কামিনী - পর্ব ১০ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


বেলাটা ঠিক ঘনিয়ে আসতেই কয়েকজন জেনে গেলো রেবেকার পালানোর খবরটি। সর্বপ্রথম যামিনী এলো হন্তদন্ত হয়ে রানির কাছে। 
রানির ঘরে তখনও সম্পূর্ণ রশ্মি এসে প্রবেশ করেনি। শুভ্র রঙের পর্দার মোটা আস্তরণ ভেদ করে সামান্য আলোটা কিছুটা দৃশ্যমানতা তৈরি করেছে কক্ষটিতে। রানি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তার কাছে তখনও খবর গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। কেই-বা খবর পৌঁছাবে? এমন খবর যে রানির কাছে নিয়ে যাবে তারই তো গর্দান যাবে। রানির এত কঠোর নজরদারি, প্রহরীর পরেও কীভাবে কারাগার থেকে অপরাধী পালিয়েছে তা যেন বুঝেই উঠতে পারছে না। আর রানি যদি একটিবার জানতে পারেন তার রাজ্যে ঘটেছে এক কাজ তা-ও তার দেওয়া প্রহরীদের তুমুল নজরদারি থাকা সত্বেও তখন যে তিনি কী করবেন তা কেউ আর ভাবতে পারছে না। ভয়ে প্রত্যেকের বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সেনাপতি হ্যাব্রোও আজ রাজ্যে নেই। সে গিয়েছে ইনান ণেকিতানদের রাজ্যে রানির দেওয়া একটি পত্র নিয়ে। তাই বর্তমানে যামিনী ছাড়া এই খবর কেউ-ই রানিকে দিতে পারবে না। স্বয়ং মন্ত্রীই তাই যামিনীকে বলেছে খবরটি রানি অব্দি পৌঁছে দিতে। 

 ঠাণ্ডার আবেশে অবসন্ন কক্ষটিতে ঢুকেই যামিনীর শীত শীত করতে লাগলো। সখী যে কীভাবে এত ঠাণ্ডায় ঘুমুতে পারে সে বুঝে উঠতে পারে না। 
সূর্যের আলো প্রবেশ করার জন্য সে জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিলো। জানালার পর্দা সরতেঢ ঝলমলে প্রভাতের আলো এসে পরম আবেশে লুটিয়ে পড়লো রানির বিছানায়। সেই আলোতে ঘুমন্ত রানিকে দেখালো বৃক্ষের সবচেয়ে সুন্দরতম পুষ্পটির মতন। কোনো প্রসাধনী নেই মুখে, নেই কৃত্রিমতা। তবুও ওষ্ঠ গুলো গোলাপের পাপড়ির মতনই সুন্দর। চোখের পাপড়ি গুলো ঘন। গালে লাল আভা। এতটাই সুন্দর গায়ের রঙটি মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বড়ো যত্ন কাঁচা হলুদের রঙ মিশিয়ে দিয়েছেন সেই গায়ে। রানিকে দেখে মাঝে মাঝে যামিনীরও ঘোর লাগে। অবাক হয়। বিস্ময় জাগে বুকে। মনে মনে ভাবে, সৃষ্টিকর্তা কত যতনেই না সৃষ্টি করেছেন এই নারী দেহকে। কতই না মুগ্ধতা লেপে দিয়েছেন এই দেহের প্রতিটা ভাঁজে। 

 যামিনীর পেছন-পেছন রানি দাসী ফ্রেয়া এলো। যামিনী ফ্রেয়াকে মদ্যরস পাত্রে সাজাতে বলে ধীরে এগিয়ে গেলো রানির মাথার কাছটায়। খুব নরম, তুলতুলে স্বরে ডাকলো,
"সখী, উঠো। বেলা যে গড়ালো।"

হালকা ডাক। এক হাত দূরে দাঁড়ানো মানুষও হয়তো শুনতে পাবে না। অথচ রানি শুনলেন এবং বেশ অকপটে জবাব দিলেন,
"উঠবো, সখী। বসো।" 
চোখের পাতা তখনও বন্ধ রানির। যামিনী অবাক না হলেও, অবাক হলো ফ্রেয়া। মদ্যরস পাত্রে ঢালতে ঢালতে একবার ঘুরে তাকালো রানির দিকে। সে ভেবেই পেলো না এত ধীর ডাকেও রানি কীভাবে উঠে যান, কীভাবে উপস্থিতি বুঝে যান!

রানির অনুমতি পেতেই বসলো যামিনী। ফ্রেয়াকে চোখের নির্দেশে মদ্যরসের পাত্রটি দিতে বলল। ফ্রেয়া ইশারা বুঝতেই পাত্রটি নিয়ে এলো। যামিনী সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,
 "তোমার মদ্যরস তৈরি, সখী।"

রানি এবার চোখ মেললেন। কোনো আড়মোড়া ভাঙা নেই, কোনো অলসতা নেই দেহে এমন ভাবেই তৎক্ষণাৎ উঠে বসলেন। নাম মাত্র হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মদ্যরসের পাত্রটি নিলেন যামিনীর কাছ থেকে। প্রশ্নাত্মক চোখ তাকিয়ে বললেন,
"কী বলবে, সখী? বলো।"

 রানি কামিনীর এই মানুষের মুখাবয়ব দেখে বুঝে ফেলার ব্যাপারটা অবগত যামিনীর। তবুও প্রতিবার সে অবাক হয়। প্রতিবারের ন্যায় এবারেও শুধালো,
"বুঝলে কীভাবে যে আমি কিছু বলতে এসেছি?"

 "খুব সহজ বিষয়। আমার ঘুম থেকে উঠেই মদ্যরস পান করার বিষয়টি তোমার পছন্দ নয়। সেই তুমিই যখন আমাকে কিছু বলতে চাও তার আগে নিজে থেকেই মদ্যরসের পাত্র হাতে ধরিয়ে দাও। যার অর্থ, তুমি কিছু বলতে চাও। এবং এমন কিছুই বলতে চাও যা শুনে আমি হয়তো রাগান্বিত হতে পারি।"
রানির এই তীক্ষ্ণ যুক্তি, ঈগলের ন্যায় চতুর দৃষ্টি হতবিহ্বল করে তুলে উপস্থিত দুই নারীকেই। যামিনী সেই হতবিহ্বলতা নিয়েই বলে,
 "একটি দুঃসংবাদ আছে, সখী।"

রানি মদ্যরসের পাত্রটিতে চুমুক দিতে দিতে সটান বুক নিয়ে বলেন,
 "দুঃসংবাদ বলতে কিছু নেই, সখী। আমি বার বার তোমাকে বলেছি। দুঃখ কিংবা সুখ দু’টোই আপেক্ষিক বিষয়। অর্থাৎ তোমার অনুভবের উপর এদের নির্ভরশীলতা। তুমি যখন অনুভব করবে কোনো একটা কিছু তোমার মনকে ভীষণ আঘাত করেছে, কষ্ট দিয়েছে তখনই সেটার নাম তুমি দুঃখ দিয়ে বসবে। আবার এমন কিছু যেটা তুমি অনুভব করবে তোমাকে শান্তি দিচ্ছে, তুমি নিজেকে আনন্দিত অনুভব করছো তখন তুমি সেটার নাম সুখ দিয়ে বসবে। তার মানে তোমার অনুভবের উপরই সুখ, দুঃখ নির্ভরশীল। তাহলে যেই দুঃখ আমার উপর নির্ভরশীল, আমি অনুভব করলেই তার নাম দুঃখ হবে এবং সে আমার জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলবে তাকে কেন আমি অনুভব করবে? কোনো কিছুই দুঃখের নয়। আবার কোনো কিছুই অসম্ভব সুখের নয়। সেগুলোকে আমাদের অনুভূতি দুঃখ কিংবা সুখের বলে স্বীকৃতি দেয়। তাই রানি কামিনীকাঞ্চন কখনো কোনো কিছুকে এমন ভাবে অনুভব করেনি কিংবা করে না যার নাম দুঃখ দেওয়া যায়। বুঝতে পেরেছো?"

যামিনী মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ঘাড় নাড়ায়। যার অর্থ, সে বুঝতে পরেছে। এবং এতই দারুণ ভাবে বুঝেছে যে সে কয়েক মুহূর্তের মাঝেই ভুলে গেলো মূলত সে কী বলতে এসেছিলো এখানটায়। 
 রানি শুধালেন আবার, "তো বলো কী সেই সংবাদ যা রানিকে দুঃখ দিতে পারবে?"

রানি কামিনীর প্রশ্নে ধ্যান চ্যুত হয় যামিনীর। এমন ধ্যানমগ্ন হয়ে গিয়েছিলো বলে একটু বোকা বোকা হাসেও সে। অতঃপর নিজেকে ধাতস্থ করে কিঞ্চিৎ ফিসফিসিয়েই বলল,
 "রেবেকা কারাগার থেকে পালিয়েছে।"

যামিনী ভেবেছিল এই অতি বিস্মিত ঘটনাটি শুনে রানি চমকে যাবেন। হৈ-হল্লা শুরু করবেন। কিন্তু তা হলো না। বরং রানি বেশ ধীরস্থিরে বললেন,
"কীভাবে পালালো সে? কারাগারে কারা ছিলো পাহারায়? মন্ত্রীকে বলো তাদের জমায়েত করতে।"

 যামিনী আরও খানিক আমতা-আমতা করে বলল,
"প্রায় সাতাত্তর প্রহরী ছিলেন পাহারায়। তাদের মাঝে উনিশ জন পালিয়েছেন।"

যামিনীর এই বাক্যে রানির কপাল কুঁচকালেন। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
"ওরা পালিয়েছে কেন?"

 "খুব সম্ভবত ভয়ে। তুমি যদি জানো রেবেকা পালিয়ে গেছে ওদের পাহারার পরেও তাহলে তো গুরুতর শাস্তি দিবে। তাই সেই ভয়ে হয়তো ওরা প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়েছে।"

যামিনীর কথাটা রানির কর্ণগোচর হতেই তার টান টান চোয়াল কিছুটা নেতিয়ে গেলো। চোখ গুলোতে আর সেই ক্রুর ভাবটা নেই। ঠোঁটের কোণার বাঁকা হাসিটাই বেনামি বিজ্ঞাপনে পথ নিয়েছে হারাবার। কী ভেবে যেন তার মনে মনে ভীষণ প্রশ্ন জাগলো। কী ভেবে তার মন কিছুটা স্তব্ধ হয়ে গেলো। ভীষণ আনচান করলো বুকটা। প্রজাদের বুকে সে এতটাই ভয় জাগিয়ে ফেলেছে তাহলে?

এরপর আর কথোপকথন এগুতে পারলো না। রানি নিমগ্ন হয়ে গেলেন মদ্য পানে। কক্ষ থেকে যামিনী ও ফ্রেয়াকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। 
গগণের এক পাশে উদীয়মান সূর্যটিকেও নির্বাক দেখালো। রানি চোখ বন্ধ করলেন। চোখের পাতায় ভেসে উঠলেন একটু পুরুষের অহংকারের হাসি। বিশ্ব জয় করে ফেলার মতন কুটিলতা যেই লোকটির শিরায় শিরায় বিদ্যমান ছিলো। এরপর সেই জয়ের একমাত্র টোপ হলেন রানি। তারপর.....

আর বাকিটুকু ভাবতে পারলেন না রানি। লাথি মেরে ফেলে দিলেন সামনের রৌপ্য রঙের কেদারাটি। ভেঙে ফেললেন বড্ড সুন্দর ফুলদানিটি। পুরো পৃথিবী তার বিষিয়ে গিয়েছে যেন। সবাইকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। সবাইকে।

******

 বৈঠক খানায় বসে আছেন রানি। তার সামনেই আসনে বসা হ্যাব্রো। বসা মন্ত্রী রবার্ট ব্রিফল্ট। খুব গুরুতর আলোচনায় রানি কেবল এই তিনজনকেই রাখেন। বিশাল বৈঠকখানা। লাল রঙের কেদারা গুলোতে শিল্পের সমস্ত শৌখিনতা ফুটে আছে।
 প্রথমে রবার্ট ব্রিফল্ট বলল,
"রানি, আপনি রাজা ইনানের সাথে কী করতে চাচ্ছেন?"

রানি তখন নিমগ্ন তামাকের ধোঁয়ায়। ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে বললেন,
"আপনি কী বুঝছেন, মন্ত্রী ব্রিফল্ট? কী করবো আমি?"

রবার্ট ব্রিফল্ট কিছুটা আমতা-আমতা করলেন। কারণ রানির মতিগতি রানি নিজেই বুঝেন না, উনি আর কী বুঝবেন। এরচেয়ে সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় সে ভালো উত্তর দিতে পারতো।
 মন্ত্রীর নিস্তব্ধতায় ক্রুর হাসলেন রানি। জড়িয়ে আসা স্বরে বললেন,
"ক্যামিলাস রাজ্য আমাদের শত্রু ভাবছে। তাই আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে কিছু করলে ওরা আরও রেগে যাবে এবং বুঝে যাবে আমাদের পরবর্তী চাল। তাই ওদের সাথে খেলতে হবে রাজা ইনানের মাধ্যমে।"

 "তার মানে আমাদের হয়ে রাজা ইনান ণেকিতান কাজ করবেন? কিন্তু কোন কারণেই বা উনি আমাদের সাথ দিবেন?"

রানি হেসে উঠলেন। কী ঝংকার সেই হাসিতে! গায়ে হীম ধরে যায় যেন। মন্ত্রী বুঝলেন না যদিও সে হাসির অর্থ। তাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো হ্যাব্রোর দিকে। হ্যাব্রোর মুখ বরাবরের মতন স্থির। সে বোধহয় জানে হাসিটার মানে। 
মন্ত্রীকে বেশিক্ষণ অজানায় থাকতে হলো না। তার আগেই রানি বললেন,
 "পৃথিবীতে পুরুষের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা কী, মন্ত্রী ব্রিফল্ট? আপনারা নিশ্চয় জানবেন। পুরুষের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হলো কাম, যৌনতা। আর ইনান সেই কামের জন্যই করবেন আমাদের হয়ে কাজ।"

মন্ত্রীর বোধহয় এবার বোধগম্য হলো রানি কী করতে চাইছেন। 
রানি কামিনী এবার হ্যাব্রোর দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
 "রাজা ইনান কাল আসবেন না পরশু?"

হ্যাব্রো মাথা নত করে জবাব দিল, "পরশু।"

"ঠিক আছে। তার আপ্যায়নের সর্বোচ্চ বন্দবস্ত করবে। ক্যামিলাস যাওয়ার আগেই আমি গুটি সাজিয়ে দিতে চাই।"

 "যথা আজ্ঞা।" 

রানি উঠে গেলেন। তামাকের ধোঁয়া তখনও কক্ষ জুড়ে বিরাজমান। রানি কক্ষ হতে বাহিরে যেতেই মন্ত্রী হ্যাব্রোর দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী স্বরে শুধালেন,
"রানি কীসের আয়োজন করতে বললেন? তার মানে উনি কি রাজা ইনানের সাথে মধুচন্দ্রিমা করতে রাজি?"

 হ্যাব্রো সাথে সাথে চোখ তুলে তাকালো। তার চোখে ঝরে পড়ল ক্রোধ। গলায় চাপা জোর দিয়ে বলল,
"আপনি আপনার ভাষা সংযত করবেন। আপনি এই রাজ্যের বিশেষ ব্যক্তিবর্গের একজন। রানির সম্মান করা আপনার কর্তব্য।"

হ্যাব্রোে চাপা রাগে মন্ত্রী ব্রিফল্ট ক্ষুব্ধ হলেন,
"তুমি আমাকে হুশিয়ারি দিচ্ছো? আমি কী করতে পারি জানো?"

 "সে যা-ই করুন কিন্তু রানির অবমাননা আমি সহ্য করবো না।"

মন্ত্রী বেশ তাচ্ছিল্য করে উঠে গেলো। যেতে যেতে বাঁকা সুরে বলল,
"তোমার তো গায়ে লাগবেই। স্নানাগার অব্দি যেতে পারছো, রানির ভুবন ভুলানো রূপ দেখে এরকম অন্ধ তো হবেই।"

মন্ত্রীর এই পরিহাসে মনে হলো তার প্রাণটা কেঁড়ে নিতে পারলে শান্তি পেতো। কিন্তু তা আর হলো না। 

******

 রাত্তিরের বুকে চন্দ্র উঠতেই নিদ্রায় ঢলে পড়লো রাজ মহলের সকলে। নেশায় তখন বিভোর রানি। বাগানের চারপাশটা জুড়ে নেশা করছেন আর হাঁটছেন। ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার শরীর। 
ঠিক তখনও খুব দূর থেকে ভেসে এলো বাঁশির সুর। মোহনীয় সেই সুর রানির কানে এসে পৌঁছাতেই থম মেরে গেলেন রানি। চোখ গুলো তার টেনে টেনে আসছে তবুও চোখের পাতা না আটকানোর তীব্র প্রয়াস। মুগ্ধ করা সেই বাঁশির সুরে নেশা ধরে গেলো তার। তিনি যেন ঘোরগ্রস্তের মতন হাঁটতে লাগলেন। রাজ প্রসাদের বিরাট দরজা জুড়ে পাহারা দেওয়া প্রহরীরাও রানিকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহসটুকু নেই বলে তারা প্রশ্ন করলো না। 

হাঁটতে হাঁটতে রানি অনেকটা দূরে চলে এলেন। তখনও বিশাল মদ্যরসের পাত্রটি তার হাতে ধরা। মোহগ্রস্ত রানি তখন জঙ্গলের প্রায় শেষ সীমানায়। আসমানে উদিত হওয়া চাঁদের জোছনায় ঝলমলে সেই সীমানা। সেখানেই একটি পাথরের উপর বসে বাঁশি বাজাচ্ছে একটি ছেলে। সুঠাম দেহের ছেলেটিকে তেমন দেখা যাচ্ছে না। অস্বচ্ছ লাগছে। তবুও উনার চিনতে অসুবিধা হলো না। অস্ফুটস্বরে বললেন,
 "হ্যাভেন না?"

বাঁশি বাদকের সুর থেমে গেলো। রানি দেখলেন ঘোলাটে চোখেই পুরুষটি তার দিকে এগিয়ে এসেছে। 
রানি তখন নেশার দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে আছেন। হ্যাভের সামনে আসতেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, "থামালেন কেন? বাজান। আমি শুনতেই তো এসেছি।"

গলার স্বরে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে রানির বর্তমান অবস্থা। হ্যাভেন অবাকও হয়েছে এত রাতে রানিকে দেখে। তাই অবাক গলাতেই জিজ্ঞেস করল,
"এত রাতে আপনি এখানে, রানি কামিনীকাঞ্চন?"

রানি জড়ানো গলাতেই বললেন, "তো কী হয়েছে? আপনি... আপনি জানেন না এটা আমার রাজ্য?"

 "জানি। কিন্তু আপনার রাজ্যে আপনার যে শত্রুর অভাব নেই।"

"তা ঠিক, ঠিক বলেছেন আপনি। জানেন, ওরা... ওরা আমাকে একটুও বুঝলো না। আমি কি এতই খারাপ?"

হ্যাভের পড়লো মহা সংশয়ে। রানির শরীর টলছে। যেই কোনো মুহূর্তে পড়ে যাবেন হয়তো। হ্যাভেন তাই রানির দুই কিনারায় হাত দিয়ে রেখেছে নিরাপত্তার জন্য। রানি পড়ে গেলে যেন সে আঁকড়ে ধরে বাঁচাতে পারে।

"জানেন, আমার কারাগার রক্ষীরা আজ উনিশ জন পালিয়েছে। কেন পালিয়েছে জানেন? কারণ কারাগার থেকে একজন অপরাধী পালিয়েছে। রেবেকা উযোয়ার ছিলো না? আমার খাস দাসী, ও পালিয়েছে। ও পালিয়ে গেছে বলে যদি আমি রক্ষীদের শাস্তি দিই সে ভয়ে ওরাও পালিয়েছে। আমি কি এতই পাষাণ বলুন? আমি কি এতই কঠিন? আমি যদি কঠিন হতাম তবে কি... "

রানির কণ্ঠ এবার জড়িয়ে গেলো। হ্যাভেনের বুকে তখন অগাধ কৌতূহল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করল,
"তবে কী?"

 "তবে কি আমি উযোয়ারকে পালিয়ে যাওয়ার পথ করে দিতাম বলুন? দিতাম না যে! আমি আমার প্রজাদের যে ভীষণ ভালোবাসি। আমি..."

বাকি কথা বলতে পারলেন না রানি। তার আগেই একটি শব্দ হলো এবং নিজের ডান বাহুতে অনুভব করলেন তীব্র ব্যথা। পৃথিবীর সমগ্র ঘুম যেন তার চোখে এসে বসতভিটে গড়ে তুলল। কেবল কানে আবছা শুনলেন একটি পুরুষালী কণ্ঠ বলছে,
"আর তীর মেরো না উনাকে। তোমরা এখন যাও। উনাকে মৃত্যু দেওয়া যাবে না এখন।"

রানির চোখের কোণে সামান্য অশ্রু বিন্দু দেখা দিলো। বিড়বিড় করে বললেন,
"হ্যাভেন.. আপনিও বেইমান?"
.
.
.
চলবে....................….................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp