথা ভাবছো!"
কমল হাসলো শুধু। তারা বিল নিতে চাইছিল না যেহেতু আমরা খেতেই পারিনি তার উপর এমন একটা এক্সিডেন্ট। কমল জোর করে দিল। এরপর আমি তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেলাই টেলাই লাগেনি অবশ্য। ইমার্জে ন্সিতে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিল। সাধারণত প্রতিবার দেখা হওয়ার পর সে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। এই প্রথম আমি তাকে বাসায় পৌঁছে দিলাম। বাসায় ফিরে আমি কারো সাথে কোনো কথা বলিনি। ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ বসে ছিলাম। আমার ভাবনায় বিরাট একটা তোলপাড় শুরু হলো সেদিন। কে আমি কমলের? হবু স্ত্রী কিন্তু স্ত্রী তো নই। প্রেমিকাও নই। অথচ নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে আমাকে সম্পূর্ণ অক্ষত রাখলো। আর যাই হোক, এই মানুষটার সাথে নিশ্চিন্তে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। এই ঘটনা আমার মনকে স্থির করে দিল। বিবাহিত একজন মানুষকে একতরফা ভাবে ভালোবাসার জন্য আমি এই মানুষটার সাথে অন্যায় করতে পারি না যার সাথে পুরো জীবনটা জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে ঢুকলাম। আদনানের আইডিতে ঢুকে তাকে ব্লক করলাম। যাতে মন চাইলেও আর তার প্রোফাইলে যেতে না পারি। অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? সেদিনের পর থেকে তার প্রোফাইলে যেতে আমার মনও চায়নি আর। আমি কমলকে ভালোবাসি না। কমলও হয়তো আমাকে ভালোবাসে না। কিন্তু আমরা দুজনেই দুজনকে পছন্দ করি। খুব পছন্দ করি। মুরুব্বিরা বলে বিয়ের নাকি এক ঐশরিক ক্ষমতা থাকে, যার বলে অচেনা দুজন মানুষের মধ্যেও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাহলে এত ডিভোর্স কীভাবে হচ্ছে এসব প্রশ্ন করিনি তাদের। বরং সেই ঐশরিক ক্ষমতার প্রভাবের অপেক্ষায় আছি।
.
.
.
চলবে.............................................