নিশীথিনী - পর্ব ০৪ - হুমায়ূন আহমেদ - ধারাবাহিক গল্প


সাইকোলজি বিভাগের সভাপতি ডঃ সাইদুর রহমানের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। মেজাজ খারাপের প্রধান দুটি কারণের একটি হচ্ছে–সুইডেনে একটি কনফারেন্সে তাঁর যাবার খুব শখ ছিল, কিন্তু আমন্ত্রণ আসে নি। তিনি চেষ্টা তদবিরের তেমন কোনো ত্রুটি করেন নি। যেখানে একটা চিঠি দেয়া দরকার, সেখানে তিনটি চিঠি দিয়েছেন। প্রফেসর নোয়েল বার্গকে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের নমুনা হিসাবে একটি চটের ব্যাগ পাঠিয়েছেন, যেটা কিনতে তাঁর তিন শ’ টাকা লেগেছে। রাজশাহীতে তৈরি খুব ফ্যান্সি ধরনের ব্যাগ। প্রফেসর নোয়েল বার্গ একটি চিঠিতে ব্যাগের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, কিন্তু বহু প্রতীক্ষিত নিমন্ত্রণের চিঠি পাঠান নি।

সাইদুর রহমান সাহেবের মেজাজ খারাপের দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে–মিসির আলি-সংক্রান্ত সমস্যা। মিসির আলি লোকটিকে তিনি মনেপ্রাণে অপছন্দ করেন। পার্টটাইম টীচার হিসেবে মিসির আলির অ্যাপয়েন্টমেন্টের বিপক্ষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। লাভ হয় নি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। এবং অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় ভাইস-চ্যান্সেলর সাহেব বলেছেন, কোনো পোস্ট অ্যাডভারটাইজ হওয়ামাত্র তাঁকে নেয়া হবে। সাইদুর রহমান সাহেব গত দু’ বছরে কোনো পোস্ট অ্যাডভারটাইজড হতে দেন নি। এডহক ভিত্তিতে এক জনকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন।

তাঁর ধারণা ছিল এডহক অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে মিসির আলি হৈচৈ করবেন। কিন্তু মিসির আলি কিছুই করেন নি। এটাও একটা রহস্য। এই লোকটির কি জীবনে উন্নতি করবার কোনোরকম ইচ্ছা নেই, না তার সবটাই ভান?

মিসির আলির ওপর আজ ভোরবেলায় তাঁর রাগ চরমে উঠেছে। কারণ তিনি দেখেছেন, সুইডেন থেকে মিসির আলির নামে একটি খাম এসেছে। তাঁর ধারণা, এটা কনফারেন্সের নিমন্ত্রণপত্র। কারণ, প্রেরকের নামের জায়গায় প্রফেসর নোয়েল বার্গের নাম আছে। প্রফেসর নোয়েল বার্গ হচ্ছেন কনফারেন্সের আহ্বায়ক।

সাইদুর রহমান সাহেব অফিসে খোঁজ নিলেন–মিসির আলি এসেছেন কি না। জানা গেল, তিনি এসেছেন। কাজেই সুইডেনের সেই খাম নিশ্চয়ই খোলা হয়েছে। সাইদুর রহমান সাহেব হেড ক্লার্ককে বললেন, ‘মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে যদি দেখা হয়, তাহলে বলবেন, আমি খোঁজ করছিলাম।

‘জ্বি আচ্ছা স্যার।’

‘তাঁকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না। ডিপার্টমেন্টে আসেন না নাকি?’

‘ক্লাস না থাকলে আসেন না।’

‘গতকাল এসেছিলেন?’

‘জ্বি, গতকাল এসেছিলেন। এক জন ছাত্রীর ঠিকানা খুঁজে বের করবার জন্যে খুব হৈচৈ করলেন।’

‘তাই নাকি?’

‘জ্বি স্যার। নীলুফার ইয়াসমিন। সে দেড় বছর ধরে ইউনিভার্সিটিতে আসে না, এখন তার ঠিকানা খোঁজার জন্যে যদি অফিসের সব কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে তো মুশকিল।’

‘কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হবে কেন? এ-সব পার্সোনাল কাজের জন্যে তো অফিস না। আপনি স্ট্রেইট বলে দেবেন।’

‘জ্বি আচ্ছা স্যার।’

‘তা ছাড়া এক জন টীচার ছাত্রীর ঠিকানার জন্যে ব্যস্ত হবে কেন? এ-সব ঠিক না। নানান রকমের কথা উঠতে পারে।’


মিসির আলি ভেবেই পেলেন না, ইউনিভার্সিটির এক জন ছাত্রীর ঠিকানা বের করা এত সমস্যা হবে কেন? অফিসে নেই। অফিস থেকে বলা হল, সমস্ত রেকর্ডপত্র ডীন অফিসে। ডীন অফিসে গিয়ে জানলেন, রেকর্ডপত্র আছে রেজিস্ট্রার অফিসে। রেজিস্ট্রার অফিসে যে কেরানি এসব ডীল করে, দু’ ঘন্টা অপেক্ষা করেও তার দেখা পাওয়া গেল না। সকালবেলা সে নাকি এসেছিল। চা খেতে গিয়েছে। মিসির আলি রেজিস্ট্রার অফিসের ক্যান্টিনেও খুঁজে এলেন। দেখা পাওয়া গেল না। আবার আসতে হবে আগামীকাল।

ডিপার্টমেন্টে ফিরে এসে শুনলেন–সাইদুর রহমান সাহেব তাঁকে খোঁজ করেছেন। মিসির আলি বিস্মিত হলেন। সাইদুর রহমান সাহেব তাঁকে পছন্দ করেন না। বড় রকমের প্রয়োজনেও তাঁর খোঁজ করেন না। আজ করছেন কেন?

‘স্লামালিকুম স্যার।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

‘আপনি কি আমার খোঁজ করছিলেন?’

‘বসুন মিসির আলি সাহেব। আছেন কেমন?’

‘ভালো।’

মিসির আলি বসলেন।

‘কি জন্যে ডেকেছিলেন?

‘তেমন কিছু না।’

সাইদুর রহমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। সুইডেনের চিঠির প্রসঙ্গ তুলবেন কি না বুঝতে পারলেন না। তুললেও এমনভাবে তুলতে হবে, যাতে এই লোক বুঝতে না পারে, তিনি এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী।

মিসির আলি বললেন, ‘স্যার, আপনি কি কিছু বলবেন?’

‘তেমন ইম্পর্টেন্ট কিছু না। সুইডেনের কনফারেন্সের খবর কিছু জানেন? মানে আমার যাবার কথা ছিল। পেপারের অ্যাবস্ট্রাক্ট পাঠিয়েছিলাম প্রফেসর নোয়েলের কাছে।’

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, ‘আমি ওদের ইনভাইটেশন পেয়েছি। পেপার দেবার জন্যে বলছে।’

‘তাই নাকি?’

সাইদুর রহমান সাহেব নিভে গেলেন। টেনে-টেনে বললেন, ‘যাচ্ছেন কবে নাগাদ এক সপ্তাহের ভেতরই তো রওনা হওয়া উচিত?’

‘আমি যাচ্ছি না স্যার।’

‘কেন?’

‘আমার কাজের মেয়েটি অসুস্থ।’

সাইদুর রহমান সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কাজের মেয়ে অসুস্থ, এই জন্যে সে সুইডেন যাবে না। বদ্ধ উন্মাদ নাকি!

‘কাজের মেয়ে অসুস্থ, সেই কারণে যাচ্ছেন না?’

‘ওটা একটা কারণ। তা ছাড়া অন্য একটি কারণ আছে।’

‘জানতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই পারেন। আমি এক জন রোগীর মনোবিশ্লেষণ করছি। এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।’

‘সত্যি বলছেন?’

মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘মিথ্যা বলব কেন?’

‘আপনি কি আপনার ডিসিসন ওদেরকে জানিয়েছেন?’

‘আজই তো মাত্র চিঠি পেলাম।’

‘তবু আপনার উচিত ইমিডিয়েটলি আপনার ডিসিসন ওদের জানানো। হয়তো ওদের কোনো অলটারনেট ক্যানডিডেট আছে।’

‘স্যার, আপনার কি সেখানে যাবার ইচ্ছা? ইচ্ছা থাকলে বলেন।’

‘বলব মানে, আপনি কী করবেন?

‘নোয়েল আমার বন্ধুমানুষ। ইংল্যাণ্ডে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আমার তিনটা পেপার আছে, যেখানে নোয়েল হচ্ছে এক জন কো-অথর। আপনার বোধহয় চোখে পড়ে নি।’

সাইদুর রহমান সাহেবের মুখ তেতো হয়ে গেল। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘সুইডেন কি একটা যাওয়ার মতো জায়গা? আছে কি সেখানে, বলুন? দেখার কিছু আছে? কিছুই নেই। একটা ফালতু জায়গা।’

‘দেখাদেখিটা তো ইম্পর্টেন্ট নয়। সেমিনারটাই প্রধান। সারা পৃথিবী থেকে জ্ঞানীগুণীরা আসবেন।

‘ঐসব কচকচানি শুনে কোনো লাভ হয়? কোনোই লাভ হয় না। শুধু বড়-বড় কথা।’

‘এটা ঠিক বললেন না। সেখানে যাঁরা আসবেন, তাঁরা কথার চেয়ে কাজ অনেক বেশি করেন। বিশেষ করে এমন কিছু লোকজন আসবেন, যাঁদের দেখলে পুণ্য হয়।’

‘আপনিও তো ওদের নিমন্ত্রিত, তার মানে বলতে চাচ্ছেন, আপনাকে দেখলেও পুণ্য হবে?’

মিসির আলি একটু হকচকিয়ে গেলেন। পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘তা হবে। আপনি অনেকক্ষণ আমাকে দেখলেন। অনেক পুণ্য করলেন। উঠি স্যার?’

ডঃ সাইদুর রহমান বহু কষ্টে রাগ সামলালেন। মনে-মনে এমন কিছু গালাগালি দিলেন, যা তাঁর মতো অবস্থার ব্যক্তিরা কখনো দিতে পারে না। এর মধ্যে একটি গালি ভয়াবহ।
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন