কামিনী - পর্ব ০৭ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


 ফুরফুরে শীতল পবনে রানির শরীরে কম্পন ধরে খানিক। গত একদিনের আসা-যাওয়ায় বেশ ক্লান্ত অনুভব করেন শরীরে। তাছাড়া রাজ ঘোড়াটাও তো কতটা পথ, কতটা সময় যাবত ছুটেছে। 
রাজ প্রাসাদের খানিকটা দূরে এসেই থেমে যান রানি। নিজের ঘোড়াটাকে থামান। একটা বাদামি রঙের ফতুয়া গা দেওয়া কোঁকড়া চুলের, সুঠাম দেহী পুরুষকে দেখা যায় রাজ প্রসাদের বাহিরে পদচারণ করতে। 
ভ্রু কুঞ্চিত করেন রানি। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে পুরুষটির উদ্দেশ্যে বললেন, "কে?"

পুরুষটি কিছুটা চমকালেন রানির কণ্ঠে। হতবিহ্বল হয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখলেন রানিকে। রানিও পুরুষটির চেহারা দর্শন করার সাথে সাথে চমকে উঠলেন। 
 "হ্যাভেন না আপনি?"

রানির মুখে নিজের নামটি শুনতেই হ্যাভেনের ঠোঁট জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো হাসি। মাথা নাড়িয়ে বলল,
"রানি কামিনীকাঞ্চন আমার মতন সামান্য মানুষের নাম স্মরণে রেখেছেন এ যে পরম সৌভাগ্য আমার।"

রানি ঘোড়া থেকে নামলেন না। বসে রইলেন ঠাঁই। হ্যাভেনের কথায় চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালেন। কুটিলতায় মাখা হাসি তার ওষ্ঠ জুড়ে খেলা করছে। ডান ভ্রু'টি সামান্য উঁচিয়ে বললেন,
 "রাজ প্রাসাদে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার অপরাধে শাস্তি হতে পারে তা কি আপনি জানেন?"

হ্যাভেন অকপটে স্বীকার করল, "জানি।"

"তাহলে উঁকি মারছিলেন কেন?"

 "কোথায় উঁকি মেরেছি? আমি তো বুক টান টান করেই এলাম প্রাসাদের সামনে। বীরের মতন। আমি কাপুরুষ নই যে উঁকিঝুঁকি দিবো।"

"এত ভোরে বুক টান টান করে আসুন কিংবা কুঁজো হয়ে আসুন, এসেছেন মানেই কোনো কুমতলব আছে।"

 "শুনেছিলাম রানির রাজপ্রাসাদ নাকি প্রজাদের জন্য সবসময়ই খোলা থাকে। তাহলে ভোরে আসি কিংবা রাতে, আহামরি অপরাধ তো কিছু হয়নি।"

হ্যাভেনের কথার যুক্তি রানিকে বাকরুদ্ধ না করে পারলো না। লোকটা এত দুর্দান্ত ভাবে কথা বলেন। রানি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। বললেন,
 "তা অবশ্যই। তাহলে বলে ফেলুন দরকারটি কী আপনার?"

হ্যাভেনের ঘোড়ার একদম কাছটায় এগিয়ে এলো। ভোরের শীতে নাকটা লাল হয়ে গিয়েছে তার। সে নিজের হাতা থাকা ছোটো কাপড়ের থলেটি এগিয়ে ধরল রানির দিকে, 
 "আপনার জন্য জড়িবুটি এনে ছিলাম।"

 "আমার জন্য! তা-ও জড়িবুটি!"

"হ্যাঁ। ঐ পরশু আপনার হাতটা কেটে গেলো না সেজন্য এনেছি।"

"আপনি জড়িবুটিও তৈরি করতে পারেন না-কি?"

 "পারি বৈকি।"

রানি সাদরে গ্রহণ করলেন হ্যাভেনের দেওয়া থলেটা, 
"ধন্যবাদ। চলুন রাজপ্রাসাদে। আপনার পারিশ্রমিকটা দিয়ে দিচ্ছি।"

হ্যাভেন রহস্য করে বলল, "পারিশ্রমিক দিবেন?"

"হ্যাঁ, এত কষ্ট করে আমার জন্য এনেছেন, দিতে তো হবেই।"

"কী পারিশ্রমিক দিবেন শুনি?"

হ্যাভেনের অভাবনীয় প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন রানি। কারণ রানির দেওয়া পারিশ্রমিক কিংবা দান অবশ্যই স্বর্ণমুদ্রা হয়। তাহলে আবার লোকটি নতুন করে জিজ্ঞেস করছেন কেন? রাজ্যে নিশ্চয় নতুন নন। আর নতুন হলেও বা কী? এতটুকু তো বিশ্বের সকলেই জানে হয়তো!

রানি নিজের ভেতর হওয়া অবাকটাকে চাপিয়ে রাখলেন অভিজ্ঞ উপায়ে। সবটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ন্ত্রণে রেখে বললেন,
 "সবাইকে যা দিই, তা-ই দিবো। স্বর্ণমুদ্রা।"

 "স্বর্ণমুদ্রা আমার চাই না। দিতেই যদি হয় তবে যেটা আমি চাই সেটা দিবেন।"
কী অকপটে রানির মুখের উপর নাকচ করে দিলো হ্যাভেন। রানি ভেবেই কূল পেলো না তার রাজ্যের প্রজা কি-না তার মুখের উপর কী সহজ ভাবে না শব্দটি উচ্চারণ করছে। আবার শর্ত রাখছে। 

রানির কণ্ঠে আর হাসি কিংবা কোমলতার রেশ রইলো না। বরং তার জায়গায় ধরা দিলো গাম্ভীর্যতা,
"পারিশ্রমিক কখনো চেয়ে নিতে শুনেছেন?"

"আমি প্রথমে চাইনি তো! আপনিই বললেন দিবেন। যদি দিবেনই তাহলে আমার চাওয়া মোতাবেক কিছু দিতে কী ক্ষতি, রানি কামিনীকাঞ্চন? না-কি প্রজাদের আবদার মানতে রানির সম্মানে লাগে?"

 "রানিকে এতটুকুই জানলেন? প্রজাকে কিছু দিতে আমার কখনোই আপত্তি নেই। বলুন কী চাই?"

হ্যাভেন বেশ খানিকটা সময় স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল রানির দিকে। এরপর কালবিলম্ব না করেই বলল, 
"যদি দিতেই হয় তবে আপনার রাজ ঘোড়াটি আমায় দিয়ে দিন।"

রানি চমকে উঠলেন। এই রাজ ঘোড়া তার জীবনে সবচেয়ে পছন্দ ও প্রিয়। কতটা যত্ন, মায়া, মমতা দিয়ে এই ঘোড়াটিকে তিনি নিজের খুব কাছটাতে রেখেছেন। আর হ্যাভেন কি-না শেষমেশ এই ঘোড়াটি চেয়ে বসলো?
 ভেতর ভেতর তীব্র দোলাচল। চাইলেই তিনি নিষেধ করে দিতে পারেন। ঘোরাটি দিবেন না বলে জানাতে পারেন। রানির মন বলতে লাগল এই ঘোড়াটি দিতে অস্বীকার করলে তাকে কেউ জোর করবে না। তাই তার উচিত অস্বীকার করা। আর মস্তিষ্ক বলল, প্রজার কাছে তবে কথার মূল্য রইলো কী?

মন মস্তিষ্কের এই নিবিড় যুদ্ধে রানি মস্তিষ্ককে প্রাধান্য দিলেন। বুদ্ধিমানরা কখনো মনের আবেগকে প্রশয় দেন না। কারণ মনের আবেগ আমাদের সবসময় লোকসমাজে হাসির, অবজ্ঞার আর অবহেলারই পাত্র বানিয়ে দেয়। অতিরিক্ত আবেগ প্রদর্শন জীবনের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে। আর রানি কামিনী কখনো নিজের জীবনে ভুল আবেগ দেখানওনি!

রানি নিজের দম্ভে ভরা কণ্ঠে বললেন, "ঠিক আছে, তবে তাই হবে। এই রাজ ঘোড়া আপনাকে দেওয়া হলো।"
কথাটি শেষ করে যেই না রানি ঘোড়াটা থেকে নামার জন্য পা বাড়ালও ঠিক সেই মুহূর্তে রানির পায়ের নিচে হাত মেলে ধরলো হ্যাভেন। রানি চমকে ওঠলেন। আশ্চর্যান্বিত স্বরে বললেন,
 "আরে করছেন কী! পায়ের নিচে হাত দিচ্ছেন কেন?"

 "আমি আপনার অকৃতজ্ঞ প্রজা নই, রানি কামিনীকাঞ্চন। রানিকে মাঝ পথে নামিয়ে ঘোড়া নিয়ে নিবো এমন কাপুরুষও নই আমি।"

রানি হ্যাভেনের মতিগতি বুঝে উঠতে পারলেন না ঠিক। বললেন, "তবে চাচ্ছেনটা কী আপনি?"

 "ঘোড়াটি আপাতত আমি আপনার কাছে রাখলাম গচ্ছিত। যেদিন সময় হবে আমি ঠিক নিয়ে যাবো।"

এই হ্যাভেনকে বুঝা উঠা দায়। রানির দ্বারা তো সম্ভবপর হয়েই উঠছে না। তবে রানির তেমন খারাপও লাগছে না। সব মানুষ রহস্য ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু এই হ্যাভেন নামক লোকটির ভেতর যথেষ্ট রহস্য রয়েছে এবং রয়েছে শ্রদ্ধা। যা এই রাজ্যে রানি কখনো কারো মনে অন্তত তার জন্য দেখেননি। 

রানি অকপটে রাজি হলেন, "ঠিক আছে৷ তা-ই হবে। রাজ ঘোড়া আপনার। নিয়ে যাবেন যখন মন হবে।"

হ্যাভেন মাথা নাড়িয়ে চলে যাওয়ার পথ ধরলো। রানি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন। পুরুষ মানুষ অতি রহস্য তৈরি করে চতুরতা প্রকাশ করে। নারীকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করে। হ্যাভেনও কি তাই করছে?
মনে মনে নিজেকে এই প্রশ্ন করে নিজেই হাসেন রানি। কামিনীকে বশ করবে, আকর্ষিত করবে এমনও রহস্য পৃথিবীতে হয়? হতে পারে? বোকা পুরুষ মানুষ! তারা জানেও না, তারা যেই বলে নারীকে রপ্ত করতে চায়, সেই বল নারীর কাছে নিছকই একটি পিঁপড়ের সমান। নারী না চাইলে কোনো পুরুষ নারীকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে না। নিজের আয়ত্তে আনার ক্ষমতা রাখে না। নারী যখন অনুভব করবে যে সে কারো মোহে ডুবতে চায় একমাত্র তখনই তারা কোনো পুরুষের সাথে সম্পর্ক সমারহে মিলিত হয়। 
 এদিকেই যে নারী-পুরুষের বিরাট পার্থক্য। পুরুষ কেবল নারীর দেহ পেলেই গলে যায়, আকর্ষিত হয়। আর নারী সেই পুরুষের অন্তর, অনুভূতি এবং ভাবনাকে ছুঁয়ে এরপর পুরুষে নিমজ্জিত হয়। পুরুষ নারীকে ছুঁতে পারলেই সর্বজয় করার মতন আনন্দিত হয়। আর নারী আনন্দিত হয় পুরুষের হিয়াকে, পুরুষের কাম বিহীন প্রেমকে ছুঁতে পেরে। যা অবশ্য এই ধরাতে বিলুপ্ত প্রায়।

 ৯.

 দুপুরের পাতা ভরা বাগানটিতে ডাকছে কতক চেনা-অচেনা পাখি। পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে সূর্য়ের তীর্যক রশ্মি গুলো এসে চুম্বন এঁকে দিচ্ছে রানির চোখে-মুখে। 
রানি কামিনী হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন খাঁচাটি। একটু বেশিই সুন্দর খাঁচা। কোথা থেকে এত সুন্দর খাঁচাটি এনেছে সে মানব কে জানে! 

পায়রাটা কী সুন্দর খাঁচার ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছে। যেন তার কোনো চিন্তা নেই। এই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সুখী সে। রানি খাঁচাটির বন্ধ দরজা খুলে দিলেন। আচমকাই পায়রাটিকে উড়িয়ে দেওয়ার সাধ জেগেছে তার মনে। পায়রাটি খাঁচার দরজা খোলা পেতেই বেরিয়ে গেলো। উড়তে লাগলো চারপাশ জুড়ে। প্রথমে রানি ভাবলেন পায়রাটি উড়ে চলে যাবে। তাই তিনি তাকিয়ে রইলেন পায়রাটির দিকেই। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পায়রাটি তার আশেপাশেই ঘুরতে লাগলো। যেন রানিকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই তার। কোনো আকাঙ্খা নেই। তার সমস্ত জীবনটা জুড়ে গিয়েছে যেন রানির সাথে। 
তাজ্জব না হয়ে পারলেন না রানি। পায়রাটি কি মনে মনে পণ করেছে রানির সঙ্গ না ছাড়ার? নাকি হ্যাভেনের পায়রা হ্যাভেনের মতনই আকর্ষণ করার ক্ষমতা রেখেছে? 

রানির একচিত্তে ধ্যানে মগ্ন হওয়ার সময়টিতেই হ্যাব্রো এলো। অনুমতি নিয়েই প্রবেশ করলো বাগানটায়। বেশ চিন্তিত দেখা গেলো তাকে। রানি না তাকিয়েও হ্যাব্রোর চিন্তিত মুখটির খোঁজ পেলেন। স্থির চোখে তাকিয়ে শুধালেন,
"হয়েছে কী? সমস্যা?"

হ্যাব্রোর মাথা নত তখনও। মাটির দিকে তার দৃষ্টি। সে শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, "একটা দুঃসংবাদ আছে, রানি।"

 "দুঃসংবাদ বলতে কিছুই হয় না এ জগতে। দুঃখ, সুখ এগুলো আপেক্ষিক বিষয়। বলো তোমার কী সংবাদ।"

"আমাদের পশ্চিম রাজ্য ক্যামিলাস থেকে একটি পত্র এসেছে।"

 "পত্রে কী লিখা?"

"পত্রে লিখা ছিলো— রানি যেমন নির্মম, রানির জন্য তেমনই নির্মম উপহার রইলো। আমাদের দেখা হবে একদিন অপেক্ষা করবেন।"

রানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কী উপহার?"  

 "ঐ রাজ্যে আমাদের দু'জন গুপ্তচর গিয়েছিলো। তাদের মৃতদেহ সমেত এই পত্রটি পাঠিয়েছেন উনারা।"

রানি এবার ভীষণ চমকে গেলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। বললেন, 
 "গুপ্তচরদের কথা ওনারা কীভাবে জানলেন? কেবল উনারা নয়, যেসব রাজ্যে আমাদের গুপ্তচর আছে তাদের কারোই তো জানার কথা নয় এটা!"

"আমরাই তো সেটা ভেবে ভীত। মন্ত্রী বললেন একটি বৈঠক ডাকা খুব জরুরী। ঐ রাজ্য হয়তো আমাদের উপর ক্ষিপ্ত প্রচন্ড।"

রানি মনে মনে ভারি অবাক হলেন। যেখানে প্রায় সব রাজ্য রানি কামিনীকে মান্য করে চলে, কামিনীর রাজ্যের সাথে শত্রুতা করার আগে বার বার ভাবে সেখানে কি-না ক্যামিলাস রাজ্য সাগ্রহে শত্রুটা ডেকে নিচ্ছে?

 রানির চোখে-মুখেও এবার কিছু একটা ভাবনার ছাপ দেখা গেলো। কিন্তু প্রকাশ করলেন না তেমন। কেবল বললেন,
"বৈঠকের আয়োজনই করো হ্যাব্রো। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাইকে বৈঠকে আসার নির্দেশ দিবে। মনে হচ্ছে আমাদের মহলেই কেউ সর্ষের ভেতর ভূত।"

হ্যাব্রো খানিক আমতা-আমতা করে বলল, "আপনি অনুমতি দিলে আমি আরেকটি কথা বলবো, রানি।"

হ্যাব্রো কখনো এই স্বরে কথা বলে না। রানির দেখা মতে হ্যাব্রোর মতন দারুণ ছেলে কোথাও নেই। প্রচন্ড সাহসীও বটে। রানির জন্য যেন তার জান হাজির। 
 রানি বললেন, "বলো।"

হ্যাব্রো আর সংশয় করলো না, দ্বিধাও করলো না। বরং ভীষণ অকপটে বলল,
"আপনার অবর্তমানে আপনি কাউকে রাজ্য কিংবা রাজকোষের সিদ্ধান্ত দেওয়ার অনুমতি কি দিয়েছেন, রানি?"

 এ যেন এক প্রকারের কৈফিয়ত চাওয়া। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে রানি ঠিক রেগে যেতে কিন্তু হ্যাব্রোর উপর তিনি রাগলেন না। কারণ হ্যাব্রো অপ্রয়োজনে কিছু বলে না।
রানি বললেন, "না তো। কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।"

 "রাজস্ব নিয়ে কথা বলতে দু'জন আপনার নিকট এসেছিলো। এবং আপনার সখী যামিনী সেই সমস্যার কথা বলে সমাধান দিয়ে দিয়েছেন। আপনি কি তা জানেন?"

রানি এবার ভীষণ রকম চমকালেন। অতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, "না। আমাকে তো বলেনি, সখী।"

 রানি মুহূর্তেই শান্তি শিষ্ট থেকে প্রচন্ড রেগে গেলেন। সাথে সাথে চললেন প্রাসাদের ভেতর। হ্যাব্রোকে জোর গলায় নির্দেশ দিলেন, 
"হ্যাব্রো, এখুনি যামিনীকে আমার কক্ষে আসতে বলো। দ্রুত।"

রানির মুখাবয়ব দেখে যেকেউ ধারণা করতে পারবে যে তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছেন। হ্যাব্রোর যদিও তাতে কিছু আসে যায় না। রাজ্যকে সে ভীষণ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে রানিকে। তাই এই রাজ্যের কোনো ক্ষতি কারো নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের জন্য হোক তা সে কখনোই হতে দিবে না। 

হ্যাব্রো যখন খবর নিয়ে গেলো যামিনীর কাছে, মেয়েটা তখন ঘুমুচ্ছিলো। দাসী এসে তাকে জাগিয়ে যখন সংবাদটি দিলো মেয়েটা তখন দিশেহারার মতন বেরিয়ে এলো। এসেই কপাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো তামাটে দেহের হ্যাব্রোকে। বুক উঁচিয়ে, টান টান করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। হ্যাব্রোকে দেখেই যেন যামিনী আঁচ করে নিলো সবটা। ব্যথিত নয়নে কেবল এতটুকুই বললো, "তাহলে, এবার শান্তি হলো তো?"

হ্যাব্রো জবাব দিলো না। এই কণ্ঠে অভিমান ছিলো না অনুরাগ তাও বোধহয় বোঝার চেষ্টা করলো না। 

যামিনী রানির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইতেই রানি অনুমতি দিলেন। হ্যাব্রোকেও নির্দেশ দিলেন আসার। 

যামিনী ঢুকতেই তার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন রানি। রুক্ষ, কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
"আমার অবর্তমানে রাজস্ব নিয়ে নাকি তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছো, সখী?"

যামিনীর হৃদয় খানিক কম্পিত হলো। এর আগে এতটা কঠিন করে যে রানি তার সাথে কথা বলেনি কখনো! 
 যামিনীে নিস্তব্ধতায় আরও খানিক কণ্ঠ উঁচু করলেন রানি। প্রায় ধমকেই শুধালেন, "কী হলো? কথা বলছো না কেন?"

যামিনী ভীত, অভিমানী কণ্ঠে বলল, "তুমি ছিলে না। ভেবেছিলাম দরকারী তাই...."

"তাই তুমি আমার অনুমতি ব্যতীত একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তাই তো? এই অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?"

 "আমি দুঃখীত, সখী।"

"দুঃখীত! ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে এরপর বলছো দুঃখীত। তুমি জানো রাজকোষের অবস্থা কী বর্তমানে? কোন কারণে আমার অবর্তমানে তুমি এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছো?"

"আমায় ক্ষমা করো, সখী। চাইলে শাস্তি দাও।"

 "শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবেই, সখী। আমার বিচার কারোর জন্য বদলানো হয় না তা তুমি ভালো করেই জানো। আমার কাছে দোষীর কোনো ক্ষমা নেই।"

যামিনী ভাবতেও পারেনি তার একটি ভুলের জন্য সখী এতটা নির্মম হবে। তাই ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইলো সখীর দিকে। কামিনী চোখ ঘুরিয়ে নিলো। অন্য দিকে তাকিয়ে হ্যাব্রোকে বলল,
 "রাজ প্রাসাদের সামনে যেই বালুর পাহাড়টি আছে সেখানে এখন থেকে সন্ধ্যা অব্দি সখী যেন দাঁড়িয়ে থাকে তা-ও খালি পায়ে। হ্যাব্রো, তুমি নিজে সবটা অনুধাবন করবে। সখী শাস্তিতে কোনো হেলাফেলা করছে কি-না তা আমাকে জানাবে।"

যামিনী হতবিহ্বল হলো। তার অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া ঘুরে বেড়ালো ঘর জুড়ে। হ্যাব্রো মাথা নত করেই রইলো। কামিনীরও চোখে কী ঝিলিক দিয়ে ওঠল অশ্রু? ঠিক বোঝা গেলো না। 

*

 রাতের নিস্তব্ধপুরী রাজপ্রাসাদ। ঘুমিয়ে আছে সকলে। জ্বরের ঘোলে গোঙাচ্ছে যামিনী। তার মাথার কাছটাতেই বসে আছেন রানি। চোখ দু'টো তার লাল হয়ে আছে। যামিনীর কপালে জলপট্টি দেওয়া কাপড়টি ক্ষণে ক্ষণেই বদলে দিচ্ছেন রানি। টানা সারা দুপুর রোদে দাঁড়িয়ে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এখন জ্বরে বিভোর। 

হ্যাব্রো তখনও কপাটের কিনারায় দাঁড়ানো। কিছুটা ধীরেই বলল,
"আপনি একটু বিশ্রাম নিন, রানি।"

যামিনীর থেকে দৃষ্টি সরালেন রানি। হ্যাব্রোর দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বললেন, "ও যদি চোখ মেলে কাউকে না পায়, তবে কষ্ট পাবে।"

হ্যাব্রো যৎসামান্য হেসে ভরসা দিলো রানিকে। বলল, "আমি আছি এখানে। আপনি যান।"
ভরসা পেতেই রানি উঠলেন যামিনীর পাশ থেকে। হ্যাব্রোকে এখানে থাকতে বলেই বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে। পা রাখতে পারছেন না জুতোয়। ফোস্কা গুলো বড়ো জ্বালাচ্ছে। জ্বরও কী ভিষণ এসেছে। শরীরটা দিয়ে যেন বের হচ্ছে গ্রীষ্মের উত্তপ্ত গরম হাওয়া।

পালঙ্কে শুতেই কখন যেন নিদ্রায় ডুবে গেলেন তিনি। ঘুমের ঘোরেই অনুভব করলেন পায়ের পাতায় কে যেন ঠান্ডা কিছু মেখে দিচ্ছে। কী শান্তি লাগছে তার! স্বপ্নে দেখতে পেলেন হ্যাভেনকে। কী আশ্চর্য! হ্যাভেন তার পায়ে চুমু দিচ্ছে। লুকিয়ে রাখা এই জ্বর ও পায়ের ফোস্কা নিয়ে রানির ঘুম ভীষণ ভালো হলো। কবে এতটা ভালো ঘুমিয়েছেন মনে পড়ে না।
.
.
.
চলবে................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp