মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ১৫ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


বছর তিনেক আগে.............

কৌশিক প্রয়োজনের তাগিদে ইতালির মাটিতে পা রেখেছিল। অপরিচিত শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সে জীবনের জটিল সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত। একদিন, ক্লান্তি ও অসতর্কতার মাঝে, সে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেছিল। গাড়ির গতি ছিল বেপরোয়া, আর এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত তাকে ভয়ঙ্কর এক দুর্ঘটনার মুখোমুখি করে।

রাস্তার এক তীক্ষ্ণ মোড়ে ব্রেক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে ধাক্কা খায় রাস্তার ধারে থাকা একটি মোটা লোহার খুঁটির সঙ্গে। সংঘর্ষের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, গাড়ির সামনের অংশ সম্পূর্ণ দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল। ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া উঠছিল, আর জানালাগুলো ভেঙে চারদিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়েছিল।

কৌশিক দুর্ঘটনার ধাক্কায় স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে সজোরে আঘাত পায়। তার কপাল ফেটে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছিল। ডান হাতে গভীর কাটা দাগ, পাঁজরের কয়েকটি হাড় ভেঙে গেছে। মুখে, ঘাড়ে আর পিঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কাঁচের টুকরোর ক্ষত। তার নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছিল, চোখ বুজে বুজে আসছিলো।

গাড়ির দরজা আটকানো ছিল, বাইরে দাঁড়ানো মানুষদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। রাস্তায় প্রচন্ড ভিড় জমে গিয়েছিল। কেউ একজন ফোনে সাহায্য চাইছিল, আর অন্যরা গাড়ি ভেঙে তাকে বের করার চেষ্টা করছিল। রাস্তার ধুলো আর রক্ত মিলে এক ভয়াবহ দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। কৌশিকের ভারী পোশাক ভিজে ঝপঝপে অবস্থা। মুখে কাঁচের টুকরো লেগে কেটেকুটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।

অনেকটা সময় পর যখন কৌশিকের জ্ঞান ফেরে, নিজেকে হসপিটালের বেডে শয়ন অবস্থায় আবিষ্কার করে। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিল অ্যামোনিয়ার গন্ধ আর মনিটরের বিচ্ছিন্ন শব্দ। তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়া, ক্ষতস্থান থেকে রক্ত তখনো ঝরছিলো, ভেতর থেকে ব্যথার তীব্রতা বেড়েই চলেছিল।

কৌশিক উঠে বসার চেষ্টা করতেই সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ে। দুর্বল হাতে আশেপাশে কাউকে খুঁজে পায় না। রুমে একটি বড় কাঁচের জানালা ছিল, যেখান দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছিল ভেতরে। হঠাৎ সেই আলো তাকে প্রচণ্ড টানতে থাকে। ব্যথার তীব্রতা যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়।

জানালার দিকে টলমল পায়ে এগিয়ে যায় কৌশিক। তার শ্বাস ভারী, চোখে ছিলো কষ্টের ছাপ। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সে চন্দ্রের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ, এক চিৎকারের সঙ্গে সে জানালায় ঘুষি মারে। কাঁচ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়, বিকট শব্দ রুমের নীরবতা ভেঙে দেয়।

হাওয়া তার র'ক্তাক্ত শরীর ছুঁয়ে যায়। ব্যান্ডেজগুলো ধীরে ধীরে খুলে পড়তে থাকে। কৌশিক চাঁদের আলোয় সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ তার বুকের ডান পাশ থেকে আকাশি রঙের ঝলকানি বের হয়, যা পুরো রুম আলোকিত করে দেয়। সেই আলো চাঁদের শক্তি শুষে নিতে থাকে। সমগ্র রুম আলোয় ভরে যায়।

যন্ত্রণায় কৌশিক গর্জে ওঠে, হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। রক্তের ধারাগুলো মেঝে বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তার মুখমন্ডলে ছিল অদ্ভুত এক জেদ। হঠাৎ তার শরীরের ক্ষতস্থানগুলো আলো ছড়াতে ছড়াতে ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করে। এক মুহূর্ত পর সে নিথর হয়ে রক্তাক্ত মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।

রুমে তৎক্ষণাৎ এক নার্স প্রবেশ করে। সামনের ভয়ানক দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠে "হেল্প! হেল্প!" বলে। কিন্তু সেই চিৎকার থেমে যায়, যখন কৌশিক আচমকা চোখ খুলে বসে। তার চোখের মণি গাঢ় আকাশি রঙে বদলে যায়। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে, শরীর জুড়ে নতুন এক সাহসিকতার রক্ত বইতে থাকে যা পূর্বাভাস দেয় ধ্বংসের।

কৌশিক এক গর্জনে উঠে দাঁড়ায়। তার শরীরের ভঙ্গি পশুর মতো, প্রতিটি পেশী শক্তিতে ভরপুর। সিংহের মতো এক লাফে নার্সের সামনে এসে দাঁড়ায়। নার্সটি আতঙ্কে পেছনে হটে যেতে চায়, কিন্তু তার পা স্থির হয়ে যায়। কৌশিক দ্রুত দরজার দিকে তাকায়, তার বাম হাতের এক আঙুলের ইশারায় ওটির দরজা শক্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তারপর কৌশিক ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যায় নার্সের দিকে। নার্সটি ভয়ে আতংকে আবারো চিৎকার করে উঠে, হেল্প উচ্চারণ করার আগেই কৌশিকের বাম হাত নার্সের পেটের অন্দরে প্রবেশ করে খুবলে ছিঁড়ে ফেলে, তছনছ করে দেয় নাড়িভুঁড়ি আর ভেতরের সবকিছু।

নার্সের চোখ লাল হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসে, মুখ থেকে বের হয় করুণ গোঙানি। তার দুই চক্ষু হতে ভয়ের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে , কিন্তু কণ্ঠস্বর বের হয়েও হয় না। কৌশিক তার আরেক হাত দিয়ে নার্সের চোয়াল শক্ত করে ধরে। নার্সটি বাধ্য হয়ে তার চোখের দিকে তাকায়। কৌশিকের চোখের আকাশি আলো নার্সের শরীরের ভেতর থেকে সব শক্তি শুষে নিতে থাকে।

কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই নার্সের নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে যায়। কৌশিক ঠোঁটের কোণে সেই একই রহস্যময় হাসি ধরে রেখে জানালার দিকে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে ভাঙা কাঁচ সরিয়ে এক লাফে জানালা দিয়ে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর পেছনে রেখে যায় এক বিভীষিকাময় নীরবতা।

কৌশিক সেদিনই প্রথম অনুভব করেছিলো, তার শরীরে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত শক্তি কতটা বিপজ্জনক। চন্দ্রের আলো আর তার অভ্যন্তরীণ শক্তি মিলিত হয়ে তাকে এক পাগলাটে প্রাণীতে রূপান্তরিত করেছিল। সেই শক্তি নিয়ন্ত্রণ রাখা বড়ই কঠিন, কৌশিক নিজের মধ্যে থাকে না তখন। ওইদিন ও সে পারেনি নিয়ন্ত্রণ করতে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চারপাশের মানুষদের ওপর।

এক লাফে গাছের ডাল থেকে বিল্ডিংয়ের ছাদে, সেখান থেকে রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যাচ্ছিল সে। তার দেহে ছিল শুধুই রক্তের চিহ্ন। চোখে ফুটে উঠেছিল এক ভয়ংকর পৈশাচিক রূপ।

যাকেই সামনে পাচ্ছিল, কৌশিক দুই হাতে তুলে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল। কখনো কারও বুক চিরে, কখনো গলা ধরে আকাশে ছুঁড়ে ফেলে, আবার কখনো স্রেফ তাদের শক্তি শুষে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছিল প্রাণহীন দেহ।

ইতালিতে সেই সময় এই ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। শহর জুড়ে ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় ছিল মৃতদেহ, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া রক্তের লাল ধারা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কেউই তার রক্তমাখা চেহারা কিংবা তার গতিবিধি স্পষ্ট করে মনে করতে পারেনি।

কৌশিক কয়েক ঘণ্টা ধরে এই অস্বাভাবিক, হিংস্র আচরণ চালিয়েছিল। তারপর, চন্দ্রের আলো যখন ম্লান হতে শুরু করেছিল, তার শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে লাগল। সে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, যেন এক ঘোর থেকে জেগে উঠেছিল। চারপাশের দৃশ্য দেখে তার নিজেরই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। সেদিন সে বুঝেছিল, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা শক্তি কতটা ভয়ানক হতে পারে।

পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই কৌশিক নিজের গালে কয়েকবার জোরে চাপড় দিলো, সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলো মনে করতে চায় না সে। 
তারপর হুংকার দিয়ে নিককে উদ্দেশ্য করে বললো,
"শাট আপ! চাঁদ অনেক ডেঞ্জারাস! আমি আর সেই অতীতের কথা মনে করতে চাই না!"

নিক অবাক হয়ে দ্রুত তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
"কেনো? এত ভয় পাচ্ছো কেনো?"

কৌশিক গভীর শ্বাস নিয়ে নিকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
"লিসেন! চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। এটি সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে আলোকিত হয়। আর সেই সূর্যের প্রতিফলিত স্বল্প আলোই আমার শরীরে প্রবেশ করে অদ্ভুত এক খারাপ প্রভাব ফেলে। সেই আলো আমাকে হিংস্র প্রাণীতে রূপান্তরিত করে। তখন আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।"

নিক চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকতেই কৌশিক আরো যোগ করলো,
"তাছাড়া অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। আমার অভ্যন্তরীণ শক্তি শুধু শোষণ করতে জানে। যদি কোনোদিন এর মাত্রা ছাড়িয়ে যায় একে তো পৃথিবী ধ্বংস হবে, দুই আমি কি করবো তা নিজেও জানি না।"

তার কথা শুনে নিক হতভম্ব হয়ে গেলো। এই প্রথমবার সে কৌশিকের ভয় আর যন্ত্রণার গভীরতাটা অনুভব করতে পারছে।

অনন্যা কৌশিকের ঢিলেঢালা প্যান্ট আর কালো টিশার্ট পরে ড্রয়িং রুমে পা রাখলো। তার চুলগুলো কাঁধের দুই পাশে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিল, মনে হচ্ছে সেগুলো গুছানোরও সময় পায়নি মেয়েটা। কাঁচা ভোলাভালা মুখশ্রীতে এক ধরনের সরলতা ঝরে পড়ছিল, যা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, অনন্যা অনেকটাই নির্ভার এবং শিশুসুলভ।

নিক আর কৌশিক নিজেদের কথাবার্তা থামিয়ে মুহূর্তের জন্য অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত নির্দোষ আকর্ষণ ছিল। দেখে মনে হয় কেউ মেয়েটাকে কিছু বললে সহজেই বিশ্বাস করে নেয় সবকিছু।

পায়ে নরম স্লিপার পরে অনন্যা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। লারাকে সে আজ ছুটি দিয়ে তার রুমে পাঠিয়েছে। তবে লারা যাওয়ার আগে রান্নার জন্য কাটাকুটির কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিল। অনন্যা চলে যাওয়ার পর নিক বললো,
"কিউট গার্ল!"

কৌশিক বসা থেকে উঠে বললো,
"নট ইউরস!"

নিকের মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটলো। কৌশিক হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কিছু মনে করলো, তাই দাঁড়িয়ে পড়লো। সে আবারও ফিরে নিকের সামনে এসে দাঁড়ালো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে, একটু কেশে বললো,
"নিক! আমার মুখের দিকে তাকাও।"

নিক কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে কৌশিকের দিকে তাকালো। কৌশিক জিজ্ঞেস করলো,
"আমি কী দেখতে ইঁদুরের মতো?"

নিক চিন্তিত হয়ে কৌশিকের সামনে দাঁড়ালো। একবার ডান সাইডে দাঁড়িয়ে দেখলো, আরেকবার বাম সাইডে। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর বললো,
"দেখি ঠোঁট উঁচু করো।"

কৌশিক ঠোঁট উঁচু করলো। নিক হাত তালি দিয়ে বললো,
"হুম, ঠোঁট উঁচু করলে কিছুটা ইঁদুরের মতোই লাগে। বাই দ্য ওয়ে, কে বলেছে এটা? তোমাকে গভীরভাবে দেখেছে হয়তো। আর কী কী বলেছে শুনি?"

কৌশিক একটুখানি নাক ফুলিয়ে "কিছু না" বলে সামনে হাঁটা শুরু করলো।


অনন্যা নিজের মতো করেই বাঙালি খাবার রান্না করছিল। ধোঁয়া ওঠা পাতিলে লাফিয়ে উঠছিল ডাল, পাশে সসপ্যানে কষানো হচ্ছিল মাছের ঝোল। রান্নার ঘরে ভরপুর খুশবু ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাধ সাধল কৌশিক স্যার। ডাইনিং টেবিলে একদম চোখের সামনে বসে ম্যাগাজিন হাতে, যেন ওর প্রতিটি কাজ নজরদারি করছে। নির্লিপ্ত চেহারা মনে হচ্ছে গভীর মনোযোগ দিয়ে বসে আছে ম্যাগাজিনে। কিন্তু অনন্যা জানে লোকটা তার দিকে নজর রাখার জন্যই বসে আছে।

অনন্যা বিরক্তিতে ঠোঁট কামড়াল।
"এই লোকটা কি করার কিছু পায় না?" মনে মনে বিরবির করে উঠল সে।

তার মধ্যে চুলগুলো সামনে পড়ে বারবার কাজের অসুবিধা করছে। চুল বাঁধার মতো কিছু নেই। আগে জানলে বাসা থেকে বস্তা ভরে জিনিসপত্র নিয়ে আসতো। মেয়েদের যে কতকিছু দরকার হয়, তা ওদের থেকে ভালো আর কেউ বুঝবে না। অগত্যা নিজের হাত দিয়েই সামলে নিল চুলগুলো। বেসিনে গিয়ে আবারো হাত ধুয়ে আসতে হলো‌।

কৌশিক ম্যাগাজিনটা টেবিলে রেখে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। হাত দিয়ে ঝোলানো চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিলো। অনন্যা মাথা নিচু করে নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল, আর মনে মনে ভাবছিল,
"এই লোকটা আবার রান্নাঘরে কেন? কী চাই এর?"

কৌশিক রান্নাঘরে ঢুকে চারপাশটা নিরীক্ষণ করতে লাগলো। কড়াইতে ফুটতে থাকা খাবারের গন্ধ গভীর শ্বাসে টেনে নিলো, যেন খাবারের স্বাদ অনুমান করার চেষ্টা করছিল। রান্নাঘরের নীরবতা একটুখানি কৌতূহল মাখা অস্বস্তি তৈরি করলো।

হঠাৎ, কৌশিক চামচের সেট থেকে একটা কাঁটা চামচ তুলে নিলো। কিছুক্ষণ পরখ করে নিলো চামচটি। অতঃপর কোনো কথা না বলে সে অনন্যার পিছনে দাঁড়ালো। অনন্যার খোলা চুলগুলো তার কাজের পথে বারবার এসে পড়ছিল। কৌশিক দু'হাত বাড়িয়ে তার চুল আলতো করে গোছালো। নরম হাতের স্পর্শে মুহূর্তে থমকে গেল অনন্যা। স্থির হয়ে দাঁড়ালো। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠলো। 

চামচটা দিয়ে চুলগুলো পেঁচিয়ে কৌশিক শক্ত করে আটকে দিলো। কৌশিকের আঙুলের হালকা শীতলতা আর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পিঠে অনুভব করে অনন্যার সারা শরীরটা শিউরে উঠলো।

অন্যদিকে, কৌশিক তার কাজ শেষ করে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি নিয়ে পেছনে সরে দাঁড়ালো।
হালকা গলায় বললো,
"এখন তো আর সমস্যা হচ্ছে না, তাই না?"

অনন্যা মৃদু কাঁপা গলায় বললো,
"না, ধন্যবাদ।"
আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিলো অনন্যা, অস্বস্তি ভাবটা একটুও কমেনি, উল্টো লোকটার করা কাজটি তাকে বেশি করে ভাবিয়ে তুলছে। 

★★★★★

"দেখি বড় করে হাঁ করুন!"

কৌশিক ভ্রু দ্বয় উঁচিয়ে পাশ ফিরে অনন্যার দিকে তাকালো। শঙ্কাজনক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"কেনো? কেনো হাঁ করবো?"

অনন্যা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, "লারাকে দিয়ে ব্যথার ট্যাবলেট আনিয়েছি। ট্যাবলেট খেলে ব্যথা সেরে যাবে, পরে আমি ব্যান্ডেজ করে দেবো নাহয়।"

কৌশিক ডাইনিং টেবিলের উপর মাথা নিচু করে বললো, "এসব ট্যাবলেট আমার শরীরে কাজ করবে না, বরং বিক্রিয়া করে নেশা দ্রব্য হয়ে যাবে। আমি ঠিক আছি। চিন্তা করতে হবে না তোমার।"

অনন্যার রাগ একটু বেড়ে গেলো, তাও সে ঠাণ্ডা মাথায় বললো, "আপনাকে কি কিছু জিজ্ঞেস করেছি? শুধু হাঁ করতে বলেছি। হাঁ করবেন। এত কথা কেন বলছেন?"

কৌশিক চোখ মুখ কুঁচকে বললো, "সবসময় ঝগড়াঝাঁটির মুডে থাকো কেনো তুমি? বললাম তো, লাগবে না।"

অনন্যা হঠাৎ নাক মুখ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, "খেতে বলেছি। খাবেন। সবসময় এতো ঘাড়ত্যাড়ামি পছন্দ হয় না।"

কৌশিক কিছু বলার আগেই অনন্যা তার মুখ চেপে ধরে ট্যাবলেট ঢুকিয়ে দিলো, সাথে পানি ঢেলে দিলো গ্লাসে, তারপর কৌশিকের মুখে। তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো অনন্যা। কৌশিক পানি গলাধঃকরণ করতে গিয়ে হেঁচকি উঠিয়ে ফেললো। একবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে। মেয়েটা এতো পরিমাণ জেদী কেনো? যা বলবে করতেই হবে, এমন মনে হচ্ছে।

নিক অনন্যা আর কৌশিকের কাণ্ড দেখে দূর থেকে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসলো। কৌশিকের পাশে আরেক চেয়ার টেনে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
"ব্রো, ভালোই একটা বাসায় এনেছো। কথার হেরফের হলেই মাথায় আগুন ধরে যায়। একদম তোমাকে টেক্কা দেওয়ার মতো মেয়ে।"

কৌশিক আরো এক গ্লাস পানি পান করে বিরক্তের সাথে বললো,
"নিক! মজা করবে না বলে দিলাম। এমনিতেই কী খেয়ে ফেললাম!"

কিছুক্ষণ থেমে আবারও বললো,
"যাই হোক, তুমি আজ বাসায় কেনো?"

"আজ ক্ষুধা কম তাই আরাম করছি। "
নিকোলাই হাত ছড়িয়ে বললো কথাটা। কৌশিক বোঝার ভান করে মাথা নাড়লো।

অনন্যা লারা, তামংকে ডেকে নিয়ে এসে সবাইকে নতুন ডাইনিং টেবিলে ঠিকঠাক বসিয়ে প্লেট, খাবার দাবার নিয়ে আসলো। লারাও উঠে সাহায্য করলো তাকে। তামং সাধারণত কম কথা বলে, তবে লারার সাথে নিজের রুমে বেশ বকবক করে বোঝা যায়।

সবাইকে খাবার দিয়ে অনন্যা বললো,
"শুনেছি, আপনাদের তিন বন্ধুর কোনো ফ্যামিলি নেই। তাই মাঝে মাঝে এভাবে ফ্যামিলি টাইম স্পেন্ড করবো আমরা। সেদিন আমি রান্না করবো, সেটা মাসে একদিন হতে পারে অথবা দুই-তিন দিন। এখন খাওয়া শুরু করুন।"

লারা আগ বাড়িয়ে বললো,
"তুমিও বসো। একসাথে খাও।"

"হ্যাঁ খাবো! আগে দেখে নেই আমার হাতের রান্না কেমন লাগলো আপনাদের", অনন্যা হাসিমুখে উত্তর দিলো।

চারজনে খাবারের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির সাথে মুখে দিলো। কিছুক্ষণ পরে লারা, তামং ছাড়া বাকি দু'জন চুপচাপ বসে রইল। অনন্যার চোখ সরু হয়ে এল। ওদের খাবার চলছে না কেনো?

কৌশিক কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর একবার ফুস করে ধোঁয়া ছাড়লো। তারপর এক গ্লাস পানি পান করলো। অন্যদিকে, নিকের অবস্থা খারাপ, সে গ্লাসের পর গ্লাস পানি খাচ্ছে। একসময় নিক অনন্যার দিকে তাকিয়ে হাসার ভান করলো। অনন্যা তাকে প্রশ্ন করলো,
"কেমন লাগছে?"

নিক একটুখানি হাসি দিয়ে বললো,
"ভালো, খুব ভালো।"

এদিকে, কৌশিক আর খেতে পারছে না, নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। অনন্যা তাকে দেখে বললো,
"খাচ্ছেন না কেনো?"

কৌশিক অসহায়ভাবে তার দিকে তাকালো , চোখ পিটপিট করে বললো,
"এতো ঝাল দেওয়ার পরিবর্তে বি'ষ দিয়ে দিতে তাহলে ভালো হতো!"

লারা এক মুহূর্ত দেরি না করে বললো,
"ঝাল খাবার তো আমগোর ঠিক হ্যায়। কিন্ত সাবেরা তো এত ঝাল খায় না। উনারা সব পাতলা পাতলা খায়া পছন্দ করে।"

অনন্যা মাথা চুলকে অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে বললো,
"এতে আমার কী দোষ? বাঙালি রান্না ঝাল না হলে ভালো হয় না।"

কৌশিক জোরে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ ঘুরিয়ে বললো,
"অত্যাধিক ঝাল। আমি নিতে পারছি না।"

অনন্যা নাক ফুলিয়ে বললো,
"আপনি তো আমার কোনোকিছুই নিতে পারেন না। এটা তো সামান্য খাবার।"

কৌশিক বিরক্ত হলো, কঠোর গলায় উচ্চারণ করলো,
"বেশি বলো না। যা সত্যি তাই বলেছি। নিকের অবস্থা দেখো, ও তো খেতে পারছে না।"

অনন্যা নিকের দিকে তাকালো। বেচারা লালচে মুখ নিয়ে, একবারে কষ্ট সহ্য করেই খাচ্ছে। আর অন্য হাত দিয়ে টিস্যু টানছে, নাক মুছছে।

নিক অনন্যার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
"না, ঝাল হয়েছে। তাও ভালো হয়েছে। তাই না খেয়ে থাকতে পারছি না।"

কৌশিক ইংরেজিতে কয়েকটা গালি দিলো তাকে, মেয়ে মানুষ দেখলে ছেলেটা সব ভুলে যায়। অনন্যা বুক ফুলিয়ে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললো,
"দেখলেন এটাকেই বলে মেয়েদের প্রতি সম্মান করা। উনিই একদম রিয়াল ম্যান। আপনার মধ্যে সেটা নেই। আপনার কাছে তো ভাতের ফেন ও ভালো লাগবে পাতলা পাতলা।"

কৌশিক ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত ঝাড়ি দিয়ে বললো,
"ঠিক আছে, ভাতের ফেনই নিয়ে আসো। কিন্তু এসব আমি খেতে পারছি না।"

অনন্যা কটমটিয়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর কৌশিক প্লেট ঠেলে দিয়ে উঠে গেলো। অনন্যার খুব খারাপ লাগলো বিষয়টা। উনি আগে বলে দিলেই তো হতো, অনন্যা উনার জন্য অল্প ঝাল দিতো। কতক্ষণ তো চোখের সামনেই বসে ছিল। সব ওকে জ্বালানোর ফন্দি।

সবাই খাওয়া শেষে উঠে গেলে লারা সব পরিষ্কার করতে লাগলো। লারা কৌশিকের প্লেট নিতে নিলে অনন্যা বারণ করলো। তার প্লেটেই খেলো অনন্যা। এতো গুলো খাবার ফেলে দেওয়া একদম উচিত কাজ হবে না। 


কৌশিকের মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। সারাক্ষণের গম্ভীর ভাবটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। চারপাশটা কেমন গোলমেলে লাগছে, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিজের রুমে বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে সে। হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকালো। আস্তে ধীরে আশেপাশের কিছু পরিমাণ বায়ুকে কাবু করলো সে। কিন্তু মুহুর্ত পরে আবারো কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছে, মনোযোগ দিতে পারছে না। স্পেলগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারছে না, নিজের উপর বিরক্তি এসে জমেছে।

মনে হচ্ছে এই অস্বস্তি অনন্যার দেওয়া ওষুধের জন্যই। তবু ভেতরে এক তীব্র কষ্ট তাকে গ্রাস করে রেখেছে। সে তো আর সম্পূর্ণরূপে মানুষ না, যে একটি ট্যাবলেটেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই ব্যথা তার শরীরের প্রতিটি কোণে গেঁথে আছে, প্রতিটি শিরায় শিরায়, প্রতিটি লোমকূপে খুব আবেশে বাস করে যাচ্ছে, মাত্রা বাড়াচ্ছে দিনের পর দিন। তবে কৌশিক চায়ও না ব্যথা সাড়ুক। এই ব্যথাই তার শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, তাকে মনে করিয়ে দেয় সীমা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৌশিক রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঘুম বলে তার জীবনে‌ কিছু নেই, চুপ করে কতক্ষণ এভাবেই বসে থাকতে থাকতে হয়তো মাথা চক্কর দেওয়াটা ঠিক হয়ে যেতে পারে। কিয়ৎকাল পর, হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ এলো। কৌশিক বসে থেকেই হাতের ইশারায় দরজা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অগত্যা বিছানা থেকে নেমে হেলেদুলে হেঁটে দরজা খুলতে হলো। 

অনন্যা এসেছে। ট্রে হাতে কৌশিকের রুমে ঢুকলো সে। ট্রেতে এক গ্লাস দুধ আর পাউরুটি। কৌশিক দুধের গ্লাস দেখে নাক কুঁচকে ফেললো। এটা তার একেবারেই অপছন্দের। দরজা খুলে আবার বিছানায় বসলো কৌশিক। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ট্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। অনন্যা কৌশিকের রুমে প্রথমবার আসলো। রুমটা বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। একপাশে একটা কালো ডিভান রাখা আছে, তার পাশে বুকশেলফ। টেবিল রয়েছে হাতের ডান দিকে। টেবিলে কম্পিউটার রাখা সাথে চেয়ার। রুমের মাঝেই বিছানা। বিছানার পাশেই একটা পেঁচানো সিঁড়ি সম্ভবত ছাদে যাওয়ার জন্য।

অনন্যা টেবিলে ট্রে রেখে পেঁচানো সিঁড়ির দিকে তাকালো। বিস্মিত হয়ে বললো,
"আহ... আপনার রুমে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি! আমি তো ভাবছিলাম, এই বাড়িতে ছাদে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।"

কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে রইলো। অনন্যা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা উপরে উঠে দেখে আসলো। ছাদে যাওয়ার জন্য আবার একটা ঢাকনা জাতীয় কিছু একটা খুলতে হয়। বিষয়টা বুঝে আবার নিচে নেমে আসলো, হেঁটে দাঁড়ালো কৌশিকের সামনে। ট্রে থেকে দুধের গ্লাসটা সামনে ধরে বললো,
"নিন! দুধ খেলে শক্তি বাড়বে।"

কৌশিক উদাস চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর আচমকা হাত দিয়ে গ্লাস সরিয়ে দিলো। মুখ শক্ত করে বললো,
"আমি এসব খাই না। আর পরেরবার আমার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তোমার চিন্তা করার দরকার নেই।"

অনন্যার হাত ফসকে গ্লাস নিচে পড়ে গেলো। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। কেঁপে উঠলো অনন্যা। মেঝের দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। কেউ জোরে কথা বললে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, কান্না এসে পড়ে। আজ ও পারলো না, চোখে অশ্রু এসে ভর করলো, কিন্তু তারপরও নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করলো। 

কান্না ভেজা গলায় বললো,
"থাকবো না। আমি বেশিদিন থাকবো না এখানে। কিছু টাকা জমিয়ে চলে যাবো। আপনার এই দয়া বা সহানুভূতি আমার দরকার নেই। তাছাড়া, তখন আপনি নিজেই বলেছিলেন, আমাদের সম্পর্ক মুখের কথায় শেষ হয়ে গেছে। বারবার আপনার বোঝা হয়ে থাকতে চাই না আমি। আর চিন্তা করবো না আপনাকে নিয়ে। সময় হলে ঠিক চলে যাবো। কিছুদিন অপেক্ষা করুন।"

এটুকু বলে অনন্যা হাঁটু গেড়ে ভাঙা গ্লাসের টুকরো তুলতে শুরু করলো। চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলো না, চুপচাপ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।

কৌশিক কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে বসে রইলো। তার ভেতরে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। কিছু বলবে কিনা বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে কী হয়ে যায়, কী করে বসে নিজেই বুঝতে পারে না। এমনিতেই মাথাটা কেমন যেন করছে, তার মধ্যে এসব! অবশেষে কৌশিক ধীরে ধীরে বললো,
"থামো। তোমার হাত কেটে যাবে। আমি..."

কথাটা শেষ করার আগেই অনন্যা মাথা উঁচু করে তাকালো। চোখে জমে থাকা অশ্রু গাল বেয়ে নেমে আসছে। সে ধীরে ধীরে বললো,
"এখন আর কিছু বলবেন না। আমার ভুল ছিল আপনার জন্য কিছু করতে যাওয়া।"

কৌশিক বিছানা থেকে নেমে শক্ত করে অনন্যার বাহু চেপে ধরে তাকে দাঁড় করালো। অগোছালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"না, আমার ভুল হয়েছে। আমার কারণে ভেঙে গিয়েছে তাই এসব করতে হবে না তোমাকে।"

অনন্যা হাতের বাহু ছাড়িয়ে বললো,
"ডোন্ট টাচ মি! আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে ছোঁয়ার!"

কৌশিক চরমভাবে ক্ষেপে গেলো, আকস্মিকভাবে বাক্য দুটো তার ভেতরটাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেলো। আচমকা তার চক্ষুযুগল জ্বলে উঠলো, আকাশি মণি গাঢ় নীল হয়ে জ্বলজ্বল করতে লাগলো। কৌশিক হুট করে অনন্যার হাতের কব্জি ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। এক হাত দিয়েই শরীরের সাথে চেপে ধরলো মেয়েটাকে। কৌশিকের আকস্মিক কর্মকাণ্ডে অনন্যা চমকে উঠলো। চোখের পানি অজান্তেই শুকিয়ে গেলো।

কৌশিক মুখে রহস্যময় হাসি টেনে মাথা ঝুঁকিয়ে অনন্যার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
"ডোন্ট টাচ মিই? শোন মেয়ে, তুই আমার টাচ ছাড়া এই জীবনে আর কারো টাচ পাবি না!"

কৌশিক আরো জোরে হুংকার দিয়ে বললো,
"আই উইল টাচ এভ্রি পার্ট অফ ইউর বডি! লেট'স সি হু স্টপস মি!"

অনন্যা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো, কিন্তু কৌশিকের শক্তি যেন অমানবিকভাবে বেড়ে গেছে। তার আঙুলের বাঁধন হয়ে গেছে পাথরের মতো শক্ত। অনন্যার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বললো,
"প্লিজ, স্যার! ছাড়ুন আমাকে। আমি আপনার সাথে নিজেকে আর জড়াতে চাই না। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আপনি মনে হচ্ছে নিজের মধ্যে নেই!"

কৌশিক হঠাৎ কর্কশ হাসিতে ফেটে পড়লো। সেই হাসি এতোটাই হিংস্র যে ঘরের দেয়ালগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার চোখে অদ্ভুত নীল আগুন জ্বলছে। হাসি থামিয়ে আবারো ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে, নেশাময় কণ্ঠে কৌশিক বললো,
"এখন বলে আর কী হবে? আমি প্রচণ্ড রেগে গেছি। রেগে গেলে আমি কারো কথা শুনি না। আর কী যেন বলেছিলে? আমাদের সম্পর্ক শেষ?

যে সম্পর্ক আমি শুরু করিনি, সেটাকে শেষ করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এখন যা শুরু করবো, তার শেষ তোকে দেখিয়েই ছাড়বো।"

অনন্যার শরীর কাঁপতে শুরু করলো, ভয়ে ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। তার স্থান এখনো কৌশিকের বুকের নিচের অংশে। যেখানে সুখ পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে মাথা রেখে দমবন্ধ অনুভূত হচ্ছে অনন্যার। চোখ উপচে পানি বেরিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আজকে তার জীবনের শেষ দিন। লোকটা কী করতে চাইছে তার সাথে? স্যারের চেহারায় কত মলিনতা, সাবলীল ভাব ছিল। আর ভেতরে ভেতরে এই লোকটা শয়তানের আরেক রূপ। যদি সে আগে জানতো বিয়ে করতো কী এই দুমোখো লোকটাকে? অনন্যার ভেতরটা ফেটে পড়তে চাইছে, কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর চাপা আতঙ্ক তাকে একদম নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। কি করবে? কার কাছে যাবে? কে তাকে বাঁচাবে এই অসহায় মুহূর্তে?

★★★★★

সুদূরের এক বিলুপ্ত দেশে বয়ে চলা ল্যুমিস নদী কৌশিকের রাগ, ক্ষোভ অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। নদীর স্রোত আজ বড়ই অস্বাভাবিক। পানির ঢেউগুলো প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে আছড়ে পড়ছে দুই তীরে। কৌশিকের অভ্যন্তরীণ শক্তির উৎস ল্যুমিস নদী, তার অনুভূতির সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত এই নদী। কৌশিকের রাগের প্রতিটি তরঙ্গ ল্যুমিস নদীর পানির প্রতি ঢেউয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

তথাকথিত শান্ত আর নিরব নদীটি আজ যেন সমস্ত বাঁধ ভেঙে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। নদীর স্রোতের গর্জন আশেপাশের পরিবেশকে ভয়ানক আর শীতল আতংকে ভরিয়ে তুলেছে। ঘন কুয়াশার মতো নদীর কোলাহল গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। নদীর পাশে বসবাসরত মানুষেরা জানালা দিয়ে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে, কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমেই গভীর হচ্ছে। "আজ যদি এই নদী বন্যার রূপ নেয়? যদি এই স্রোত তাদের ঘরবাড়ি, ফসলের জমি আর জীবন-জীবিকা সবকিছু বয়ে নিয়ে যায়?" অনেক অনেক প্রশ্নে একেকজনের মুখে অসহায়তা আর ভয় ফুটে উঠছে।

শিশুরা মায়েদের আঁচলে লুকিয়ে পড়েছে, বৃদ্ধরা প্রার্থনার ঝুলি হাতে নিয়ে ঝুঁকে বসেছে। নদীর তীব্রতা দেখে মনে হচ্ছে, তার রাগ থামানোর মতো কোনো শক্তি নেই। আজকের রাতটি হয়তো অনেকের জন্য দীর্ঘতম হবে।

অনন্যার আঁখি পল্লব ভিজে উঠে ভারি হয়ে গেছে। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা এখন লালচে আভায় ভরে উঠেছে, অনুশোচনার বোঝায় মাথা নত। তার ভুলের পরিণাম আজ তাকে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কৌশিকের জ্বলন্ত চক্ষুযুগল হঠাৎ ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বাল্বের দিকে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটি প্রচণ্ড শব্দে বাল্বটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। বিস্ফোরণের হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠলো অনন্যা। উপরের দিকে তাকাতে নিলেও তাকাতে পারলো না। রুমটি অন্ধকার হয়ে যেতেই বোঝা হয়ে গেছে কী হয়েছিল কয়েক মুহূর্ত পূর্বে!

কৌশিক ঠান্ডা আর হিংস্র দৃষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকিয়ে নিজের হাতের সামান্য ইশারায় অর্ধভেজা দরজাটি সশব্দে বন্ধ করে দিলো। অনন্যা ছাড়া পাওয়ার সুযোগ বুঝে তড়িঘড়ি ছুটে গেলো দরজার দিকে। হাত দিয়ে দরজায় সজোরে আঘাত করতে লাগলো, কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করতে লাগলো, "কেউ আছে? কেউ শুনছে? নিক ভাইয়া! লারা!"

অনন্যার চিৎকার যেন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে গেলো। কৌশিকের ঠোঁটে এক অশুভ বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। যেনো সে পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে। জোরালো এবং স্নায়ু শীতল করা গলায় কৌশিক বললো,
"অনন্যাআ! কেউ তোমার আওয়াজ শুনবে না। এই ঘর থেকে তোমার কণ্ঠ বেরোবে না, ডার্লিং। তোমার আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে যাবে, কারো কাছে পৌঁছাবে না।”

অনন্যার ভয়ার্ত চোখে স্যারের দিকে তাকালো , মাথা নিচু করে উষ্ণ ঢোক গিললো। পেছনে দাঁড়ানো কৌশিক স্যারকে দেখে মনে হচ্ছে সে আর আগের মানুষটি নেই। তার চোখ দুটো রক্তনীল, আগুনের মতো নীল শিখা নিয়ে জ্বলছে। এই চোখের দৃষ্টিতে অনন্যার শরীর শিউরে উঠলো। মনে হলো, লোকটি তাকে এক মুহূর্তে গ্রাস করবে। অনন্যা সামনে ফিরে চোখ বন্ধ করে পুরো পরিবারের মানুষের মুখগুলো মনে করতে লাগলো, সবশেষে খুব জোরে চিৎকার করলো সে। দরজা ধাক্কাতে লাগলো। সেদিনের বাঘ থেকেও বেশি এই লোকটা ভয়ংকর। এর চেয়ে জঙ্গলের বাঘটি তো শতগুণে ভালো ছিল।

কৌশিক অনন্যার চিৎকার শুনে এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ ধীরে ধীরে নেমে গেলো নিচে পড়ে থাকা কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে। এক ইশারায় কাঁচের বড় টুকরো কৌশিকের হাতের মুঠিতে প্রবেশ করলো। কৌশিক বিদ্যুতের গতিতে এগিয়ে গেলো অনন্যার পেছনে। হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজের সাথে তার উপস্থিতি যেন ঘরের তাপমাত্রা আরও নিচে নামিয়ে দিলো। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, কাঁচের ধারালো অংশ দিয়ে অনন্যার কানের ঠিক পেছনে এক ক্ষুদ্র ছিদ্র করলো কৌশিক।

অনন্যা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় থমকে গিয়ে চিৎকার থামালো। দ্রুত পেছনে ঘুরে বোঝার চেষ্টা করলো কী ঘটেছে। তার হাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে গেলো কানের দিকে। অনুভব করলো কিছু একটা ভিজে আর গরম, যা ধীরে ধীরে তার কানের পিছন বেয়ে নেমে আসছে।

কানের পাশ দিয়ে রক্তের সরু ধারা বইছে। নিজের হাতের তালুতে লাল রঙ দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে কৌশিকের দিকে তাকালো, কিন্তু স্যারের মুখে কোনো অনুশোচনার চিহ্ন নেই। ঠোঁটের আগায় সেই হিংস্র, নৃশংস হাসি।

রক্তে অনন্যার টিশার্ট ইতিমধ্যেই লাল বর্ণ ধারণ করে ফেলেছে। কৌশিকের হাত থেকে কাঁচের টুকরোটি পড়ে গেলো, সে আরো কাছে এসে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল অনন্যার ঠোঁটে আলতোভাবে স্পর্শ করালো, ধীরে সুস্থে আঙুল বুলিয়ে নেশাময় ঠোঁট ছোঁয়ালো অনন্যার ঠোঁটে। অনন্যার পিঠ দরজার দিকে সেটে গেছে। কৌশিক মেয়েটার হাত দুটো শক্ত করে ধরে উপরে উঠিয়ে নিলো। ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দুজনের। 

অনন্যা চোখ তুলে চাইলো। এক সেকেন্ড ও দেরি হলো না, সাথে সাথেই কৌশিক অনন্যার কপালে খুব জোরে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ধীরে ধীরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো কৌশিক, উত্তপ্ত করলো সম্পূর্ণ পরিবেশ। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বললো,
"ওহ, মাই ডার্লিং! একটু চুপ থাকতে পারো না? চুপচাপ থাকলে তোমাকে কষ্ট দিতাম না। কিন্তু তুমি তো অবাধ্য! মেয়েরা মোমের মতো গলে যায়, রগে রগে আমার স্পর্শ চায়। তুমি চাইলে না কেন? গাড়িতে আজকের দেওয়া চুমুতে রাগ করেছি বলে?

তাহলে শোনো, তোমার চিন্তা ভুল। সেই চুমুটা আমাকে অন্য কারো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো, এজন্যই রেগে গিয়েছিলাম।

কিন্তু নাহ আমাকে ভুল বুঝবে না, আমি ওরকম নই। আই লাইক সামওয়ান স্পেসিফিক, মাই টাইপ! এন্ড....ইউ আর মাই টাইপ। তোমার চোখ, তোমার স্টাইল, তোমার একগুঁয়েমি, তোমার পাগলামি, তোমার ঝগড়ুটে স্বভাব,সবকিছুই।

তাহলে চলো, আজ তোমাকে নিয়ে একটা ভয়ংকর খেলা খেলবো আমি। তখন অধিকার চাইছিলে না? ওকে দিবো আমি। সম্পূর্ণ অধিকার দিবো আজ।"

অনন্যার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে কৌশিকের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
"আমি কিছু খেলতে চাই না, কোনো অধিকার চাই না ছাড়ুন আমাকে।"

কৌশিকের ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠলো। সে নিচু হয়ে হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে অনন্যার গাল এক হাত দিয়ে চেপে ধরলো, হিমশীতল গলায় বললো,
"কাঁদবে না। মেয়েদের এই কান্না আমার একদম পছন্দ নয়।"

অনন্যা ভয়ার্ত গলায় জবাব দিলো,
"তাহলে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেনো? এভাবে অত্যাচার করার মানেটা কী?"

কৌশিক গম্ভীর হয়ে চোখ নামিয়ে বললো,
"ছাড়বো, অবশ্যই ছাড়বো। তবে তার আগে আমার কাজ শেষ হোক!"

অনন্যার গলার স্বর এবার চিৎকারে ফেটে পড়লো,
"আমি কোনো ভোগ্যপণ্য নই যে ভোগ করবেন, তারপর ছেড়ে দেবেন!"

এই কথায় কৌশিকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। তার নখ অনন্যার গালে ডেবে গেলো, আর রক্তের চিকন ধারা বয়ে যেতে লাগলো। সে অনন্যার মুখ আরো কাছে টেনে আনলো এবং ঠোঁটে গভীরভাবে কামড় বসালো। অনন্যা প্রথমে হতবাক হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পর তার চেতনা ফিরে এলো, সে মরিয়া হয়ে কৌশিককে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করলো।

অনন্যার হাত কৌশিকের বুকে আঘাত করছিলো, আঁচড় বসাচ্ছিলো তার ঘাড়ে। কিন্তু কৌশিক থামলো না, তার কামড়ে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে অনন্যার। কৌশিকের হাত দুটো অনন্যার মুখ থেকে ধীরে ধীরে সংবেদনশীল অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পেটের দিকে এগোতে থাকলো।

অনন্যা প্রাণপণে কৌশিককে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। তার শরীর কাঁপছিলো, আর চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছিলো। কৌশিকের শক্তি আর আচরণ দেখে মনে হচ্ছিলো, যেন সে আর মানুষ নেই, এক ভয়ংকর দানব হয়ে গেছে।

কৌশিক ধীরে ধীরে অনন্যার ঠোঁট ছেড়ে গালের রক্তাক্ত অংশে আলতো করে হাত রাখলো। দশ মিনিট ধরে অত্যাচার চালানোর পর অনন্যার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। কৌশিকের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, তার আঙুলগুলো দগ্ধ আগুনের মতো অনন্যার গালে স্পর্শ করছিল, যা ভালোবাসার আভাস দেওয়ার পরিবর্তে অনন্যার মনে ঘৃণার বীজ বুনছিল। অপর হাতটিও তার শরীরে ঘন ঘন ছুঁয়ে যাচ্ছিল, প্রতিটি ছোঁয়া যেন কাঁটার মতো বেঁধে যাচ্ছিল অনন্যার মনে। 

অনন্যার চোখ থেকে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়ছিল, ভেতরটা ক্রমশ দগ্ধ হচ্ছিল ঘৃণা আর দুঃখে। যে স্পর্শ কিছু সময় আগেও সুরক্ষার অনুভূতি দিত, সেই স্পর্শ আজ তাকে অপমানের গ্লানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে।

নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো অনন্যা, মনে হচ্ছিল এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী। ভেতরে ভেতরে বারবার ভাবছিল, "কী এমন পাপ করেছি যে এই লোকটাকে আমার জীবনের সঙ্গী বানালাম? কোন অভিশপ্ত দিনে জন্মেছিলাম যে এমন এক ভাগ্যের মুখোমুখি হতে হলো?"

কৌশিক দীর্ঘক্ষণ অনন্যার গালে হাত বুলিয়ে অতঃপর ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
"অযৌক্তিক কথা বললে এভাবেই শাস্তি পাবে তুমি।"

কথাটা বলে গালে গভীর চুম্বন বসালো কৌশিক। অনন্যার খোলা চুলে হাত বসালো, চুলগুলো ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিলো, কানের পেছনে আলতো হাতে চুল গুঁজে দিলো। কানের ক্ষুদ্র ছিদ্রে আঙুল বুলিয়ে সেখানে ক্ষুদ্র চুমু বসালো কৌশিক, অনন্যা কাঁদতে কাঁদতে শিউরে উঠলো। 

হঠাৎ আবারো হিংস্র চোখে হাত চালালো কৌশিক, অনন্যার টিশার্টের গলার অংশ টান মেরে অর্ধেক ছিঁড়ে ফেললো। দৃশ্যমান হলো আরো একটি টিশার্ট। হতবাকই হলো কৌশিক। শক্ত কণ্ঠে বললো,
"আরো একটা?"

কৌশিক আবারো একইভাবে টিশার্টটিকে ছিঁড়তে গেলে
ফোলা ফোলা রক্তাক্ত ঠোঁট নিয়ে অনন্যা চিৎকার করে বললো,
"প্রিন্স, থামো।"

চোখেমুখে গভীর কৌতূহল নিয়ে কৌশিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার হাত দুটো অজান্তেই থেমে গেলো, পাঞ্জা শক্ত হয়ে নিচে নেমে এলো। অনন্যার কণ্ঠস্বর, ভয় আর বেদনার মিশেলে, কৌশিকের ভেতর অদ্ভুত এক ধাক্কা দিলো।

অনন্যার ঠোঁট থেকে উচ্চারিত প্রিন্স শব্দটি কৌশিকের মনে যেনো গভীর ঢেউ তুলে দিলো। তার চোখের হিংস্র দৃষ্টি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেলো। ল্যুমিনাস নদীর ঝড়ো হাওয়া ধীরে ধীরে থেমে গেল, সেখানকার মানুষেরা উপরওয়ালার কাছে বারবার মাথা ঠুকলো।

কৌশিক বুকের ডান পাশে হাত দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। শ্বাস ভারী হয়ে এলো তার, আর কণ্ঠস্বরে ফিসফিস করে ভেসে এলো, "প্রিন্সেস আরিসা..."

অনন্যা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। "প্রিন্সেস আরিসা?" নামটা তার কাছে একেবারেই অচেনা। কিন্তু কৌশিকের মুখের ভঙ্গি, তার চোখে ছাপা পড়া ভয়, সব কিছুই অনন্যাকে অদ্ভুত শূন্যতায় ফেলে দিলো।

কৌশিক ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো, কিন্তু অনন্যার পরিবর্তে সে যেন অন্য কারো মুখ দেখছে। এক অপরূপ সুন্দরী নারীর মুখমণ্ডল ধরা দিয়েছে চোখের ধারে, চারপাশে বেগুনী আলো। লম্বা, ঘন কালো চুল, অন্ধকারে চুলগুলো সাপের মতো নড়ছে। মেয়েটির রহস্যময় উপস্থিতি রুমটিতে এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করলো। কৌশিকের মুখটা ভয়ে আর হতাশায় বিকৃত হয়ে উঠলো।

"প্রিন্সেস আরিসা!" কৌশিকের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল। "আপনার জন্যই আমার এই হাল! নিশ্চয়ই এসেছেন আমাকে শেষ করতে!"

কৌশিকের শ্বাসজ্ঞান অবাধ্য আচরণ করছিল। সে এক ঝটকায় পাশে পড়ে থাকা এক কাঁচের টুকরো তুলে নিলো। চোখে এক অদ্ভুত পাগলামির ছায়া আর ঠোঁটে বিকৃত হাসি।

কৌশিক চিৎকার করে বললো,
"পারবেন না আপনি,বারবার আমার হাতেই আপনার মৃ/ত্যু হবে। বারবার আপনি আসবেন... আবার নিঃশেষ হয়ে যাবেন!"

অনন্যা আর নিজেকে থামাতে পারলো না। ফ্লোরে বসে, চোখে পানি আর কন্ঠে আক্রোশ নিয়ে বলে উঠলো,
"স্যার! আমি... আমি অনন্যা। অনন্যা শিকদার! আপনি কার কথা বলছেন? এখানে তো কেউ নেই!"

কৌশিক যেন হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলো। হাতে থাকা কাঁচের টুকরোটা খসিয়ে ফেলে দিলো। তারপর দু’হাত সামনে বাড়িয়ে শিশুর মতো অসহায় কণ্ঠে বললো,
"শিকদার! আমার খুব শীত করছে। আমাকে জড়িয়ে ধরো, প্লিজ।"

অনন্যা হতবাক হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষটা তার জন্য বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল, সে এখন ভেঙে পড়েছে। কি হলো কৌশিক স্যারের? হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ কেনো করছে লোকটা?

অনন্যা নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্তের দ্বিধার পর সব ভুলে, সব ভয় পেছনে ফেলে, কৌশিক স্যারকে জড়িয়ে ধরলো। কৌশিক জাপটে ধরে রাখলো অনন্যাকে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছিল, গলার স্বরও অস্পষ্ট শোনাচ্ছিলো। প্রচন্ড ভয়ে সে অনন্যার মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, মনে হচ্ছে ভেতরের সমস্ত কষ্ট, পাগলামি আর অস্থিরতা থেকে মুক্তি চাচ্ছে কৌশিক।

অনন্যার মনে ভারী প্রশ্ন জমতে লাগলো। হঠাৎ স্যার এমন পাগলাটে আচরণ কেনো করলো? স্যারের সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি, জোরজবরদস্তি করা, আর অলৌকিক কাজগুলো সব একে একে মাথায় ঘুরতে লাগলো। তারপর প্রিন্সেস আরিসা? আরিসা কে? স্যার তাকে এতো ভয় পান কেনো? সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কৌশিকের শরীর ধীরে ধীরে গরম হয়ে পড়েছে, কপাল ঘেমে গেছে। অনন্যা বুঝতে পারছে কিন্তু কিছু করার নেই, স্যার যেভাবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে ছাড়ানোর ও উপায় নেই। এভাবেই যে কখন চোখে ঘুম এসে ভর করলো একদম খেয়াল নেই অনন্যার। ঢুলতে ঢুলতে অনন্যা হেলে পড়ছিল, তবে কৌশিকের সুবিধায় অনন্যা তার কাঁধে মাথা রাখতে পারলো।
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন