স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা - পর্ব ১০ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


চিংকির ছটফটানি দেখে জাওয়াদ স্বর খাদে নিয়ে বলল,
 “দীপশিখা, আমি কিন্তু তোমার ছটফটানি থামানোর উপায় জানি। উপায়টা তোমার পছন্দ হবে না, তাই ভদ্র মেয়ের মতো বসো।”

জাওয়াদের স্বর মস্তিষ্কে আন্দোলিত হলো। জমে গেলো চিংকি। বড় বড় চোখে তাকালো সে। জাওয়াদের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। হ্যান্ডেলবারে ঝুলানো একটি হেলমেট পড়িয়ে দিলো চিংকিকে। খানিকটা ঝুঁকে চিংকির মুখ বরাবর মুখে এনে বললো,
 “শক্ত করে ধরে রাখবে, পড়ে গেলে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”

চিংকির উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। বাইকে বসে স্টার্ট দিলো। নক্ষত্রখচিত শীতল দীর্ঘায়িত রাতে পিচের রাস্তা চিরে তীব্র বেগে চলছে জাওয়াদের বাইক। চিংকি শক্ত ধরে জড়িয়ে রেখেছে তার কোমড়। চোখ বন্ধ। শীতল হাওয়া তীব্র বেগে ছিটকে পড়ছে শ্যাম মুখে। জাওয়াদের এক হাত তার ভয়ের কম্পনরত হাতজোড়া ধরে রেখেছে। প্রায় মানবশূন্য রাস্তায় বাইক চালানোর মজাই আলাদা। একটু পর পর সোডিয়ামের আলো ছুয়ে যাচ্ছে তাদের। তারপর আবার আঁধার। চিংকি কাঁপা স্বরে বললো,
 “আস্তে চালান।”
 “পারবো না, শাস্তি কখনো আস্তে দিতে শুনেছো?”
 “আপনি খুব খারাপ।”
 “জানি, নতুন কিছু বলো।”

বলেই হাসলো জাওয়াদ। চিংকির মনে হলো মানুষটি পাগল হয়ে গেছে। ঠান্ডায় তার মস্তিষ্ক জমে গেছে। তাই নিউরণগুলো কাজ করছে না। জাওয়াদ প্রায় চিৎকার করে বললো,
 “দীপশিখা, চোখ খুলো। দেখো, রাতটা কত সুন্দর!”

জাওয়াদের আশ্বস্ত স্বরে পিটপিট করে চোখ খুললো চিংকি। সে জানে না ঠিক কোথায় আছে তারা। তবে চেনা শহরটাকে অচেনা লাগলো যেন। কালো নীলাম্বরে থালার মতো বিশাল একটা চাঁদ। মেঘহীন আকাশে তারা গুলো অলংকৃত করে আছে। বিশালকায় রাস্তায় কুয়াশার সাথে প্রতিযোগিতা করছে জাওয়াদের বাইক। পাশ থেকে চলে যাওয়া গাড়ির হেডলাইট গুলোয় ধোঁয়া উড়ছে। কুয়াশাকনায় শীতল হয়ে যাচ্ছে হাত, নাক, মুখ। মনে হলো কোনো ব্যথিত প্রেমিকের গদ্য পড়ছে যেন। চিংকির মস্তিষ্কে ভেসে উঠলো চেনা গান,
 “এই ধুলো-ধুলো শহর তোমার আমার।
আসতে পারো, চলে যেতে পারো।
এ পৃথিবীর বিষণ্ণ ধুলোয় মিশে যেতে পারো।
তবু, এই বিষাদগ্রস্ত মেঘময় প্রাচীন শহর।
বারবার তোমাকে ফিরে পেতে চাইবে……”

জাওয়াদ এক অচেনা বিল্ডিং এর সামনে বাইক থামালো। চিংকি অবাক স্বরে বললো,
 “এটা কোথায়?”
 “আমাদের বাড়ি।”

চিংকি অবাক দৃষ্টিতে চাইলো। জাওয়াদ নরম স্বরে বললো,
 “নামো।”

চিংকি একরাশ জড়তা নিয়ে নামলো। তার মুখখানা জমে গেছে শীতে। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। জাওয়াদ তার বাইক পার্ক করে আসলো। চিংকিকে ভুতের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব যত্নে তার হেলমেট খুললো। হাত ধরে বললো,
 “চলো।”
 “এটা আপনাদের বাড়ি?”

বিল্ডিংটি এখনো আন্ডার কন্সট্রাকশনে আছে। সাত তালার উপর শুধু ইটের গাঁথুনি। একটা মানুষের ছায়াও নেই। চিংকির চোখে মুখে দ্বিধা। জাওয়াদ হেসে বললো,
 “ভয় নেই, তোমাকে মেরে টেরে দিবো না।”
 “আপনার কি ভরসা?”

জাওয়াদ হাসলো কিন্তু উত্তর দিলো না। তারপর হাত ধরে সিড়ি বেয়ে উঠলো তারা। খুব সাবধানে জাওয়াদ চিংকিকে ধরে ধরে উঠালো। সিড়ি বাইতে বাইতে হাঁপিয়ে গেলো চিংকি। শরীরটা একটু কমাতে হবে। সাত তালা উঠা কি চারটেখানি কথা। সাততালায় কোনো দেয়াল নেই। শুধু ইটের গাঁথুনি। এখান থেকে আকাশটা যেন আরোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ধোঁয়ার মতো কুয়াশার পরদে ঝাপসা লাগছে রুপালী চাঁদটা। জাওয়াদ একেবারে কোনায় গিয়ে একটি চেয়ার টেনে বসলো। চিংকি ঘাবড়ে বললো,
 “করছেন কি? পড়ে যাবেন তো।”
 “পড়বো না আসো তো। আজ জ্যোৎস্নাবিলাস করবো।”

ঠান্ডায় এই লোকের মস্তিষ্ক একেবারে গেছে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক ভয়ে ভয়ে চিংকি বসলো। ঠান্ডা বাতাস মুখে লাগছে। নীরব, শান্ত, মায়ানগরীকে এই প্রথম দেখছে। মাথার উপর ছাঁদ আছে তবুও দেয়ালহীন জায়গাটিকে মেঘের উপর মনে হচ্ছে। জাওয়াদ এক নজরে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। চিংকি গম্ভীর স্বরে বললো,
 “কি কথা বলবেন বলুন।”
 
কিছুসময়ের নীরবতা। চিংকিও কথা বললো না। নীরবতা ভাঙলো জাওয়াদ, 
 “সরি!”

চিংকির মনে হলো সে কি ভুল শুনলো? কান ঠিক আছে? জাওয়াদ যে কি না নাক আইফেল টাওয়ারে রেখে চলে সে তাকে সরি বলছে? অবাক স্বরে শুধালো,
 “জি?”
 “তখন ওভাবে আমার রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি।”

গাঢ়, ম্লান স্বরে নীরবতাটা আরোও ঘন হলো। শীতল পরিবেশে বিষাদ ঢেলে দিলো যেন কেউ। চিংকি অপ্রস্তুত হলো। কোনো কথা বলতে পারলো না। জাওয়াদ নিজ থেকেই বললো,
 “আমি সহজে রাগী না। আমার গন্ডারের চামড়া। তখন সেভাবে রেগে যাওয়াটাও খুব বেমানান আমার স্বভাবের সাথে। তবুও আমি রেগেছি। কেনো জানো?"
 "কেনো?"

আবছা স্বরে শুধালো চিংকি। জাওয়াদ ম্লান হেসে বললো,
 "কারণ তোমার মধ্যে আমাকে দেখতে পেয়েছিলাম।"
 
আবার তিক্ত নীরবতা। জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,
 “আমি ছোটবেলা থেকেই খুব জনপ্রিয় ছিলাম জানো? ইচ্ছে করে না। অজান্তেই মানুষ আমাকে খুব পছন্দ করতো। আমার সাথে মিশতে চাইতো। আমি বাঁধা দিতাম না। বন্ধু কার না পছন্দ! আর আমি ছিলার এক্সট্রোভার্ট। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে আমার গলার কাঁটা হতে থাকলো। অতিরিক্ত ভালোবাসা, জনপ্রিয়তা মাঝে মাঝে অন্যের ঈর্ষার কারণ হয়। সেই ঈর্ষাগুলো প্রতিহিংসায় সীমাবদ্ধ থাকে না। একটা সময় ঘৃণা হয়ে যায়। তুমি বুঝতেও পারো না, কেউ তোমাকে নিজের পুরোটা হৃদয় দিয়ে ঘৃণা করছে। মুখে হাসি ঝুলিয়ে তোমাকে প্রতি মুহূর্তে বদদোয়া দিচ্ছে। তোমাকে অপদস্ত করে নিজের অন্তরাত্মাকে প্রসন্ন করছে। কতটা ভয়ংকর বলতো! যার কোনো ক্ষতি তুমি করনি, শুধুমাত্র তোমাকে মানুষ ভালোবাসে বলে তুমি তার চক্ষুশূল। তাই তোমাকে ঘিরে মৌমাছির ঝাঁক থাকলেই, তোমাকে অজস্র মানুষ ভালোবাসলেই তুমি খুব হ্যাপি-- তত্ত্বটা ভুল। আমি হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছি। আমার ইন্টারের ফেয়ারওয়েলের দিনটাই স্মৃতিটাই বিষাক্ত হয়ে গেছে!”

ইন্টারের ফেয়ারওয়ালের কথাটা শুনতেই জমে গেলো চিংকি। অব্যক্ত অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে। এই দিনটাতেই মনের অভিব্যক্তি বলেছিলো জাওয়াদকে। হাত-পা জমে গেলো। দাঁত দিয়ে ক্ষতবিক্ষত হলো তার নিম্নোষ্ঠ। জাওয়াদ তার দিকে তাকালো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষন্ন স্বরে বলল,
 “আমার একটা বন্ধু ছিলো, স্কুলে বন্ধু। ও খুব ইনসিকিউর ছিলো। চেহারা সুরত মোটামুটি ছিলো, ছাত্রও মোটামুটি ছিলো। তবুও সে খুব ইনসিকিউর ছিলো। আমি জানি না কেন, আমাকে সে সহ্য করতে পারতো না। একই সাথে উঠা-বসা, চলা-ফেরা কিন্তু আমার প্রশংসা, আমাকে নিয়ে আলোচনা ওর সহ্য হত না। একটা সময় এলো যখন সুযোগ পেলেই আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলা শুরু করতো। আমি পাত্তা দিতাম না। আমার অহেতুক নিজের রেপুটেশন নষ্ট করার ইচ্ছে ছিলো না। ভালো ছেলের ট্যাগ হারানোর ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম অপর মানুষটির প্রশান্তি আমাকে নিচে নামানোতে। সেদিন বহু প্রেমপত্র পেয়েছিলাম, তারমধ্যে একটা মেয়ে আমাকে সবার সামনে থেকে টেনে এক চিপায় নিয়ে গিয়েছিলো।”

বলেই আড়চোখে তাকালো চিংকির দিকে। চিংকি তখন কাচুমাচু হয়ে বসে রয়েছে। জাওয়াদ একটু হেসে বলল,
 “তো অই মেয়ে যখন আমাকে চিপায় নিয়ে গেলো, এটা আমার বন্ধুদের মধ্যে ব্রেকিং নিউজ হলো। আমার সেই বন্ধু ভাবলো সেই মেয়েটি আর কেউ নয় বরং তার ক্রাশ। কারণ দূর্ভাগ্যবশত সে যে মেয়ের উপর ক্রাশিত, সে আমার উপর ক্রাশিত। এই ভুল বোঝাবোঝির মধ্যে সে নিজেকে মিশা সওদাগর ভাবা শুরু করলো। বন্ধু আমার নিজেকে আটকাতে পারলো না। পুরো কলেজের সামনে আমাকে অপমান করাই তার লক্ষ হলো। আমি যখন প্রেমপত্রগুলো নিয়ে ক্লাসে গেলাম সে অতর্কিতে আমাকে মেরে বসলো। সবার সামনে তার এলিজিটলি প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপবাদ দিলো। চিৎকার করে সবাইকে বললো, আমি বন্ধু নামের কলঙ্ক। বন্ধু হয়ে তার পিঠে চুরি দিয়েছি। জানা সত্ত্বেও ও যাকে পছন্দ করে তার সাথে ফ্লার্ট করেছি ব্লা ব্লা ব্লা… ফলে অবাক দর্শকের মতো ক্লাসের সবার চোখ আমার দিকে। তারাও কোথাও না কোথাও মেনে নিলো আমি নিম্ন মানসিকতার মানুষ যে বন্ধুদের ঠকাই। আমার বন্ধু ভাবলো সে জনগণের সামনে হিরো হয়ে গেছে। ফলে সে আবার আমাকে মারলো। একপর্যায়ে আমিও শান্ত থাকতে পারলাম না। ফলে জীবনে যা কখনো আমি করি নি সেদিন তাই করলাম। আমার কলেজের শেষদিন আমি মারপিট করলাম। প্রিন্সিপাল স্যার ডেকে নিয়ে গেলেন। দুজনকেই শাসালেন। আমার ফেয়ারওয়েল জলে। ইট ওয়াজ দ্যা ওরস্ট ডে। আমি মনেও করতে চাই না দিনটাকে। সেদিন একটা সত্যি বুঝতে পারলাম। মানুষ তোমার সাথে হেসে কথা বলছে মানে এই না যে তোমার বন্ধু। আর এইসব বিষধর সাপদের যত প্রশ্রয় দিবে তখন জোরে এরা ছোবল দিবে। তাই আমি সবার সাথে হেসে কথা বললেও আমি একজন বন্ধুহীন প্রাণী। আমি জানি সবাই আমার বাহিরের খোলশটা দেখেই আকর্ষিত হয়। কেউ আমাকে বোঝার জন্য আমার সাথে বন্ধুত্ব করে না। এই যে তুমি, তুমিও হয়ত কোথাও না আমার বাহিরের খোলশটাতেই আকর্ষিত।”

জাওয়াদের কথাটি শেষ হবার পূর্বেই চিংকি দুহাতে তার গালজোড়া চেপে ধরলো। দৃঢ় স্বরে বললো,
 “মোটেই নয়। আমি কখনোই আপনার বাহিরের খোলশ দেখে আকর্ষিত হয়নি। আমি আপনাকে আপনার জন্য পছন্দ করি। আমার কিচ্ছু যায় আসে না আপনি দেখতে কেমন, আপনি খুব ভালো ছাত্র নাকি খুব টাকা কামান। আমার যায় আসে না।”

চিংকির কথাটা সান্ত্বনার জন্য ছিলো না। জাওয়াদের ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়লো প্রসন্ন হাসি। মৃদু স্বরে বললো,
 “সত্যি?”
 “হ্যা।”
 “তাহলে তুমি আমাকে পছন্দ কর বলো……………
.
.
.
চলবে...................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন