কামিনী - পর্ব ০৩ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


 উন্মনা উদাসীন সমীরণে নড়ল গাছের পাতা। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ সেই বাতাসে উড়ে গেলো দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রজারা ভীত চোখে তাকিয়ে দেখলো তুমুল বেত্রাঘাতে কেমন করে নাথানের উলঙ্গ শরীরটি মূর্ছা যাচ্ছিলো। রানির ঠোঁটে লেগেছিল ক্রুর হাসি। বারে বারে তিনি চোখ ঘুরিয়ে দেখছিলেন প্রজাদের। বুকের ভেতর এক অন্যরকম শিরশির স্বস্তি বইতে লাগলো। খানিক গর্বিত হলেন নিজেকে নিয়ে। এরপর রওনা হলেন নিজের রাজপ্রাসাদের দিকে। 

আজ আরও একটি কালো গোলাপের গাছ লাগাবেন রানি নিজ বাগানে। 

৪.

 মহল জুড়ে পিনপতন নীরবতা। চারপাশে একটি থমথমে ভাব বিরাজমান থাকে সদা। এই প্রাসাদে হাসি যেন চরম অপরাধ। রানির পছন্দ নয় কারো হাসির শব্দ। তার অসহ্য লাগে। বিদঘুটে লাগে। তাই কেউ ভুলবশতও হাসির শব্দ করে না। 

গুনগুনিয়ে গাওয়া গান ভেসে আসছে মহলের সামনে বিশার প্রাচীর ঘেরা বাগানটি থেকে। রানি গাছ লাগাচ্ছেন। 

  তার কোঁকড়া সোনালি কেশ গুচ্ছতে সূর্য এসে লুটিয়ে পড়ছে। গায়ের অতি উজ্জ্বল রঙটা যেন হেয় করছে বাগানের ফুটন্ত কালো গোলাপ গুলোকে। যেন নিখুঁত তাচ্ছিল্য করে বলছে, 

 "পুষ্প, তোমায় পৃথিবী সুন্দর বলে আখ্যায়িত করে রোজ। এবার বলো তো সুন্দর কে? এই কামিনীর গায়ের শোভা না-কি তোমার রূপ?" ফুল গুলো সেই তাচ্ছিল্যে হয়তো নত হচ্ছে। আর হিংসেয় জ্বলেপুড়ে ছাঁই হচ্ছে ভেতর ভেতর। ভাবছে, দুনিয়ায় ফুলের চেয়েও মানুষ কীভাবে সুন্দর হতে পারে! 

গোলাপের চারাটা রোপণ করতে করতেই বাগানের ঠিক বাহির থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। হ্যাব্রোর কণ্ঠস্বর,

 "রানি কামিনী, আসবো?"

 রানির তখন এক ধ্যান গাছের চারায়। কণ্ঠে তার বরাবরের মতনই একনিষ্ঠ কাঠিন্যতা বিরাজমান,

"কোনো সংবাদ আছে, হ্যাব্রো?"

"আপনার পত্র এসেছে।"

রানি অনুমতি দিলেন আসার। মাটি গুলো সুন্দর করে চাপা দিতে দিতে বললেন, "পত্র নিশ্চয় পাশের রাজ্য থেকে এসেছে? রাজা ইনান ণেকিতান নাকি?"

 রানির প্রশ্নে খানিক অবাক হলো হ্যাব্রো। কারণ পত্রটি না দেখেই রানি ঠিক আন্দাজ করেছেন। সে জবাব দিলো, "হ্যাঁ।"

"আমার হাতে মাটি, হ্যাব্রো। তুমি পাঠ করো।"

রানির আদেশে কিঞ্চিৎ বিব্রতবোধ করলো হ্যাব্রো। খানিক কণ্ঠস্বরে ভাঁটা দেখা দিলো তার, "কিন্তু উনি পত্রতে উল্লেখ করে দিয়েছেন ব্যক্তিগত পত্র শব্দটি।"

রানি এবার কিছুটা চোখ তুলে হ্যাব্রোর দিকে তাকালেন। রানির চোখের সাদা অংশটি কেমন হলদেটে হয়ে আছে। রানির এই গভীর দৃষ্টির মানে হ্যাব্রোর বোধগম্য হলো না ঠিক। সংশয়ে বুক কাঁপতে লাগলো তার। কোনো ভুলভাল বলে ফেললো কি-না সেই ভয়ে তার মাথা আরেকটু ঝুঁকে গেলো। 

তাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে রানি বললেন, 

 "রাজা ইনান ণেকিতান পত্র পাঠিয়েছেন এবং সেই পত্র তুমি আমার কাছে নিয়ে আসা মানেই পত্রটি ব্যক্তিগত পত্রই ছিলো। সেটা আমাকে বলে বুঝাতে হবে কি, হ্যাব্রো? যাই হোক, তুমি সখীকে এখানে পাঠিয়ে দেও। পত্রটি সখীর হাতে দিয়ে দিও। কেমন?"

হ্যাব্রো রানির আজ্ঞা মেনে নিলো সাথে সাথে। 'ঠিক আছে' বলেই পা বাড়ালো বাগানের বাহিরে যাওয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে রানি বললেন, 

 "হ্যাব্রো, তুমি বলো তো, রাজা ইনানের সাথে ব্যক্তিগত পত্র পাঠানোর কোনো সম্পর্ক আমার আছে কি-না?"

হ্যাব্রো এই প্রশ্নের জবাব কী দিবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তাই আবারও মৌন রইলো। কামিনীও জবাবের আশা করল না। কখনো মৌনতার অন্তরালেই লুকিয়ে থাকা তীব্র জবাবটি। 

 হ্যাব্রোর প্রস্থানের মিনিট দুই পেরুতেই পত্র হাতে উপস্থিত হয় যামিনী। তার নূপুরের ঝঙ্কার, তার গহনা রুনুঝুনু শব্দেই তার উপস্থিতি সরব হয়ে উঠে। রানি কামিনীর কাছে এসেই সে ঠাট্টা করল। 

অতঃপর রসাত্মক স্বরে বলল, "কী সখী, শুনলাম সুদূর ভিনদেশী রাজা নাকি তোমার জন্য পত্র পাঠিয়েছে?"

রানি কামিনী সেই ঠাট্টার বিপরীতে পরিহাস করে জবাব দিলেন, "তাই তো দেখছি। তাও কি-না ব্যক্তিগত পত্র!"

 "দেখেছো তো! বলেছিলাম না, রাজা ইনানও তোমার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে যাবে। দেখো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে বোধহয়।"

"আহা সখী, তোমায় না বলেছিলাম- প্রেম, ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না। এই পৃথিবীতে যা আছে তার কিছুটা মোহ, কিছুটা টান আর কিছুটা কাম। পুরুষদের কামই ভদ্র সমাজে স্বীকৃতি পায় প্রেম নামে। ঐ তো, মুখের লাজে বলতে পারে না যে- তোমার প্রতি আমি কাম অনুভব করছি, তাই তার পরিবর্তে বলে প্রেম অনুভব করছি। বুঝলে?"

 যামিনী ঠোঁট টিপে হাসল। সম্মতি দিয়ে বলল, "ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম।"

"এবার পত্রখানা পড়ো দেখি। তোমার ভাষ্যমতে প্রেম কেমন অনুভব করছে রাজা ইনান ণেকিতান আমিও দেখি!"

 রানির নির্দেশে হ্যাব্রোর মতন যামিনীও কিছুটা দ্বিধায় পড়ল। শুধালো, "আমি পড়বো?"

"তোমাকেই তো বললাম পড়তে। পড়ো, দেখো, প্রেম কেমন হয়।"

যামিনী অধিক সজ্জিত পত্রখানা খুললো কিছুটা সময় নিয়ে। তখনও তার ভেতর-ভেতর সংশয়ের বালুকণার উপস্থিতি ছিলো। পত্র খুলতেই টানা টানা হাতে লিখা অক্ষর গুলো ভেসে উঠলো—

‘রানি কামিনীকাঞ্চন, 

 পত্রের সম্বোধনে আমার অনেককিছুই দেওয়ার মনস্কামনা ছিলো। কিন্তু আপনি যদি মান করেন সেই চিন্তা করে আর সম্বোধন দিলাম না। আপনি হয়তো জানেন না আপনি আমার কতগুলো নির্ঘুম রাতের কারণ। ঘুমাতে নিলেই চোখের পাতায় ভেসে উঠে আপনার মুখখানি। আপনার সেই ভরাট চোখ, ওষ্ঠ আমার নিদ্রাযাপনে বড়োই বাঁধার সৃষ্টি করছে। সিন্ধুর লহরির মতন আপনার সুডৌল বক্ষোজ, আপনার চিবুকের খাঁজ, আপনার চরণের উপর সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টির ঐ লাল তিল আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। চোখের পাতায় কেবল ভেসে ভেসে উঠছে। 
আমি আপনার কাছে দু'হাত জোর করে অনুরোধ করছি, আমার প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করুন। আমার রাজ্যের ভূমিতে আপনার পায়ের স্পর্শ দিয়ে যান। আমি আপনাকে আমার রাজ্যের মহারানি করে রাখবো। চিরজীবন আপনার পায়ের দাস হয়ে থাকবো।

ইতি
আপনার দাস হতে চাও
ইনান ণেকিতান’

পত্রটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো যামিনী। রানির গাছ লাগানো শেষ ততক্ষণে। নিশ্চুপ যামিনীর দিকে তাকিয়ে রানি পরিহাস করে বললেন,
 "এবার বলো তো সখী, প্রেম কাহারে কয়? রাজা ইনানের প্রেমপত্র পড়ে নিশ্চয় বুঝলে, প্রেমের গোপন নাম কী?"

যামিনী শ্বাস ফেলল তপ্ত। তারও ভেতর ভেতর কিছুটা রাগ হলো পুরুষ শ্রেণির উপর। প্রেম নামক পবিত্রার নাম নিয়ে শেষমেশ কি-না কামের তাড়নার পত্র লিখলেন রাজা ইনান? অন্তত তিনি একটু ভালোবাসা বুঝতেন! অন্তত তিনি একটু রানি কামিনীর মনের ভেতর অব্দি পৌঁছানোরই চেষ্টা করতেন। 

"সখী, আমার পায়ের তিল, থুঁতনির ভাঁজ, স্তন যুগলই কেবল দেখলো তোমার প্রেম। আমার হৃদয় দেখার সুযোগ বুঝি পেলো না?"
যামিনী এবারও জবাব দেওয়ার ভাষা পেলো না। কি'বা বলবে সে? 

 রানি নিজ মনেই গুনগুনিয়ে কবিতা বললেন। কবিতা ঠিক নয়, কয়েকটি লাইন কেবল—

 ❝ কখনো সখনো আমি অনুভব করিয়াছি,
প্রেমই স্বর্গের আদুরে ডাকনাম হয়তো,
 কখনো সখনো ধরণী ঘুরিয়া দেখিয়াছি,
প্রেম কাম ব্যতীত আর কিছু নয়তো।

এ ধরা, এ জরাজীর্ণ ভূমি, 
প্রেম কাহারে বলে
জানো কি তুমি?

আমি বলি- প্রেম তাহাই হয়,
যাহা ছুঁইতে না পারে কেহ,
যাহা দেখিতে না পারে
যাহা একবার না মারিয়া, 
মারে বারে বারে। 

ওহে জীর্ণ ভূমি, 
 কাছে ডাকিয়া, ওষ্ঠে ডুবিয়া যাওয়াকে 
প্রেম ভাবো কি তুমি?

ওহে কাম যাতনায় তৃষ্ণিত, ভূমি,
শতো সহস্র হাজারো বার 
ধিক্কার ধিক্কার ও ধিক্কার নিও তুমি।❞

তুমুল ঘৃণা, উপহাস নিয়ে কবিতাটি বলেই প্রাসাদের ভেতরে চলে গেলেন রানি। যামিনী ঠাঁই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো চিঠিটির দিকে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে প্রশ্ন করল, এই প্রেম ও কামের যুদ্ধ শেষ হবে কবে? কিন্তু নিশ্চুপ রইলেন সৃষ্টিকর্তাও। আকাঙ্ক্ষায় কেবল রয়ে গেলো কামিনীর ভালোবাসা পাওয়ার হাহাকার। 

 ৫.

 সন্ধ্যার বিদায় ক্ষণে অম্বরের সূর্যটি নীরবেই ডুবে গেলো। অগ্রহায়ণের প্রায় শেষদিক বলেই আকাশ কুঞ্জে সাজ ধরেছে কুহেলি। ফিনফিনে বাতাস এসে লাগছে দেহের ভাঁজে ভাঁজে। 
রানি কামিনী দাঁড়িয়ে আছেন অশ্বত্থ বৃক্ষের সামনে। তার পেছনেই হ্যাব্রো দাঁড়ানো। চারপাশটাতে ধিক্ ধিক্ করে জ্বলছে কয়েকটি মশাল। সেই মশালের হলদেটে আলো এসে রানির চোখ-মুখে আভার সৃষ্টি করছে। তার লাবণ্যময়ী রূপে সেই হলদে আলোটা কী ভীষণ সুন্দর লাগছে! স্বর্ণের বদন মনে হচ্ছে। 
হ্যাব্রো রানিকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজ থেকেই বলল,
 "রানি কামিনী, নাথানকে সারাদিন কয়েকশো বেত্রাঘাত করা হয়েছে। তবুও তার প্রাণায়ু ফুরায়নি। আপনি বললে এখন বাকি কাজটুকু করে দিবো!"

রানি কামিনীর দৃষ্টি তখনও উলঙ্গ নাথানের দিকে। যার সারা শরীরে জ্বলজ্বল করছে ক্ষত। মশালের আলোতে সুস্পষ্ট ক্ষতের সতেজতা। রানি সেদিকেই দৃষ্টি রেখে বললেন, 
 "না, ওকে মেরো না, হ্যাব্রো।"

 "মারবো না? কিন্তু আপনি যে আদেশ দিয়েছিলেন ওকে হত্যা করার!"

রানি খুব গভীর ভাবনায় তখন মগ্ন। ঘোরগ্রস্থদের মতন বললেন, "হ্যাব্রো, গল্পের ভেতরও যে গল্প থাকে। ওকে বাঁচিয়ে রাখো। ওকে বাঁচিয়ে রাখলেই শত্রু চেনা যাবে।"

রানির কথার অর্থ বুঝতে পারলো না হ্যাব্রো। কিন্তু প্রশ্ন করারও আর জো নেই। তাই আদেশ মেনে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, "ঠিক আছে। বাঁচিয়ে রাখবো। আপনি কি এখন রাজপ্রাসাদ ফিরে যেতে চান?"

 "না, আমাকে একটিবার রাজ কবিরাজের নিকট নিয়ে চলো তো, হ্যাব্রো।"

হ্যাব্রো আজ্ঞা মেনেই এগিয়ে গেলো রানির ঘোড়ার সামনে। রানি বার কয়েক অশ্বত্থ বৃক্ষটির চারপাশে চোখ বুলালেন। এখানে শত্রুর উপস্থিতি খুব করে টের পেলেন তিনি। রানির ঈগলের মতন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঠিক শত্রুর আবছায়া আটকে গেলো। শত্রুর এই লুকোচুরিতে হাসলেন রানি। রানি কামিনীকাঞ্চনকে সামান্য শত্রু মাত দিবে তা-ও কি হতে পারে? অসম্ভব।
ঘোড়ায় চড়ে বসলেন রানি। নাথানের ক্ষত-বিক্ষত দেহটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
 "তোমার দুর্ভাগ্য, নাথান। এত সহজে তোমার মৃত্যু হবে না যে! আরও খানিকটা সময় অপেক্ষা করো। তোমার সঙ্গী আসছে। অপেক্ষা।"
এরপর ঘোড়ার পায়ের সেই উদভ্রান্ত শব্দ তুলে বিদায় হলেন রানি। তার যাওয়ার পথটাও যেন তুমুল রহস্যের সৃষ্টি করলেন। 

 রাজ কবিরাজের ঘরের ভেতর রয়েছে হরেক রকমের দ্রব্যাদি। রানির একান্ত যত্নের মানুষ হলেন কবিরাজ। বৃদ্ধ কবিরাজ রানির ঘোড়ার পায়ের ধ্বনি শুনেই বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বিচলিত নয়নে তাকিয়ে দেখলেন রানি কামিনী এবং তার সেনাপতি হ্যাব্রো এসে দাঁড়িয়েছে তার কুটিরের সামনে। একটি জঙ্গলের ভেতর রাজ কবিরাজের কুটিরটি অবস্থিত। কবিরাজ একাকী বাস করেন এইখানে। দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছেন তার জীবন এই কুটিরটাতে। কোনো পরিবার নেই, পরিজন নেই। কেবল আছেন রানি। তার একমাত্র কাছের মানুষ। 
রানিকে দেখেই বিচলিত হলে কবিরাজ। ছুটে গিয়ে দু-হাত করজোড়ে অভিবাদন জানালেন। শুধালেন,
 "বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এসেছেন এখানে, রানি? আমাকে ডাকলেই তো হতো! এতটা পথ এলেন।"

রানি ঘোড়া থেকে নেমেই প্রথমে হ্যাব্রোর দিকে তাকালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
 "আজ রাতে নাথানের কাছে পাহারাদার হিসেবে তুমি থাকবে, হ্যাব্রো। এখুনি যাও সেখানটায়।"

হ্যাব্রো আদেশ মেনে নিয়ে বলল, "ঠিক আছে। আপনাকে পৌঁছে দিয়েই আমি পাহারায় যাবো।"

 "আমাকে পৌঁছে দেওয়ার কথা কি আমি তোমাকে বলেছি?"
রানির রাগী প্রশ্নে থতমত খেলো হ্যাব্রো। আমতা-আমতা করে বলল, "আসলে, আপনি একা যাবেন। আর তো কাউকে সঙ্গে আনেননি।"

"রানি কামিনীর কাউকে দরকার হয় না সেটা আর কতবার তোমাকে বুঝাতে হবে, হ্যাব্রো? আমার প্রাণের নিরাপত্তা আমি নিজেই দিতে পারি। তুমি যাও। আমি কবিরাজের সাথে কথা শেষ করে আসছি।"

হ্যাব্রো ঘাড় নত করেই প্রস্থান নিলো। সে দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই রানী রাজ কবিরাজের দিকে তাকালেন। প্রখর তার দৃষ্টির ভাষা। কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো শব্দ কণিকা, 
 "রাজ কবিরাজ, আমার জন্ম কুন্ডলী বের করুন। আমি নিজের চারপাশে শত্রুর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। আপনি দেখুন তো।"

রাজ কবিরাজ তৎক্ষণাৎ বললেন, "বের করছি। আপনি আসুন ভেতরে। আমি এখুনি দেখে জানাচ্ছি আপনাকে।"

রানি ভিতরে গিয়ে বসলেন। রাজ কবিরাজ রানির জন্ম কুন্ডলী বের করলেন। তামাটে রঙের কয়েকটি কাগজ৷ সেখানে আক্ষরিক শব্দে কিছু লিখা ছিলো। কবিরাজ ভালো করে লেখাগুলো দেখলেন। তার মুখে তখন ঘনিয়ে এলো আঁধার। কিয়ৎক্ষণ কাগজটির দিকে তাকিয়ে থেকে শঙ্কিত স্বরে বললেন,
 "আপনার নক্ষত্রে অমানিশার বিরূপ প্রভাব দেখাচ্ছে, রানি। আপনার মঙ্গলেও দোষ লেগেছে। আপনাকে কিছু দিন সাবধান থাকতে হবে। আপনার প্রাণনাশের ঝুঁকি রয়েছে।"

কবিরাজের কণ্ঠে বিচলিত ভাব থাকলেও রানি রইলেন নিরুত্তর। কুটিলতা তার চোখে খেলা করছে। গভীর ভাবনায় নিমগ্ন তিনি। কবিরাজ রানির এই ভাবলেশহীন মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝলেন রানি কিছু একটা বলবেন। এবং হলোও তাই। রানি বললেন,
 "আপনি খারাপটুকু বললেন, ভালো কিছু তো বললেন না। রাহু নক্ষত্রে দোষ আমার, ভাগ্যেও দোষ। আর কি কিছু ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে?"

রানির বুদ্ধিমত্তায় আবারও খুশি হলেন কবিরাজ। মুচকি হেসে বললেন, "আছে। বুধ শান্ত আপনার। সঙ্গী নির্বাচন করতে পারেন চাইলে।"

রানি এবার হা হা করে হেসে দিলেন। কবিরাজের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললেন, "সঙ্গী বাছবে রানি কামিনীকাঞ্চন? এতদিন আমাকে এই জানলেন আপনি, রাজ কবিরাজ?"

বৃদ্ধ জবাবে হাসলেন কেবল। 

 রানি যেভাবে এসে ছিলেন সেভাবেই ফেরার পথ ধরলেন। রাজ কবিরাজ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন রানির দিকে। তার চোখ চিকচিক করছে। এই রাজ্য যতটাই ভয় পায় রানিকে, রাজ কবিরাজ ঠিক ততটাই স্নেহ করেন। তার বড়ো মায়া হয় এই মেয়েটির জন্য। আর কেউ না জানলেও তিনি তো জানেন মেয়েটি কেমন দুঃখে দিন কাটিয়েছে। কেমন ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছে! যে মেয়েটা ভালোবাসাকে ঘৃণা করে, সে-ই মেয়েটিই যে গুমরে মরে একটু ভালোবাসার তৃষ্ণায়, এই কথাও তার অজানা নয়। 

ঘন জঙ্গলের নিশুতি পথ। ধীর গতিতেই এগুচ্ছিলো রানির ঘোড়া। ঠিক তখনই রানি অনুভব করলেন জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মায়াময় একটি ধ্বনি। একটি বাঁশির সুর। যেই সুর শিহরণ জাগাচ্ছে রানির দেহের কোণায়। রানি ঘোড়ার দড়িতে টান দিয়ে চলা থামালেন। নেমে পড়লেন ঘোড়া থেকে। আকাশে তখন কুহেলিকার আনাগোনা প্রচন্ড। এই বাঁশির সুর, এই মায়াময় রাত্রি যেন মরণ বীণার গান শুনালো। রানি ঘোরে ডুবে গেলেন। জঙ্গলের বাহিরে না গিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলেন জঙ্গলের ভেতর। যত ভেতরে যাচ্ছেন ততই যেন আকর্ষণ বাড়ছে তার। নিজের শরীরকে আনতে পারলেন না নিয়ন্ত্রণে। এই সুর তাকে এক নেশায় ডুবিয়ে ফেললো। 
রানি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন জঙ্গলের প্রায় শেষ দিকটায়। যেখানে রয়েছে উন্মুক্ত পাহাড়। কলকলিয়ে ঝর্ণা বেয়ে জল পড়ছে। বাঁশির সুর, সেই জলের স্রোতের কোলাহল রানিকে মুহূর্তেই যেন অন্য দুনিয়ায় নিয়ে গেলো। রানি চোখ বন্ধ করে কেবল উপভোগ করতে লাগলেন সেই দুনিয়াকে। যে দুনিয়ায় রানির কোনো দুঃখ নেই, কলঙ্ক নেই, যন্ত্রণা নেই। আছে কেবল ভালোবাসা। বাঁচার আকুতি। 
 হুট করেই থেমে গেলো বাঁশির সুরটি। রানি বুঝতে পারলেন না তার সাথে কী হলো! তার ঘোর কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। রানি খেয়াল করলেন তিনি একটি খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। জঙ্গলের ভেতরে এত সুন্দর জায়গাটি সে আগে কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। কিন্তু ঠিক তখনই রানির মনে হলো তিনি ভুল করে ফেলেছেন। হয়তো শত্রুর পাঁতা ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছেন। 

রানির মাথার উপর তখন দুটো পায়রা এসে উড়তে লাগলো। সাদা রঙের পায়রা। সেই ভিড়ের মাঝে দেখতে পাওয়া পায়রা গুলো। রানি তীর-ধনুক বের করে নিশানা ঠিক করলেন। এই সুন্দর পায়রা গুলোর দিকেই নিশানা নিক্ষেপ করার আগেই তিনি দেখলেন তার গলার কাছটাতে একটি ছোটো তলোয়ার। দূরে জ্বালানো মশালের আলোয় চকচক করছে অস্ত্রটি। রানি হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন সেই চোখ গুলো। ভিড়ের মাঝে তার ধ্যান কেড়ে নেওয়া সেই বিড়ালের মতন ঘোলাটে চোখ। সেই সোনালী রঙের চোখের মনি গুলো জ্বলজ্বল করছে। এই প্রথম কোনো পুরুষের চোখে রানি কাম দেখলেন না। তবে কিছু একটা দেখলেন। কিন্তু কী সেটা? ক্রোধ, ক্ষোভ নাকি রাগ?
.
.
.
চলবে...........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন