তন্ময়ের কাছে অরুর অভিমানিনী রূপ বড়ো ভয়ংকর। এই রূপ সে বিন্দুমাত্র সহ্য হয় না। গুণে-গুণে কয়েকটি বার এই অভিমানের কবলে সে বিশ্রী ভাবে পড়েছে ইতোমধ্যে। অগত্যা এখন রিতীমত ভীতি কাজ করে। অরুটার বয়স কম। ভীষণ অবুঝ। তবে বুঝিয়ে-মানিয়ে নিলে আবার চট করেই তন্ময়কে বুঝে। তাই যতভাবে সম্ভব…যেকোনো কঠিন, ব্যস্ত, কর্মঠ পরিস্থিতি সরিয়ে ওকে নিজের কাছে, ঠিক পাশে বসিয়ে— পরিষ্কার করে মনের অব্যক্ত কথাগুলো বুঝিয়ে দেয়াটাই উত্তম কাজ হবে। এবারো তন্ময় সেটাই করে। অরুর মসৃণ হাত টেনে ধরতেই, সম্পূর্ণ অরুটাই এসে মিশে যায় তার শক্তপোক্ত পুরুষোচিত বুকে। ওর চুলের ঘ্রাণ সুন্দর। কী শ্যাম্পু যেন ব্যবহার করে বলেছিল? ঠিকঠাক খেয়াল নেই। তবে তার নেশা ধরে যায়। নরম তুলতুলে কোমর জড়িয়ে ধরে তন্ময় ভারী তবে মিহি আওয়াজে বলে,
‘জানিস— আমার গত সপ্তাহে একটা কাজের জন্য খুলনা যাওয়ার কথা ছিল? আমি যাইনি। কার জন্য? তোর জন্য। জানতাম তো এমন জেদ ধরে বসবি। আমার হয়ে পাঠিয়েছিলাম আমার ম্যানেজারকে। আমি পারতে তোকে ছাড়া এক'পা সরি না। সরতে চাই না। তুই বুঝিস না? আমিওতো যেতে চাচ্ছি না তোকে ছেড়ে। কিন্তু কাজ তো করতে হবে! মাত্র দু’দিন। যাব আর আসব। অপেক্ষা করবি তো আমার জন্য? করবি না? হুঁ?’
অরু চোখ তুলে চায়। দু’চোখের মণি জোড়া চকচক করছে। মনে হচ্ছে মণি দুটোতে তারা ভাসছে। তন্ময় সেই মণিতারায় চেয়ে রয় একচিত্তে। অরু বিড়বিড় করে,
‘আপনার কাছে মাত্র লাগছে? দু’দিনে কয় ঘণ্টা হয় জানেন? আটচল্লিশ ঘণ্টা! আটচল্লিশ!’
তন্ময় হেসে ফেলে। অরু আড়চোখে সেই হাসির এক ঝলক দেখে ফের মিহি স্বরে বিড়বিড়িয়ে ওঠে আপন ভাবনায়,
‘আপনি যখন অফিসে যান ওই সময়ে আমি কমছে কম নব্বই বার ঘড়ি দেখি। সময়ের আপডেট রাখি। বারান্দায় কয়েকবার করে যাই দেখতে আপনার গাড়িটা এসেছে কী-না। কান সজাগ রাখি যেন গাড়ির শব্দ মিস না করি। শুধুমাত্র আপনি কখন ফিরবেন এই আশায় বসে থাকি। আবার আপনি যখন পাশে, আমার সাথে থাকেন আমার বিন্দুমাত্র আইডিয়া থাকে না সময়ের। ঘড়ির দিক তাকাইও অবদি না। আপনি কী বুঝেন এসব? বোঝেন না।’
হৃদয়ের অনুভূতি যদি অকপটে ব্যক্ত করার কোনো কম্পিটিশন হতো তাদের দুজনার মধ্যে— তন্ময় বাজি করে বলতে পারে অরুই জিতবে। মেয়েটা এতো সাবলীলভাবে সব বলে দেয় যে তন্ময় এতবার করে শুনেও অভ্যস্ত নয়। প্রত্যেক বারই তার অন্তর কেঁপে ওঠে। অনুভূতির সাগরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তন্ময় বিনাবাক্যে ওকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় নিজের মধ্যে। এক শক্তপোক্ত বন্ধনের মধ্যে অরু অস্বস্তি অনুভব করে থাকলেও মুখে রা অবদি করেনি। অরু কী উপলব্ধি করতে পারছে তন্ময়ের হাইস্পিডের হার্টবিট? দ্রিম… দ্রিম…দ্রিম শব্দ তুলছে তো। তন্ময় শান্ত হয়। মাথা নুইয়ে ঠোঁট নামিয়ে আনে অরুর কানের খুব কাছটায়। অরুর কানের লতিতে বিন্দুর মতন লাল একটি তিল আছে। সেথায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে তন্ময় শুধোয় গাঢ় স্বরে,
‘কাজকর্ম বাদ দিয়ে দিই তাহলে? আমার জান যা বলবে তাই। সে যদি বলে কাজে যেতে হবে না— আমি শাহজাহান তন্ময় কথা দিচ্ছি… যাব না। কোথাও যাব না।’
তন্ময় অনুভব করল অরুর মূর্তি বনে যাওয়া বদনখানি। কেমন ধড়ফড় করছে ওর হৃদয়। সে সুস্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। তন্ময় মিথ্যে বলেনি। কোনোপ্রকার বাহানা দেয়নি। অরু যদি আরেকটিবার মুখ ফুটে বলে— সে যাবে না। কোথাও যাবে না। অরুর নামানো হাত দুটো এবারে তার কোমর জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মুখ গুঁজে বুকের মধ্যখানে। সেভাবেই বলে অস্পষ্ট ভাবে,
‘আপনি এটা আমায় সবসময় বলেন না।’
তন্ময় নিঃশব্দের হাসিটুকু চেপে বুঝেও না বোঝার মতো করে জিজ্ঞেস করে,
‘কোনটা?’
অরু আরও ঘন করে মিশে যায় তন্ময়ের বুকে,
‘ওইযে ওই শব্দটা। এটা আপনার মুখে শোনা খুব রেয়ার।’
অরুর সিল্কি চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তন্ময় ফের জানতে চায়,
‘কোন শব্দ?’
অরু চোখমুখ ভালোভাবে চওড়া বুকে লুকিয়ে অবশেষে বলে,
‘জান।’
তন্ময় হাসে। সেই হাসিতে কাঁপে তার বুক। বুকে মিশে থাকা অরুও অনুভব করে সেই কম্পন। তন্ময় সময় নিয়ে হাসিমাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘তোর ভালো লাগে?’
অরু চোখমুখ বুজে মাথা দোলাল ক্রমান্বয়ে। ভালো করে বোঝাল তার কোন পর্যায়ে ভালো লাগে। তন্ময় ওর রক্তিম গাল দুটোয় হাত রেখে মাথা উঁচিয়ে ধরে। চোখে চোখ রেখে বলে,
‘সবসময় বললে কি আর ভালো লাগা থাকবে? কমন হয়ে যাবে না? এইযে মাঝেমধ্যে তুই এমন মুখ ফুলিয়ে বসিস। তোকে মানানোর জন্য ওসব শব্দ তোলা আছে। যখনই অভিমান করবি এভাবে ডেকে গলিয়ে ফেলব।’
অরু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মুগ্ধ গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘আজ আপনি কত সুইটলি কথা বলছেন!’
তন্ময়ের হাসিহাসি মুখের হাসি আরও গাঢ় হলো, ‘আমি সুইটলি কথা বলি না বুঝি?’
অরু ডান হাত তুলে আঙুলের পরিমাপ দেখিয়ে প্রত্যুত্তর করল, ‘বলেন। তবে খুব কম।’
তন্ময় আশ্চর্য হলো, ‘আমিতো সবসময় তোর সাথে খুব ধীরে, খুব নাইসলি কথা বলি।’
এবার অরুর আশ্চর্যের পালা। চোখ বড়ো করে ফেলল সে,
‘আপনি? আর নাইসলি? আপনার মনে আছে আগের কথা? গম্ভীরমুখে তাকিয়ে থাকতেন। মনে হতো আমি আপনার পকেট মেরেছি। আর গম্ভীর গলায় ধমকে ধমকে আমার প্রাণ শেষ করে ফেলতেন। একটু, শুধুমাত্র একটুউ নাইসলি, আদরের সাথে কথা বলেন—- তাও রিসেন্টলি।’
তন্ময় মুখ ভরে হেসে ফেলল, ‘তখন বোন ছিলি তাই শাসনে রেখেছি। এখন তো বউ তাই আদরে রাখছি।’
অরু কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। হা করে চেয়ে রইল খানিকটা সময়। তন্ময় আটপৌরে এক চুমু ওর স্নিগ্ধ কপালে বসিয়ে ফেলল। অরু দ্রুত চোখ বুজল। বিড়বিড় করে উঠল,
‘যান। তবে দু’দিন কিন্তু। আর আমায় ঘনঘন ভিডিও কল দিতে হবে। অডিও কলও দিতে হবে। গান শুনিয়ে পাঠাবেন। ফ্রি থাকলেই কল করবেন। মনে থাকবে?’
তন্ময় ওর আধবোঁচা নাকে মৃদু টোকা মেরে বলল,
‘মনে না থেকে উপায় আছে? এখন গিয়ে নাস্তা লাগাতে বল। আমি বেরোব।’
তন্ময় ঘরের উত্তরদিকে হাঁটা দিয়েছে। শেল্ফের দিকটায়। শার্ট হাতার বোতাম লাগাতে নিয়ে সে শেল্ফে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে। অরু পিছু পিছু যেতে নিয়েই বলে,
‘জোহরের আজান দেবে। লাঞ্চ করে যান? দেরি তো হয়েই গিয়েছে, তাই না?’
তন্ময় ফিরে তাকিয়ে হাসি চেপে চাপাস্বরে বলল, ‘আচ্ছা। আমার বউ যা বলবে তাই।’
অরুর উজ্জ্বল মুখটা ফের থমথম করে আশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছে। ও বোধহয় কখনোই তন্ময়ের মিষ্টি কথাবার্তার সঙ্গে সহজ হতে পারবে না। সাধারণ কিছু বললেও কেমন লজ্জায় ছটফট করে। রক্তিম হয়ে গাল দুটো। তবে জ্বলজ্বল করছে চোখজোড়া। মনে হচ্ছে, ম রে যাওয়া ফুল পানির স্পর্শে সতেজ হয়ে উঠেছে পুনরায়। অরু দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তন্ময় হাসল আনমনা। এই আনমনা হাস্যারর একটি শিরোনাম আছে। কলেজ লাইফে রিয়ান এই শিরোনাম উদ্ভোদন করেছিল। আনমনা হাসি হচ্ছে, গুরুতর গভীর প্রেমে পড়া আধপাগল প্রেমিকের কাজ। তাই এই আনমনা হাসির নাম, ‘কট খাওয়া’ রেখেছিল। তন্ময় ঘনঘন আনমনা হাসে। তারমানে কি সে ঘনঘন কট খাচ্ছে? রিয়ান এই হাসি তার মুকজে দেখলেই হয়তোবা বলে ফেলতো, ‘কট খাইছস। কঠিন কট খাইছস, মামা।’
———
শাবিহার বিয়ের দিনটি ঘনিয়ে আসছে। শপিং, বাজার-সদাই করা যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না। শেষ হচ্ছে না শাহজাহান বাড়ির কাজকর্মও। বিয়ের আগের দিন রাতেও তন্ময় বোনদের নিয়ে শপিং মলে পৌঁছেছে। বসুন্ধরা বন্ধ করে দেবে তখনো তারা শপিং করছিল। শপিং শেষ করে বেরিয়ে দেখে সব বন্ধ। রীতিমতো একটি মানুষ মাত্র নেই। মলের গার্ড দাঁড়িয়েছিল অবশ্য তাদের জন্য। গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাদের গাড়ি ছিল। সেটিতে চড়ে চটপট বেরোতে হয়েছে। সে রাতে বাড়ির একটি মানুষ ঘুমোতে যায়নি। অরু ব্যতীত! ও তন্ময়ের রানে মাথা রেখে লিভিংরুমেই ঘুমোচ্ছে। শপিং থেকে এসে বসেছিল সোফায়। কখন সোফাতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে! তন্ময় আলগোছে ওর হেলেদুলে পড়ে যেতে চাওয়া মাথাটা এনে রেখেছে নিজের পুরুষোচিত রানে। আনোয়ার সাহেব কম্ফোর্টার এনে মেলে দিয়েছেন মেয়ের শরীরে। রাত তখন দুটি বিশ। সামনেই লুডু খেলছেন তিন বুজুর্গ শাহজাহান। তাদের সাথে তন্ময়ও আছে। খেলা শেষের পথে প্রায়। ক্লাইমেক্স চলছে। আনোয়ার সাহেব আর ওহী সাহেব জিতে বসে আছেন। তন্ময় আর মোস্তফা সাহেবের গুটি জেতার ঘরে। তন্ময়ের প্রয়োজন কানা, আর মোস্তফা সাহেবের দুই। দুজনেই গভীর ভাবে ছক্কা ফেলছে। একসময়টাতে ছয় চেয়েও ওঠেনি। এখন ছয়ের বন্যা বইছে। এই নিতান্তই মশকরা বৈ কিছু নয়। তাদের দুজনের এই লড়াইয়ের দর্শক নেহাতি কম নয়। চতুর্দিকে সবাই হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে উপস্তিত আছেন গিন্নিরাও। জবেদা বেগম এই ছেলের খেলা দেখছেন তো এই স্বামীর। তন্ময় খুব গুরুগম্ভীর এবং জেতার জন্য অস্থির হাবভাব নিয়ে খেললেও, সে জেতার জন্য মোটেও অস্থির না। বরংচ বলা যেতেই পারে সে হেরে যেতে অস্থির। সে কৌশলে ছক্কা ফেলছে। কোনোভাবেই কানা সে তুলবে না। চাইলে জিততে পারতো প্রথমেই। কিন্তু তন্ময় তা চাচ্ছে না। তার বাবা-চাচারা জিতুক, উল্লাসে মেতে উঠুক…এটাই সে চাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তন্ময়ের কানা ঘুরে যাচ্ছে বার বার। অবশেষে মোস্তফা সাহেবের দুই উঠল। আনোয়ার সাহেব সহ সকলেই আনন্দে-উল্লাসে মেতে উঠলেন। মোস্তফা সাহেব মোটেও উল্লাস করলেন না। চোখ জোড়া ছোটো ছোটো করে ছেলেকে কড়া চোখে দেখে নিচ্ছেন। তন্ময় হেসে ভ্রু তুলে শুধোয়,
‘কী? জিতে খুশি নন?’
মোস্তফা সাহেব গমগমে গলায় বলেন, ‘মশকরা করছো? এই কেমন জেতা? তুমি ইচ্ছে করেই তো হেরে যাও। আমি কি ছোটোশব্দ করে বাচ্চা? বুঝব না ভেবে রেখেছ?’
তন্ময় এবারে শব্দ করে হাসল। তার প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দে মুখরিত বসবার ঘর। ওহী সাহেবও তাল মিলিয়ে হাসছেন। জবেদা বেগম ছেলেকে স্নেহের চোখে দেখে প্রশ্ন করেন,
‘অ্যাপল জুসটা তো তখন খেলি না। এখন আনব?’
হাসিমুখে বাবার ভোঁতা মুখে চেয়ে থেকেই জবাবে বলে, ‘আনো।’
জবেদা বেগম রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। তন্ময় তাকাল নিজের কোলের দিকে। অরু গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুতে পারছে না। এই কারণ ধরেই বোধহয় ওর ভ্রু'দ্বয়ের মধ্যিখানে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে। ঘুমের মধ্যেই অসন্তুষ্ট, হাপিত্যেশ করতে ব্যস্ত। ও তো সচরাচর উত্তর দিকে মাথা দিলে পশ্চিমে পা রাখে। ঘুমের রুলস রেগুলেশনের ওপর বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে। রুবি হঠাৎ করে বলে বসল,
‘অরু কিছুটা ওয়েট গেইন করছে বোধহয়।’
সুমিতা বেগম আদুরে স্বরে মেয়েকে ছুঁতো ধরে বকেন,
‘খাওয়াদাওয়া নিয়েও খুব ঝামেলা করছে। এটা খাবে না, ওটা খাবে না। আজ কোনোরকমের মাছ ছুঁয়েও দেখল না।’
এই বাক্য শুনেই তন্ময় মুখ খুলল। একই সময়তে আনোয়ার সাহেবও। এবং দুজনের কথার মানে একই দাঁড়াল, ‘কী খেতে পছন্দ করছে?’
প্রশ্ন করেই চাচা, ভাইপো চোখাচোখি করল। মোস্তফা সাহেব হেসে ফেলেছেন। শব্দ করে হেসে আকাশ বলল,
‘চাচ্চু তুমিতো দেখি নিজের দ্বিতীয় কপি মেয়ের জন্য পেয়ে গেছো।’
এতে অট্টহাসির রোল পড়ল। অরুর ঘুম তবুও ভাঙল না। তবে সে ঘুমের মধ্যে মিটিমিটি হাসছে। অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলছে! তন্ময় ঠিক শুনতে পেলো না। তবে সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখছে।
———
কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে অতিথিদের আনাগোনা।
বধূ রূপে স্টেজে বসে আছে শাবিহা। পাশেই অয়ন। কাজি বিয়ে পরিয়ে উঠেছেন মাত্রই। তন্ময় তাকে নিয়ে বসিয়েছে খাবার টেবিলে। খেয়েদেয়ে যাবে। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে পরপরই।
মোস্তফা সাহেব আর আনোয়ার সাহেব এদিক-ওদিক ছুটছেন। খাওয়াদাওয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। ওয়েটারদের বিশ্লেষণ দিচ্ছেন এদিক যাবার তো ওদিক। তন্ময় খেয়াল করল শাবিহা এখনো কাঁদছে। অয়ন অস্থির হয়ে ঝুকে কিছু একটা ফিসফিস করে বলে চলেছে। কান্না থামানোর অস্থির প্রচেষ্টা। অরুর চোখ রক্তিম। এককোণে বসে আছে। শাবিহা কবুল বলার সময় কেঁদেছে। সাথে ভ্যা ভ্যা করে এই মেয়েও কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে বলছিল,
‘আপু তাড়াতাড়ি কবুল বলো। ভাইয়াকে আর কত অপেক্ষা করাবে।’
শাবিহা আর অয়নের যদি কোনো নাটক থাকতো সেই নাটকের এক নাম্বার ফ্যান হতো এই মেয়ে। সারাদিনব্যাপি হাপিত্যেশ করে বেড়াতো। এখন যখন অবশেষে দুজন দুজনার হয়েছে চিরতরে… নিশ্চয়ই খুব খুশি ও? অরু এযাত্রায় চাইল। ভেজা ভেজা চোখজোড়া দেখে তন্ময় আর অদূরে থাকতে পারল না। এগুল ওর দিকে। কাছাকাছি এসে ছুঁয়ে দিলো ওর চোখের কোণ,
‘এতো কাঁদার কী আছে? পাশের বাসাতেই থাকবে। প্রত্যেকদিন দেখতে পাবি।’
অরুর চোখ ফের ভিজে উঠল, ‘পাশের বাড়িতে! আমাদের বাসায় তো নয়।’
বারংবার নিজেকে বোঝানো কথাটির বাস্তব রূপী এই কথা শুনে তন্ময়ের শান্ত করা হৃদয় ফের অশান্ত হলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার এই তীব্র চেষ্টা যেন বিফলে যেতে উতলা। শাবিহাকে যখন সাজানো গাড়িতে তুলে দেয়া হবে, তখন যেন আর স্বাভাবিক থাকা সম্ভব হলো না। শাবিহা বাবার পর এবার বড়ো ভাইয়ের বুকে মিশে কান্নায় মত্ত। তার হাউমাউ করা কান্না শুনে অস্থির হয় তন্ময়। পুতুলের মতন আগলে রাখা ছোটো বোন যে কীভাবে এতটা বড়ো হয়ে গেল! এইতো বিয়ে দিয়ে দিতে হচ্ছে। সারাজীবনের জন্য অন্যের ঘর করবে। এই বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর। তন্ময় দু'হাতে আগলে নিলো বোনকে। মাথায় হাত বুলিয়ে চলল ক্রমাগত। তার রক্তিম চোখজোড়া আজ আর লুকোনোর কোনো পথ নেই। মোস্তফা সাহেব কেঁদে ফেলেছিলেন মেয়ের সাথে। অয়নের দু’হাত ধরে প্রলেপ করছেন এখনো। অয়নের নিজের চোখজোড়াও ভেজা। সে বারংবার, সবভাবেই আশ্বস্ত করে যাচ্ছে। এতে কী আর আশ্বস্ত হয় বাবা, ভাইয়ের মন? এই নিষ্ঠুর যন্ত্রণার কোনো আশ্বস্তে শান্ত হয় না। শান্ত হয় সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে। অবশেষে শাবিহাকে তন্ময় গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। তুলে দিলো অয়নের দু’হাতে। শাহজাহান পরিবারের সামনে দিয়ে গাড়িটা ধীরেসুস্থে চলে গেল। গ্রাউন্ড ফ্লোরে তখন সবাই অবস হয়ে দাঁড়িয়ে। তন্ময় নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো খুব জলদি। মোস্তফা সাহেব নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তন্ময় বাবাকে ধরল দু’হাতে। কাঁধ জড়িয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। বারবার করে আদেশের মতন বলে গেল,
‘এতো মন খারাপ করছো ক্যানো? পাশের বাড়িতেই তো। প্রতিদিন চারবার করে দেখতে যাব।’
আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেবও গাড়িতে উঠে বসেছিলেন। এহেন কথাতে হেসে ওঠেন পালাক্রমে। মোস্তফা সাহেব সামান্য স্বাভাবিক হলেন। আকাশ উঠে বসেছে ড্রাইভিং সিটে। গাড়িটা সে টেনে বেরিয়ে গিয়েছে। বাকিরাও মিলেমিশে অন্য এক গাড়িতে উঠে বসেছে। তন্ময় সেই গাড়ির ড্রাইভিংয়ে বসেছে৷
অরু তার পাশের সিটেই। হাতে টিস্যু। মেকাপ গলগল করে পড়া চোখের জলে মিলেমিশে যাচ্ছেতাই অবস্থায় অবস্থান করছে। এখনো নাক টেনে যাচ্ছে একমনে। আড়চোখে বারবার করে তন্ময়কে দেখছে খুব নিপুণ কৌশলে। ও পাশে থাকলে তন্ময় কখনোই দীর্ঘসময় মন খারাপ করে থাকতে পারবে না। সম্ভব না।
.
.
.
চলবে................................................