কল্পনাও করতে পারেনি কয়েক মূহুর্তের ভেতর এমন কিছু ঘটে যাবে! যেখানে পণ করেছিল ওই লোকের সামনে ও যাবেই না, ধরাই দিবে না, সেখানে ফিহার মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার সামনে যাওয়ার দরকার। নতুবা, যে ধ্বংসলীলা ওর আর ওর মানব-দরদী সেবা পাওয়া সেই ডাক্তার লোকটির জন্য অপেক্ষা করছে, তা এই বিয়েবাড়ির সমস্ত আয়োজনকে চুরমার করে যথেষ্ট। ওই নিষ্ঠুর মেজাজী চরম দাম্ভিক পুরুষটা শুধু শুধু ওর ব্যাপারে ভুল বুঝল না? ও তো সামান্য একটু মনুষ্যবোধ থেকে স্বল্প পরিচিত এক ব্যক্তির হাতে শুশ্রূষা বুলিয়ে দিয়েছে। যেটা পথেঘাটে প্রায়ই কোনো-না-কোনো হাঁটু ছিলে যাওয়া পথযাত্রী, অথবা আঘাত পাওয়া কোনো মানুষের জন্য নিজেই ফার্মেসীর দোকান থেকে ঔষুধ কিনে নিঃস্বার্থ মনে করে থাকে। এটা বাবার শেখানো চমৎকার একটি শিষ্টাচার। যেখানে বাবা সবসময় বলেছেন, প্রতিটি ভালো কাজের জন্য তুমি অবশ্যই প্রতিদান পাবে। তবে এই প্রতিদান তুমি মানুষের কাছে চাইবে না। চাইবে তোমার সৃষ্টিকর্তার কাছে। যখন তুমি কোনো চরম বিপদে পড়বে, একুল-ওকুল সব বন্ধ দেখবে, তখনই তুমি সৃষ্টিকর্তার কাছে ওই কাজের জন্য আর্জি জানাতে থাকবে। বলবে, আমার অমুক কাজটির জন্য আপনি মহান সৃষ্টিকর্তা, এই বিশ্বজাহানের একমাত্র অধিপতি, সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে যিনি সর্বশক্তিমান, আপনি আল্লাহ্ আমার ওমুক সৎ কাজটির জন্য আমাকে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করুন। কথাটা মনে থাকবে আমার মা? কখনো এই উপদেশ ভুলা যাবে না। এটা হতে হবে একেবারে নিঃস্বার্থ কাজ। নিঃস্বার্থ কাজে দুঃখ আছে, কিন্তু কৃপণতা নেই। আজও ফিহা বাবার শেখানো চমৎকার ওই বাক্যগুলো নিজের আশু বিপদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করল। মনে মনে তেজস্বী দৃঢ়কণ্ঠে নিজেকেই সে স্বগোতক্তি করল, এমন ভুল আমি করিনি, যার জন্য কাউকে কষ্ট পেতে হবে। যদি আমার এই নিঃস্বার্থ কাজটা কারো নজরে কষ্টদায়ক হয়, তবে আমি চাইব তার মনের ভুলটা ঠিক হোক। এর জন্য যদি তার সামনেও আমাকে যেতে হয়, আমি নাবিলা হক ফিহা যাব। তার সামনে যেতে পিছপা হব না।' ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের সিক্ত মুখশ্রীর পানে অটলদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মুখটা কেমন শুকনো করে বলল, ' শুধু, কেউ আমাকে ভুল না-বুঝুক। আমি এখানে অন্য চিন্তা নিয়ে লোকটার সামনে পড়িনি। আমারই একটা ভুলের জন্য তার হাতে গরম কফিটা পড়ে যায়। যার জন্য আমাকেই সেটা শুধরে দিতে হয়েছে। কিন্তু, জানালার কাছে যেই হিংস্র চোখজোড়া আমি দেখেছি, এটা ঠিক সেদিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই শেষ সাক্ষাৎটা! যখন তাঁকে শেষবারের জন্য দেখেছিলাম। ' এবার মনের ভেতরে কু ডেকে উঠল ফিহার। সেদিনও তো এই মানুষটা ক্রুর চাহনি ছুঁড়ে ওর মুখপানে তাকিয়েছিল, কিন্তু সে চাহনির অর্থ বোঝার মতো ক্ষমতা বা বুদ্ধি তখনো পরিপক্ক হয়নি ওর। তাহলে, এখন যেটা মনে মনে ভাবছে সেটাই কী তবে সত্য? সেদিনও কোনো এক ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওভাবেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছুঁড়ে চুপ করে মানুষটা ক্ষোভ বোঝাচ্ছিল? চকচকে আয়নায় বিন্দু বিন্দু পানি ফোঁটার মাঝে ফিহার বিস্ময়বিমূঢ় মুখটা ফুটে রয়েছে। খোলা জানালা দিয়ে আসা দমকা হাওয়ার দল সেই বদ্ধ স্মৃতির ধূলোমাখা বইটা খুলে দেয়। খসখস করে পাতা উলটাতে উলটাতে পেছনে ছুটে যায় ফিহা। একটা পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত অতীতে ফিরে গেলে থমকে যায় ও; কাজল-কালো মায়াবী-নিখুঁত চোখদুটো বুজে নেয় ধীরে ধীরে। দু'হাতে সাদা বেসিনের দু'দিক পাঁচ আঙুলে শক্ত করে চেপে ধরে, ঠিক তখনই অন্ধকার জগতে ফুটে উঠে অতীতের চোখ ঝলসানো আলো।
ভারী বর্ষণমুখর রাত। রাতটির চেহারা ভীষণ কঠিন, ভীষণ হাহাকার করা। থেকে থেকে চমকে উঠছে কালো আকাশের কুচকুচে বুক। বুক চিড়ে প্রতিটি ফর্সা চাবুকের আঘাত পৃথিবীর বুকে ভূমিশুদ্ধো কাঁপিয়ে দিচ্ছে। গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ছে আকাশ। যেন তার আজ কোনো মহামূল্যবান সম্পদ বড়ো নিষ্ঠুরভাবে হারিয়ে গেছে। ফিরে না পাওয়ার দুঃখ-যন্ত্রনায় সে ভীষণ কাহিল; সে নিঃস্ব, ভারাক্রান্ত। নিশুতি রাতের সুনশান, স্তব্ধ, জনহীন পথ ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। গাড়ির জন্য আরো চারটা ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে বাড়িতে। আবহাওয়ার এমন রূঢ়মূর্তি দেখে কোনো গাড়িচালক বেরোতে চাচ্ছিল না। তার মধ্যে কীভাবে যেন বাবা এই ছয় সীটের হাইব্রিড গাড়িটা ব্যবস্থা করে ফেলেছে। গায়ের পাতলা ফিনফিনে সাদা ওড়নাটা আরেকটু গায়ে জড়িয়ে নিয়ে জানালায় তাকাল ফিহা। বৃষ্টির করাল ঝাপটায় স্বচ্ছ কাঁচটা বারবার অস্বচ্ছ হচ্ছে। বৃষ্টির মতোই ওর মায়া মায়া আঁখিদুটোতে টলোমলো অশ্রু। হাতের উলটোপিঠে চোখটা মুছতে মুছতে পুরো হাতটাই ভিজে গেছে। বাঁ'পাশে বসা ফিমা আপু ওর নরম কাঁধে মাথা হেলিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। ভিজে যাচ্ছে ওর কাঁধের কাছে জামাটা। সামনের সীটে বিড়বিড় করে প্রগলভ্ করছে শোকার্ত মা। মার ঘোরগ্রস্ত উন্মাদ আচরণগুলো সামাল দিচ্ছে বাবা। পেছনের সীটে দু'বোন তখন গভীর নীরবতায় চুপটি মেরে আছে। সামনে থেকে বাবার ফোনে একটা কল আসলে বাবা তা রিসিভ করে বললেন,
- ওয়ালাইকুম। হ্যাঁ সবাই উঠেছি। তুমি বিপদের মধ্যে রক্ষা না করলে কী যে হতো! না না, ওভাবে বোলো না বাবা। একটা গাড়িও সেখানে যেতে চায় না। হ্যাঁ, মোংলা বাজারের কাছাকাছি আছি। আচ্ছা, আচ্ছা ঠিকআছে। আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।
বাবা ফোনটা কেটে দিতেই গাড়িটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে সরু একটা পথে ঢুকে গেল। কাদায় প্যাচপেচ করা মেঠোপথ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় আসলো গাড়িটা। লোহার মরচে ধরা জীর্ণ গেটটা আজ শূন্য। কেউ নেই। গেটের কাছে যেই বৃদ্ধ লোকটি কোমরের পিছনে দু'হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো, আদরের নাতী-নাতনীদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো, আজ সেই অপেক্ষারত মানুষটি আর নেই। গায়ে ধবধবে সাদা পাজামা-পান্ঞ্জাবী, মাথায় পাতলা একখানা সাদা টুপি, মুখভর্তি ফর্সা দাড়ির মানুষটি কী যে খুশি হতেন! খুশিতে একশোবার এটা-ওটা আনার জন্য বাজারের দিকে ছুটতেন তিনি। আফজাল কাদিরের চামড়া কুঁচকানো মুখ, ফোকলা মুখের প্রাণ জুড়ানো হাসি, হাসি দিয়ে ডাকা ' নানুভাই ' শব্দটা আজও রিনরিন করে বাজছে। ওই নানা মানুষটা পান্ঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা দুটো টাকা, কখনো মসজিদ থেকে আনা খুরমা-জিলেপি, কখনো মুঠোভর্তি করে সবার জন্য লজেন্স এনে আনতেন। তিনি নিজের জন্য কিচ্ছুটি রাখতেন না। আজ পুরোনো সব দিনগুলো মনে পড়তেই ফিমা শব্দ করে কেঁদে উঠল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল,
- ফিহা, নানুভাই বাঁচবে তো? মরে যাবে না তো? নানু মারা গেলে আমরা আর কখনো এখানে আসতে পারব না।
ফিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বহুকষ্টে কান্নার ডলাটা গিলে নিলো ফিহা। বৃষ্টির মধ্যে একহাতে ছাতা সামলে, অন্যহাতে আপুকে আগলে রেখেছে ও। বুক ফেটে ওরও যে ভেতরটা ছিঁড়ে আসছে তা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। মনে মনে চিৎকার করেই আর্জি জানাচ্ছে, ' এই বুড়ো মানুষটা যে করেই হোক, আজ সুস্থ হয়ে যাক। অলৌকিকভাবে এমন কিছু হোক, যেন তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটুক। ' বাড়িভর্তি অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করছে। পাড়ার প্রতিবেশি থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তের বহু লোকজন এই বৃষ্টি মাথায় আফজালকে দেখতে আসছে। সরল মনের মফস্বলবাসীদের ভালোবাসা দেখে বুকভরা কান্নায় আব্বার পানে চাইলেন নাজনীন। এই মানুষগুলো আব্বাকে কতটা শ্রদ্ধার নজরে দেখে! বাবার সামান্য একটা খবর শুনেই যে যার মতো সবকিছু ছেড়েছুড়ে ছুটে এসেছে এখানে। বৃষ্টিও তাদের বাঁধা দিতে পারেনি। তাদের নজরে আফজাল কাদির একজন সৎ, সাহসী, সত্যবাদিতার মূর্তপ্রতীক। যার কাছে ভিখারী এলেও কোনোদিন শূন্যহাতে ফেরেনি। আজ সেই মানুষটার মৃত্যুশয্যা দেখে সকলের বুকে আহাজারি লেপ্টে আছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি আর হলো না। হাতের নাড়ি পরীক্ষা করে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, আর বেশিক্ষণ হাতে বাকী নেই। আফসানা বারবার ছেলের নাম্বারে ফোন দিয়ে যাচ্ছেন। বাজতে বাজতে ফোনটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ধরছে না। যখন শেষরাত্রির সবচাইতে কঠিন মূহুর্তগুলো পার হচ্ছিল, তখন আব্বার মাথাটা কোলে নিলেন আফসানা। পাশে রোকসানা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাজনীন আব্বার ডানপাশে বসে আছে, নাতী-নাতনিরা রোদনভরা চোখে শেষ দেখা দেখে নিচ্ছে। একবার চোখ পিটপিট করে সবার দিকে হাসি দিলেন বৃদ্ধ। কী সুন্দরই না তাঁর হাসি! যেন চাঁদের এক টুকরো মিষ্টি জোছনা ওই নিষ্পাপ মুখের মৃত্যুক্ষণে ফুটে উঠেছে। চোখের সামনে মৃত্যুদূত দেখতে পেয়েও শেষবারের মতো হাসি দিয়েই বুঝি বিদায় জানালেন আফজাল। যেন অস্ফুট কণ্ঠে বলছেন, আলবিদা আমার আপনজন। আলবিদা বসতভূমি। আলবিদা দুনিয়ার মানুষ। আমি চললাম, শেষ বিদায়। ' আফসানার দিকে নিভু নিভু নয়নে তাকাতেই ভীষণ দুর্বলকণ্ঠে ক্ষীণতার সাথে বললেন, ' আআমার সা-সাসাসাঈদ নানারে বকবি না '। দু'চোখের কোণায় অশ্রু ছাড়তেই শেষ ইচ্ছাটা যেন বলে দিলেন আফজাল। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও তিনি প্রাণপ্রিয় নাতীটির কথা স্মরণ করছেন। শেষ ভালোবাসাটা প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা এবং কালেমা জপলেন আফজাল।
ধীরে ধীরে ফজরের আযানে মুখরিত হচ্ছিল বৃষ্টিপ্রবল প্রকৃতি। আযান শেষ হবার কিছুকাল হতেই চিরনিদ্রায় বিদায় জানালেন আফজাল কাদির। চলে গেলেন দূরে, বহুদূরে, অজানা কোনো ভুবনে; যেখান থেকে ফিরে আসার যোগাযোগটুকু বন্ধ রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা। আফজাল শেষবারের মতো স্নেহের প্রিয়, সবচাইতে বিশ্বাসভাজন নাতীটির মুখ দেখে যেতে পারলেন না। যেই নাতীটি এই ধরণীর বুকে শুধু তাঁরই কথা একমাত্র মনোযোগ দিয়ে শুনতো। তাঁর প্রতিটি আদেশের শেষে একটাই উত্তর থাকতো, ' জ্বী, আমি করব। জ্বী, আমি মানব। ' আজকের পর থেকে এই আদেশসূচকের আজ্ঞা আর কেউ দিতে পারবে না। তার অন্তর্মুখী নাতীটি আর কখনো নানার স্থানটা খুঁজে পাবে না। পাবে না ওইটুকু কোমল সান্নিধ্য।
••••••••••••
ভোরের ফর্সা আলো ফুটতেই শোকগ্রস্ত বাড়ির অন্দরমহল স্বজন হারানোর আহাজারিতে ছেয়ে উঠে। দাফন কার্য তখনো করা হয়নি। এখনো দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেনি সাঈদ, দূর সম্পর্কীয় কিছু আত্মীয় আর রোকসানার স্বামী। দীপ একটা পর্যায়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে উঠল,
- আর কত অপেক্ষা করবেন বড়ো আন্টি? ভাই যদি আজ না আসে, তাহলে কী নানার লাশ এভাবেই ফেলে রাখবেন? আপনাদের আক্কল জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম! ওইদিকে মুরুব্বি দাদারা দাফনে এমন দেরি করছেন দেখে খুব রাগারাগী করছে। কী করবেন এখন? বসে থাকবেন এখানে?
সবে একটু পানির পিপাসায় গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন আফসানা, কিন্তু দীপের অমন শূঁল বিঁধানো কথা শুনে পানিটা আর গিলতে পারলেন না। পিচ্ করে পানিটা সিঁড়ির কাছে ফেলে সরাসরি দীপের দিকে চাইলেন,
- মুখের লাগাম টেনে কথা বল্। আমি তোর মা, কাকি নই। মা-কাকিদের সাথে ওই গলায় চপর চপর করিস।
এটুকু শুনেই দুম করে নিভল দীপ। সে যে আবারও অনধিকার চর্চা করে বড়ো আন্টিকে চটিয়ে দিচ্ছে, এটা সে মোটেও ঠিক করেনি। তবু নিজেকে সাফ সাফ দেখানোর জন্য যেই মুখটা খুলতে নিবে, তখনই দূর থেকে রোকসানা চোখ গরম করে থামিয়ে দিলেন। চক্ষু ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন,
- পেছনে তাকিয়ে দ্যাখ্। কে আসছে লক্ষ কর্।
মায়ের নীরব ইশারা বুঝতে পেরে দীপ সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল, ঠান্ডা একটা দিনেও প্রচণ্ড ঘেমে আছে ওই লৌহকঠিন মুখ। সাদা শার্ট জবজবে ভিজে গিয়ে পুরুষালী দেহের শক্ত কাঠামোর সুদৃঢ় গাঢ় খাঁজটা কাটা-কাটা রূপে ফুটে আছে। শার্টের আবরণ ভেদ করেই যেন গায়ের উজ্জ্বলবর্ণের চামড়া পুরোপুরি স্পষ্ট। ওই চওড়া প্রশস্ত কাঁধের দিকে তাকালে বুকের ভেতরে ভয় ভয় কাজ করে। যেন ওই কাঁধের উপর ভারী ভারী দায়িত্বের বোঝা চাপানো। চুলগুলো এতোটাই পাতলা যে হালকা মৃদু বাতাসে কপালের উপর ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলছে। তার প্রখরদীপ্ত চোখদুটো ভাবহীন, নির্বিকার; তবু ওই চোখ দিয়েই কর্তৃত্বের মতো ভাব ফুটিয়ে বলল,
- খাটিয়া কোথায় রাখা?
জড়বুদ্ধির মতো মিনমিন করে হাতটা বাড়ির দিকে দেখাল দীপ। কেন জানি এই ব্যক্তির ঝাঁজালো তীব্র স্বর শুনলেই জিভটা ওর আড়ষ্ট হয়ে যায়। সাঈদ সেই হাতটা লক্ষ করে ডানদিকে তাকাতেই আবারও দীপকে কাঁপিয়ে দিয়ে বলল,
- ভেতরে কোন বুদ্ধিতে রাখা হয়েছে? তুই জানিস না কীভাবে মরদেহ রাখতে হয়? ওই ঘরে কোন আন্দাজে রাখতে দিলি? তোকে ফোন করেও পর্যন্ত ---
এবার সিঁড়ির কাছ থেকে বোনপো'র কথা কাটলেন নাজনীন,
- বাবা! সাঈদ, আর দেরি কোরো না বাবা। তোমার জন্য এমনিতেই দু'ঘণ্টা দেরি করে ফেলেছি। আর এভাবে রাখা সম্ভব না বাবা। পাড়ার চাচারা খুব মন কষাকষি করছেন।
মুরুব্বি নামক দলটা পান্ঞ্জাবী-টুপি মাথায় দিয়ে একটু দূরেই বসে আছে। সেখানে চেয়ার পেতে বসতে দিয়েছে মেজো আন্টি রোকসানা। আশেপাশে মানুষের উপচে পড়া ভীড়। সাঈদ একপলক তাদের দিকে তাকিয়ে এবার দৃষ্টি ঘুরাল নাজনীনের দিকে,
- আঙ্কেলকে বের হতে বলুন। আমি ওনাদের সাথে কথা বলে আসছি।
নাজনীন ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কিছুক্ষণের ভেতর দাফন কার্য শুরু হয়ে যায়। পকেট থেকে সাদা রুমালটা বের করে মাথায় টুপির মতো বেঁধে নেয় সাঈদ। নিজের ডানকাঁধে নানার নিষ্প্রাণ দেহের খাটিয়া তুলে গোরস্থানের পথে হাঁটা দেয় সে। বৃষ্টিভেজা নরম মাটির সাড়ে তিনহাত ঘরে শুইয়ে দিল সবাই। চিরতরে শেষবার বিদায় জানিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হলো। সবাই যখন দোয়া, আর্জি শেষে স্ব স্ব স্থানে ফিরে যাচ্ছিল, তখন সেই জনমানবশূন্য কবরস্থানের ভেতর পা ঘুরিয়ে ফিরে যায় সাঈদ। কেউ খেয়াল করেনি, সে যে পিছু থেকে আর আসেনি। নরম মাটির উপর পা ফেলে ফেলে আবারও সেই সদ্য কবরটার কাছে থামল সে। মাটিতে দুই হাত গেড়ে মাথার কাছটায় চুপটি করে বসে রইল। মাথা থেকে ডানহাতে টুপিটা খুলে ফেলে বুকের গভীরতম শ্বাস ছেড়ে বলল,
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,
তবে একলা চলো রে।
আপনি একাই চলে গেলেন। আমাকে অন্যের কাছে বুঝিয়ে পর্যন্ত দিলেন না। সবার মতো আপনিও আমাকে ত্যাজ্য করলেন নানা। আমি শুধু সময় চেয়েছিলাম। শুধু মাপযোগ করা সময়। আপনিও যে অন্যদের মতো আমাকে নিঃসঙ্গতায় ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন, এতো তাড়াতাড়ি ভাবিনি।
আজও কৃষ্ণাভ চোখের তারায় তারায় সেই পুরোনো দিনগুলো ভেসে উঠে। কখনো রাতবিরেতে নির্ঘুম চোখে, কখনো জ্বরতপ্ত শরীরে সংজ্ঞাহীন ঘোরে, কখনো আজকের মতো তুচ্ছ একটি ঘটনার জেরে। হাতদুটো কোমরের কাছে পিছমোড়া করে বেঁধে সটান জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে মস্ত একখানা গোলাকার চাঁদ। পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ফুটফুটে জোৎস্না দ্বিগিদিক ছড়িয়ে আছে। ' ঠকঠক ' করে করাঘাতের শব্দ হতেই আরেকটু সচকিত হলো সাঈদ। কণ্ঠ গম্ভীর করে রাশভারী স্বরে অনুমতি দিল,
- বাহিরে যে-ই আছেন, ভেতরে আসুন।
ক্যাচ্ ক্যাচ্ করে দরজা খোলার শব্দ হতেই ভেতরে প্রবেশ করল কেউ। জানালার সামনে ' কমাণ্ড ' স্টাইলে দাঁড়ানো যুবকটির উদ্দেশ্যে বলল,
- উপরে যাবি ভাই? আর তো এইসব কাউয়া কণ্ঠের কাউকাউ শুনতে ভাল্লাগে না। উপরে একটু চল্, মুডটা একটু আন্, আর ওখানকার অ্যাটমোস্ফিয়ারটা জাস্ট বদলায় দে। আয় প্লিজ! মানা করিস না।
- এখানে কন্ট্রোভার্সি করাতে আসিনি। যার জন্য এসেছি, সে আমার চাইতেও মহাব্যস্ত। কিছু বিদেশি কুকুরদের উহঃ আহঃ করা নাটকটা দেখে চা° ম ড়া. তু° ল তে. মন চাইছে।
- পরে তুলিস রে ব্যাটা। এখন উপরে চল। উপরে গিয়ে আড্ডায় বস্ একটু। আয়।
ফাহাদের কথায় তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল সাঈদ। কিছুক্ষণ ওভাবেই চতুর দৃষ্টি হেনে ঠান্ডা মেজাজে বলল,
- হৈচৈ, আড্ডা, গল্পগুজব এসব আমি ছেড়ে দিয়েছি, এটা নিশ্চয়ই তোকে নোটিশ ছাপিয়ে বলতে হবে না। আমি এখন কী চাই, আই হোপ এটা বোঝার মতো পার্ফেক্ট হুঁশটা তোর আছে।
ফাহাদ বন্ধুর পাথুরে পাথুরে কথায় হাঁপ ছেড়ে বলল,
- তোর বিরক্ত লাগে না এভাবে চলতে? ওর সাথে যদি এই ধরণের আচরণ তুই দেখাস, তাহলে কীভাবে তুই এক্সপেক্ট করিস ও তোকে বুঝবে? ওর কী ঠ্যাকা পড়ছে যে তোর মতো ডেম্পারেটরে বুঝা লাগব? উলটো, তোর এইসব হম্বিতম্বি দেখলে নিজেরই চরম রাগ লাগে।
- ওহ্! রাগটা আমার চাইতেও বেশি?
- সাঈদ, তুই টপিক বদলাবি না! তুই তোর চোস্ত চালাকি আমার সাথে খাটানোর আগে আমার পজিশনটাও একটু ভেবে নিস। রাগটা আমারও কোনো অংশে কম না। বাট, তোর মতো নাকের ডগায় বারুদ নিয়ে চলি না। তোর রাগটাই যেন সবকিছু নষ্টের মূল না-হয়। ডোন্ট ফরগেট অ্যাবাউট ইয়োর পাস্ট। ইয়োর এক্স বিলাভড্ ফিহা শেখ। কন্ট্রোল করিস।
বন্ধুর মুখে আবারও জঘন্য দিনের স্মৃতিচারণ শুনে খুব চরম কিছু বলতে যাচ্ছিল সাঈদ, কিন্তু তার পূর্বেই পায়ের মৃদু মৃদু শব্দ শুনে দরজায় তাকাল সে। দরজার মুখে যে প্রাণীটি দাঁড়িয়ে আছে, সে ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে স্বাভাবিক স্বরেই বলে উঠল,
- আপনি যদি কাজে ব্যস্ত না-থাকেন, তাহলে আপনার সাথে একটু কথা—
কথাটা আর সম্পন্ন করতে পারল না ফিহা। জানালার কাছ থেকে ওই জলদগম্ভীর স্বরটা ওকে ভৎর্সনা করে বলল,
- দরজায় আগে নক করতে হয়, ঢোকার আগে পারমিশন লাগে, কথা বলার আগে আশপাশ দেখে নিতে হয়, এসব আপনি জানেন নাবিলা হক? আমি এই মূহুর্তে একা নই। কাইন্ডলি, রুমের বাইরে গিয়ে ম্যানার্সটুকু শিখে আসুন। আপনার মতো সেবাদানকারী, বুদ্ধিমতি, মানব দরদী মেয়ের কাছে ইমম্যাচিউরিটি এক্সপেক্ট করিনি। বুঝা গেছে?
এভাবে ঠান্ডা মাথায় অপমান করতে দেখে ফাহাদ নিজেও টাষ্কি! কীভাবে কথার ছলাবলায় ফিহাকে চাক্ষুষ আঘাতে অপমান করল। কিন্তু কেন? কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতেই একবার সাঈদের দিকে তাকাল, আরেকবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাইল ফিহার স্তব্ধ মুখশ্রীর দিকে। কী ভয়ংকর এই দৃশ্য! এরকম শীতল যুদ্ধের মানে কী? হয়েছে কী ওদের মধ্যে? ফাহাদ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ' মাইন্ড রিডিং ' ব্যাপারটার মতো সাঈদ ওকে পড়ে ফেলল। দরজার দিক থেকে মুখ সরিয়ে সরাসরি ফাহাদের দিকে চিড়বিড়ানো সুরে বলল,
- চুপ থাকবি ফাহাদ। কারো তরফদারী করবি না। এই মূহুর্তে প্রশ্ন করার জন্য এটা বেটার মোমেন্ট নয়। তুই ওকে সঙ্গে নিয়ে বের হ। আমি একা থাকব। কারো মুখ আমি দেখতে চাই না। কেউ একজন একটা কথা ঠিকই বলেছিল। হাই ইনফ্লুয়েনশিয়াল ব্যক্তিদের কাছ থেকে মূল্য পাওয়া মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি সম্ভবত সেই লাক নিয়ে জন্মাইনি।
কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না ফাহাদ। হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতেই ফিহার দিকে ও তাকাল। মুখ খুবই শান্ত, যেন কথার আঁচড়ে কিছুই হয়নি ওর। তবু চোখদুটোর চাহনি কেমন অপলক হয়ে আছে! মুখ ফুটে কিছু না বললেও হাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট ব্যান্ডেজটা দলা পাকিয়ে গেল। সেদিনের বলা ওরই কথাটা ওকেই উলটো শুনিয়ে দিয়েছে। ডানহাতের মুঠোয় থাকা ব্যান্ডেজটা ওখানেই ফেলে দিয়ে দ্রুতবেগে পালিয়ে গেল ফিহা। ফাহাদ এমন অপ্রতিভ কাণ্ড দেখে ওর পিছু পিছু ছুটে গেলে সাঈদ এবার একটু শান্ত হলো। মুখের শক্ত ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক করে দরজা লাগাতে চলে যায়। ঠিক তখনই ও দেখল, ফ্লোরে একটা নতুন ব্যান্ডেজ পড়ে আছে। যার অবস্থা দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে এই ব্যান্ডেজখানা কী ও তার কপালের জন্য এনেছিল?
.
.
.
চলবে......................................................................