প্রেমান্বেষা - পর্ব ২৯ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


" ইশ কি জঘন্য প্রপোজাল! যান মোহাব্বতের শরবত খেয়ে আসুন।"

স্মরণ হাসলো। হেসে উঠলো তার চোখজোড়া। যে চোখে এ মুহূর্তে বিরাজ করছে শুধুই মুগ্ধতা। নীলিমাকে নিয়ে মুগ্ধতা। কিছুক্ষণ পূর্বের সময়টুকুও ছিলো তার বিষণ্ণতায় ভরপুর। অথচ এখন তার মনে খুশি যেনো ধরছে না। 
স্মরণ নীলিমার কথার তালে তাল মিলিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
" মোহাব্বতের শরবত খেলে কি হবে?"

নীলিমা ভ্রু কুঁচকে তেরছা গলায় বললো,
" আপনার কথায় মোহাব্বত বাড়বে।"

স্মরণ হো হো করে হাসলো। নীলিমা তার এ হাসি দেখে গাল ফুলিয়ে ফের বললো,
" হাসছেন কেনো? সত্যি কথা বলছি। এত বোরিং, খসখস প্রপোজাল কে দেয় শুনি? সেটাও আবার বিয়ের! প্রেমের প্রপোজালও দিয়েছিলেন এমন শুকনো মুখে, বোরিংভাবে৷ বিয়ের প্রপোজাল এভাবে মানবো না৷ "

স্মরণ ঈষৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। দু হাত বুকে আড়াআড়িভাবে গুঁজে বললো,
" তাহলে আয়োজন করে প্রপোজাল নিয়ে আসবো নাকি?"

" তা নয়তো কী? তবে এর আগে মোহাব্বতের শরবত খান।"

" তুমি বানিয়ে খাওয়াও। "

নীলিমা ভেঙচি কেটে বললো,
" মোহাব্বতও করবো আমি, আবার মোহাব্বতের শরবতও আমি খাওয়াবো! হুহ... শখ কত! পুরান ঢাকায় যান। "

স্মরণ পকেট দেখিয়ে বললো,
" পকেট দুটো খালি। অত দূর যাবার টাকা নেই। আমি বরং বিয়ে অব্দি অপেক্ষা করি, তোমার হাতের মোহাব্বতের শরবত খাওয়ার জন্য।"

" বিয়ে অব্দি কেনো? বিয়ের আগেই খাবেন। এমন প্রপোজালে আমার বাড়িতে বরযাত্রী আনতে পারবেন না বলে দিলাম। "

" আচ্ছা হবু বেগম, আপনার জন্য স্পেশাল প্রপোজাল থাকবে। তবে সেটা সারপ্রাইজ থাকবে।"

এতক্ষণ বেশ তেজি, অভিমানী স্বরে কথা বললেও স্মরণের মুখে 'হবু বেগম' সম্বোধন শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সে। চুলের আড়ালে কান দুটো গরম হয়ে আসছে লজ্জায়। স্মরণ তার রক্তিমাভাব গাল দুটো দেখে আরোও লজ্জা দিতে বললো,
" এটুকু শুনেই কুপোকাত তুমি! আরোও কতশত প্রেমময় কথা বলা বাকি আমার!"

নীলিমা লজ্জায় পালিয়ে যেতে পারলো না। তাই তো বহু কষ্টে নিজেকে সামাল দিয়ে বললো,
" অনেক বলেছেন। আপনার অফিস নেই?"

স্মরণ একটুখানি নড়েচড়ে বসলো। বললো,
" উঁহু, আজকে ছুটি নিয়েছি। বিরহের সাগরে ডুব দেয়ার জন্য ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো আজ সুখের সাগরে ডুব দিবো আমি!"

নীলিমা মৃদু হাসলো। তার হাসিতে হঠাৎ করেই স্মরণ যেনো রহস্যের ঘ্রাণ পেলো। নীলিমার দিকে ঘুরে একদম সামনাসামনি বসলো। অতঃপর ভ্রু তুলে কিঞ্চিৎ সন্দেহের সুরে শুধালো,
" এই নীলিমা! সত্যি করে বলো তো, আমার উপর প্রতিশোধ নিতে আসোনি তো?"

নীলিমা অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
" প্রতিশোধ! কিসের প্রতিশোধ? "

" এই যে তুমি আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করবো। আমি তোমার প্রেমে আবারো হাবুডুবু খাবো। আর তুমি টুপ করে লুকিয়ে আকাশকে বিয়ে করে আমাকে সারাজীবনের জন্য ছ্যাঁকা দিয়ে যাবে।"

নীলিমার মুখশ্রীতে একই সাথে ক্রোধ ও বিস্ময়ের প্রতিক্রিয়ার দেখা মিললো। কিন্তু স্মরণের এমন অদ্ভুত চিন্তাভাবনায় সে হেসে ফেললো। বললো,
" যতসব আজগুবি চিন্তাভাবনা আপনার! ছ্যাকা দেয়ার জন্য আপনার সাথে প্রেমের অভিনয়ের কোনো দরকার নেই। আপনি এমনিই আধ ছ্যাকা খেয়ে বসে আছেন। আরেকটু দেরি করলে আপনার ছ্যাকা খেয়ে বারবিকিউ হওয়া বাকি ছিলো।"
বলেই দুজনে সমস্বরে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ বাদে হাসি থামিয়ে স্মরণ জিজ্ঞেস করলো,
" এতদিন আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আজ হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত বদলে গেলো কিভাবে?"

নীলিমা প্রশ্ন শুনে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর বললো,
" আমার সিদ্ধান্ত গতকালই বদলে গিয়েছিলো, যখন ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছিলো। বিশ্বাস করুন স্মরণ ভাই, আমি ঐ মুহূর্তে এত বেশি নার্ভাস ছিলাম, কিছু হারানোর এত ভয় কাজ করছিলো, আপনাকে আসলে আমার পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। কিন্তু আমার সামনে আপনি ও আকাশ দুজনই বসে ছিলেন। সে মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো, আমি যদি বিয়ের পর সবচেয়ে বেশি সুখী হই, সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী হই, তবে তা আপনাকে বিয়ে করেই হবো। ঐ সময়ে আপনার কাছেই নিজেকে সেফ মনে হচ্ছিলো৷ মনের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসছিলো, আপনার সাথে জীবন কাটালে কখনও ঠকবো না। "
এই বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফের বলতে আরম্ভ করলো,
" আমি না ভীষণ কনফিউজিং একটা মেয়ে। তীব্র দোদুল্যমনতায় আমার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ক্লাস টেনে সাইন্স না কমার্স নিবো সেটা ভাবতেই আমার তিনদিন লেগেছিলো। আর জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত আমি যে সহজে নিতে পারবো, এটা আসলে অভাবনীয়। এতদিন আমি প্রচুর দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। আপনাকে বিশ্বাস করবো কি না, আপনার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে সুরক্ষিত বোধ করবো কি না। কিন্তু গতকাল আকাশের সামনে গিয়ে আমার সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। হয়তো আমি এমনই কোনো সুযোগের খোঁজে ছিলাম যেটায় আমি শক্ত মনে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। কিন্তু সে সুযোগটা যে ছেলে দেখার মাধ্যমে হবে তা না।
আমি যদি ছেলে হতাম, তবে গতকাল ঐ জায়গাই আব্বুকে বিয়ে দেয়ার জন্য রাজি করাতাম। কিন্তু যেহেতু আমি মেয়ে অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে এমন করতে ইচ্ছে হলেও চুপচাপ হয়ে ভদ্র মেয়ে সেজে বসে ছিলাম। কিন্তু আপনি তো পারতেন তখনই আব্বুকে আমার আর আপনার বিয়ের প্রস্তাব দিতে!"

স্মরণ মৃদু হাসলো। বললো,
" তোমার সম্মতি ছিলো না যে! তোমার সম্মতি ছাড়া আমি কিভাবে ফুপাকে বিয়ে প্রস্তাব দিতে পারি বলো?"

" তো এক্ষুণি চলুন। আব্বুকে বলুন আমার আর আপনার কথা! "

" এখন না নীলিমা। কোরবানি ঈদের আগ দিয়ে আমার প্রমোশন হবে। বেতনও বাড়বে। তাই তখনই প্রপোজাল নিয়ে যাবো ফুপার কাছে। এখন টাকা পয়সা নিয়ে একটু অভিযোগ থাকলেও প্রমোশনের পর আর থাকবে না। তখন স্বেচ্ছায় তার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবে। "

নীলিমা স্মরণের প্রমোশনের কথা শুনে বেশ খুশি হলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা গেলো তার কপালে। বললো,
" তাহলে বিয়ের প্রপোজাল দিতে দিতে ঈদ চলে আসবে। আমি আকাশের কথা কিভাবে বলবো?"

" কিভাবে বলবে মানে? সরাসরি না করে দিবে। বলবে তোমার ঐ হ্যাবলাকান্তকে পছন্দ না। ব্যস কাজ শেষ।"

নীলিমা হেসে উঠলো। স্মরণের চোখে চোখ রেখে শুধালো,
" তাহলে এই দেড় দুইমাস কি করবো শুনি?"

স্মরণ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
" কেনো প্রেম করবো!"
বলেই সে পিছনে হাত ঠেকিয়ে গা সামান্য এলিয়ে মাথার উপর আকাশের দিকে তাকালো। সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
" যে ছেলেটা এত বছরেও প্রেম করেনি, সে তার হবু বেগমের সাথে এই দেড় মাস চুটিয় প্রেম করবে। তার প্রথম প্রেমকে স্মরণীয় করে রাখবে। যে মেয়েটা তার ছোটবেলার ক্রাশের সাথে প্রেম করতে পারেনি, সে এখন প্রেম করবে। নিজের প্রেমিককে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন পূরণ করবে। ব্যাপারটা মজার না?"
বলেই সে নীলিমার দিকে তাকালো। নীলিমার চাহনিতে একরাশ স্বস্তি, আরাম। ইশ কতগুলো দিন পর এমন একটা শান্তিময় দিন এলো! যেখানে ভবিষ্যতের জীবনসঙ্গিকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। স্মরণকে স্বীকার করবে কি না এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। শুধুই আছে নিশ্চয়তা। ভবিষ্যত জীবনসঙ্গির নিশ্চয়তা। যে তাকে পাওয়ার জন্য তীব্র অনুনয় করে গিয়েছে। নীলিমার মন থেকে তীব্র এক আওয়াজ আসছে, স্মরণ কখনও তাকে ঠকাবে না। স্মরণ আজীবন তাকে ভালোবেসে যাবে, আজীবন। 
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন