রাত্রিটা নির্ঘুম। গায়ে জড়ানো কালো চাদরটা ভেদ করে শরীরে বাতাস ঢুকল। মোহনা খানিকটা কেঁপে কেঁপে উঠল তাতে। চায়ের কাপে আবারও চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“হঠাৎ বিয়ে?”
“ভালো একটা ছেলে পেয়েছি তাই আর কি!”
“আপার বিয়ে দিয়েছ বছরও তো গেল না বাবা। অবশ্য বছর তো রাখো ছয়মাসই তো হলো না এর মধ্যে আমার বিয়ে দিতে চাইছ।”
“বিষয়টা তেমন না। ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ। বিয়ে দিব বলতে সরা-কাবিন করে রাখব তোর পড়াশোনা শেষ হলে উঠিয়ে দিব।”
“খুব বেশি তাড়াহুড়ো হচ্ছে না?”
“তোর কি কোনো পছন্দ আছে?”
পুরনো ঘায়ে খানিকটা হলেও জ্বালা পোড়া হলো মোহনার। চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“না বাবা তেমন কেউ নেই।”
“তাহলে সমস্যা কোথায়?”
মোহনা চুপ করে রইল। উত্তর দিল না। চায়ের কাপ খালি হলো। মোহনার বাবা এগিয়ে গিয়ে চায়ের দাম মিটালেন। সঙ্গে একটা ললিপপ কিনে মোহনার হাতে দিলেন। মোহনাও নিল। তার ললিপপ খুব পছন্দ। বিশেষ করে হাঁটতে হাঁটতে খেতে। চায়ের দোকান ছেড়ে মোহনা আর তার বাবা নামল রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে বললেন মোহনার বাবা,
“দেখ মা, মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস তখন বিয়ে করে পরের বাড়ি তো যেতেই হবে। ছেলেটা খুব ভালো। দেখবি তুই খুব সুখে থাকবি।”
মোহনা ললিপপের কাগজটা খুলে মুখে পুড়ল। চাদরটা আর একটু শক্ত করে পিষ্টে ধরল গায়ে। মোহনার বাবা সারারাস্তায় অচেনা সেই ছেলের প্রশংসা করেই গেলেন। আর মোহনা নীরব দর্শকের মতো শুনেই গেল। কোনো কথা বলল না।
•••••••••••••••
সময়ের চাকা কোথা থেকে যে চলে যায়— বোঝা যায় না। দেখতে দেখতে কিভাবে যে নভেম্বর মাসটা পেরিয়ে গেল ধরা গেল না। এখন পৃথিবীতে ডিসেম্বরের শুরু। শীতের তীব্র বাতাস প্রকৃতি ছুয়ে দিচ্ছে। জানান দিচ্ছে তীক্ষ্ণ শীত এসে গেল।
তখন ভোর। কুয়াশায় মোড়ানো সুন্দর প্রকৃতি। অতিথি নিবাসের কোলেও আজ কুয়াশা জন্মেছে। শীতের ছোঁয়ায় শরীরটা খানিকটা কাঁপে। আরহান দাঁড়িয়ে আছে অতিথি নিবাসের ছোট্ট কপাট-টার সামনে। গায়ে জড়ানো ফুলহাতার টিশার্ট। কালো প্যান্ট। চুলগুলো বেশ অগোছালো। আর হাতে চায়ের কাপ। ধোঁয়া উঠছে তাতে। বাড়ির ভিতর তৌহিদ আর শান্ত ঘুমোচ্ছে। তার চোখে ঘুম নেই। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে এখন দাঁড়াল দুয়ারে। সমস্ত বাড়িটাই নিরিবিলি। ওই তো ফাবিহার কক্ষের বারান্দাটা আবছা আবছা দেখা যায়। ছাঁদটাও কেমন শিশিরে ভিজে একাকার। আরহান লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। চায়ের কাপে চুমুক দিল নিমিষেই। নিস্তব্ধ এই শীত সকালে গরম গরম চা'টা বেজায় খারাপ লাগছে না। তবুও মন তো বিষণ্ণ। এই তো আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা এরপরই আরহান, তৌহিদ আর শান্ত পাড়ি দিবে অন্যকোনো গন্তব্যে। অন্যকোনো এলাকায়, অন্যকোনো পরিবেশে। জীবনটা বোধহয় টানা-পোড়াতেই চলে যাবে। কখনো কি সে এক স্থানে থামবে না। যদিও আরহান থামতে চায় না। সে ছুটবে, শুধুই ছুটবে। জীবন মানেই তো ছোটা। সেই শুরু থেকেই ছুটছে। থামাথামি নেই। ছোটার প্রথম শুরুটা ছিল গ্রাম ছাড়া। মায়ের কোল ছাড়া। বাবার ধমক ছাড়া। আজকাল আর বাবা তেমন রাগারাগি করেন না। এই যে এবার গেল— সে কি আপ্যায়ন! বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা আমার, মুরগীর রানটা আমার, পছন্দের সকল খাবার আমার। মায়ের আদর। জিনিসগুলো কত সুন্দর! তবুও মাঝে মাঝে পুরনো আমিকে ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ফেরা আর হয় না। সম্ভবও নয়। আমরা প্রতিদিনই নতুন নতুন রূপে জন্ম নেই। এই যে আজকের আমি, আবার কালকের আমি ভিন্ন। পরশুর আমি আর একটু ব্যতিক্রম। এভাবে মানুষ ধীরে ধীরে বদলায়। কখন যে অনেকটা বদলে যায় টেরও পাওয়া যায় না। দেখা যায় আজ যা ভালো লাগে, কাল তা ভালো লাগে না। সময়ের সাথে সাথে বয়স বাড়ে, পরিস্থিতি পাল্টায়, শারীরিক ঘটন পর্যন্ত বদলায়। জীবন কি অদ্ভুত তাই না।”
“এই ভোর বেলা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ আরহান?”
আকস্মিক কারো কণ্ঠ শুনে নিজের সকল ভাবনা ছেড়ে বের হলো আরহান। সামনে তাকিয়ে দেখল মাসুদ আঙ্কেল দাঁড়িয়ে। আরহান চায়ের কাপ হাতেই এগিয়ে এল। সাবলীল কণ্ঠে জানাল,
“তেমন কিছু না আঙ্কেল। এমনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
“জি। তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমি একটু হাঁটতে বের হলাম। আমার আবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে না পারলে ভালো লাগে না।”
“ওহ আচ্ছা।”
“তা যাবে নাকি হাঁটতে?”
“ইচ্ছে করছে না।”
“ঠিক আছে। থাকো তাহলে,
মাসুদ উদ্দিন চলে গেলেন। আরহান খানিকক্ষণ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চলে গেল ভিতরে। দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করল ফাবিহা। মেয়েটাও যে সারারাত ঘুমায়নি। মাত্রই দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়।
••••••••••••
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল দশটা ছাড়িয়ে। অতঃপর সকল মায়া ত্যাগ করে নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে অতিথি নিবাসের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ, শান্ত আর আরহান। এই তো মাত্র কয়টা মাস এখানে ছিল। এতেই কেমন মায়া ধরে গেল সমস্ত বাড়িটার ওপর। বাড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপর। শান্তর কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্টটা বাড়ি ছাড়ার নয়। কষ্টটা হলো দুটো মানুষ একে অপরকে ভালোবাসার পরও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের গন্ধ চলছে বলে।
মায়াকুঞ্জের কপাটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ উদ্দিন, রিনা বেগম, উর্মি এবং রাহেলা। আহির অফিসে যাওয়ায় থাকতে পারেনি। ফাবিহাও আছে তবে সবার থেকে দূরে দাঁড়ান। শান্ত, তৌহিদ, আরহান তিনজনই একসঙ্গে এগিয়ে আসলো সবার সামনে। অতিথি নিবাসে তালা লাগানো শেষ। আরহানই তালাটা লাগাল। প্রথম দিন খুলেও ছিল সে আর আজ বন্ধটাও করল সে। আরহান সর্বপ্রথম এগিয়ে যায় মাসুদ উদ্দিনের দিকে। অতিথি নিবাসের চাবিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার সম্পদ স্যার। খুব সুন্দর ছিল। কতটুকু যত্নে রাখতে পেরেছি জানা নেই। তবে চেষ্টা করেছি।”
উত্তরে মৃদু হাসলেন মাসুদ উদ্দিন। চাবিটা হাতে নিয়ে আরহানের মাথায় হাত বুলালেন। বললেন,
“সবসময় ভালো থেকো তোমরা।”
আরহানের পর তৌহিদ, শান্ত এগিয়ে গেল। তৌহিদ বলল, “আমাদের দারা যদি কখনো কোনো ভুল হয়ে থাকে তবে আমাদের ক্ষমা করবেন স্যার। আমরা চেষ্টা করেছি যাতে কোনোরূপ ভুল না হয়। তবুও অজান্তে যদি কিছু ঘটে থাকে মাফ করে দিবেন।”
শক্তপোক্ত মাসুদ উদ্দিনের চোখ ভেসে উঠল। ছেলে তিনটে কখন এত আপন হয়ে উঠল বুঝতেই পারলেন না। নিজেকে সংযত করে। দুহাত দিয়ে তৌহিদ আর শান্ত মাথায় হাত বুলালেন। বললেন,
“ভালো থেকো। জীবনে অনেক উন্নতি করো তোমরা।”
শান্ত, তৌহিদ, আরহান এগিয়ে গেল রিনা বেগমের দিকে। তার চোখ দিয়ে ইতিমধ্যে পানি পড়ছে। আরহান খানিকটা হেসে বলল,
“আমরা যখন প্রথম এসেছিলাম আপনি তখন মাসুদ আঙ্কেলের ওপর অনেকটা রেগে ছিলেন তাই না আন্টি।”
রিনা বেগম কথা বলেন না। তৌহিদ বলে,
“আপনার রাগ করা জায়েজ আছে আন্টি। আপনার বাড়িতে দুটো যুবতী মেয়ে আছে। আমরা তিনটে যুবক ছেলে। আমাদের বিশ্বাস করতেও তো সময় লাগবে। আপনার জায়গা আমরা থাকলেও আমাদেরও লাগত। আপনার হাতের রান্না খুব মিস করব আন্টি।”
রিনা বেগম এবার মুখ খুললেন। চোখের অশ্রু মুছে জানালেন, “এতই যখন মিস করবে তাহলে যাচ্ছো কেন?”
প্রতিউত্তরে আরহান জানায়,
“আমরা নিরুপায় আন্টি।”
“এবার তোমরা বিয়ে করো। সুখে শান্তিতে থেকো কেমন!”
উত্তরে লাজুক হাসল সবাই। সবার মাঝে রিনা বেগম বেশি পছন্দ করতেন শান্তকে। তিনি শান্তর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “সবসময় ভালো থেকো বাবা। তোমরাও ভালো থেকো।”
মাথা নাড়াল তিনজনই। তৌহিদ এগিয়ে গেল রাহেলার দিকে। সেও কাঁদে। তৌহিদ ঠাট্টার স্বরে বলল, “দেখলে তো রানু মন্ডল আমরা কিন্তু তোমার ডাইনি আপার দিকে নজর দেইনি।”
রাহেলা কিছু বলল না। শুধু কাঁদল। কিছু সময় পর জানাল, “সবসময় ভালো থাইকেন ভাইজান।”
উত্তরে হাল্কা হেঁসে রাহেলার মাথায় হাত স্পর্শ করল তৌহিদ। অবশেষে উর্মিকেও ভাবি বলে বিদায় জানাল তিন তিনটে সুদর্শন যুবক। যাদেরকে প্রথমদিন রাহেলা তার ফাবিহা আপার জামাই ভেবেছিল। ফাবিহাকেও দূর থেকে বলল তারা,
“ভালো থাকবেন ফাবিহা।”
মৃদু আওয়াজের উত্তর ফাবিহার,
“আপনারাও।”
অতঃপর সকল মায়া, সকল ভিতরকার অনুভূতি, যন্ত্রণা সবটা দমিয়ে রেখেই অতিথি নিবাস, মায়াকুঞ্জ ত্যাগ করল শান্ত, তৌহিদ আর আরহান। বাড়ির বড়গেটটা ভেদ করে সবাই বাহিরে বের হতেই ফাবিহা দৌড়ে ছুটে গেল তার ঘরে। শেষমেশ আরহান পেরেই গেল তাকে ছেড়ে দূর সীমানায় যেতে। বড় নিষ্ঠুর আরহান। বড় নিষ্ঠুর তার মন, তার হৃদয়। নিষ্ঠুর সমস্ত মানুষটাই। কেঁদে উঠল ফাবিহা। মনে মনে বলল, “আপনি খুব খারাপ আরহান। আপনি খুব খারাপ।”
••••••••••••••
বিশাল বড় বাড়ি। বাড়ির বড় নেইম প্লেটে লেখা 'তৌহিদ ম্যানশন'। মূলত বাড়িটা তৌহিদের বা তার বাবার। গাড়ি থেকে নেমেই বাড়িটা দেখতেই চমকে উঠল তৌহিদ। প্রশ্ন করল, “আমরা এখানে কেন এলাম?”
আরহান নিশ্চুপে নামল। শান্তও নামল তার পিছু পিছু। এরই মধ্যে বাড়ির বিশাল কালো গেটটা খুলে গেল। গেটের বাহিরে তৌহিদের বাবা দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, “চলে আসো। তোমাদের ঘর তৈরি।”
.
.
.
চলবে........................................................................