তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ২৮ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


আজকের এই নির্জন সন্ধ্যা, রৈনীলের অদ্ভুত আচরণ আর বিস্ময়কর এক জোড়া চোখ, সবমিলিয়ে রহস্যময় এক আবহ তৈরি করেছে।

আমি শান্ত হয়ে গেছি। 

রৈনীল আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থাতেই বললো, 'শেষবার রিসোর্টে তোমাকে যা বলেছিলাম, তার জন্য তুমি কি আমাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছিলে?' 
'এর উত্তর আমি দেবো না।'
'এখন কি আমাকে তোমার খুব অপছন্দ?'
'পছন্দ অপছন্দের চেয়েও শক্তিশালী শব্দ আছে। রাগ, অভিমান। সেগুলো কেন আপনি বলছেন না?'
'আমি তো সেগুলো জানি। আমার ওপর তোমার প্রচণ্ড অভিমানের কথা তো আমার অজানা নয়।'
'তাহলে কি পছন্দ নিয়ে মাথাব্যথা আপনার? আমি এর কোনো উত্তর দিচ্ছি না। আপনার যা ইচ্ছে ধরে নিন। দয়া করে সব রহস্যের জট খুলে দিন আমাকে। আমি এইমুহুর্তে কোনো জটিলতা মেনে নিতে পারবো না।'

রৈনীল উঠে অন্য একটা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসলো। মাথা নিচু করে বললো, আমি আজকে যা যা বলেছি তার একবিন্দুও মিথ্যা নয়।
'আপনি কি তখনও আমাকে পছন্দ করতেন?'

রৈনীল চুপ করে রইলো। মাথা নিচু করে মাটির দিকে রাখা ওর দৃষ্টি। আমি শান্ত হয়েই আছি এখনো। রৈনীলের চোখের ভাষা দেখার পর আপাতত আমার কোনো তাড়া কাজ করছে না। সেই চোখে আমি আমার জন্য গভীর মায়া দেখতে পেয়েছি। 

'আমাকে কি পছন্দ করতেন আপনি?' 
'হুম।'

আমি চমকে উঠলাম। যতটা না চমকেছি, তারচেয়ে বেশী শিহরিত হয়েছি। গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে আমার। রৈনীল জানে কী করে সবকিছু সুন্দর করে ব্যাখ্যা করতে হয়। অথচ সেটা না করে সবকিছুকে জট পাকিয়ে রেখেছে। আমাকেই বারবার প্রশ্ন করে জেনে নিতে হচ্ছে সব। আমি ঠিক করলাম আর কোনো প্রশ্ন করবো না। কেবল অপেক্ষা করবো তার উত্তরের জন্য।

কিন্তু সে আমাকে পছন্দ করে এটা জানার পর আমার হৃদয়ে সীমাহীন তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এমনটা তো আমার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। 

মৃদু স্বরে শুধু বললাম, যখন আমি তার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলাম, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল আমার। তখন আমাকে ভীষণ অপমানে দূরে ঠেলে দিয়ে আজ এত বছর পর আমাকে জানানো হচ্ছে সেও আমাকে পছন্দ করতো! এটা কি উপহাস? নাকি রসিকতা? 
'সবকিছুর উত্তর পাবে তুমি। এখন শুধু এটুকু জেনে রাখো, সেদিন রিসোর্টে যা বলেছিলাম, তা সত্যি ছিলো না।'
'কিহ!'

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম! এরচেয়ে বড় বিস্ময় আমার জীবনে আর নেই। যে সত্যকে বুকে ধারণ করে প্রচণ্ড অনুভব করা সত্ত্বেও আমি নিজেকে দূরে রেখেছিলাম, সেই সত্যিটা নাকি আদতে মিথ্যা ছিলো! 

রৈনীল বললো, ওগুলো আমার মনের কথা ছিলো না। সবটাই মিথ্যা ছিলো। এর কারণ অবশ্যই জানাবো তোমাকে। জানানোর জন্যই তো তোমাকে খুঁজে বের করেছি। 

আমি স্তব্ধ। রৈনীল মাথা নিচু করে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে কোনোমতেই এটাকে মজা কিংবা দুষ্টুমি মনে হচ্ছে না। সিরিয়াস চেহারা তার। মুখের ভাঁজে কাঠিন্যতা। আর কণ্ঠে সীমাহীন কোমলতা। এই সবকিছুকে মিথ্যে ভাবা ঘোর অন্যায়। তবে আমি ওকে বিশ্বাস করতে শুরু করবো? কিন্তু.. এটা যে অসম্ভব মনে হচ্ছে আমার কাছে। 

কতটা সময় আমরা মুখোমুখি বসে কাটিয়ে দিলাম কেউই জানিনা। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। সত্যি বলতে আমি বলার মতো কিছুই খুঁজে পাইনি। আর সে, হয়তো এত বছরের জমানো কথাগুলো গুছিয়ে বলার মতো অবস্থায় আসেনি এখনও।

একসময় আমি উঠলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, 'রাত হয়ে যাচ্ছে। আমার রান্না করতে হবে। অফিস থেকে ফিরে অনেক ক্ষুধার্ত ছিলাম।'
'আই এম সরি সরণী।'
'ইটস ওকে। আমি রান্না বসাচ্ছি, সরি বলতে হবেনা।'
'রান্নায় লেট হওয়ার জন্য সরি বলিনি।' 

আমি এবার চমকে উঠলাম। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম আমি। জানি সে কোনো একটা অপরাধবোধ থেকে সরি বলছে। সেটা জানার চেষ্টা করছি না। তার নিজ থেকে বলার অপেক্ষায় রইলাম।

এমন ভাবে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যেন রুমে কেউ নেই। প্রথমদিকে রৈনীল চেয়ারেই বসে রইল। কিছুক্ষণ পর উঠে এসে আমার সঙ্গেই রান্নায় হাত লাগালো সে। আমি মুখ টিপে হাসলাম। রৈনীল পাশে দাঁড়িয়ে সবজি কাটলো। সবজির শেইপ ঠিক আছে কিনা সেটা দেখালো আমায়। এরপর পেয়াজ কুঁচি করে বাটিতে রাখলো। চুলায় তখন ভাত ফুটছে। আমার হাতে তেমন কোনো কাজ নেই বলে রৈনীলের রান্নার আয়োজন দেখতে লাগলাম। 

আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে মানুষটাকে নিয়ে আমি সব সময় কল্পনায় একসাথে কাজ করে এসেছি, সে মানুষটা বাস্তবে আমার কাজে হেল্প করছে। কখনো বোরিং ফিল করলে যাকে আমি কল্পনায় আনার চেষ্টা করতাম, ভাবতাম সে আমার পাশেই আছে। আজ সত্যি সত্যি সেই মানুষটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে! এই নির্জন রাতে সব কিছুকে নিছক স্বপ্ন মনে হওয়াটা ভুল নয়।

৫ বছর আগে মা আমার ফোনটা ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে আমি দীর্ঘ এক বছর ফোন ইউজ করিনি। এর ফাঁকে বেশ কয়েকবার স্বাগতা আপু ওর বাসায় আমাকে দাওয়াত করেছে। এমনকি নিজে বাসায় এসে আমাকে জোরাজোরি করতো নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি যেতে চাইনি বলে শেষটায় সে বলেছিল রৈনীল আসবে। রৈনীল নাকি বলেছে আমার সঙ্গে তার কিছু কথা আছে। সেদিন ভীষণ চমকালেও আমি যাইনি। কেন যেন তার সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করতে একদম ইচ্ছে করেনি।

তার কিছুদিন পর ছিলো রৈনীলের জন্মদিন। এই প্রথমবার নিজে নিজে সে একটা পার্টি এরেঞ্জ করেছে। কাছের বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে ছোট্ট একটা পার্টি। সেখানেও দাওয়াত করেছিল আমাকে। তখন আমি ফোন ব্যবহার করছি না বলে আমার বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। স্বাগতা আপু সেবারও খুব চেষ্টা করেছিল ওর জন্মদিনের পার্টিতে আমাকে নিয়ে যেতে। মাকেও রাজি করিয়েছিলো। কিন্তু আমি যাইনি। 

হঠাৎ করেই সমস্ত পৃথিবীর ওপর অভিমান করে বসেছিলাম আমি। মনে হয়েছিল কাছের মানুষগুলো আমাকে যতটা তিক্ততা দিয়েছে, এই মানুষগুলোর প্রতি আমার আর কোনো প্রত্যাশা নেই। এমনকি নিজের প্রতিও কোন প্রত্যাশা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। 

একদিন ভার্সিটিতে ফারাহ এসে আমাকে বলল রৈনীল কল দিয়েছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় ।
ফারাহ তার ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি শুধু কয়েক সেকেন্ড ফারাহ'র ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর ফোনটা আমি হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখিনি। জানিনা কেন তখন অসম্ভব অভিমান জমে ছিল সবার প্রতি। বিশেষ করে আমার মায়ের ওপর। মায়ের সঙ্গে অভিমান করেই আমি আমার জীবন থেকে সবকিছু মুছে ফেলেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম রৈনীল হয়তো সাধারণ খোঁজখবর নেয়ার উদ্দেশ্যে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। তার দেয়া আঘাতে আমার যেন কিছু না হয় সেটা হয়তো বলতে চাইবে। তার প্রতি ততদিনে আমার সমস্ত প্রত্যাশা মরে গিয়েছিল। কিন্তু আজ আমার খানিকটা আক্ষেপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেদিন যোগাযোগ করলে হয়তো রৈনীলের মনের কথাটা জানতেও পারতাম! হয়তো তখনই সে স্বীকারোক্তি দিতো যা এখন দিয়েছে। তবে কি তখন ভুলটা আমারই ছিল? 

কি ভাবছো এত? 

রৈনীলের কথা শুনে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। শুকনো হাসি দিয়ে বললাম, তেমন কিছু না। 
- ফেসবুকে তোমার একটা পেজ ছিল না? ওটাতে ভিডিও দিতে পারো এখন।

আমি ভীষণ চমকে গেলাম। আমার সেই পেজটার কথা ভুলেই গিয়েছিলান। যদিও ওটা ছিল আমার জীবনের একটা ছোট্ট জানালা। রৈনীলকে হারানোর পর সেই পেজটাকে ঘিরে আমি নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। আমার জীবনে কোনো আনন্দ ছিল না। পেইজে নিয়মিত কনটেন্ট বানানোর বিষয়টাতে আমি অনেক আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটাও যখন আমার মা চিরতরে বন্ধ করে দিলেন, তখন সত্যিই জীবন থেকে সব কিছু মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিলো। ভেবেছিলাম আর কোনোদিন আমার কোনো কিছু করতে ইচ্ছে হবে না। 

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, সে তো অনেক আগের কথা। 
এখন নতুন করে শুরু করতে পারো। তুমি এখন অফিস গোয়িং একটা মেয়ে। সবাই তোমার লাইফ স্টাইল অনেক পছন্দ করবে। 
'আমি চাইনা। আমার মন থেকে আমি সবকিছু মুছে ফেলেছি।'
'এটা আমার থেকে ভালো কে জানে?'

রৈনীল আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। আমি শুকনা হাসি দিলাম। এর বিপরীতে আসলে কিছুই বলার নেই। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ মুছে ফেলেছিলাম সত্যি। তবে আমার মন থেকে কখনোই না। 

রান্নার পুরোটা সময় জুড়ে রৈনীল আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। জগতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প গুজব চালিয়ে গেল। বহুদিন পর কারো সাথে আমি এত সময় নিয়ে গল্প করছি। একা থাকতে থাকতে এখন কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। তবে রৈনীলের কথা শুনতে মন্দ লাগছে না আমার। 

আমার রান্নায় অনেক ভুল আছে। এখনো ঠিক করে রান্নাটা শিখিনি। আজকের তরকারিটা মোটামুটি রৈনীল নিজেই রান্না করলো বলা চলে। রান্না করতে করতে সে আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছিল কিভাবে তরকারি কষাতে হয়। কিভাবে সব উপকরণ সঠিকভাবে দিতে হয়। রান্নাটা শিখতে শিখতে আমি খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। তরকারির রংটা দেখে মনে হলো খেতে খুবই মজা হবে। গত কয়েকদিন নিজের হাতের পানসে রান্না খেতে খেতে আমি বিরক্ত। তাই এই সুস্বাদু খাবারটা খাওয়ার জন্য আমার আর তর সইছিল না। রান্না শেষ হওয়ার আগেই আমি প্লেট ধুয়ে খাবার টেবিল গুছিয়ে ফেললাম। 

বাটিতে করে খাবার নিয়ে রৈনীল নিজেই টেবিলে পরিবেশন করলো। আমার সামনে বসলো সে। এই প্রথম আমরা একসঙ্গে ভাত খাব। আমার অনুভূতিটা ঠিক কেমন আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। কখনো মনে হচ্ছে স্বপ্ন, কখনো কল্পনা আবার কখনো মনে হচ্ছে আমি কোনো গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েছি। 

রাত বাড়লে এখানে ঝিঁঝিঁর ডাক প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমি নিঃশব্দে খাবার খেতে আরম্ভ করলাম। 
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp