তুমি রবে নীরবে - পর্ব ৩৪ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


রাশেদ জামালের হাঁকডাক শোনা গেল। বাড়িতে মেহমানদের পদধূলি পড়েছে বোঝা যাচ্ছে। আজকে বেশ পরিপাটি হয়ে আছেন শারমিন বেগম। সব কাজ জুলেখাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। বেশিরভাগটা কুহুই সামলিয়েছে নিজ দায়িত্বে। শরবত হাতে বসার রুমে আসলো কুহু। ছেলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলালো। মাথা নিচু করে বেশ ভদ্র ভঙ্গিতে বসে আছে। গালের একপাশে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। চোখে চশমা এঁটে রাখা। উজ্জ্বল তামাটে গাত্রবর্ণ। সাদা শার্ট পরা। টেবিলের উপর শরবত রেখে চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুহু। মনে একটুও শান্তি পাচ্ছে না। রিশাকে আজ একবারের জন্যও বেরোতে দেখেনি রুম থেকে। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কি হয় কে জানে। রাশেদ জামাল বেশ হাসিমুখেই ছেলের বউয়ের পরিচয় দিচ্ছেন। মধ্য বয়স্ক দম্পতিদের সালাম জানিয়ে চলে গেল কুহু। ততক্ষণে জুলেখা হাত ভর্তি খাবারের ট্রে নিয়ে চলে আসলো।

রিশার দরজায় সবে একটা টোকা দিয়েছে কুহু, ওমনি দরজা খুলে গেল। রিশার গায়ে গাঢ় নীল রঙা তাঁতের শাড়ি। সাজসজ্জা ভালোই। কুহু তাজ্জব বনে গেল! স্বাভাবিকই লাগছে রিশাকে। তবে কি মেয়েটা মন থেকে সব মেনে নিয়েছে? হঠাৎ করেই কেমন লাগা ছুঁয়ে দিল কুহুকে। উচ্ছ্বসিত হয়ে রিশার হাত চেপে ধরলো সে। ছেলেটির বর্ননা দিতে লাগলো। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না রিশা। একটুখানি হাসলো শুধু। মেকআপের আড়ালে কান্না মাখা বিধ্ব-স্ত মুখ কতখানি লুকাতে পেরেছে কে জানে। কিছুক্ষণের মাঝে শারমিন বেগম আসলেন মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মাথায় বড়োসরো ঘোমটা টেনে নিশ্চুপ মায়ের সঙ্গে চলল রিশা। কন্ঠনালী শক্ত হয়ে আছে কেমন। চোখদুটো আবারও জ্বালা করছে। পেছন পেছন কুহুও আসলো। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেল তার। সকলের কথার মাঝে কলিং বেল বেজে উঠলো। বাইরে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রওনক এসেছে বুঝতে বাকি নেই কুহুর। দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল সে। রওনক চোখ তুলে তাকাতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল! কালো রঙা সুতির শাড়ি পরে আছে কুহু। আজকে রিশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বেশ ভালো করেই জানা তার। তবে কুহুকে শাড়ি অবস্থায় দেখবে ভাবেনি। উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিল। ইশারায় কুহুকে বোঝালো ভীষণ সুন্দর লাগছে। আচমকা অপ্রস্তুত হয়ে গেল কুহু। দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই ভেতরে প্রবেশ করলো রওনক। বসার ঘরে এসে সবাইকে সালাম দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। দরজার কাছে গিয়ে কুহুকে ডাকলো। খানিক লজ্জা পেল কুহু। সেটুকু সঙ্গোপনে আড়াল করে চলে গেল রুমে। রিশার যেন বসে থাকা ধৈর্য্য কুলচ্ছে না আর। শরীর টলছে মনে হচ্ছে। ছেলের বাবা বললেন, দুজনকে যেন একত্রে কথা বলার সময় দেওয়া হয় একটু। কথাটা কর্নপাত হতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল রিশা। উঠে চলে যেতে যেতে বলল ছাদে আছে সে। মেয়ের এহেন কান্ডে থতমত খেলেন শারমিন বেগম। হাসার চেষ্টা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

◼️

ড্রয়ার থেকে রওনকের জন্য শার্ট আর প্যান্ট বের করে নিল কুহু। হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। কোমড়ে আঁচল গুঁজে নিয়েছে মেয়েটা। ফর্সা উদর অনেকখানি দেখা যাচ্ছে অনায়াসে! দৃষ্টি সেদিকেই কিয়ৎক্ষণ আঁটকে রইল রওনকের। বেশ ব্যস্ত হাতে এগিয়ে আসলো কুহু। রওনকের হাতে জামাকাপড় ধরিয়ে দিয়ে তাড়া দিল। বাসায় মেহমান বসে আছে। কোনো তোয়াক্কা করলো না রওনক। কুহুর চোখের দিকে দৃষ্টি রেখেই টেনে নিল কাছে। বারকয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো কুহু। জিগ্যেসু দৃষ্টি তার। উন্মুক্ত কোমড়ে পেলব স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো! ভ্রু কুঁচকে এলো তার। রওনকের ঠোঁটে বাঁকা হাসি লেপ্টে আছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল সে,

"এই মুহূর্তে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমার সাথে। তোমার এই শাড়ি পরা রূপ আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে কুহু! আমার পাগলামিতে সামিল হবে?

কথাটুকু বলে'ই কুহুর কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে দিল রওনক। ভয়ানক চমকে উঠলো কুহু। তৎক্ষনাৎ শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে ঠিক করতে করতে বলল,

" বাইরে সবাই আপনার অপেক্ষায় আছে খেয়ালে আছে? এত প্রেম আসে কোথা থেকে আপনার?

কুহুকে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল রওনক,

"একজীবনে যখন অনেক তপস্যা করে প্রিয় মানুষটাকে পাওয়া হয়, তখন প্রতিদিনই নব্য ভাবে প্রেম জাগে হৃদয়ে। ঠিক এমন ভাবেই!

কুহু যেন আচমকা থমকে গেল! কি বললেন রওনক ভাই? কুহুকে পেতে তো কোনো কষ্টই করেনি সে! উল্টো দায়ই নিয়েছে। এসব মনভুলানো কথাতে কি আর পূর্বের কথা ভুলে যাওয়া যায়? তাদের জীবনে তো কেবল ভালবাসার সূচনা হলো! 

◼️

হাত ভাজ করে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে রিশা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আদনান। অম্বরে ঘটা করেই রাতের আয়োজন নেমেছে। অজস্র নক্ষত্রের মাঝে রিশাকে একফালি চাঁদ মনে হচ্ছে। আপন মনেই একটু হাসলো আদনান। তার মনের আকাশ রিশা নামক চাঁদ উঁকিঝুঁকি মারছে। কেমন একটু জড়তাই কাজ করছে। কি কথা বলবে বুঝতে পারছে না। গলা ঝেড়ে বলল,

" আপনি যে মৃগনয়না, সেটা কি জানেন মিস আইরিশ? 

আইরিশ নামটা শুনতেই বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো রিশার। এই নাম তো একজনের মুখেই মানায়! পাশ ফিরে তাকালো সে। অজানা এক ঝড় উঠলো বক্ষস্থল জুড়ে। বাবা, মার মুখের দিকে তাকিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে এসেছে সে। রাতিম ভাইয়ের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত শান্তিও লাগছে না। আদনান খুব ভালো ছেলে। কথাবার্তা, আচরণে সেরকমই প্রকাশ পায়। ছেলেটা তাকে খুব পছন্দ করেছে সেটুকুও বোঝা যাচ্ছে হাবভাবে। তবে এই মুহূর্তে আদনানকে না বলার একটামাত্র রাস্তা খোলা আছে রিশার কাছে। 

"আপনার মুখ কেমন ভার হয়ে আছ। কোনো কারণে কি মন খারাপ আপনার? নাকি আমাকে আপনার ভালো লাগেনি?

রিশা কেন জানি কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কি বলা উচিৎ বুঝতে পারলো না। নিনির্মেষ তাকিয়ে রইল বাদামি চোখের মণি বিশিষ্ট পুরুষের পানে। চশমা গলিয়ে চোখের হদিস করা যায় অনায়সে! কোনো উত্তর না পেয়ে ফের বলল আদনান,

" বুঝতে পেরেছি আমাকে আপনার পছন্দ নয় মিস আইরিশ। কারণটাও হয়তো আমার জানা। চোখের কারণে তাই তো? আমার মনে হয় গল্পটা আপনাকে বলা উচিত, ছোট বেলায় ক্রিকেট খেলার সময় ডান চোখে বল লাগে আমার। কর্নিয়ায় প্রচন্ড আঘাত পাই।হাইফিমা হয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। চিকিৎসা হয়েছিল ঠিকই তবে চোখটাকে আর ভালো করতে পারিনি। অপটিক নার্ভের ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। এটা সত্য আমি এক চোখে কম দেখি। আর চোখের সমস্যাটা যে কেউ দেখেই বলে দিতে পারবে। জানেন এই চোখ নিয়ে খুব আফসোস হতো আমার। তাই একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম অপথালমোলজিস্ট হবো। যতই হোক নিজের চোখটা তো আর ঠিক করতে পারবো না। অন্যের চোখ ভালো করে দিয়ে তাতে আনন্দ আর মানসিক শান্তি খুঁজে বেড়াই।

রিশা নির্বাক হয়ে শুনছিল আদনানের কথা। তামাটে গাত্রবর্ণ হলেও সুদর্শন সে শতভাগ! উচ্চতা বেশ ভালো। এই সামান্য চোখের ত্রুটি তার সৌন্দর্য, যোগ্যতার নিচে চাপা পড়ে রইল। রিশা মনে মনে ভেবেছিল আদনানের চোখের এই কারণ টা দেখিয়ে বিয়েতে 'না' বলে দিবে। তবে ছেলেটাকে এইভাবে ছোট করা মোটেও ঠিক হবে না বিবেক বলছে। রিশা নিরুপায়। কেন জানি কান্না পাচ্ছে তার। পরিস্থিতি কেন এত কঠিন মুহূর্তে দাঁড় করায় মানুষকে? শুকনো ঢোক গিলে বলল রিশা,

"আপনি ভুল ভাবছেন আদনান সাহেব। আপনার চেয়েও অধিক অসহায় ভাবে অনেক মানুষ বেঁচে আছে পৃথিবীতে। সামান্য একটা দূর্ঘটনা তো আপনার জীবন পাল্টাতে পারে না। আমার চেয়েও যোগ্য আর ভালো মেয়ে পাবেন আপনি।

একটুখানি হেসে বলল আদনান,

" মিস, আপনি কি আমার অসহায়ত্বের কথা ভেবে মায়া দেখিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন? যদি এতটা ভেবে থাকেন তবে আমার জন্য কাঙ্ক্ষিত মানুষটা আপনিও হতে পারেন। আকাশ যেমন চাঁদকে প্রতিনিয়ত আগলে রাখে তার বুকে, আপনাকে ঠিক সেভাবেই রাখবো আমি।

রিশার কেমন অস্থির লাগা শুরু হয়ে গেল। কথার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে না তো সে? মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে বলল,

"আমার আরো সময় চাই। 

তপ্ত শ্বাস ফেলে দূর আকাশে দৃষ্টি রাখলো আদনান। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বলল,

" মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে সেটা মেনে নেওয়া ততটাই কঠিন। আমার জায়গায় আপনি নন। আপনার জায়গা থেকে আমার জন্য কেবল করুণা সৃষ্টি হয়েছে মিস। এর বেশি কিছু নয়। আর অতিরিক্ত আশা করিও না আমি। আপনার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইল। আসছি আমি।

কথাটুকু বলেই ছাদ থেকে নেমে গেল আদনান। রিশা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। তার জীবনের গতিপথ ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে? মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানলে বোধহয় পৃথিবীতে সমস্যা বলে কিছু থাকতোই না। মন ছাড়া কি আদৌ বাঁচা যেত? আঁচলের তলা থেকে ফোন বের করে রাতিম ভাইকে কল করলো। রিং বাজতে দেখে চমকে উঠলো! হাত-পা কাঁপতে লাগলো। তারমানে ম্যাসেজটা তিনি পড়েছেন? জবাব দিতে দেরি কেন করলেন? ছটফটে মন হাজার প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলো।


আদনানের বাবা, মায়ের সঙ্গে বেশ অনেক্ক্ষণ কথা বলল রওনক। বিয়ে অবধি অনেক কথাই হয়ে গেল দুই পরিবারের মাঝে। চোখমুখ শক্ত করে এগিয়ে আসতে দেখা গেল আদনানকে। বাবা, মাকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল সে। রাশেদ জামাল ছেলেকে আদেশ করলেন যেন এগিয়ে দেয় রাস্তা পর্যন্ত। বাধ্য ছেলের মতো মেনে নিল রওনক।

◼️

নারকেল গাছের তলায় বসে আছে রাতিম। সামনে শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। তার জলে স্পষ্ট চাঁদের ছায়া পড়েছে! অপরূপ সুন্দর লাগছে! চোখজোড়া তার অশ্রুশিক্ত হয়ে আছে। রিশার পাঠানো বার্তায় যতবার চোখ বুলাচ্ছে ততবার বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। নিষ্ঠুর ধরনীর সমস্ত নিয়ম বড্ড অদ্ভুত! নিশ্বাস আঁটকে আসার মতো কষ্ট হতে লাগলো রাতিমের। যে ভালবাসার জন্য চাতকের মতো বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছিল, সে ভালবাসা যখন যেচে দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে তখন হাত-পা বাঁধা! যন্ত্রাণাদায়ক সে অনুভূতি! যেটা হয়তো ব্যক্ত করার মতো নয়! হাতের উল্টো পিঠে জলের ফোটা টপটপ করে পড়লো রাতিমের। মোবাইল অন করে ফের রিশার পাঠানো বার্তাটা দেখলো। পরক্ষণে আলতো চুমু খেলো তাতে। 
·
·
·
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন