বিনিদ্র রজনী পার করছে বন কর্মকর্তা। ভাবিয়ে তুলছে মন মস্তিষ্কের কোষ। সে বুঝে উঠতে পারছে না গলদটা কোথায় হল। ঠিক কী রকম ঝামেলায় এই ভ্রমণপিপাসু দলটা জড়িয়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে এরা সাধারণ কর্ম করেনি। এমন কিছু করেনি যার দরুন ভয়ংকর একদল নরপিশাচী বাহিনী পিছু লাগবে। রাতের আকাশে প্রদীপের মতো জ্বলজ্বল করছে তারাগুলো। তাদের নীচে বিস্তীর্ণ বনশ্রেণী ঘুমোচ্ছে অঘোর। চারপাশ নীরব, নিস্তব্ধ, বড্ড বীভৎস রকম অসাড়। ডাবল এসপ্রেসো কফিটা কুয়াশার মতো পাক খেয়ে খেয়ে গরম ধোঁয়া ওঠাচ্ছে পাত্র থেকে। কালো মগটার একপ্রান্তে নিখুঁত দুই ঠোঁট চেপে চুমুক দিচ্ছে শোয়েব ফারশাদ। রেলিং সংলগ্ন দাঁড়িয়ে কয়লা বর্ণ আঁধারে সে ভাবছে বহু তাজ্জব ঘটনা। যার আগ-পাশ এখনো তার কাছে বোধগম্য না। রাফান আর পার্থ এখনো কিছু বের করতে পারেনি। তবে পরিচিত সূত্র থেকে জেনেছে রেসোর্টের মালিক ভূতুড়ে কায়দায় নিখোঁজ। কোথায় পালিয়েছে, কীভাবে গিয়েছে, কেমন সিস্টেম দ্বারা পলাতক কিছুই জানা যায়নি। মন বলছে লোকটা আর ফিরবে না। একটা বীভৎস অবস্থা বিরাজ করছে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতর। সামনে যে কী অপেক্ষা করছে কেউ সামান্যতম কিচ্ছু জানে না। এমন সময় ঘরের দরজায় মৃদু ‘ঠক্ ঠক্’ কড়াঘাতে আওয়াজ হল। মাথাটা ধীরে পিছু ঘুরিয়ে দরজার দিকে চাইল শোয়েব ফারশাদ। রাতের হিম-বরফ হাওয়ায় তার বাদামি-কালচে চুলগুলো ঝরঝর করে কপালে খেলে যাচ্ছে। চশমা জড়ানো চোখদুটো নেকড়ে জন্তুর মতো সপ্রতিভ। দরজা ঠেলে ভীষণ জড়সড় ভঙ্গিতে মুখ বাড়িয়েছে মিথিলা। মুখে একরাশ অপ্রস্তুত ভাব জড়িয়ে সৌজন্য হাসিতে বলল,
- আসব শোয়েব?
মাথাটা মৃদু নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক জবাবটা জানিয়ে দিল সে,
- আসুন। প্লিজ কাম ইন ভাবী।
ভেতরে ঢুকে চারপাশে বিস্মিত চোখজোড়া বুলাতে বুলাতে অগ্রসর হল মিথিলা। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে তার চোখদুটো উজ্জ্বল। গায়ে মোটা একটা কাশ্মীরি চাদর। কালো চাদরের তলায় ভালোভাবে হাতদুটো জড়িয়ে ঘরের সীমানা পেরিয়ে মুক্ত প্রশস্ত বারান্দায় এসে বলল,
- ঘরটা কী দারুণ করে সাজিয়েছ তুমি! আমি তো দেখে দেখে মারাত্মক আশ্চর্য। দেয়ালগুলো কী নিখুঁত, চমৎকার! মনে হচ্ছে যেন পালিশ করা কাঠ। আচ্ছা, দেয়ালগুলো কী কাঠের? নাকি কাঠের মতো করে নান্দনিক চেহারা দেওয়া?
মিথিলার দিকে হাস্য ভঙ্গিতে চেয়ে কফিতে চুমুক বসাল শোয়েব ফারশাদ। বারান্দার ওপাশে মুক্ত উদার প্রকৃতির দিকে চেয়ে বিনম্র স্কেলটা বজায় রেখে বলল,
- কাঠের মতো দেখতে, তবে কাঠের না। আপনার পছন্দ হয়েছে?
মিথিলা বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
- পছন্দ মানে! আমার বিশ্বাস, এই ঘরে যে একবার ঢুকবে, বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে চারপাশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। তোমার পছন্দ-অপছন্দ, বাছ-বিচার, চিন্তার ব্যাপারগুলো আমার সবসময়ই পছন্দ। কিছু জিনিসে আজও মনে হয় তোমার কাছে শলা পরামর্শ করলে লাভ হয়। তুমি অনেক কিছুই সামান্য ধারণা থেকে আগেভাগে আভাস দিতে পারো। তবে সব ভালোর মাঝে একটা জিনিস আমার পছন্দ নয়। বলতে পারবে সেই জিনিসটা কী?
বাঁয়ে মুখ ঘুরিয়ে ভ্রুঁতে একটা ভঙ্গি বোঝাল শোয়েব। যেন ঠোঁটে না বলে ভ্রুঁয়ের ভঙ্গিটা দ্বারাই বোঝাল ‘কী?’। মিথিলা তার দিকে চওড়া হাসিতে তাকিয়ে বাঁ চোখটা দুষ্টুমির ভঙ্গিতে টিপে বলল,
- তুমি একটা প্রেম করোনি শোয়েব! একদম খাঁটি নির্ভেজাল প্রেম। ব্যাপারটা নিয়ে আফসোস হয় আমার। শাহেদকে কী সুন্দর করে ট্রেইণ্ড তুমি করেছ, অথচ তুমি মানুষটাই কারো প্রতি মশগুল না। আশ্চর্য লাগে!
কথাগুলো বলতে বলতে আপন মনে হাসল মিথিলা। একটু আগেও চিন্তা করছিল কত কী বিষয়! এই একটা মানুষের জন্য শত সহস্র চিন্তা আসে তার। মনে হয়, এবার যদি একটু গুছিয়ে দেওয়া যায় ওর জীবনটা! একটু সামলে দেওয়া যায় কোনো মজবুত নরম হাতের মুঠোয়! কিন্তু আশপাশে নজর বুলিয়ে যা বুঝল, এমন ভয়ংকর নিরিবিলি জায়গায় সেরকম মজবুত, নরম হাতের সম্রাজ্ঞী নেই বললেই চলে। কী বন্য এক জায়গায় ও থাকছে! রাতে থাকতেও যেখানে বুকের ভেতরটা ছমছম করে উঠে! হাত-পাও শিরশির করে কাঁপে! একবুক হতাশা জড়ানো আক্ষেপ নিয়ে ডানে তাকাল মিথিলা। দেখল, কালো শার্টের ওপর নেভি ব্লু পাতলা জ্যাকেট। এই শীত ছড়ানো কুয়াশা ঢাকা আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। খাচ্ছে কফিতে ছোট ছোট গম্ভীর চুমুক দিয়ে। চোখে একসময় চশমা পরতো না, অথচ আজ কী অদ্ভুত অজানা কারণে চোখে রিমলেস ফ্রেমযুক্ত পাতলা কাঁচের চশমা পড়ছে। একটু কী বেশি শাণিয়ে এসেছে চেহারা? আগের চেয়ে কী বেশিই করছে পরিশ্রম? এর ফলেই কী বাহুদুটো আগের চেয়েও ভরাট হয়ে এসেছে? মিথিলা ভারি শ্বাস ছেড়ে চাদরের তলায় হাতদুটো নাড়াচাড়া করতেই বলল,
- তোমার জন্য এটা আনতে চাইনি। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে আমিও ছিলাম নিরুপায়।ভুল বোঝো না ভাই। তোমাকে কতটা শ্রদ্ধা করি, স্নেহ করি তুমি তো জানো। জানি, এটা তোমার জন্য বিক্ষিপ্ত করার মতো বিষয়। তবু তোমাকে দিতে এটা বাধ্য।
কফির মগে চুমুক দিতে গিয়ে আচমকা কেন জানি থামে শোয়েব। থেমে যায় চোখের স্বাভাবিক পলক। মগটা ঠোঁটের কাছ থেকে নামিয়ে ধীরে ধীরে মুখটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে মিথিলার পানে চাইল। মিথিলা চাদরের তলা থেকে এবার ডানহাত বের করে বাড়িয়ে দিল কিছু। শোয়েব ওর মুখের ওপর থেকে চোখ নামিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই মসৃণ টানটান কপালে কুঞ্চন পড়তে লাগল। হাতে বাদামি রঙা খাম। খামের ওপর নীল কালিতে কারো নাম। খামটা শোয়েবের দিকে আরো বাড়িয়ে কেমন শক্তমুখে বলে উঠল মিথিলা,
- আমাকে বলেছে এবারই শেষবার। আর কক্ষণো এসব করবে না। তুমি কোনো জবাব দাওনি বলে অনেক চেষ্টা মাধ্যম চালিয়েছে। তবে ফলাফল একটাও পায়নি। আমার কাছে ব্যাপারটা হাতে পায়ে ধরার মতো অনুরোধ করে খামটা দিয়েছে। আমি এটা নিতে চাইনি, কিন্তু—
খামের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে মিথিলার দিকে তাকিয়েছে শোয়েব। তার মুখের ভাব তখনো স্থির। অটলভাবে শান্ত। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই আদৌ কী প্রতিক্রিয়া রয়েছে সে। ঢোক গিলে মিথিলা নিজের অর্ধ সমাপ্ত কথাটা পুনরায় বলে উঠে,
- কিন্তু, আমার জন্য অনুরোধটা ফেলা সম্ভব হয়নি। তুমি জানো আমি কিছু ক্ষেত্রে আজও ইমোশনালি ডাইভার্ট হই। অনুরোধটা এমনভাবে করেছে, সম্ভব হচ্ছিল না কীভাবে মানা করব।
কথাগুলো বলে চললেও অভিব্যক্তি শূন্য ছিল শোয়েবের। ধোঁয়া ওঠা কফির মগটা রেলিংয়ের ওপর রেখে খামটা তুলে নেয় সে। লম্বা খামটাকে মাঝ বরাবর ভাঁজ করে সেটাকে ট্রাউজারের পকেটে অক্লেশে রেখে দেয়। ধীর স্থির শান্ত সংযত কণ্ঠস্বরে বলে, যেন কিছুই ঘটেনি এই এক মিনিটের ভেতর,
- যান, ঘুমিয়ে পড়ুন। জেট ল্যাগে নিশ্চয় টায়ার্ড আপনি। জেগে থাকবেন না। কাল সকালে কথা হবে।
কথাগুলো শুনে গভীর নির্বাক দৃষ্টিতে চুপ করে রইল মিথিলা। উপর্যুক্ত জবাবটা নিঃশব্দ ভঙ্গিতে পেয়েও কেমন বিচলিত গলায় বলল,
- তুমি কী আর ফিরবে না?
ঘাড়টা খুব ধীরে ধীরে বাঁয়ে ফেরাল শোয়েব। এবার আর শান্ত সংযত ভঙ্গিতে না। বরং তার চশমা, ওই চশমার আড়ালে চোখ, চোখের দুর্লভ তারাদুটো নেকড়ের মতো হিম-শীতল। আইসবার্গের চূড়ান্ত বরফ যেন এখানেও জমাতে তৎপর! কফির মগটা থেকে ধোঁয়া এখন আর উঠছে না। তবু চশমার কাঁচটা কুয়াশার ছোবলে সামান্য ঘোলা হয়ে গেলে ঘাড়টা পুনরায় সামনে ঘুরিয়ে নিল শোয়েব। কালো মগটা রেলিংয়ের ওপর রেখে চাপা দমটা সশব্দে ছেড়ে বলল,
- শো-পিস কিনেছেন? বাইরেটা কাঁচে মোড়া শো-পিস। গোলাকার, বড়ো বড়ো। বাইরে থেকে যতই লিক্যুইড ফর্মুলা দিয়ে ওয়াশ করুন, দেখবেন, বাইরের কাঁচটা শুধু চকচক করছে। কাঁচের ভেতরে ঢোকা ধূলো-ময়লাটা পরিষ্কার হচ্ছে না। কিছু জায়গার ডেফিনেশন অনেকটাই এরকম। ভেতর পর্যন্ত আঘাত দিয়ে বসে আছে, অথচ বাইরে থেকে বোঝাচ্ছে সে মলম দিয়ে ক্ষত সারাচ্ছে। সে ক্ষতর ব্যাপারে কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না, পুরোপুরি নিষ্পাপ। অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। যা কথা বলার কাল বলবেন।
কথাটা বলেই ঠাণ্ডা কফিটা এক চুমুকে খেয়ে নিল শোয়েব। বাক্যের অতলেই বুঝিয়ে দিল আর এ ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। একটা তির্যক অপরাধবোধে মুখটা পাংশু হয়ে গেল মিথিলার। মনে হল, ওই খামটা এভাবে না আনলেই ভালো হতো। উচিত হয়নি অতদূর থেকে এটাকে গুরুত্ব সহকারে বয়ে আনার। ভারি শ্বাস ছেড়ে গায়ের চাদরটা আঁটোসাঁটো করে দরজার কাছে পৌঁছে গেল মিথিলা। হঠাৎ পাদুটো থামিয়ে মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে তাকাল। ভাই সমতুল্য দেবরটির দিকে একমুখ আশান্বিত আভাস ফুটিয়ে বলল,
- শাহেদ একটা কথা আজও বলে শোয়েব। মাটির তলায় হারানো শহর যদি আবারো ফিরতে পারে, তাহলে মিথ্যার তলায় লুকানো সত্যিটা একদিন না একদিন প্রকাশ হবেই। নিজেকে ব্যর্থ ভেবো না।
কথাগুলো বলে সেখানে আর এক সেকেণ্ডও দাঁড়ায়নি মিথিলা। মাথা ঘুরিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে ঘরটা থেকে। একজোড়া পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতেই ডান পকেট থেকে খামটা বের করে শোয়েব। ইংরেজি অক্ষরে তিনবর্ণের নামটা দেখে খামটা খুলতে নেবে, এমন সময় ক্ষীণ একটা শব্দে সচকিত হলো শোয়েব। চট করে মনোযোগটা শব্দ উৎসের দিকে রাখতেই হঠাৎ চমকে উঠল সে! তড়িৎ গতিতে পা চালিয়ে গন্তব্য দিকে দৌঁড় হাঁকাল শোয়েব। এক ঘর থেকে অপর ঘরের দূরত্ব বেশ ভালো রকম বলেই দৌড় লাগিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত দুয়ারে পৌঁছে ধড়াস করে দরজাটা খুলল সে! পরিস্থিতি এতোটাই বিপণ্ণ বিশ্রী হলো যে ঠিক তখনি গেল বৈদ্যুতিক সংযোগ! ঘরের ভেতর ভয়ানক ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবছা আঁধারে চোখদুটো সয়ে আসতেই বিছানা সংলগ্ন ব্যাপারটা দেখতে পায় শোয়েব। দূর থেকে আশ্বস্ত গলায় জানান দিয়ে উঠে,
- তুমি ঠিক আছ? নেমো না, থাকো ওখানে!
কথাগুলো বলতে বলতে খোলা জানালার দিকে চোখ আঁটকাল শোয়েবের। বুঝতে বাকি রইল না, শৈত্য হাওয়ায় বেসামাল হয়েছে প্রকৃতি। বাইরে প্রবল হাওয়ার তোড়, গাছের ডালে ডালে চলছে সপাটে ঘর্ষণ। উন্মত্তের মতো জানালার পর্দাগুলো ফুলে ফুলে দাপাচ্ছে। একছুটে ঘরের ডানদিকের জানালাটা শক্ত লাগামে ধরে আঁটকে দিল শোয়েব। কানে তখনো শুনতে পাচ্ছে মেয়েটার খুশখুশে কাশির তীব্রতা! ত্রস্ত হাতে কাজটা সম্পণ্ণ করতেই দামাল কাশির মাঝে চোখ তুলে তাকিয়েছে শাওলিন। নিজেও শুনতে পাচ্ছে, অভ্যস্ত হাতে বেসামাল পর্দা ধরে জানালাটা বন্ধ করছে কেউ। অন্ধকার ফুঁড়ে বিশাল একটি দীর্ঘ ছায়ামূর্তি বিছানা সংলগ্ন টেবিলটার কাছে চলে আসে। ড্রয়ার খুলে কিছু একটা বের করতেই খচ্ করে দিয়াশলাই জ্বালাবার আওয়াজ ফুটল। সেটুকু ক্ষীণ আলোয় নিজেকে প্রশস্ত একটি শয্যায় আবিষ্কার করল শাওলিন। সুবিশাল মস্ত বিছানা, চারিদিকে উচুঁ উচুঁ চারটি কাঠের স্ট্যাণ্ড, স্ট্যাণ্ডের চর্তুপাশে নরম ফিনফিনে সাদা পর্দা দ্বারা বেষ্টিত। যেন ছবিতে দেখানো রাজা-বাদশাসুলভ কোনো রাজকীয় রাজশয্যা। ততক্ষণে ছোট্ট আগুনটা পুরুষ্টু সাদা মোমের সুঁতোয় ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হলুদ মিঠে আলোয় ভরে উঠেছে জায়গাটা। তিরতিরে আলোয় সেই শুভ্র ফিনফিনে পর্দার ওপর ফুটেছে একটি কালো ছায়া। খাপে খাপে প্রকট হয়েছে বল-সর্বস্ব বাহুদ্বয়, দুটো চওড়া কঠোর কাঁধ, দৈহিক কাঠামো প্রসঙ্গত সুসংহত। এক চাপা অপ্রতিরোধ্য ভাব অঙ্গ-সৌষ্ঠব্যে বিদ্যমান। ভরাট পেশির বাঁহাতে ফিনফিনে শুভ্র পর্দাটা ঝটিতি সরিয়ে দিল সে, ঠিক তখনি দৃশ্যমান হল শোয়েব ফারশাদ। কাশিতে বিধ্বস্ত শাওলিন সহসা একপলক দৃষ্টি তুলেছিল, কিন্তু সেই দৃষ্টি আর নত হয়নি। স্থির, নিশ্চল, থমকানো রইল চাহনি। ডানহাতে পানির গ্লাসটা ধরে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল শোয়েব। ওরই সামনে, ওরই মুখোমুখি, চোখে বিদ্ধ চোখের চাহনি।
- পারবে খেতে? মনে তো হচ্ছে না হাতটাও নাড়াতে পারবে। দেখো তো চেষ্টা করে।
শাওলিন চোখ নামিয়ে নিজের কোলের দিকে চাইল। এতোক্ষণ খেয়াল করেনি দুটো হাত অস্বাভাবিক ব্যাণ্ডেজে মোড়া। পড়ণে দেখা যাচ্ছে অচেনা একটা জামা। চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতেই বাঁদিকে বেণি করে দিয়েছে। কানের দুপাশে, মুখের ওপর গুচ্ছ গুচ্ছ চুলেরা উড়ু উড়ু করছে প্রচুর। চেষ্টা করল হাতদুটো নাড়িয়ে আঙুলগুলোতে সাড়া পেতে, কিন্তু তীব্র ব্যথায় চোখমুখ খিঁচিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল শাওলিন। জোরে দম ফেলার মতো করে চোখ বুজেই বলল,
- হচ্ছে না। সাড়া . . না, আমি — ব্যথা পাচ্ছি।
বলার ভঙ্গিটা দেখে ওর হাতদুটোর দিকে তাকাল শোয়েব। নাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে ও, কিন্তু বাজে রকম ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। ব্যথায় চোখ কুঁচকে উঠলে বাঁধা দিয়ে বলল শোয়েব,
- আচ্ছা, ছাড়ো।
কথা বলেই ওর সামনে থেকে গ্লাসটা সহসা সরাল শোয়েব। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য চিন্তা করতে লাগল সে নিজে ওই অবস্থায় থাকলে কীভাবে ব্যাপারটা ঘটতো। একজন নার্স বা চিকিৎসক কীভাবে তাকে পানিটা খাওয়াতো! গ্লাসের দিকে তাকাতেই চট করে উত্তরটা মস্তিষ্কে খেলে যায়। দ্রুত গ্লাসটা ফ্লোরে এক লহমার জন্য রেখে হাঁটুতে ভর দেওয়া অবস্থাতেই বাঁদিকে হাত চালাল শোয়েব। টেবিলের সেকেণ্ড ড্রয়ার থেকে ব্যস্তভাবে কি যেন একটা প্যাকেটজাত বস্তু বের করে সেটাকে ছিঁড়ে ফেলল সে। শাওলিন আশ্চর্য হয়ে দেখল সম্পূর্ণ ইনট্যাক্ট একটা স্ট্র বের করেছে। স্ট্রটা পানির গ্লাসে রেখে পুনরায় শাওলিনের সামনে গ্লাসটা বাড়িয়ে বলল,
- খেয়ে নাও। খুঁতখুঁতে ব্যাপারের কিছু নেই। প্যাকেট এইমাত্রই খোলা হল।
শাওলিন একপলক গ্লাসের দিকে তাকাল, পরক্ষণে চোখদুটো ঘুরিয়ে নিল দুটো নীল ফসফরাস তারায়। কয়েক মুহুর্ত সম্পূর্ণ স্থির রইল শাওলিন। একদম অটল! এরপরই চরম অপ্রত্যাশিত কায়দায় নরম ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। চোখের তারায় তারায় সেই চাপা হাসির আভাস মাখিয়ে প্রসন্ন স্বরে বলল শাওলিন,
- আপনি একজন বুদ্ধিমান মানুষ। এটা অভাবনীয় ছিল। ধন্যবাদ অফিসার ফারশাদ।
সৌজন্যের হাসিতে উদ্ভাসিত হলো শাওলিনের কোমল মুখ। চোখ নামিয়ে দুঠোঁট স্ট্রয়ে চেপে দেয় ও। বহুক্ষণ পর পানির ঢোকে শান্তিটা টের পায় শাওলিন। আকণ্ঠ তৃপ্তিতে পানিটুকু খেতে লাগল ও। খেয়ালও করল না, ওর এলোমেলো চুলের ঝাপটায় চশমাধারী চোখদুটো বিদ্ধ হয়ে গেছে। চুপচাপ ওভাবে কী দেখছে তা বোঝা গেল না। তবে অনুমান করা গেল, শোয়েব এক টুকরো হাসলো। অল্প, কিঞ্চিত, না দেখানো হাসিতে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল, ছোট নামটা রেখে চারবর্ণের নামটাই কেন? সহজটা ছেড়ে কেন জটিল নামটায় পৌছুঁনো? প্রশ্নটা আর করা হল না। গ্লাসের পানিটা আশিভাগ খালি দেখে অন্য প্রশ্নটাই করে উঠল,
- পানি আরো খাবে?
এক সেকেণ্ডও দেরি করল না শাওলিন,
- খাব।
জবাবটা এমন দ্রুততায় দিল যেন প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুতই ছিল। শোয়েব ডানহাতে গ্লাসটা ধরে রেখে টেবিল থেকে জগটা বুঝে নিল। বজ্রমুষ্টিতে হ্যাণ্ডেলটা আঁকড়ে পুনরায় গ্লাসটা সম্পূর্ণ ভরে এগিয়ে দিল। এবারও তৃপ্তি সহযোগে বক্ষতালু পর্যন্ত শুকিয়ে থাকা অবস্থাটা নিবারণ করল শাওলিন। একজন বসে ছিল নরম বিছানায়, অন্যজন বসে ছিল বরফ ঠাণ্ডা মেঝের ওপর। তবু ঠাণ্ডা অবস্থাটা অগ্রাহ্য করে কী যেন ভাবল শোয়েব। কণ্ঠের ভারত্ব সংযত রেখে ডাকল হঠাৎ,
- শাওলিন,
সহসা মৃদু চমকে উঠে স্ট্র ছেড়ে দেয় শাওলিন। চোখে মুখে চুলের ঝাপটা খেলে গেলে একমুখ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়েছে। নিজেও বুঝতে পারেনি, ওকেও যে চারবর্ণের নামটায় সম্বোধন করা হল। করা হলো চার এবং চার দিয়ে অদৃশ্য সমতা। শাওলিন বিস্ময় বিভোর চোখে তাকিয়ে থাকলে প্রশ্নটা করে উঠল শোয়েব,
- এই মুহুর্তে একটা কল করতে চাও? মণি নামের কন্টাক্ট থেকে অসংখ্যবার কল এসেছে। রাত বারোটা বেজে ত্রিশের দিকে। অন্যটা একটা পাঁচে। ঘড়িতে এখন একটা চল্লিশ। যদি চাও, তো ফোন প্রোভাইড করতে পারি।
এক মিনিট নিজের মতো করে চিন্তা করল শাওলিন। মনে মনে হিসেব কষে দেখল আজ কী বার, কত তারিখ, কোন মাস। মণির জন্য কেন রাত জেগে থাকার আবশ্যক পড়ল? ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল ওর! চট করে শোয়েবের দিকে তাকিয়ে 'হ্যাঁ' বোধকে মাথা নাড়িয়ে বলল শাওলিন,
- কল করতে চাই। আমি কল না দেওয়া পর্যন্ত উনি ঘুমাবেন না। এখনই যদি ফোন দেওয়া —
কথাটা শেষ করার আগেই শব্দ আঁটকাল শাওলিন। ততক্ষণে ট্রাউজারের পকেট থেকে নিজের ব্যক্তিগত ফোনটা বের করেছে শোয়েব। ফিঙ্গারপ্রিন্ট লকটা আনলক করে শাওলিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
- কল করো, সিম ওয়ান।
বাড়িয়ে দেওয়া ফোনে চোখ রাখল শাওলিন। অজানা অনুভূতিতে ভেতরটা কেমন শুকিয়ে এল। আজ পর্যন্ত দাদা ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের ফোন ও ধরেনি। অথবা, বন্ধুদের ফোনও আজ অবধি ছুঁয়ে দেখেনি শাওলিন। নিজের হাতটা যখন ফোনের জন্য উঠাতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি বুঝতে পারল নির্মম সত্যিটা। ব্যাণ্ডেজের দরুন ফোনের স্ক্রিনে এক অক্ষরও টাচ হবে না। নিরাশায় মুখটা কালো করে ফেললে শোয়েব নিজেই কিপ্যাডে আঙুল বসিয়ে বলল,
- নাম্বার বলো।
শাওলিন কালক্ষেপণ না করে দ্রুত নাম্বারটা জানিয়ে দিল। কলট ডায়ালে ফেলে অপেক্ষা করতেই খট্ করে রিসিভের শব্দ এল। শাওলিন ভেতরের সমস্ত উৎকণ্ঠাকে মাটি চাপা দিয়ে প্রথম কথাটা নিজেই বলল,
- আসসালামুয়ালাইকুম। মণি, আপনার শাওলিন বলছি। আপনি ঠিক আছেন?
ওপাশ থেকে গুমোট নীরবতা। কোনো সাড়া পর্যন্ত নেই! একবার মনে হল কলটা বুঝি কেটে গেছে। কিন্তু না, কলটা কাটেনি। তার মানে মণি ভয়ংকর কিছু ভেবে বসেছে। ঢোক গিলে চোখদুটো এবার বুজে নিল শাওলিন। মিথ্যাটা বলার সময় চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলতে পারে না। হালকা দুটো শ্বাস ছেড়ে একদম স্বাভাবিক গলাতে বলে উঠল,
- মাত্র নেটওয়ার্ক পেলাম। এতোক্ষণ এদিকে নেটওয়ার্কই ছিল না। নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি ইচ্ছে করে ফোন বন্ধ রেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এখানে কল করার মতো আসলেই সিগন্যাল নেই। নেটওয়ার্কের ঘরগুলো সব খালি।
কলের ওপাশ থেকে আরো কিছুক্ষণ নীরব রইলেন রেবেকা। শেষে স্বর ফোঁটালেন হঠাৎ,
- তুমি ঢাকায় ফিরছ কবে? চারদিনের ঘুরাঘুরি এবার শেষ না? নাকি আরো একদিন বাকি আছে?
শাওলিন মনে মনে ভেবে দেখল আরো একদিন বাকি আছে। ওদের হিসেব মতো পরিকল্পনা হয়েছিল চারদিন। কিন্তু চারটে দিন চারটে যুগের মতো ব্যাপক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ভয়ংকর দুঃসাহস আর পেরোবেই না! চোখ বুজে রাখা অবস্থায় ফের বলল শাওলিন,
- আমরা পরশুদিনই ফিরতাম। কিন্তু রাস্তায় এখন সমস্যা চলছে মণি। মহাসড়কে ভয়ংকর একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় অবরোধ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আপনি যদি জোর দেন, তবে আমি কালই চলে আসতে পারি। আসব?
কথাটা এমনভাবে বলল যেন ওর শরীরে ব্যথাই নেই। আজকের এই নারকীয় ঘটনায় ওর যেন কিছুই হয়নি। পুরোপুরি সার্বিক অবস্থা সুস্থ বুঝিয়ে গলাটা একদম শান্ত রেখে বলল,
- আপনি বললে আমি কালই —
- না, কোনো দরকার দেখছি না। এখানকার নিরাপত্তা নিয়ে ভুলেও দস্যিপণা করবে না। অতো দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে পরে একটা বিপদ ঘটিয়ে ফেলবে, তা চলবে না। দেখো, তোমাকে যেতে অনুমতি দিয়েছি শুধু একটা কারণে। সে কারণটা তুমি নিজেও ভালো জানো। মন হালকা করে ঘুরে আসো, তারপর গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করব। তবে একটা জরুরি কথা বলার জন্য দুপুর থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমার নাম্বারে কলই যাচ্ছে না।
কেমন যেন আভাস পেয়ে চোখদুটো খুলে ফেলল শাওলিন। তৎক্ষণাৎ কী যেন আশঙ্কায় লাউডে থাকা কলটার দিকেই তাকাল। ভ্রুঁদুটো আস্তে আস্তে কুঁচকে এলে শুধাল,
- জরুরি কথাটা কী?
কলের ওপাশ থেকে রেবেকা নেওয়াজ দুই সেকেণ্ড থামলেন। এই দুই সেকেণ্ডই মনে হল সহস্র মিনিট! শাওলিন পুনরায় তাগাদা দিতে গেলে এবার রেবেকা নিজেই চুপটি ভেঙে বললেন,
- একটা লোক তোমার ব্যাপারটা খোঁজখবর নিচ্ছে শাওলিন। ব্যাপারটা কিন্তু সুবিধে না। দুপুর একটার দিকে খবর পেয়েছি, সোহার মাও একই ঘটনার ভুক্তভোগী। ঘটনা কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু হয়েছে শাওলিন? তোমার বন্ধুদের ব্যাপারে তেমন কিছু কী জানো?
কথাগুলো এবার পিলে চমকে উঠল ওর! এসব কী বলছে আবার? এগুলো কী ধরণের কথা? ক্যাম্পাসে সেরকম কিছু ঘটেছে বলে তো মনে পড়ছে না! সবাই যে যার মতো পরীক্ষা শেষে ছুটি উপভোগ করছে। আর ছুটিটাও কাটাচ্ছে অনেকটা একইসাথে! বরঞ্চ, মূল বিপদটা ঘটছে তো এই চট্টগ্রামে! এটার ঢামাঢোল ঢাকা অবধি এতো দ্রুত পৌঁছুবে কী করে? এসবের সঙ্গে কী নাযীফের ক্যামেরা বা সোহানার ব্যাগ চুরি কিছু জড়িত? আসলে কী ক্যাম্পাসে কিছু ঘটেছে বলেই ওরা ছয়জন এভাবে চট্টগ্রামে এল? এ কেমন গোলকধাঁধা? কী ঘটছে আদতে? শাওলিনের মনে হলো, ও যেন ভয়ংকর কোনো বিপদে জড়িয়ে গেছে। যে বিপদের সূঁতো ওর খুব কাছ থেকে ছড়ানো! হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পরতেই অশনি আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল ওর! চোখজোড়া বিস্ফোরিত করে অস্ফুটে বলে উঠল,
- “আ-আপনি! এখানে! ”
ওর ওই অবস্থা দেখে মাথাটা পিছু ঘুরাল শোয়েব। দরজার দিকে তাকাতেই কপালের খাঁজ যেন প্রবলভাবে গাঢ় হলো! ঘটনা কী? ব্যাপারটা কী ঘটল?
.
.
.
চলবে........................................................................