-“বাবা, ভালো আছো?”
-“ভালো আছি। আন্টি কোথায়?”
-“বাপের বাড়ি গেছে সে। তুমি কও, কিছু লাগবে?”
নক্ষত্র কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,
-“কিচেনটা দেখিয়ে দিন, খালা।”
-“কিছু লাগবো? আমারে কও।”
-“স্যুপ বানাব, খালা।”
-“তুমি খাইবা? আমি বানায় দিই?”
-“প্রীতির জন্য।”
মনে মনে আপ্লুত হলেন আমেনার মা। তাদের এত আদরের প্রীতিকে বিশেষ অনুভব করানোর জন্য ছেলেটা রান্না করবে! আমেনার মা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,
-“ওইদিকে, বাবা। আসো। আমি দেখায় দিই সব।”
নক্ষত্র দক্ষহাতে রান্না শেষ করল। আমেনার মা বেশ অবাকই হলেন। আজকালকার ছেলেরা রান্নাও জানে। তাদের সময় তো রান্নাঘরে প্রবেশ করাটাকেও পুরুষেরা কাপুরুষোচিত আচরণ মনে করত। দীর্ঘশ্বাসগুলো আশীর্বাদ হয়েই বেরোল, “আল্লাহ, বাচ্চা দুইটাকে ভালো রাইখো।”
নক্ষত্র খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করে প্রীতিকে দেখতে পেল না। সেন্টার টেবিলে ট্রে রেখে ওয়াশরুমে নক করল। কোনো সাউন্ড এলো না। গুনগুনানো আওয়াজ এলো ব্যালকনি হতে। নক্ষত্র সেদিকে এগোল। গুনগুনানো গান অস্পষ্ট শোনা গেল এখন,
“কারা যেন, ভালোবেসে, আলো জ্বেলেছিল।
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল...”
প্রীতি বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশ। শুক্লা দ্বাদশীর সরু চাঁদের আলোও ক্ষীয়মাণ। ঠিক যেন প্রীতির মনের মতন।
“যাহা চাই তাহা পাই না। যাহা পাইবার হাত বাড়াই, তাহাও উড়িয়া যায় কর্পূরের ন্যায়।”—বাক্যদুটোর গভীরতম উপলব্ধিতে প্রীতি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
-“ভাগ্যে কি শূন্যদশা চলে নাকি? ক'দিন আগেও না আমার দিন চলছিল?”
নক্ষত্র শব্দহীন পায়ে প্রীতির পিছে এসে দাঁড়াল। প্রীতি অবাক হলো। পিছে না ঘুরেই বলল,
-“আমি ভেবেছিলাম, আপনি চলে গেছেন।”
-“আমি আছি।”
প্রীতির নিঃশ্বাস আটকে এলো। আছে! আসলেই আছে? এই তো তার উপস্থিতি! বাতাসে ঝাঁঝালো পুরুষালি সুগন্ধী! রুমের আলোতে তার ছায়া এসে পড়েছে প্রীতির ঠিক পাশেই। সেই সাথে গম্ভীর ও কর্কশ, দয়ামায়াহীন আওয়াজের ‘আমি আছি!’
এটা হয়তো সাধারণ কোনো বাক্য ছিল না। এটায় অন্যকিছু ছিল। একবুক আস্থা, দুঃসময়ের সঙ্গ ও থেকে যাওয়ার অঙ্গীকারের সাথে অব্যক্ত অনুভূতি সবও মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল।
প্রীতি কেমন এলোমেলো হয়ে গেল ভেতর থেকে। শব্দ বের করল না একটাও। নক্ষত্র ছোট্ট করে বলল,
-“ভেতরে চলো।”
-“কেন?”
এই প্রশ্নটা প্রীতি কেন করল জানা নেই। এর উত্তরে কী আসবে, তাও জানে না। উত্তরের অপেক্ষাও করছে না। তার সবকিছু ভুল হচ্ছে। ভুলের শুরুটা তো হয়েই গিয়েছে।
নক্ষত্র কিছু না বলে সরে এলো রুমের ভেতরে। প্রীতিও পিছে ঘুরল। পরনে হালকা রঙের গোলজামা। চুলগুলো খুলে রাখা। চোখ দুটো ফুলে আছে, ঠোঁট একটা অন্যটার থেকে আলগা। ছোট্ট গোল শ্যামমুখটায় বিস্ময়। পুরো গায়ে অলংকার বলতে পায়ে একজোড়া রূপার নূপুর আছে।
নূপুরের ঝুমঝুম শব্দে সে রুমের ভেতরে চলে এলো। নক্ষত্র ঘর গোছাচ্ছে। বিছানা এলোমেলো করে রাখা। দুটো ওড়নাও ফেলানো একপাশে। নক্ষত্র বিছানা গোছাতে গোছাতে প্রীতিকে বলল,
-“ওখানে বসো।”
প্রীতি সোফায় বসতেই সে বলল,
-“খাও।”
প্রীতি খাবার দেখেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলো। আমেনার মা এসব কী বানিয়েছে! এত করলা-তেতো অনুভূতি সে মুখে না এনে পারল না,
-“ইছ! এগুলো মানুষ খায়? খালাকে কত বলি, এসব না বানাতে। সুস্থ জাতের মানুষ এসব বানায় না, খায়ও না...”
-“আমি বানিয়েছি।”
প্রীতির কথা আটকে এলো। সময় নিয়ে প্রশ্ন করল সে,
-“কেন?”
-“খাও।”
এখন নক্ষত্রের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। প্রীতিরও খিদে পেয়েছে ভীষণ। রাগ করে দু-বেলা খেয়েছে কি খায়নি, সবাই তো এরপর খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেছে। প্রীতি খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে বলল,
-“এমনিতে ভালো রাঁধেন আপনি। এজন্য খেতে ভালো লাগছে। আমার ধারণা, আপনি যদি দু গামলা ঘাস একটা আস্ত গুইসাপ দিয়ে রান্না করেন—খুব চমৎকার খেতে হবে।”
নক্ষত্র প্রীতির কথাগুলো উপভোগ করতে লাগল। ওড়না দুটো ভাঁজ করে কাবার্ডের সামনে গিয়ে বলল,
-“কোনটা খুলব?”
প্রীতি মাঝেরদিকে আঙুল তাক করে বলল,
-“ওটা। এই না না না! খুলবেন না প্লিজ!”
বলেও লাভ হলো না। নক্ষত্র কাবার্ড খুলতেই ঠেসে ঢোকানো সব কাপড় তার ওপর পড়ে গেল। সে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর তাকাল প্রীতির দিকে। প্রীতি অপ্রস্তুত হাসল,
-“আসলে ভাঁজ করতে আলসেমি লাগে তো..”
নক্ষত্র চাপা শ্বাস ফেলে কাপড়গুলো উঠিয়ে বিছানার ওপর রাখল। ঠিক তখনই চোখ গেল খাটের নিচে।
প্রীতি বিরবির করতে লাগল অবিরতভাবে,
-“আল্লাহ, না না না! না, প্লিজ! একদিনে এত লজ্জা কেমনে সহ্য করব?”
ধরণী দ্বিধা হলো না। নক্ষত্রের চোখ ঠিকই গিয়ে পড়ল খাটের নিচের একগাদা কাপড়ের দিকে। নক্ষত্র বিমূঢ় হয়ে পূনরায় প্রীতির দিকে তাকাল,
-“তাই বলে খাটের নিচে?”
প্রীতি প্রায় কেঁদেই ফেলবে এবার। এমন মুখে বলল,
-“এগুলো আজ বিকেলের। আপনি আসার আগে কী পরব কী পরব না এসবের ট্রায়াল দিচ্ছিলাম। আর তখনই দেখি আপনার আসার সময় হয়ে গেছে। তাই ওখানে। আই সয়্যার, আপনি গেলেই ভাঁজ করে ফেলতাম।”
নক্ষত্র বড়ো করে শ্বাস ফেলে বলল,
-“দ্রুত খাও।”
প্রীতির খাওয়া শেষ হতেই সে একটা প্যারাসিটামল দিয়ে বলল,
-“গেলো।”
প্রীতি ওষুধটা দেখেই মনে মনে বেশ অশ্লীল একটা গালি দিলো। তারপর নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে নক্ষত্রকে বলল,
-“আমি আপনার বাপের জমি-জমায় ভাগ বসিয়েছি, স্যার?”
ভ্রু উঁচু করে তাকাল নক্ষত্র। প্রীতি চিবিয়ে চিবিয়ে অসহায়ের মতো বলল,
-“তাহলে বিষ দিলেন কেন?”
-“বিষ দিয়েছি?”
-“তা নয়তো কী?”
-“যদি আমি বিষও দিয়ে থাকি, তবে তাই পান করতে হবে তোমায়।”
এ কথার বিপরীতে প্রীতি কিছু বলল না। তিন গ্লাস পানির সাথে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিল। এরপর চিৎ হয়ে পড়ল সোফার ওপরে৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভীষণ ঘামের সাথে জ্বর নেমে গেল। নক্ষত্র স্লিভসের বোতাম খুলে কনুই অবধি গোটাতে গোটাতে স্টাডি টেবিলে বসল। বের করল বই-খাতা। প্রীতি আলসেমি নিয়ে ডাকল,
-“স্যার?”
-“ইয়েস?”
-“অনেক রাত হয়েছে, স্যার। ভালো ছেলেরা বাড়ি ফিরতে রাত করে না। আপনার মা বাড়িতে অপেক্ষা করছেন। মায়ের লক্ষ্মী ছেলে, মায়ের কোলে ফিরে যান।”
এটুকু বলে প্রীতি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-“লক্ষ্মী ছেলে আপনি, পেঁচার মতো কাজ করছেন কেন? পড়ব না আমি।”
নক্ষত্র ক্রুর হাসল,
-“তোমাকে পড়তে হবে না।”
-“আসলেই? অহ থ্যাংকস! তো আপনি এখানে আর কী করবেন? বাড়ি যান, স্যার। গুড নাইট।”
নক্ষত্র আড়চোখে তাকাল প্রীতির দিকে,
-“আমি তোমাকে পাহারা দেবো।”
-“মানে?”
-“বেডে তাকাও।”
বিছানার ওপর রাখা কাপড়ের স্তুপের দিকে তাকিয়ে প্রীতি হাসি আটকাতে পারল না,
-“স্যার, পিরামিডের মতো দেখাচ্ছে। মিশরে ট্রায়াঙ্গেল টাইপের পিরামিড আছে। বইয়ে আছে ফুড পিরামিড। আর আমার ঘরে ফেব্রিক পিরামিড। স্যার, আমার মনে হয় এটার একটা ছবি তোলা উচিত। এরপর ফেইক আইডি দিয়ে পোস্ট করব। দেখবেন কী রকম ভাইরাল হয়। এমনিতে আমরা বাঙালি মানেই উদ্ভাবনের শ্রেষ্ঠ জাত। স্যার, আপনার কী মনে হয়?”
নক্ষত্র শান্তচোখে তাকিয়ে বলল,
-“ভাঁজ করো এগুলো।”
চোয়াল ঝুলে পড়ল প্রীতির,
-“এখন?”
-“হুম।”
-“আপনি গেলেই করব স্যার, আই প্রমিস।”
-“এখন করো।”
-“স্যার, আপনি একজন অসুস্থ মানুষকে দিয়ে কাজ করাবেন?”
-“আনডাউটেডলি ইয়েস।”
-“পারবেন?”
-“হোয়াই নট?”
-“কষ্ট হবে না?”
-“নাহ।”
-“পাষাণ!”
-“আই নো।”
-“অসহ্য।”
-“উই নো।”
প্রীতি বলার মতো আর কিছু না পেয়ে বলল,
-“আপনি রীতিমতো শিশু নির্যাতন করছেন।”
-“শিশু?”
-“আমি।”
-“বয়স কত?”
-“সতেরো বছর আর নয়মাস।”
নক্ষত্র খানিকটা ভেবে এরপর বলল,
-“ব্যাপার না, প্রীতিলতা। আজকালকার বারো বছর বয়সী মেয়েরাও ম্যারিটাল লাইফ নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। সেই হিসেবে সতেরো বছরের কাউকে শিশু অন্তত বলা যায় না।”
প্রীতি কাপড়ের স্তুপের দিকে তাকিয়ে এবার কেঁদেই ফেলল,
-“বিশ্বাস করেন স্যার, আমি মনে-প্রাণে একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু। আমার চেহারার দিকে তাকান।”
নক্ষত্র থার্মোমিটার এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“প্যারাসিটামল নেওয়ার পরও জ্বর মাথায় উঠল? দেখো তো কত! হসপিটালে নেব নয়তো।”
জ্বর নিরানব্বই দশমিক শূন্য শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট আছে। অর্থাৎ এগুলো জ্বরের ঘোর নয়, বরঞ্চ প্রীতিলতার নাটক। সে আর কিছু বলার মতো পেল না। ভাঁজ করতে লাগল কাবার্ডের সাতদিনের জমানো সব কাপড়।
কিছুক্ষণ পর রুমে প্রবেশ করলেন আমেনার মা। হাসিখুশি মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে ঢুকলেন,
-“আর কিছু লাগব তোমাদে..”
কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। তন্মধ্যে প্রীতিকে এত এত কাপড়ের পিছে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। বিস্ময় না চেপে বললেন,
-“প্রীতি আম্মা, কী করতেসো এগুলা?”
প্রীতি বলল,
-“খাটাচ্ছে।”
নক্ষত্র কথাটার শোধন করল,
-“খাটাচ্ছি না, খালা। শিখিয়ে নিচ্ছি। আমার বউকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া আমার দায়িত্ব।”
আমার বউ! লোকটা কী থুয়ে কী বলে? সে তো ভাবি হতে যাচ্ছে। পাশা কি ওলটালো তবে? কবে? কখন? কীভাবে? প্রীতির প্রশ্নাত্মক চাহনিতে হতবুদ্ধিভাব দেখে নক্ষত্রের গম্ভীর চেহারার আড়ালে ঠাট্টার হাসি খেলে গেল। সে বলল,
-“অ্যান্ড নাউ, আ'ম ইন মাই ডিউটি..”
.
.
.
চলবে.............................................................