পাতা বাহার - বেলা শেখ - অনু গল্প


পাতা আলমারি খুঁজে বিয়ের সেই মেরুণ রঙের বেনারসী শাড়িটা বের করে। মুখ জুড়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসির গল্পকথা। পুরনো স্মৃতির আলাপন। পাতা দরজা লক করে ঘরেই পোষাক পাল্টে নিলো। সেই পুরনো পাতায় নিজেকে মুড়িয়ে নিলো। আয়নায় নিজেকে দেখে সময় নিয়ে। খুব বেশি সুন্দর না লাগলেও মন্দ লাগছে না। পাতা চুলের কাঁটা খুললে কোমড় সমান চুল গুলো নৃত্য করে। সে চুলগুলো আঁচড়ে খোঁপা গেঁথে নেয়। ড্রেসিন টেবিলে রাখা গোটাকয়েক গোলাপ ক্লিপের সাহায্যে খোঁপায় গুঁজে নেয়। কানে সেই পুরনো স্বর্নের ঝুমকো এখনো দ্যুতি ছড়ায়। মারাঠিদের মতো সেই নাকের নথ! পাতা আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হাসলো। কাজলের স্টিক টা তুলে সুক্ষ টানে এঁকে নেয় নয়ন যুগ্ম। টকটকে লাল রঙে রঙিন করে ওষ্ঠাধর! চোখের কোনা থেকে একটু কাজল কর্নিষ্ঠা আঙ্গুলে ছুঁয়ে আয়নায় নিজ প্রতিচ্ছবির উপর লাগায়। 

-" শালার জামাই আজ শেষ!"

পাতা গুন গুন করে ঘর থেকে বেরোয়। ইতি উতি না তাকিয়ে সোজা ছাদের পথ ধরে। কুঁচি ধরে সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি বায়।খোলা পায়ে ছাদে আসতেই নজরে আসে পাতার ব্যক্তিগত মানব টাকে। ফোন হাতে তাঁর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে। উঁচু গলায় ঝাড়ছে কাউকে। লোকটা দিন দিন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। পাতা অতি সাবধানে শব্দহীন পায়ে এগিয়ে যায়। গোধূলি বেলায় নীলাম্বরের রাঙা অরুণ অস্তমিত হবার পথে। তারই লাল আভায় অম্বর মেদিনী রঙিন।অরুণ সরকার রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পাতা তাঁর নিকটে পিঠ পিছনে দাঁড়াল। বিরাট বটগাছের নিচে নিজেকে দূর্বা ঘাস মনে হচ্ছে। পাতা বলিষ্ঠ পিঠে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে 'ভাও' বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। তবে ম্যানারলেস লোকটা ভয়ের ভ'টাও পেলো না। তবে অঘটন যা ঘটার ঘটেই গেলো। অরুণ সরকারের হাত থেকে ফোনটা ফসকে একেবারে নিচে বাগানে বসে হাহাকার করছে। পাতার মুখ খানা কাঁচুমাচু হয়ে যায়। মিনমিনে সুরে 'স্যরি' বলে। সাথে সাথেই ধমক পড়ে,

-" বাচ্চা তুমি পাতাবাহার? দূর্ঘটনা বশত যদি ফোনটার কাছে আমি থাকতাম?"

-" ফোনটা তো আর আমার আপন কেউ না তাই ফসকে যেতে দিয়েছি। আপনাকে ধরে নিতাম!"

পাতার মিনমিনে সুর। গম্ভীর অরুণ সরকারের কপালের ভাঁজ শিথিল হয়। তবে মুখটা এখনো গম্ভীর। এই চুনোপুঁটির শরীর নিয়ে তাকে ধরে নিবে? হাস্যকর না? সে দুই হাতে পাতার কোমড়ে রেখে শক্ত করে ধরে শূন্যে তুলে রেলিংয়ের ওপর বসিয়ে দেয়। সবকিছু এতো দ্রুত হলো পাতার ঠাহর করতে বেগ পোহাতে হয়। বুঝে উঠতেই ভয়ে চোখ মুখ বিবর্ণ হয়ে আসে। শক্ত করে অরুণের টি শার্টটার কলার চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলে,

-" ভোরের বাবা পড়ে যাবো। নামান বলছি? সামান্য ফোনের জন্য কেউ বউকে ফেলে দেয়?"

পাতার কোমড়ে থাকা হাত একটু শিথিল করতেই পাতা আরেকটু ঘাবড়ে যায়। গম্ভীর অরুণ সরকারের মুখাবয়ব ঠাহর করা মুশকিল। চোখে মুখে দুষ্টুমির ছাপ নেই। পাতা ঢোক গিলে আবারও বলে,

-" আমি কিন্তু ভোরকে ডাকবো? ভোর...উম্"

চোখ মুখ খিঁচে নেয় পাতা। খাবলে ধরে হাতের মাংসল পেশি। শান্ত হতে একটু সময় নেয়। তবে অশান্ত কেউ শান্ত হবার পথে নেই। আধিপত্য তার ওই কৃত্রিম রাঙা হৃষ্ট পুষ্ঠ ওষ্ঠপুটে। অরুণ সরকার পাতার কোমড় শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে রেলিং থেকে নামিয়ে একটু আড়ালে চলে যায়। পানির ট্যাংকের ওপাশটা বিভিন্ন ফুলের টবে একটু নির্জন সেখানে অবস্থান নেয়। তবে এক মুহূর্তও ছেড়ে দেয় নি। সময় গড়ায় পাতা দম নেবার জন্য ছটফটিয়ে উঠলে অরুণ সরকার ছেড়ে দেয় তবে সময়কাল খুবই ক্ষীণ। পাতা শ্বাস ছেড়ে আবারও টেনে নিবে ওষ্ঠপুটে আবারও আক্রমণ। পাতা অবগত এই আক্রমণের হতাহতের পরিমাণ।সব দোষ তারই। অরুণ সরকার দিনক্ষণ স্থানভেদ ভুলে হারিয়ে যায়। একহাতে চোয়াল দ্বয় শক্ত করে ধরে অপর লাজহীন হাত খেই হারায়। পাতা বাঁধা দেয়। ওই তো দূরপাল্লার মসজিদ হতেই আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। অরুণ সরকার বিরক্ত মাখা মুখে পাতাকে ছেড়ে গমগমে সুরে বলে,

-" সমস্যা কি?"

পাতা ছাড়া পেয়েই দূরত্ব মেপে সরে যায়। চোখ রাঙিয়ে বলে,

-" আপনার মাথা! আজান দিচ্ছে কানে যায় না? আমারই ভুল কোন কুলক্ষনে এখানে আসতে গেলাম!"

বলেই পাতা উল্টো পথে পা চালায় কেটে পড়বে। অরুণের চোখে মুখে ফুটে আকাশসম ত্যাক্ত অনুভূতি! ভালোই তো একান্ত মুহূর্তগুলো স্বর্গে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। মেয়েটা এবার ঠাস করে তাকে ফেলে দিলো মনে হয়। সে ট্রাওজারের পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছে সামনে ধরে। তারপর ব্যস্ত পায়ে পাতার পিছু নেয়।

-" পাতাবাহার স্টপ? দাঁড়াও বলছি?"

পাতা দাঁড়ায়নি বরং পায়ের গতি বাড়িয়ে চলে যায়। অরুণ দাঁত কটমট করে মেয়েটা ইজ্জতের চাটনি বানিয়ে দিবে। অরুণ সরকারের ইজ্জতের চাটনি বানানোর জন্য পাতার সম্মুখে সুফিয়া দন্ডায়মান। পাতার আপাদমস্তক দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

-" বুড়া বেডির আবার ঢং হুঁ! বলি নতুন কইরা বিয়ার শখ জাগলো নাকি? জাগলে ভালো দেইখা রসিক রসকষ ওয়ালা মানুষ খুইজেন!"

পাতা হতাশ এই মহিলা তাকে দেখলে এতো জ্বলে কেন? সে কিছু বলবে সুফিয়া বোমা ফালায়,

-" লিপিস্টিক ঠোঁটে লাগায় জানতাম! আপনে তো মুখ জুড়ায় লাগাইছেন। ভালো ভালো.."

সুফিয়া থম হয়ে চেয়ে রয় পাতার পেছনে এগিয়ে আসা অরুণ সরকারের দিকে। তাঁর অলিখিত সমীকরণ সিদ্ধ হয়। সে মুখে আঁচল গুঁজে পাতার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-" লাজহীন বেডি! লজ্জা হাঁটে বেঁইচা খাইছে। দুই বাচ্চার মা তাও হুঁশ জ্ঞান নাই বেক্কল!"

বলেই চলে যায় ব্যস্ত পায়ে। পাতার হাত পা যেন অসাড় হয়ে গেলো লজ্জায়! আঁচলে মুখ ঢেকে নেয় তৎক্ষণাৎ। কারো পায়ের শব্দে পেছনে ফিরে তাকায়। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

-" নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য ইতর লোক!"

-" ওয়াও বিউতিপুল আম্মু লাল তুকতুক বউ!"

পাতা সামনে তাকায়। মেয়েকে ফেলেই একপ্রকার মুখ লুকিয়ে ঘরের দিকে চলে যায়; বিড়বিড় করে অরুণ সরকারের পিন্ডি চটকাতে ভুলে না। ভাবনা গাল ফুলিয়ে নেয়। মা তাঁর কথা শুনলো না কেন? পঁচা মা! অরুণ সরকার এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। ফুলো গালে চুমু দিলে ভাবনা নাক টেনে বলে,

-"মানালুস বাবা? মা গেল কেনু?"

অরুণ ছোট ছোট চোখে চায়। তাঁর ঘরে ছিঁচকাদুনের মেলা বসেছে যেন! সেও ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলে,

-" ভোরের বাবা অমুকের বাবা তমুকের বাবা মানালুস বাবা! আম্মাজান শুধু বাবা বলতে কিসের আপত্তি?"

-" শুদু বাবা!"

বলেই গা কাঁপিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ভাবনা সরকার। অরুণের অধরকোনেও হাসি ফুটে ওঠে। 

-" কলিজা কোথায়?"

-" ভাই আম্মুল জন্যি ইয়া বলো কেক আনিছে। আমাল ইত্তুও দেয় নাই।"

ছোট্ট ভাবনার অভিমানী সুর। অরুণ আশ্বস্ত করে সবটুকু কেক তাকেই দিবে। ভাবনার খুশি দেখে কে। সে বাবার গালে মুখে আদরের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। অরুণ মুচকি হাসলো। মেয়েটা খেতে ভালোবাসে খুব। কোনো কিছুতেই না নেই। একটু ক্ষিধে পেলেই চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। অরুণ ঘরে ঢুকে দেখে পাতার অর্ধেক শাড়ি খোলা শেষ। সে দরজা লক করে বলে,

-" এখনি শাড়ি খোলার কিসের তাড়া? রাতে যত্নসহকারে আমি.."

পাতার চোখ রাঙানিতে অরুণ সরকার থেমে যায়। তবে তাঁর দুষ্টু চাহনি থামার নয়। পাতা বিড়বিড় করে তার গুষ্টির ষষ্ঠি বানায়।শাড়ি খুলে পাতা আলমারি থেকে আরেকটা শাড়ি বের করবে অরুণ মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে একটা পার্সেল পাতার দিকে বাড়িয়ে বলল,

-" হ্যাপি ম্যারিজ এনিভার্সারি! টেইক ইয়ুর গিফট! আই উইল টেইক মায় ওউন গিফট অ্যাট ডিপ নাইট!"

পাতা ভস্ম নজরে তাকিয়ে অরুণের হাত থেকে বক্সটা ছিনিয়ে নেয়। বিছানায় রাখতেই ভাবনা এগিয়ে এসে নিজেই খুলে বক্সটা। একটা জলপাই রঙের বেনারসী, একই রঙের এক মুঠো কাঁচের চুড়ি, গোটাকয়েক লাল গোলাপ, দুটো ডার্ক চকলেট, একটা চাবির রিং, একটা গয়নার বাক্স, আরেকটা বক্স যেটা র্যাপিং করা! ভাবনা চকলেট দুটো নিজের দখলে নিয়ে মিটিমিটি হাসে। পাতা অরুণ সরকারের দিকে চায়। চোখে মুখে পাতার ঢের অবাকতা অথচ অধরজুড়ে মিষ্টি হাসির গপ্পো কথা! সে গয়নার বাক্স খুলে দেখে একটা সাধারণ স্বর্নের হার, টিকলি, একজোড়া ঝুমকো আর কঙ্গনা! পাতার অষ্ঠাধরের মাঝে ফাঁক লক্ষনীয়! সে চোখ বড় বড় করে অরুণের দিকে চায়। রসকষহীন জামাইটা সেই পরিচিত ষাঁড় মুখো বানিয়ে রেখেছে। পাতা র্যাপিং করা বক্সটা আনপ্যাক করে। ফোন? ফোন বের করতেই পাতা অজ্ঞান হতে নিয়েও হয় না। মিনি হার্ট অ্যাটাক করলো কি? আইফোন!!!! তার চোখ চড়কগাছ!! খুশিতে তাঁর ভাবনার মতো গড়াগড়ি খেয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে! পাতা ফোনটা হাতে নিয়েই অরুণ সরকারের গলায় ঝুলে পড়ে। 

-" থ্যাংক ইয়ু নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। পাতা আপনাকে একটু আকটু না অনেকটাই ভালোবাসে।"

বলেই টুপ করে গালে চুমু দিয়ে সরে আসে। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে শাড়ির ভাঁজ খুলে ব্লাউজ সহ প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে ছোটে। অরুণ হাসে তাঁর বাচ্চামোতে। বিছানায় মেয়ের দিকে তাকাতেই ভাবনা কোমড়ে হাত রেখে আঙুল উঁচিয়ে বলে,

-" আমাল গিফুট কই মানালুস বাবা?"
.
.
.
সমাপ্ত.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp