নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ০২ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


সরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ছেলে মেয়েরা সারি সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে। সকলের পরণে একই উর্দি। ছেলেরা সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরিহিত অবস্থায় আর মেয়েরা গাড় নীল রাঙা কামিজে। সালোয়ার, স্কার্ফ, ক্রস বেল অবশ্য সাদা। তাদের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা মন্ডলী। জাতীয় পতাকার পাশে প্রধান শিক্ষক দাঁড়িয়ে। অধর নড়ছে মৃদু মন্দ। শুধু তাঁর নয় সকলেরই। জাতীয় সংগীত গেয়ে যাচ্ছে সমস্বরে,

                   কি শোভা কি ছায়া গো!
                   কি স্নেহ কি মায়া গো!
                   কি আঁচল বিছায়েছ! 
                   বটের মূলে নদীর কূলে কূলে.....

সবার মুখেই একই ভঙ্গিতে নড়েচড়ে। তবে সারির পেছন থেকে সুর ভেসে আসে খুবই ক্ষীণ। তাদের মনোযোগ জাতীয় সংগীতের চরণে মোটেই নেই। স্যারের কাছে পেদানি না জোটে সেই অভিপ্রায়ে মুখ নড়ায় শুধু। সুযোগ পেলে আগে পেছনে পাশের সহপাঠিদের সাথে দুদন্ড গালগপ্পো করতে ভুলে না। এই দিকে মেয়েরা অবশ্য এগিয়ে আছে। ষষ্ঠ ,সপ্তম শ্রেণীর মেয়েরা খুব একটা সুযোগ না পেলেও অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর মেয়েরা অধিকাংশই সারাদিনের গল্প যেন এই পিরিয়ডেই সেরে নেয়। পিটির স্যার বেত হাতে এসে ঢু মেরেও ধরতে পারে না কে কথা বলল। অধিকাংশই যে বোরকায় মুড়ে। মেয়েদের সারির একেবারে শেষ প্রান্তে দশম শ্রেণির মেয়েরা দাঁড়িয়ে। সুরেলা সবার শেষে দাঁড়িয়ে গুসুর ফুসুর কথা বলছে। কোন ছেলে কার দিকে তাকিয়ে আছে, কত বার ভেটকি দিলো। কোন মেয়ে সেটা দেখে মুচকি হাসলো। আড়চোখে কথা বললো কোন জুটি! সুরেলা পেছনে দাঁড়িয়ে সবই খেয়াল করছে আর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবীকে জানাচ্ছে!

-" এই মারু? দেখ আমাদের ক্লাসের জসীম, সেভেনে পড়া বুশরার দিক হা কইরা তাকায় আছে। বুশরা অবশ্য পাত্তা দিতাছে না!"

সম্মুখে দন্ডায়মান বান্ধবী মারিয়া পেছন দিকে হেলে ফিসফিসিয়ে বলে,

-" বুশরার সাথে নাইনে পড়া ফাহিমের লটর পটর আছে। দেখোস নাই সেভেনের ক্লাসে খুয়া দিয়া বড় বড় করে লিখছে বি প্লাস এফ!"

-" ইশ্ কেউ একটু আমার নামটা লিখলো না! দুঃখু বান্ধবী!"

মারিয়া নামক মানবী মাথা হালকা কাত করে পেছনে দান্ডায়মান সুরেলাকে দেখে ভেংচি কাটলো।

-" নাটক বাদ দে সুর! তুই যে তলে তলে বড় মাছ ধরার ফন্দি করছিস সেটা কি আমি বুঝিনা ভাবছিস? বইয়ের পাতায় পাতায় এন! বইয়ের মলাটের ভেতরের ভাঁজ..."

স্যারের আগমনে থেমে যায় মারিয়া। কালা বেঁটে গোছের স্যার বেত দেখিয়ে হুমকি দিয়ে যায়। সুরেলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কি আশ্চর্যের বিষয় ব্যাক্তিগত বিষয়ে কেন বান্ধবীদের নাক গলাতে হবে? নাকি এটা তাদের বান্ধবীগত অধিকার! স্যার চলে গেলে মারিয়া ইশারায় ছেলেদের দেখিয়ে বলে,

-" দেখ ভাই সবাই রূপসার দিক কেমনে তাকায় আছে? মনে হয় চোখ দিয়াই ছিঁড়া খাইতেছে। সব কয়ডা লুচ্চার দল!"

-" বাহ রে সুন্দর জিনিস দেখবো না? তোর আমার দিকে তাকায়? আমরা যে কাইল্লানি! হে তো আকাশের চাঁদ।"

হাসতে হাসতে বলে সুরেলা। পরপর ভেংচি কেটে বলে,

-" মেয়েটারেও বলি হারি বোরকা পড়তে গা চুলকায়? সবাইরে দেখায় দেখো আমি কত সুন্দর!"

মারিয়া ঘার ঘুরিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলো।

-" জ্বলে তাই না বান্ধবী?"

সুরেলা তার বাহুতে ঠাস করে একটা লাগিয়ে পা বাড়ায়। পিটি পিরিয়ড শেষ হয়েছে। সবাই শ্রেণীকক্ষের উদ্দেশ্যে ছুটছে। ছেলে মেয়েদের শ্রেনী ভবন আলাদা। তাই ঝুট ঝামেলা নেই। মারিয়া এসে বান্ধবীর বাহু জড়িয়ে গুনগুন করে হাঁটা দেয়। তাদের শ্রেণী কক্ষ দোতলায় একেবারে কিনারায়। তারা বারান্দায় উঠতেই কারো ডাকে থেমে যায় দুই বান্ধবী। পেছনে ফিরে রূপসাকে দেখতেই সুরেলার চোখে মুখে বিরক্ত ভর জমায়। মেয়েটাকে দেখলেই তাঁর গা জ্বলে যেন। রূপসা এগিয়ে এসে বলে,

-" দুইদিন হলো তোমাকেই খুঁজছি সুর আপা। স্কুলে আসো নি কেন দু'দিন?"

-" মেয়েলী সমস্যা! কেন খুঁজছিলে?"

-" হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি? ক্লাস শুরু হয়ে যাবে যে!"

রূপসার কথায় মারিয়া ও সুরেলা হাত ধরে উপরে ওঠে। রূপসা তাদের পেছনে পেছনে হাঁটছে। অষ্টম শ্রেণীর কক্ষে দাঁড়িয়ে যায় সবাই। রূপসা নিজ শ্রেনী কক্ষে প্রবেশ করে প্রথম বেঞ্চে রাখা গোলাপি রঙের ব্যাগটা খুলে কিছু একটা নিয়ে আসে হাতের মুঠোয়। সুরেলার দিকে বাড়িয়ে বলে,

-" এই নাও তোমার নুপুর। সেদিন রিজ ভাইয়ের ঘরে ফেলে এসেছিলে তাই না? খুঁজে ছিলে নিশ্চয়ই? ভাইয়া পেয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলো!"

সুরেলার বিস্ময়কর চাহনি নুপুর জোড়ায় নিবদ্ধ। কতবড় ধরিবাজ লোক ভাবা যায়? সে এখন মানা করবে কিভাবে? সে কি বলবে নুপুর জোড়া তাঁর নয়! সুরেলা বলতে নিবে কথা টা রূপসা সুরেলার হাতে নুপুর জোড়া ধরিয়ে দিয়ে শ্রেনী কক্ষে ঢুকে যায়। স্যার এসেছে যে। সুরেলা ঘার ঘুরিয়ে দেখে তাদের স্যারও আসছে। মারিয়া টেনে নিয়ে যায় সুরেলাকে। সুরেলা নুপুর জোড়া মুঠোয় ভরে শ্রেণীকক্ষে যায়। স্যারটা রাগি হওয়ায় পুরো ক্লাস দুই বান্ধবী কথা বলার সুযোগ পায় নি। তবে খাতার পাতা ছিঁড়ে সেথায় টুকিটাকি কথা বলে নেয়। কিন্তু হায়! এতো বড় রস মেশালো বিষয়ে এভাবে মন ভরে? প্রথম ক্লাস হওয়ার দরুন এক দুইয়ের বাহানাও দিতে পারছে না। ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই দুই বান্ধবী যেন আকাশে ঈদের চাঁদ দেখতে পেলো। স্যার বেরোতেই তারাও বগলদাবা করে বের হয়ে ছোটে ওয়াশ রুমের উদ্দেশ্যে। স্কুল জীবনে সেটা যে এক অনবদ্য আড্ডাখানা। কত গাঁথা রচিত হয় সেই দেয়ালে। 

••••••••••

বাঁশঝাড়ের ভেতরে রাস্তার এক ধারে একটা টিনের তৈরি ছোট পরিসরে গ্যারেজ। রাস্তার ওপাশে বাস স্টপেজের ছাউনী ও সাইনবোর্ড ঝুলে বিধায় গ্যারেজে টুকটাক ভালোই রুজি রোজগার করতে পারে। পাশেই এক চায়ের দোকান। চা ওয়ালারও সুবিধাই হয়েছে। বেচা কেনা মন্দ নয়। গ্যারেজ থেকে মাইল খানেক গেলেই বাজারের দেখা মিলে। গ্রামবাসীর জন্য বাজারটা বেশ দূরে হওয়ায় অনেক কৃষক গ্যারেজের আশেপাশেই কখনো সখনো কাঁচা বাজার বেচা কেনা করে। সিনান সালেহ গ্যারেজে বসে মাছি তাড়ায়। পল্টু তাঁর সঙ্গী। আজ এখন পর্যন্ত বৌনি হলো না। একটা কাস্টমারেরও দেখা নেই। তাই তাদের চিন্তার শেষ নেই। সিনানের মুখটা একটু ভার। ঝুলিতে একটা পয়সাও পড়লো না অথচ অভাবের সংসারে আকাল ফুরায় না। টাকা পেলেই বাড়িতে উনুনে আগুন জ্বলবে। হাতে যা কানাকড়ি জমিয়ে ছিলো বাবা সকাল বেলা দরকার বলে নিয়ে ফটুয়া। সিনান সালেহ বুঝতে পারে না বাবার কেন সংসারের প্রতি উদাসীন ভাব। যখন মন চাইবে ব্যাগ ভর্তি বাজার সদাই আনবে চালের বস্তা আনবে। তাঁর পকেটে টাকা গুঁজে দিবে তো মায়ের কাছে গুচ্ছিত রাখবে। আবার কখনো মাস পেরুলেও সংসারের জন্য কানাকড়িও খরচ করবে না। কিছু বললে বলবে টাকা পয়সা নেই তাকেই যেন দেওয়া হয়। সারাটা দিন কখনো কখনো রাতেও ওই চেয়ারম্যানের সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে ঘুরবে ফিরবে। নেশা পানি খায় হয়তোবা! ভাবতেই তাঁর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। বড় টায়ারের উপর বসে শফিকে ঝিমোতে দেখে খ্যাক করে ওঠে,

-" শা*লা রাত ভরা কনে কু*কাম করবার গেছিলি এহন ঝিমাইতেছোস! যা গ্যারেজের সামনে ঝাড় দে পাতা পড়ে জঙ্গল হইয়া রইছে!"

বারো কি তেরো বছরের কিশোর ছেলে নাম শফি; অসন্তোষ মুখে নারকেল গাছের শলা দিয়ে বানানো ঝাটা দিয়ে পুরো গ্যারেজ ঝাড় দিয়ে নেয়। ঝাটাটা এক কোনায় রেখে আবারও নিজ জায়গায় বসে ঝিমোয়। তবে হর্নের তীব্র আওয়াজে হড়হড় করে ওঠে। সিনানও টুল ছেড়ে উঠে আসে। জিপ থেকে নেমে আসে নওরিজ মাহবুব। সিনান তাঁর আপাদমস্তক দেখে নেয়। ইন করা সাদা শার্ট সাথে জিন্সের প্যান্ট। সাদা কেডস পড়ে চোখে কালো চশমা লাগিয়ে। এতো ভাব এদের আসে কোথা থেকে সিনান ভেবে পায় না। কাছে যেতেই সিনানের নাক সিঁকায় তুলে। সুগন্ধীর গন্ধে তাঁর বেজায় মেজাজ খারাপ হয়। শা*লা মানুষের গন্ধ কু*ত্তার থেকেও জঘন্য অথচ সেন্ট লাগিয়ে ঘোরে।

-" রিজ ভাই কোনো দরকার? আসেন বসেন?"

-" নাহ বসবো না। গাড়িটা স্টার্ট নিতে বেশ সময় নিচ্ছে। ধাক্কাতে হচ্ছে। একটু দেখে দে তো? আর পল্টু যা চা নিয়ে আয়। কাপটা ভালোভাবে ধুয়ে তবেই দিতে বলবি কুদ্দুস চাচারে।"

নওরিজ মাহবুব যেন হুকুম তামিল করলো। পল্টু 'জে আচ্ছা' বলে চায়ের টাপড়িতে চলে যায়। সিনানেল মোটেই ভালো লাগে না সব জায়গায় এরকম আধিপত্য দেখানো। ক্ষমতা আছে দেখেই সব জায়গায় সেটা বিস্তার করে বেড়াবে! ‌ ক্ষমতা কি তাঁর নেই? সে তো সাধারণ ভেসেই ঘুরে বেড়ায়! সে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি স্টার্ট করতে করতে নওরিজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-" রওশন কি বলেছিলো আমার কথা? আসলে আমি একটা সংস্থা খুলতে চাইছি। গ্রামের সকল যুবকদের নিয়ে। অনেকটা স্বেচ্ছাসেবক দলের মতো।"

নওরিজ চোখের কালো সানগ্লাসটা খুলে শার্টের সাথে ঝুলিয়ে সিনানের দিকে তাকায়। গম্ভীর গমগমে আওয়াজে প্রত্যুত্তরে বলে,

-" বললো কাল রাতে। খুবই ভালো একটা উদ্যোগ। কিন্তু এখানে আমি কি করতে পারি? উদ্যোক্তা তুই তাই তোকেই মাঠে নামতে হবে। এলাকার যুবাদের নিয়ে একটা গোল বৈঠকে বসে সবাইকে এক হতে হবে। ঐক্যতানে হাঁটতে হবে। তারপর গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মুরুব্বিদের সাথে আলোচনা করে ব্যাপারটাকে বিস্তার করতে হবে। আর আমার সাপোর্ট সবসময় পাবি সিনান!"

সিনানের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়। আশা করে নি রিজ ভাই তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিবে। চলার রাস্তা দেখিয়ে দিবে।সে বন্ধুদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেও কোনো সুরাহা পায় নি। কি করবে না করবে সব আউলিয়ে যাচ্ছিলো কেমন যেন। নওরিজ মাহবুবের কথায় যেন সে ধরতে পারলো তাকে কি কি করতে হবে! নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চায় তাঁর দিকে। সম্মুখে তুড়ি বাজিয়ে বলে,

-" ধানগড়ায় না গিয়ে মাটিতে নাম। সংস্থা পরিচালনা করবি কোথায় জায়গা ঠিক করেছিস?"

সিনান যেন ভাবনায় পড়ে। এ কথা তো তার মাথাতেই আসে নি। সে ঢের চিন্তায় পড়ে। জায়গা কোথায় পাবে। তাঁর তো বাড়ির ভিটে আর এই গ্যারেজের জায়গা ছাড়া মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। সে আমতা আমতা করে বলে,

-" আপনে এলাকার চেয়ারম্যানের পোলা। ভবিষ্যতের চেয়ারম্যান। আপনাকেই কোনো ব্যাবস্থা করে দিতে হবে রিজ ভাই!"

নওরিজ ছোট ছোট চোখে চায়। পল্টু ততক্ষণে চায়ের কাপ নিয়ে হাজির। হাতে আনে নি ট্রেতে করে এনেছে। হাতে আনলে অবশ্য নওরিজ মাহবুব ছুঁয়েও দেখতো না। খুবই খুঁতখুঁতে স্বভাবের কি না! সে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চায়ের দোকানের দিকে তাকায়। অনেকেই বসে চা গিলছে চুমুকে চুমুকে। নিশ্চয়ই এই কাঁপেও অনেকে চা খেয়েছে। তাঁর খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেলো। সে পল্টুর হাতে চা ধরিয়ে বলে,

-" তুই গিল। আমার দ্বারা হবে না এই চা গেলা!"

বলেই টিস্যু বের করে হাত মুছে নিলো। পল্টু পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী এঙ্গেলে মুখ ঘুরিয়ে ভেংচি কাটলো। আসছে নবাবের বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ হাইকমিশনার! অন্য কেউ হলে সিনান এক ধমকে ওই চা চুঙ্গা দিয়ে গলায় ঢালতো। তবে নওরিজ দেখে কিছু বললো না। মানুষ বরই স্বার্থান্বেষী কি না! সে গাড়ি ঠিক করে এসে ময়লা গামছায় হাতের কালি মুছতে মুছতে বলে,

-" কিছু বললেন না রিজ ভাই?"

নওরিজ পকেটে হাত পুরে সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে বলে,

-" এতে আমার কি লাভ?"

সিনানের মুখের আদল পরিবর্তন হয়। রাজনীতিতে জড়িত লোকেরা লাভ ছাড়া এককদমও এগোয় না। সে পল্টুর হাত থেকে চায়ের কাপ টেনে নিয়ে ঠোঁট চুবিয়ে বলে,

-" সবেতে লাভ খুঁজলে হয় রিজ ভাই? আর তাছাড়াও আপনি কি আমাকে হালকা ভাবে নেন না কি! এই সিনান সালেহর হাতের মুঠো খুব বড় না হলেও ছোটও নয়! সময় আসলে দেখতে পারবেন!"

নওরিজ পা বাড়ায় গাড়ির উদ্দেশ্যে। ঘারে হাত রেখে এদিকে ওদিকে মাথা বাঁকিয়ে বলে,

-" লাভ ছাড়া নওরিজ মাহবুব কিছুই করে না বুঝলি? সময় আসলে আমার লাভটুকু আমি চুমু দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবো!"

সিনানের ভ্রু কুঁচকে যায়। নওরিজ জিপে উঠে গাড়ি টান দিবে, গাড়ির ভিউ মিররে কারো ছোট্ট প্রতিবিম্ব দেখে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পরে। তড়িৎ গতিতে ঘার ঘুরিয়ে চায়। পরিপাটি চুল গুলো কপালে আছড়ে পড়ে। অধর কোণ বেঁকে যায় ক্ষীণকায়। অনাকাঙ্খিত দর্শন মন্দ নয়! সুরেলা মাথা নিচু করে ভাইয়ের গ্যারেজে ঢুকে যায়। বড়সড় একটা ভেংচি কাটতে ভুলে নি । তবে নেকাবের আড়ালে তা লুক্কায়িত ছিলো। সিনান অসময়ে বোনকে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,

-" এহানে কি চাই? বলছি না স্কুল বাড়ির রাস্তা ছাড়া এদিক সেদিক তাকাইলে ঘার ধইরা জামাই বাড়ি পাঠাই দিমু!"

ধমকে সুরেলা মুচকি হাসলো। ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মিনমিনে সুরে বলে, যেন ভাই ব্যতিত অন্যকেউ শুনতে না‌ পারে।

-" একটু দরকার আছিলো সিন ভাই! এখন কুদ্দুস চাচার দোকান থাইকা আগে চা পাউরুটি আনো খিদা লাগছে!"

সিনান ছোট ছোট করে চাইলে সুরেলা চোরা চোখে চেয়ে হাসলো। সিনান সালেহ বোনকে বসতে ইশারা করে পাশে কুদ্দুস চাচার চায়ের দোকানে গিয়ে মালাই চা বানাতে বলে। সুরেলা লাল টুলে বসে। ব্যাগটা কোলের মাঝে নিয়ে শফির সাথে সাথে গল্পে মেতে ওঠে। কোণা চোখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা জিপ গাড়ির স্টেয়ারিং এ বিদ্যমান বলিষ্ঠ বাহু জোড়ার মালিককে দেখে নেয়। ওই তো কেমন শকুনী নজরে তাকিয়ে আছে। যেন সে কোনো মুজলিম! সুরেলা ভাবে নুপুর জোড়া ফিরিয়ে দিবে এক্ষুনি। পরে ভাবে ভাই দেখলে এই নিয়ে অনেক কথা হবে। তবে এই ঝামেলা সে বাড়িও নিয়ে যেতে চায় না। মা দেখলে তো তাঁর গর্দান যাবে নিশ্চিত। সে শফিকে ইশারায় নওরিজ মাহবুবকে দেখায়। শফি হেসে নওরিজের দিকে তাকিয়ে বলে,

-" রিজ ভাই? গাড়ি ইস্টার্ট নেয় না? ধাক্কা দিমু?"

নওরিজ শক্ত মুখে তাকায় শুধু। কিছু বলে না। গাড়ি চালিয়ে চলে যায় ধুরুম ধাম। তার গাড়ির ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দে ও কালো ধোঁয়ায় সুরেলা মুখ বাঁকিয়ে বলে,

-" বড় লোকের রঙ ঢং দেখলেই মনে হয় কানের নিচে লাগাই একটা। শা*লা লুচ্চা কোথাকার!"

শফি হেসে ওঠে তাঁর কথায়। 

-" সুর আপা রিজ ভাই শুনলে তোমারে জুতার মালা পড়াইয়া পুরা এলাকা ঘুরাইবো! তারপর ওই গলায় কলসি বাইন্ধে নদীতে ফালাইবো। হেরে তো চিনো না!!"

সুরেলা শফির মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

-" হেরে ভালো কইরাই চিনি। অহংকার চুইয়া চুইয়া পড়ে হের গতর দিইয়া! সেইবার নির্বাচনের সময় আমগোরে বাত্তে গেছিলো না আব্বার লগে? মা তো পারে না জামাই আদর করে। আমার শখের মোরগ জবাই দিছিলো হের লাইগা। রান্না বান্না কইরা এতো সাধলো বান্দারে মানাইতে পারে নাই। এক গ্লাস পানি অবধি খায় নাই। আমরা গরিব বইলা কি পইচা গেছি ? হুঁ তুই বল শফি?"

-" রিজ ভাই খুঁত খুঁইতা মানুষ আপা। এট্টু আগেই তো চা চাইলো। দিলাম নাক সিঁটকায় কয় খাইবো না। সবসময়ই কেমন ফিটফাট হইয়া থাকে দেহো না?"

-" হ বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট!"

দু'জন ঘোর সমালোচনায় লিপ্ত হয়। নওরিজ মাহবুব নামক লোকটার দোষ গুণ বের করতে করতে একেবারে সাবান ছাড়া ধোপাগিরি করে বেড়ায়। তাদের সমালোচনায় দাড়ি বসাতে হয়ে সিনানের আগমনে। সিনান সালেহ হাতের মালাই চা এর কাপ সুরেলার দিকে বাড়িয়ে একটা টোস্টের প্যাকেট রাখে ব্যাগের উপর। সুরেলা খুশি মনে নেকাব মাথার উপর দিয়ে তুলে নেয়। টোস্টের প্যাকেট দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে দু'টো শফির হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটা চায়ের কাপে ডুবিয়ে মুখে পুরে। আর গোটাকয়েক টোস্ট ভাইয়ের দিকে বাড়ায়। সিনান গম্ভীর মুখে নাকচ করে বলে,

-" ব্যাগে ভরে নিয়া মায়েরে দিস কয়টা। আর কিসের দরকার তোর? গ্যারেজে আসতে মানা করছি না?"

-" দিমু নে! আর তুমি রাত্রে কইছিলা অংক প্রাইভেটের বেতন দিবা সকালে। কিন্তু তোমারে তো পাইলামই না। মাস শেষ হইছে। স্যার তাগাদা দিলো তো! আজ বিকেলে যামু তাই তোমার কাছে নিতে আইলাম!"

সুরেলা গড়গড় করে বলে আবারও চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। খিটখিটে মেজাজের সিনান সালেহের মেজাজ বিগড়ে যেতে সময় নেয় না। টাকার জন্য এসেছেন উনি! যেন সে টাকার গাছ লাগিয়েছে। যে যখন চাইবে দিতে হবে। সে খ্যাঁক করে বলে উঠলো,

-" আমি কি টাকা কামানের মেশিন নাকি? যখন তাখন হুকুম চালাইবি সক্কলে! পারমু না টাকা দিবার!"

সুরেলার মুখটা চুপসে যায়। মুখে থাকা খাবার গলায় আটকে গেলো যেন। সিনানের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ভাবে এবার বেতন দিয়ে সুরেলাকে মানা করে দেবে প্রাইভেট না পড়ার জন্য। মেয়ে মানুষ ওত পড়ে কি করবে? বাবা বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছে। তাছাড়াও এমন না যে সুর খুব মেধাবী ছাত্রী। টেনেটুনে পাশটা আনার মতো। তাঁর জন্য এতো খরচের মানেই হয় না। মাসে মাসে দেড়শ টাকা করে দিতে হয়! কম নাকি সেটা? তার উপর স্কুলের বেতন সহ আরও কত খরচ। কোনো মতে এসএসসি দিক সেই পাত্রস্থ করবে। সুরেলা আটকে থাকা খাবার গলাধঃকরণ করে। এক চুমুকে উসুম গরম চা গিলে নেয়। টোস্টের প্যাকেট ব্যাগে ভরে হাসি মুখে ভাইয়ের দিকে চায়।

-" কষ্ট কইরা এই মাসের বেতনটা দিও! পরের মাস থাইকা আর যামু না। বাত্তেই চেষ্টা করুম! ওহন আমি বাড়ি যাই! মা বানি চিন্তায় আছে!"

খিটখিটে মেজাজের সিনান মূক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। কিছুই বলে না। শান্ত চোখে একবার বোনের মলিন মুখখানি দেখে স্বীয় মুখ ফিরিয়ে নেয়। সুরেলা ক্ষণপল আশায় থাকে ভাই তাকে আটকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে,

-" এক থাপ্পড় দিমু সুর! প্রত্তিদিন যাবি প্রাইভেটে। জেএসসির মতো এবারও ফোর পয়েন্ট আনা চাই!"

কিন্তু তাঁর আশায় গুড়েবালি দিয়ে সিনান সালেহ কিছুই বলে না। এক অভিমানী কিশোরী রাগে ক্ষোভে হনহনিয়ে চলে যায় গ্যারেজ থেকে। চোখ জোড়া চিকচিক করে নোনা জ্বলে। আর সব মেয়েদের মতো সেও পরিবারের বোঝা বৈ আর কিছুই না। সুরেলা চলে গেলে সিনান শফিকে হুকুম তামিল করলো সুরকে যেন বাড়িতে রেখে তবেই ফিরে। শফি এতক্ষণ চুপচাপ দুই ভাই-বোনকে পরখ করছিলো। সিন ভাইয়ের আদেশ পাওয়া মাত্রই 'জে আচ্ছা' বলে ছুটে যায় সুরেলার পেছনে!

••••••••••

পুকুর ধারে দাঁড়িয়ে একাধারে সিগারেট টানছে কিছু যুবকের দল। সাদা ধোঁয়া নাক মুখে উড়িয়ে কিছু বলে একেকজন হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের কথা বলার ভঙ্গিমা যেমন বিশ্রী হাসিগুলোও তেমন জঘন্যতম। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া কিছু বাচ্চা মেয়েদেরকে দেখে তাদের বিশ্রী হাসি যেন বেড়ে যায়।

-" 'ও টুনির মা কাছে আসো? উত্তরপাড়া মেলায় নিয়া চুড়ি কিনা দিমু!"

বলেই বিশ্রী ইঙ্গিত করে। কয়েকশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে নওরিজ মাহবুব বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে তাদের কান্ড কারখানা দেখে। প্রায় সবগুলো কিশোর গোছের; কিছু সতেরো আঠারো হবে আর তিনজন তেইশ চব্বিশ হয়তোবা। বড় তিনজনকে চেনে নওরিজ। একজন অত এলাকার মেম্বরের ছেলে সেলিম রেজা অপর দু'জন ওর বন্ধু। ছেলে গুলো একেবারে উচ্ছন্নে যাওয়ার পথে। সে গাড়ি থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করে। একটা শলাকা ঠোঁটের ভাঁজে ফেলে লাইটার বের করে পকেট থেকে। সিগারেট জ্বালিয়ে সুখ টান দেয়। নাক মুখে ধোঁয়া ছেড়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছেলেদের উপর। বেয়াদব উটকো ছেলেগুলো তাকে লক্ষ্য করেও দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেট টানে আর উচ্চস্বরে হাসে। নওরিজ ভ্রু কুঁচকে চায়।সে ইচ্ছে পোষণ করে আরেকটু বাড়াবাড়ি করুক ওরা। সে গিয়ে গাল লাল করে আসবে। তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলো বোধকরি। সেলিম রেজা খারাপ ভাষায় গালি দেয়। যদিও সে স্পষ্ট শুনতে পায়নি তবে ছেলেটার ঠোঁট নাড়ানো তা স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। সে দু আঙুলের ভাঁজে সিগারেটের শলাকা নিয়ে এগিয়ে যায় ছেলেপেলেদের উদ্দেশ্যে। গমগমে সুরে প্রশ্ন করে,

-" মা***** কাকে বললি? কে বললি? এক বাপের ছেলে হলে আবার বল! আমিও শুনি একটু!"

উপস্থিত ছোকরা একটু হলেও ঘাবড়ে যায়। নওরিজ মাহবুবকে কে না চেনে! শান্ত মেজাজের তবে অতি ভয়ংকর মানব। সেলিম রেজা সিগারেটের শেষ টান নিয়ে তা মাটিতে ফেলে বলে,

-" রিজ ভাই আমরা নিজেরা নিজেরা কথা বলছিলাম! আপনারে কিছু বলি নাই‌..."

সাথে সাথেই শক্তপোক্ত হাতের শিকার হয়। সে হাতের থাবায় সেলিম রেজা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। চোখ বুজে শক্ত চোয়ালে গালে হাত রেখে মাথা নাড়লো ঘন ঘন। দাঁত কপাটি পিষ্ট করে বলে,

-" কাজ টা ঠিক করলেন না রিজ ভাই!"

নওরিজ অধর বাঁকিয়ে ক্ষীণ হেসে বলে,

-" আচ্ছা ঠিক করি নি। এখন কি করবি তুই?"

সেলিম রেজা কিছুই বলে না। এক দলা থুতু ফেলে পা বাড়াবে নওরিজ মাহবুব বলতে শুরু করে,

-" আর একবার তোর নামে মেয়ে রিলেটেড কোন অভিযোগ আমি পাই তোরে কুত্তার মতো পিটিয়ে গ্রাম ছাড়া করবো! ঘরে মা বোন নেই তোর? কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইলে চোখ দু'টোই উপড়ে দিবো! আর আজকের চরের কথা ভুলবি না নিশ্চয়।"

সেলিম রেজা অপমানে আর একদন্ডি দাঁড়ায় না। সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে প্রস্থান নেয় তৎক্ষণাৎ! নওরিজ পুড়ে যাওয়া সিগারেটের শলাকা ফেলে আবারও গাড়ির কাছে যায়। কাল মেয়েবাজটা রূপসাকে পেছন থেকে বাজে মন্তব্য করে ছিলো। তাছাড়া গ্রামের অধিকাংশ মেয়েই জা*নোয়ারটার উত্যক্তে অতিষ্ঠ। তাই একটু বাজিয়ে নিলো। আবার ধরলে কুঁচি কুঁচি করে ছাড়বে। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মাটির রাস্তার দিকে তাকায়। কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেখা মিলে না। আর কিছু পল অপেক্ষা করার পর তাঁর দেখা না মেলায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির দেখা মিলে তন্মধ্যে। গম্ভীর মুখে হাসির রামধনু রঙ ছড়ালো বুঝি? ওই তো সুরেলা সালেহ। সে হাতের সিগারেটের দিকে তাকায়,

-" পানসে হয়ে গেলি কিভাবে তুই? ছেঃ!"

বলেই ছুঁড়ে ফেলে শলাকা। লম্বা শ্বাস টেনে গলা উঁচিয়ে ডাক হানে,

-" এই সুর? শুনে যা! কখন থেকে অপেক্ষায় আছি!"

রাস্তার এক ধারে নত মুখে হাঁটা সুরেলার কানে বাজে তাঁর ডাক তবে ফিরেই তাকায় না নওরিজ নামক লোকের দিকে। নত মাথায় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলে যায় আপন মনে। তাঁর পিছনে হেলেদুলে শফি হাঁটে। নওরিজের ডাকে হাত নাড়িয়ে সালাম দেয়। নওরিজ ভাবে শফির কারণে দাঁড়ায় নি। সে বড় বড় পা ফেলে নিজেই সুরেলার সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। শান্ত চোখে চেয়ে বলে,

-" ফকিন্নীর ঝি কখন থেকে ডাকছি কানে যাচ্ছে না?"

সুরেলা চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে।‌ফকিন্নীর ঝি ডাকটা তাঁর খুবই বাড়াবাড়ি রকমের অপছন্দ।
তাঁর দাদার মা নাকি কোন কালে পাগল হয়ে অন্যের দোরগোড়ায় ভিক্ষা করে বেড়াতো। তাই গ্রামের বুড়ো ধামরা কিছু লোক ফকিন্নীর ঝি বলে ডাকে। সুরেলা নওরিজকে পাশের কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। নওরিজ আবারও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সুরেলা ক্ষ্রিপ্ত সুরে খেকিয়ে বলে,

-" এল্লা কেমন অসভ্যতামি রিজ ভাই? আপনে চেয়ারম্যানের পোলা তাই আপনার দিকে কাঁদা না ছুঁড়লেও আমার দিকে গু ছুঁড়ে মারবো গ্রাম বাসি!"

নওরিজ মাহবুব নাক সিঁটকায়; যেন গু তাঁর নাকে এসে ছিটকে লাগলো। সুরেলা বিরক্ত মুখে চায়। শফি নীরব হয়ে চতুর চোখে সবটা অবলোকন করে। ওই তো রিজ ভাই কেমন করে সুর আপার পানে তাকিয়ে আছে? তাঁর কিশোর মন অনেক কিছুই বুঝে নেয়। নওরিজ মাহবুব নাক সিঁটকিয়ে গমগমে আওয়াজে প্রত্যুত্তর করলো,

-" কোথায় অসভ্যতামী! ফর গড সেঁক আমার সামনে এইসব ছিঃ মার্কা কথা বলবি না!"

শফি, সুরেলা ড্যাব ড্যাব করে তাকায়। তাঁর অর্ধেক কথা দু'জনের মাথায় ঢুকেই নি। ছাতি মার্কা, বালতি মার্কা, আরো কত মার্কা শুনেছে তাঁরা কিন্তু ছিঃ মার্কা কখনোই শোনে নি। এটা আবার কেমন মার্কা ভাই? শফি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে উঠলো,

-" ছিঃ মার্কা কথা আবার কি? গু রে কইছেন? গু'র আবার মার্কা আছে? কুত্তার গু, মুরগির গু, মানুষের গু.."

-" এক থাপ্পড়ে কবরস্থানে পাঠিয়ে দিবো আহম্মক!"

নাক মুখ বিকৃত করে গমগমে সুরে ধমক দেয় নওরিজ মাহবুব। গা তাঁর গুলিয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। শফি যেন আরও মজা পেলো। গাল বাড়িয়ে বলে,

-" আরেকটু জোড়ে মাইরা আমাগোরে বাড়ি পাঠাই দেন! হাঁটবার মন চায় না!"

সুরেলা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নওরিজ মাহবুবের বদনখানা দেখার মতো হয়েছে। শফিও সুরেলার সাথে সুর মিলালো। নওরিজ মাহবুব ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুরেলা ভেংচি কেটে শফির এক হাত ধরে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু শফি হাঁটে না। সে পিছনে চাইতেই নজরে আসে শফির অপর হাত বলিষ্ঠ মুঠোয় আটকে আছে। শফি অসহায় চোখে তাকায় নওরিজের দিকে। সে তো সিধে সাদা মনে মজা করলো! এখন তাকে আছাড় মেরে পুকুরে না চুবিয়ে ধরে। সে আমতা আমতা করে বলে

-" ও রিজ ভাই কিছু কইবেন? সুর আপারে বাত্তে দিয়া আসি ।চাচি চিন্তা করতেছে মনে হয়!"

-" আমি দিয়ে আসবো সুরকে। তুই ভালোয় ভালোয় কেটে পর! নইলে এক চরে দিন দুনিয়া ভুলে রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াবি।"

শফির মুখখানা চুপসে যায় নওরিজ মাহবুবের ধমকে। তবে সুর আপাকে সে রিজ ভাইয়ের সাথে একা মোটেই ছাড়বে না। পরপুরুষের সাথে ঘরের মেয়েকে পাঠিয়ে দিবে না কি!! সে হঠাৎই বড়দের মতো করে বলে উঠলো,

-" রিজ ভাই সে আপনে মারেন আর যাই করেন। সুর আপারে আমিই বাত্তে রাইখা আসুম। আমার বড় বোনের লাহান ও!"

সুরেলা হৃদয় খানিই ভালো লাগার আবেশে ভরে যায়। রক্তের সম্পর্ক নেই তো তাদের মধ্যে! প্রতিবেশী তাঁরা। তাতেই ছেলেটা কতটা দায়িত্ববোধ দেখালো! এই বেঈমানির যুগে কে দেখায় এতোটা সোহাগ? সুরেলা শফিকে টেনে নওরিজের উদ্দেশ্যে বলে,

-" রিজ ভাই আপনে ভাবলেন কেমনে যে আমি আপনের লগে যামু? শফিরে ছাড়েন কইতেছি?"

নওরিজ শফিকে নিজের পাশে দাঁড় করায়। কাঁধ চাপড়ে গম্ভীর সুরে আওড়ায়,

-" সুর বড় বোনের মতো! আপা ডাকিস তাই তো?"

-" হ! আমার বড় আপা লাগে!"

-" ভালো। তোর আপার বরকে কি বলে ডাকবি?"

-" দুলাভাই!"

নওরিজের গম্ভীর মুখশ্রী পরিবর্তন হয় নিমিষেই। আড়চোখে নেকাবে মুড়ে থাকা মানবীকে দেখতে ভোলে না। ওই তো ইন্দ্রজালে টানা কান্তিমান হরিণী নয়ন যুগলের তেজস্বী চাহনিও নজরকাড়া! সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একশত টাকার কচকচে নোটটা শফির পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,

-" সম্বোধনে খুশি হলাম! মানে মানে কেটে পর জলদি! এদিক ওদিক ঘুরে একটু পরেই যাস গ্যারেজে। আর ওই খিটখিটে মেজাজের সিনানের কানে গেলে তেরোটার খবর দেখিয়ে দিবো! যাহ্?"

শফি প্রথমে হাবলার মতো মাথা নাড়লেও পরবর্তীতে বোকা মনটা বুঝতে পেরে লাজুক হাসলো। মাথা চুলকিয়ে সুরেলার দিকে তাকিয়ে বলে,

-" সুর আপা আমি গেলাম। দুলাভাইরে আমার ভারি পছন্দ!"

বলেই দৌড়ে ছুটে যায়। সুরেলা দাঁত কিড়মিড় করে। একটু আগে না খুব দায়িত্ববোধ দেখাচ্ছিল! এখন পকেটে কচকচে নোট আসতেই দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিলো? পিঠের চামড়া তুলে লবণ লাগাবে সুরেলা।

-" ওই ফকিন্নীর ঝি? হাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা গাড়িতে ওঠ?"

সুরেলা স্বীয় ব্যাগ হাতরে নুপুর জোড়া বের করে বাড়িয়ে দেয় সম্মুখে দন্ডায়মান মানবের দিকে। শান্ত সুবোধ বালিকার মতো আওড়ায়,

-" রিজ ভাই ফকিন্নীর ঝি ডাকবেন না। আর মাফ করবেন আমি আপনের সাথে যাব না। আর এইডাও নিতে পারবো না। ধরেন?"

নওরিজ মাহবুব ভ্রু কুঁচকে চায়। বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মুঠোয় নুপুর জোড়া দেখে বলে,

-" সেদিন আমি দিয়েছিলাম তুই নিয়েছিলি? তাহলে আমি নিবো কেন? আর সবচেয়ে বড় কথা আমি পুরুষ মানুষ নুপুর পায়ে পড়বো নাকি? দুই একটা বউও নেই যে তাকে পড়াবো!"

-" কথা পেঁচাইবেন না। বউ নাই যখন বিয়ে করে বউরে পড়াইয়েন শখ কইরা! রূপসার ফর্সা পায়ে খুব মানাইবো।"

নওরিজ প্রশ্নাত্মক চোখে ভ্রু কুঁচকে চায়। নুপুর জোড়া নেয় না। সুরেলার ওত ধৈর্য নেই। সে নুপুর জোড়া ছুঁড়ে ফেলে হনহনিয়ে চলে যায় নিজ রাস্তায়। নওরিজের গম্ভীর মুখের আদল শক্ত দেখায়। দাঁতে দাঁত পিষে অপমান গিলে নিয়ে বালিতে গড়াগড়ি খাওয়া নুপুর জোড়া তুলে পকেটে পুরে গাড়ি স্টার্ট দেয়। দূর চড়ায় বাঁশের তৈরি মাচালে বসে কতকগুলো চোখ এতক্ষণ তাঁদেরই লক্ষ্য করছিল সেটা অভিজ্ঞ নওরিজ মাহবুবের অগোচরেই রয়ে যায়।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp