-“খাটাচ্ছি না, খালা। শিখিয়ে নিচ্ছি। আমার বউকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া আমার দায়িত্ব।”
আমার বউ! লোকটা কী থুয়ে কী বলে? সে তো ভাবি হতে যাচ্ছে। পাশা কি ওলটালো তবে? কবে? কখন? কীভাবে? প্রীতির প্রশ্নাত্মক চাহনিতে হতবুদ্ধিভাব দেখে নক্ষত্রের গম্ভীর চেহারার আড়ালে ঠাট্টার হাসি খেলে গেল। সে বলল,
-“অ্যান্ড নাউ, আ'ম ইন মাই ডিউটি..”
প্রীতি যেন স্ট্যাচু হয়ে গেল। হ্যাং মেরে বসে রইল বিছানার ওপরে। আমেনার মা এবার মনে মনে বোকা হয়ে গেলেন। একটু আগে যখন প্রীতির জন্য নিজহাতে রান্না করল, তখন ভেবেছিল কত বউপাগলই না হবে! আর এখন এভাবে কাজ করাচ্ছে।
নাহ, শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়াটা খারাপ না। তার বউ, সে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ব্যবহার করবে। আমেনার মা নিজেকে এখানেই থামালেন। বউ বউ করছে কেন সে? বিয়ে হয়নি তো। নিজেকে থামাতে সক্ষম হলেও মুখ ফুটে এ প্রশ্নটা তিনি করতে পারলেন না। প্রস্থান ঘটালেন দ্রুততার সাথে।
প্রীতি এবার চিল্লিয়েই উঠল,
-“কী হচ্ছে বুঝিয়ে বলবেন, স্যার?”
-“কেন? তুমি ফিডার খাওয়া বাচ্চা?”
প্রীতি বড়ো করে শ্বাস টেনে বলল,
-“আপনার রক্ত ফিড করব আমি। কাছে আসুন।”
-“কেন? তুমি ভ্যাম্পায়ার?”
-“আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্লিজ, খুলে বলুন।”
প্রীতির কণ্ঠে ক্রমেই অশান্ত ও গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। নক্ষত্র চেয়ার ছেড়ে বিছানার ধারে এসে দাঁড়াল। প্রীতির আগুন গরম মাথায় হাত রেখে বলল,
-“মায়ের কাছে জিজ্ঞেস কোরো। যা হচ্ছে, হোক। যা হবে, তা হবেই। শান্ত হও।”
প্রীতি শান্ত হতে পারল না। তাকাল নক্ষত্রের দিকে। তার চোখের মণি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কম্পনরত ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র বলল,
-“তোমার ভবিতব্যে যে ছিল, সেই আছে। অ্যান্ড গ্যেস হু?”
প্রীতির স্তব্ধতায় নক্ষত্র নিজ থেকে বলে উঠল,
-“সবসময়ের মতো আমিই।”
______
সময় রাতের এগারোটা। স্মরণ রুমের ভেতরে বসে হাসছে। সকালের ওই সময়টা, ওই বোল্ড মেয়ের সরাসরি বলা কথাগুলো, শক্ত-ধারালো চাহনি, সব যেন চোখের সামনে হুবহু ভেসে উঠছে তার রং, ঘ্রাণ, জাদু নিয়ে; একদম ত্রুটিহীনতার সাথে।
নীহম স্মরণের চোখে চোখ রেখে ঘাড় ডানে কাত করল। শান্ত গলায় বলল,
-“খুব বিয়ের শখ জেগেছে? মেটাব?”
স্মরণ নীহমের হাত ধরে ফেলল। তাকে নিয়ে চলে গেল লাইব্রেরির সবচেয়ে ভেতরের এক কোণায়। এখানে সচরাচর কেউ আসে না। কারো নজরে পড়ার সম্ভাবনা কম৷ আওয়াজও বাকিদের মনোযোগ নষ্ট করতে পারবে না।
স্মরণ বলল,
-“খুলে বলো।”
-“কোনটা?”
-“আমার ব্যাপারে জানো কিছু?”
-“যেমন?”
অত খুলে বলার জন্য স্মরণ যথাযথ শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। তাই সে তাকিয়ে রইল। চাহনি অনেক কিছু বলতে পারে, যার জন্য শব্দের প্রয়োজন পড়ে না। তার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে নীহম চোখে হাসল,
-“তানজিদ আবরার স্মরণ। এইজ থার্টি ওয়ান। লেকচারার অভ মাই ডিপার্টমেন্ট। চার বছরের ক্যারিয়ার লাইফের প্রথম দিন থেকেই আমাকে পছন্দ করে। পছন্দটা অবসেশনের পর্যায়ে এসেছে অনেক আগেই। সারাক্ষণ আমাকে স্টক করা, থোট দ্যাট হি ওয়োনড মি, কেউ যাতে আমার দিকে নজর না দেয়, আমি যাতে কোনো প্রবলেম ফেইস না করি, সব হ্যান্ডেল করা। এসবের মাঝে ভদ্রলোকের নজর এড়িয়ে গেছে একটাই জিনিস...”
নীহমের আওয়াজ ক্রমেই ধীর হয়ে এলো। চাহনি সংকীর্ণ। আওয়াজ রূঢ়। শব্দে জাল। অনুভূতিতে বিমোহ। স্মরণ বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করল,
-“কী?”
নীহম চোখে চোখ রেখে এক সেকেন্ডের জন্য স্থির রইল। এরপর থেমে থেমে বলল,
-“হিজ গার্ল ইজ ইভেন মোর অবসেসড উইদ হিম...”
স্মরণ এবার এতটাই চমকেছে যে কিছু বলতে পারল না। নীহম তার অনেক কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। যা বলার, যেটুকু জানানোর সব হয়েছে। তাই এক হাতের দূরত্ব রেখে পিছে সরে এলো। দু'হাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে রইল, তাকিয়ে থাকল স্মরণের দিকে। স্মরণ সময় নিয়ে শুধাল,
-“কবে থেকে?”
-“যেদিন তুমি প্রেমে পড়েছিলে, তার আগেরদিন থেকে।”
-“আমি কবে প্রেমে পড়েছিলাম?”
-“সেকেন্ড ডে অ্যাট মাই ইউনিভার্সিটি।”
স্মরণ থমকানো গলায় বলল,
-“ওটা ফার্স্ট ডে ছিল না?”
-“উঁহু। আমি আগের দিনই এসেছিলাম। এরপর যৌবনের প্রথম দোষের দেখা পেলাম। অলক্ষ্মী মেয়ে লক্ষ্মী সেজে বাড়ি ফিরে গেলাম..”
নিজেকে এই চমক থেকে বের করতে স্মরণের দেড় মিনিট লাগল,
-“আমি এতটাও এক্সপেক্ট করিনি।”
নীহম স্মরণের দিকে তাকাল,
-“লাইফ আনএক্সপেক্টেড বোম ফাটাতে পছন্দ করে।”
নীহম থামল। তারপর আবার ডেকে উঠল,
-“স্মরণ?”
ডাকশোনা জবাবে স্মরণ বলল,
-“হু?”
নীহম শান্ত গলায় বলল,
-“উড ইউ ওয়ান্ট মি টু বি ইওয়োর্স?”
স্মরণ প্রতি মুহূর্তে একবার করে থমকে যাচ্ছে। মেয়েটা আসলে কী! সে কী শব্দ নিয়ে খেলতে জানে? নাকি মানুষের মস্তিষ্কের সাথে খেলা তার আজন্ম স্বভাব? উত্তর জানা নেই স্মরণের। সে নিশ্চিতকরণ প্রশ্ন শুধাল,
-“প্রপোজাল?”
নীহম মাথা নাড়ল,
-“কাইন্ড অভ।”
স্মরণ বড়ো করে শ্বাস টেনে এবার নিজেকে শান্ত করল,
-“যদি নেগেটিভ কিছু বলি?”
নীহম তবুও হাসল,
-“আমাকে পাওয়াটা হবে তোমার ভাগ্যের সর্বোচ্চ সুখ। আর না পাওয়াটা যেন আমৃত্যু দুঃখ। আমি জানি, তুমি বুদ্ধিমান।”
স্মরণ এখানে না হেসে পারল না,
-“আমার ম্যান্যুপুলেটিভ কুইন!”
তারপর ক্লাসটাইম হতেই নীহমকে ফিরে যেতে হলো। স্মরণ এতরাতেও সেসবই ভাবছে। কেবল বারো মিনিট আর আটচল্লিশ সেকেন্ডের কথোপকথন ছিল। তার পুরো দুনিয়াটাকে ফুলের বাগান বানিয়ে ছেড়েছে। তার সব ভালো লাগছে, সব। এক নিমিষেই যেন গোটাটা গুছিয়ে গিয়েছে। মাথার ওপর থেকে সব দুশ্চিন্তা নেমে গেছে। সবখানে কেবল শান্তি আর শান্তিই।
খটখট! কাঠের দরজায় শব্দ হলো। স্মরণ বড়ো করে শ্বাস ফেলল অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায়। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে নক্ষত্র। হাতে দুই মগ ভর্তি চা। চোখে চশমা। গায়ে কালো টিশার্ট আর ছাঁইরঙা ট্রাউজার। এদিকে স্মরণের পরনে ছাঁইরঙা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার। নক্ষত্র শিষ বাজাতে বাজাতে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইল।
স্মরণ না তাকিয়েই বলল,
-“ওহে আমার ইম্যাজিনেশনের কাবাবে হাড্ডি, বলো হে।”
নক্ষত্র হাওয়ায় শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“সিরিয়াস আলোচনা।”
-“যেমন? বাবু চাচার নাম বাবু রাখা হয়েছে কেন এটা?”
-“না। ওটার চেয়ে একটু বেশি সিরিয়াস কিছু।”
-“ওহ ওয়াও! বলতে থাক। কান খোলা আছে।”
নক্ষত্র তার সামনে এসে দাঁড়াল। বড়ো গম্ভীরমুখে বলল,
-“ভাইয়া, তোর কি মনে হয় না আমি দিন দিন ছাগল প্রজাতির হয়ে যাচ্ছি?”
স্মরণ অবাক হওয়ার নাটক করে বলল,
-“মনে না হওয়ার কী আছে? নিশ্চয়ই মনে হয়।”
-“তাহলে বলিস না কেন?”
-“তুই মাইন্ড করতে পারিস, তাই বলিনি। বাট আমি অবাক হচ্ছি। তুই হঠাৎ এটা টের পেলি কী করে?”
নক্ষত্র উদাস মনে স্মরণের পাশে বসল। চা এগিয়ে দিলো ভাইয়ের দিকে। নিজের মগে চুমুক দিয়ে বলল,
-“চুল-দাড়ি না কেটে দেখ কী অবস্থা করেছি।”
স্মরণ চায়ে চুমুক দিয়ে ওর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
-“কাটিস না কেন? মায়া লাগে? যা, ট্রিমার নিয়ে আয়। আজকেই কোরবানি করে দেবো।”
-“ধুর ভাও! না। প্রীতি ছিলা মুরগী বলবে।”
-“এই ভয়ে কাটিসই না?”
-“হু।”
-“আসলেই ছাগল হয়ে গেছিস।”
-“আমি টের পাচ্ছি, ভাইয়া।”
স্মরণ মাথা নাড়ল দু-ধারে,
-“ব্যাপার না। প্রেমে পড়লে পুরুষমানুষ ছাগলমানুষ হবে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এই স্বাভাবিক ব্যাপারকে অস্বাভাবিক মানলে মেয়েরা কষ্ট পাবে। সিগারেট খাবি?”
-“দে। চায়ের সাথে সিগারেটের স্বাদই আলাদা।”
স্মরণ সিগারেট এগিয়ে দিতেই নক্ষত্র ঠোঁটে গুঁজল। আর ওভাবেই অস্পষ্ট আওয়াজে বলল,
-“আগুন লাগায় দে, বদ্দা।”
স্মরণ হেসে ফেলল। লাইটার এগিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে নিজেরটাও জ্বালাল। তারপর এটা-সেটা নিয়ে অনেক কথা। হাসি-ঠাট্টা, একে-অপরকে খোঁচানো। সব মিলিয়ে ছয় বছরের বয়সের পার্থক্য কোথায় যেন মুছে যায়। দুইজনেই চলে যায় কৈশোরের কোনো এক সময়ে, যখন চাঞ্চল্য থাকে ঠোঁটের আগায়।
কিছুক্ষণ পর একটা আননোউন নাম্বার থেকে স্মরণের ফোনে কল এলো। ট্রু-কলারেও কোনো নাম আসছে না। স্মরণ কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রাখল। ওপাশ থেকে নীহম বলে উঠল,
-“হেই! হ্যালো? কই আছো?”
স্মরণ থমকাল,
-“নীহম? বাসায় আছি। তুমি? নাম্বার পেলে কী করে?”
-“নাম্বার পাওয়াটা বড়ো কোনো ব্যাপার না। যেখানে আমি তোমার বাসার এড্রেসও জানি।”
-“এত সাউন্ড হচ্ছে কেন? কোথায় তুমি?”
দিনের শেষ বোমাটা ফাটিয়ে নীহম বলে উঠল,
-“আমি এখন তোমার বাসার ঠিক সামনের রাস্তাতে আছি। মিট মি, নাও।”
স্মরণ দ্রুত গতিতে উঠে বারান্দার গ্লাস স্লাইড করল। রাস্তার সামনে কালো হুডি পরা নীহমকে প্রথম দেখাতে চিনে ফেলতে তার কষ্ট হলো না। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল তার। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে এলো।
নক্ষত্র সোফায় গা এলিয়ে দিলো। দুই পা তুলে নিল সেন্টার টেবিলের ওপর। চোখে ধীরতা, ঠোঁটের কোণে রসাত্মক হাসি আর সিগারেটের ধোঁয়া। স্মরণ এদিকে তাকাতেই নক্ষত্র চোখ মেরে বড়ো ভাইকে টিজ করতে বলে উঠল,
-“খুশিতে একটু কোমর দোলাও, স্মরণপাখি। আগুন লেগে যাবে ফর শিওর।”
.
.
.
চলবে..............................................................