বেশ বিস্মিত ভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে তৌহিদ তার বাবার মুখমণ্ডলের দিকে। আরহান এগিয়ে গেল। সালাম দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন আঙ্কেল?”
শুকনো হাসলেন তৌহিদের বাবা। আরহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা?”
“আমরাও ভালো।”
মিষ্টি হেঁসে জানাল আরহান। শান্ত দু'পা ফেলে এগিয়ে গেল তৌহিদের বাবার সামনে। শান্তর সাথে একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল তৌহিদের বাবার। তাও বেশ অনেকটা সময় আগে। একটু দাম্ভিকতায় ভরপুর ছিল মানুষটা। কিন্তু আজ কেমন যেন নরম নরম লাগছে। গায়ে জড়ানো সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। চোখ, মুখেও খানিকটা বিষণ্ণতায় ভরা। শান্ত যে কথা বলতে পারে না এটা তৌহিদের বাবা জানেন। তাই তিনিই আধবাড়িয়ে বললেন, “ভালো আছো শান্ত?”
মানুষের ঠোঁট পড়া বা ঠোঁট নাড়ানো দেখে তাদের মুখের কথা বুঝতে পারাটা শিখছে শান্ত। যাতে করে সে একটু হলেও হাত ইশারা ছাড়াও মানুষের ভাষা বুঝতে পারে। শান্ত কথাটা বুঝল। মাথা নাড়িয়ে জানাল, “জি।”
পাল্টা আর কিছু বলা লাগল না শান্তর তার আগেই তৌহিদের বাবা বললেন, “আমিও ভালো।”
তৌহিদ তখনও স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার বাবা আর দুই বন্ধুর দিকে। তাদের কার্যকলাপ দেখছে। শেষবার বাবার সাথে কবে সাক্ষাৎ হয়েছিল তৌহিদের মনে নেই। মাসে মাসে টাকা আর মাঝে মাঝে ফোন কল ছাড়া তেমন একটা সাক্ষাৎ ছিল না তাদের মাঝে। তৌহিদের বাবা একজন বিজনেস প্রেমিক মানুষ। জীবনভর শুধু টাকার পিছনে ছুটেছেন। তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলেও তাই করুক। কিন্তু তৌহিদ তো ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তার কাজ হবে সাধারণ। শিক্ষকতা খুব স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পেশা বলে মনে করে তৌহিদ। সে একটু একটু করে এগিয়ে গেল। ভিতরটা কেমন কেমন ঠেকছে! তৌহিদের বাবাও এগিয়ে এলেন। ঠোঁট ছোঁয়ানো তার মৃদু হাসি। চোখের পাতা খানিকটা ভিজে। তিনি এগিয়ে এলেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করলেন, “কেমন আছো তুমি?”
তৌহিদের কণ্ঠনালি বোধহয় থেমে গেল। কথা বলা যাচ্ছে না। সে শুধু স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। তৌহিদের বাবা গাল ধরল এবার। তৌহিদ চমকে উঠল খানিকটা। বলল,
“আপনি কেমন আছেন বাবা?”
কতগুলো দিন, কতগুলো মাস পর তৌহিদের মুখে বাবা ডাক শুনলেন জাহিদ রহমান। চোখ ভিজে গেল উঠল তার। ছেলের সঙ্গে এত দূরত্ব। কোনোমতে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালেন,
“ভালো। খুব ভালো।”
•••••••••••••
ফাবিহাদের বাড়ির সামনে একটা বিশাল সাদা গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামল অরিন। তার চিন্তা-ভাবনা হলো আজই শান্তকে তার ভিতরকার অনুভূতির কথা বলে যতদ্রুত সম্ভব বিয়েটা করে ফেলা। এই দূরত্ব আর ভালো লাগে না। ছেলেটাকে চোখের সামনে বসিয়ে রেখে ঘন্টা দুই তাকিয়ে থেকে মনের খোরাক যতক্ষণ না মেটাতে পারছে অরিনের শান্তি নেই। অরিন ড্রাইভারকে বলল,
“সন্ধ্যার পর আমাকে নিতে আসবে?”
ড্রাইভারও বলল,
“আচ্ছা ম্যাডাম।”
ড্রাইভার চলে গেল। অরিন জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে বাড়ির গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকল। বুকের ভেতর কেমন ধকধক করছে। কি অদ্ভুত এমন করছে কেন!"
অরিন ভেবেছিল বাড়ির ভিতর ঢুকেই আগে অতিথি নিবাসে যাবে। গেলও তাই। কিন্তু সেখানে তালা ঝুলতে দেখে বেশ অবাক হলো। পরমুহূর্তেই খুব একটা না ভেবে মায়াকুঞ্জে ঢুকেই চেঁচিয়ে ডাকল,
“ফুপুজান, ফাবিহা, রাহেলা কই তোমরা? ভাবি!'
আচমকাই অরিনের কণ্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠল সবাই। রান্নাঘরে ফাবিহা বাদে বাকি তিনজন ছিল। রাহেলা চেঁচিয়ে বলল, “চাঁচি হুনছেন, অরিন আপায় আইছে মনেকয়।”
রিনা বেগম বিস্মিত হয়ে বললেন,
“তাই তো মনে হচ্ছে গিয়ে দেখ তো।”
রাহেলা তক্ষৎণাৎ ছুটে গেল। যেতে গিয়ে রান্নাঘরের দরজার সাথে একটা টাক খেল রাহেলা। চেঁচিয়ে বলল, “ওমা গো।”
পরমুহূর্তেই কপাল ডলতে ডলতে চলে গেল সামনে। ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে এখনও চেঁচাচ্ছে অরিন। কি আশ্চর্য! কেউ কি শুনতে পাচ্ছে না সে এসেছে? অরিন আবার ডাকল, “রাহেলালালালা।”
রাহেলা দৌড়ে এল। চেঁচিয়ে বলল,
“আপা, আপনে আইছেন?”
এতক্ষণ পর রাহেলার কণ্ঠ শুনে সেদিকে তাকাল অরিন। মিষ্টি হেঁসে বলল,
“হুম এসেছি। ঘরের বাকি সবাই কোথায়?”
“চাচি আর ভাবিজানে রান্নাঘরে। ফাবিহা আপায় তার ঘরে। চাচায় আর ভাইজানে ঘরে নাই।”
“ওহ আচ্ছা। আমি ফাবিহার ঘর থেকে ঘুরে আসছি। ফুপুজানকে বলবে আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকব।”
“আইচ্ছা আপা।”
রাহেলা চলে গেল। অরিনও দ্রুত পায়ে চলে গেল ফাবিহার ঘরে।
••••••••••••
হাল্কা ফাঁক থাকা উম্মুক্ত দরজার আড়ালে দাঁড়াল অরিন। ভিতর থেকে কেমন যেন চাপা আর্তনাদের শব্দ আসছে। অরিন খানিকটা থমকে গেল। পা থেমে গেল আপনাআপনি। নিঃশব্দহীন সে আস্তে করে ফাবিহার কক্ষের কপাট সরাল। নীরব দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল। বালিশে মুখ গুঁজে ফাবিহা কাঁদছে। অরিন আশ্চর্য হলো। মনে মনে প্রশ্ন করল, “ফাবিহা কাঁদছে কেন?”
অরিন আর ভিতরে ঢুকল না। কি ভেবে যেন সরে এল ওখান থেকে। একপা দু'পা করে অরিন অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে হেঁটে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত এল। সেই মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে বের হলো রাহেলা। জিজ্ঞেস করল, “কি হইল আপা ফাবিহা আপার ঘরে যান নাই?“
অরিন তার ধ্যান থেকে বের হলো। শান্ত স্বরে বলল,
“রাহেলা শোনো।”
রাহেলা এগিয়ে এল। কিছু বোধহয় আন্দাজ করতে পারল। তার মন খারাপ হয়ে গেল।
বাড়ির পিছনটা তখন নির্জীব, নিরিবিলি আর থমথমে পরিবেশ। রাহেলা আর অরিন দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পিছনেই। অরিন বলল,
“ফাবিহার কি হয়েছে?”
“জানি না আপা।”
তক্ষৎণাৎ উত্তর রাহেলার। অরিন বিরক্ত নিয়ে বলল,
“মিথ্যে বলবে না তুমি সব জানো।”
“আমি সত্যিই জানি না আপা তয়,
“তয়,
“আপায় আরহান ভাইজানরে ভালোবাসে মনে হয়।”
রাহেলার কথা শুনে অরিন বিস্মিত হলো। চমকে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল, “মানে?”
এরপর রাহেলা সব বলল। আরহানের গ্রামে যাওয়ার সময়টুকুকে ফাবিহার আচরণ, চুপচাপ থাকা, সারাক্ষণ ঝিমানো। আবার আরহানের বাড়ির ঢোকার মুহুর্তে ফাবিহার হেঁসে ওঠা মুখখানা। সবটা বলল রাহেলা। সব শুনে অরিন বলল,
“এতে কাঁদার কি আছে?”
“ভাইজানেরা চইল্লা গেছে আপা।”
“হোয়াট!”
এত উঁচু আওয়াজে কথাটা বলল অরিন। যে রাহেলা থমকে গিয়ে দু'কদম পিছনে চলে গেল। অরিন তটস্থ ভঙ্গিতে বলল,
“চলে গেছে মানে কোথায় গেছে?”
“ওনারা বাসা ছাইড়া দিছে আপা।”
অরিনের মাথা খারাপ হলো এবার। শান্ত তাকে এ ব্যাপারে কিছু বলল না। না বলেই চলে গেল। অরিন এবার বুঝল অতিথি নিবাসে তালা ঝুলছে কেন! রাহেলার ডাক পড়ল। রিনা বেগম তাকে উঁচু আওয়াজে ডাকছেন। রাহেলাও আইতাছি বলে দৌড়ে গেল। অরিন চিন্তিত হলো, 'এবার কি করবে!'
•••••••••••••
“আচমকা আমায় কিছু না বলে আমরা এখানে এসে উঠলাম কেন আরহান?”
আরহানের জন্য বরাদ্দকৃত কামরায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলল তৌহিদ। আরহান উত্তর দিল না। ব্যাগটা বিছানায় রেখে আশপাশটা দেখল। বিশাল একখানা বাড়ি তৌহিদদের। পুরো বাড়িটাই কাঁচের দেয়াল দিয়ে বর্ণিত। এত সুন্দর। কিছুটা আমেরিকান বাড়িগুলোর মতো। আরহান রুমের দক্ষিণার পর্দাটা সরাতেই এক ফকফকা আলো তাদের ছুঁয়ে দিল। আরহান অবাক হয়ে বলল,
“তোদের এত সুন্দর বাড়ি থাকতে তুই কি না টিনের ঘরে ভাড়া থাকতি তৌহিদ।”
তৌহিদ কিছু বলল না। তবে বিরক্তবোধ করল। দু'পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আমি যেটা জানতে চাচ্ছি সেটার উত্তর দে আগে?”
“কি জানতে চাস তুই?”
বেপরোয়া ভাবের প্রশ্ন আরহানের। তৌহিদ মুখোমুখি দাঁড়াল আরহানের। কাঁধ ছুঁয়ে প্রশ্ন করল, “আমরা এখানে এলাম কেন?”
এবার আরহান স্থির হলো। দৃষ্টিভক্তির উদাসীনতা হাটিয়ে সরলতা ঘেরায় উত্তর দিল,
“এক বিকেলে আঙ্কেল আমায় কল করেছিল। তিনি চাচ্ছেন তুই তার কাছে থাক। দেখ তৌহিদ, কম দিন তো হলো না আমরা ব্যাচেলার জীবন বিলং করছি। এবার তো থেমে যাওয়া উচিত। আঙ্কেল চাচ্ছেন তুই বিয়ে কর। তার বিজনেসে হাত দে। আঙ্কেলের বয়স হয়েছে এটাও তো তোকে দেখতে হবে। দাম্ভিকতায় ঘেরা মানুষটার সেদিককার কণ্ঠ শুনে আমি অবাক হয়েছি। ওনার তোকে প্রয়োজন। খুব করে প্রয়োজন।”
আরহান একটু থেমে বলল,
“তোকেও তো নাকি কতবার কল করেছে কিন্তু তুই সেইভাবে গুরুত্ব দিসনি। আমি জানি আমরা তিনজন অনেকগুলো বছর ধরে একসাথে আছি। এবার আমাদের আলাদা হতে হবে তৌহিদ। আমাদের সবার আলাদা আলাদা একটা জীবন হবে। তোর আলাদা জীবন, শান্তর আলাদা জীবন, আমার আলাদা জীবন। শান্তর গুলশানের তৈরি হওয়া বাড়িটার কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। হয়তো আর মাস এক লাগবে এরপরই তো ও আন্টি আর দাদিমাকে নিয়ে ওখানে উঠবে। ওঠাই উচিত। তুইও আঙ্কেলের বিজনেসে হাত দিবি, বিয়ে করবি। ভাবি, সংসার ও তো হবে।”
“আর তুই?”
আচমকাই প্রশ্ন তৌহিদের। আরহান কোনোরকম উত্তর দিল, “আমি, আমিও গুছিয়ে নিব নিজেকে। আমি উড়তে বেশি পছন্দ করি জানিস তো তোরা৷ আমি বিয়ে করলেও বউ নিয়ে উড়ব। কখনো এখানে কখনো ওখানে। আর গ্রামের বিশাল বাড়িটা তো আছেই।”
তৌহিদ কিছু বলল না। বেশক্ষণ চুপ থেকে জানাল,
“ফাবিহাকে ভুলে যেতে পারবি তো আরহান?”
আরহান থমকে যায়। আঁটকে পড়ে। ঘটে যাওয়া কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে শুধায়,
“জানি না।”
•••••••••••••
আরহানের রুমের সোজাসুজি রুমটাতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে শান্তর। বিশাল রুম। বিশাল টেবিল। একগুচ্ছ বইও আছে সেখানে। শান্ত বেশ অবাক হয়েছে রুমটা দেখে। শান্ত পুরো রুমের পর্দা সরিয়ে বেলকনির দিকে পা বাড়াল। সবুজে ভরপুর একটা বেলকনি। অর্ধেক রেলিং দেয়া তাও কাঁচের। শান্ত তার চোখের চশমা সরিয়ে ফেলল। চোখ বন্ধ করে অনুভব আশপাশের পরিবেশটা। এত সুন্দর বাড়ি। সে অবাক হচ্ছে এই ভেবে এত সুন্দর বাড়ি রেখে তৌহিদ তাদের সাথে এতকাল কি সব ঘরে থেকেছে। তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তৌহিদ কখনো বুঝতেই দেয়নি। তার ওই ছোট্ট কুটিরে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। এসি নেই, জানালা নেই। বদ্ধ একটা ঘর। যদিও তারা সবসময় দু'রুমে থাকত। শান্ত আর আরহান একরুমে। আর তৌহিদ একা অন্যরুমে। অতিথি নিবাসটাও যথেষ্ট সুন্দর ছিল। শান্ত মৃদু হেসে চশমাটা চোখে দিল। ফোনটা তুলে পরিবেশটার কয়েকটা ছবি তুলল। এমন সময় তার ফোনে মেসেজ আসলো। অরিনের মেসেজ।যেখানে লেখা—
“আমাকে না জানিয়েই পালিয়ে গেলেন লেখক সাহেব।”
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল শান্ত। তক্ষৎণাৎ একটা রিপ্লাই করল। লিখল, “লেখক সাহেব?”
এর কিছু মুহুর্ত পরই কিসের যেন ছবি পাঠাল অরিন। শান্ত দেখল। বিস্মিত হলো। এবং ছুটে গেল নিজের ব্যাগের কাছে।
.
.
.
চলবে......................................................................