তুশির বাড়ি ফিরতে সময় লাগল। মেট্রোতে জায়গা পায়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার ধৈর্য তুশির নেই।
রিকশাতে বিরাট জ্যাম।
পুরো বস্তি তখন ঘুটঘুটে,চুপচাপ। এখানে আবার এগারটা বাজতেই সবাই দোরের খিল টেনে দেয়।
তুশি চটি খুলে হাতে নিয়েছে। গলির মুখে বসা কুকুরগুলো ওকে দেখে ঘেউঘেউ করে উঠল। পরপর মুখটা চেনা বুঝতেই, শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল জায়গায়।
তুশির এসবে চিন্তা নেই। ও কুকুর-টুকুরে ভয় পায় না। আপাতত ভয়টা ওর দাদিকে নিয়ে। দাদির কানে কী খবর চলে গেছে, না যায়নি? এত রাত অবধি জেগে আছে,না ঘুম? উফ! কী ঝামেলার ব্যাপার-স্যাপার।
তুশি খুব আস্তে টিনের দরজাটা ঠেলল হাত দিয়ে। পাছে শব্দ না হয়! এ বাড়িতে দরজা খোলা থাকলেও যা,বন্ধ থাকলেও তাই। চোরের ভয় নেই। কী নেবে চোর? ঘটিবাটি ছাড়া তো কিছুই পাবে না।
ঘরের ভেতরের টেবিলটা দরজার সোজাসুজি বসানো। ওতে এক টুকরো ডিমবাতির মতো হারিকেন জ্বলছে। আস্তেধীরে দম ফুরিয়ে আসছে বোধ হয়। তুশি জ্বিভ কাটল।
এহ হে, দাদি তো বিকেলে কেরোসিন আনতে বলেছিল। পকেটমারার লোভে ও সব ভুলে গিয়েছে।
ভালো করে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল পুরো ঘর। খাটে মশারি টাঙানো। তার মানে দাদি ঘুম! যাক ভালোই হয়েছে।
তুশি দোর চাপাল খুব আস্তে। খিলটা তুলে ফিরতেই,চমকাল অমনি। মুখের সামনে থান পরা বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছেন।
হঠাৎ দেখায় ভড়কাল তরুণী। হকচকিয়ে পেছালো এক পা।
বুকে থুথু ছিটিয়ে বলল,
“ হট ইচ দিস,দাদি? এভাবে কেউ সামনে এসট্যান করে? ভয়ে
এক্ষুনি ডাই করে গেলে কী হতো?”
হাসনা বানুর চোখমুখ শক্ত। কথার উত্তর দিলেন না। পালটা প্রশ্ন করলেন,
“ তুই এত রাইত পর্যন্ত কই ছিলি?”
তুশি জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। দাদিকে ও ভয় পায় না। কিন্তু মান্যি করে। সেটা হলো ভালোবাসার মান্যি। এই মানুষটা ছাড়া তো ওর আর সাতকূলে কেউ নেই।
দাদির চেহারার দশায় যা বোঝার বুঝে ফেলল মেয়েটা। নির্ঘাত বাবলু, টিনটিন দায়িত্ব নিয়ে উপকার করে গেছে। ওদের সামনে থেকেই তো ওই বদ পুলিশ ওকে খপ করে ধরেছে। মেয়ে পুলিশটা টানতে টানতে তুলেছে জিপে। ছিঃ ইজ্জ্বত বলতে তুশির কিছু রইল না। কাল ও বস্তিতে মুখ দেখাবে কেমন করে?
তুশি দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল। হাসনা বানু স্বর উঁচালেন,
“ কতা কস না ক্যা? পুলিশে ধরছিল তোরে? এত রাইত পর্যন্ত থানায় ছিলি?”
ও সময় নিয়ে বলল,
“ হু।”
অমনি ঠাস করে এক চড় মারলেন বৃদ্ধা। ঠিক তুশির গাল বরাবর লাগল গিয়ে।
চটে বললেন,
“ কত্তবার কইছি এইসব কাম ছাড়। চুরি চামারির দরকার নাই। আমি যে বাসাত কাম করি,ওই বাসায় যাই। অন্তত
খাইয়া-পইররা বাঁইচা থাকমু দুইজনে। না,হুনবো না আমার কতা। আইজ যদি হাজত দিয়া ছাড়া না পাইতি কী হইত তাইলে?”
চড়টা হাসনা জোরেই মেরেছেন। কিন্তু তুশিকে দেখে মনে হলো ওর গায়েই লাগেনি। হাত দিয়ে গাল ঘষলেও ব্যথা পাওয়ার দুঃখ নেই চোখে। ভীষণ স্বাভাবিক বলল,
“ আরে দাদি! ওরাতো আমাকে এমনি এমনি ক্যাচ করে নিয়ে যায়নি। নিয়ে গেছে বস্তির কুশলাদি জানতে।
দে গিভিং মি রেসপেক ( respect)।
চেয়ারে বসিয়েছে। টি ইটিং করিয়েছি।
কী যে খাতির! বারবার বলেছে, মেডাম হট ইউ ওন্ট?(ওয়ান্ট)
ইওর কি আর কিছু চাই?”
কষে এক ধমক দিলেন হাসনা,
“ চুপ কর। চাপাবাজি অন্য কোনোহানে করবি। পুলিশ তোরে নিয়া ম্যাডাম ডাকছে? এই গল্প আমারে কইলি ভালো, অন্য কাউরে কইস না। পাগল বুইজজা গারদে হান্দাই দিয়া আইব।”
গারদ শুনেই তুশির হাজতের কথা মনে পড়ে গেল। চোখে ভাসল ইয়াসিরের কটমটে মুখ। সাথে রুহানকে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারার দৃশ্য। কেমন ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেল ছেলেটা! হাতে কত জোর
হলে মানুষ অমন থাপ্পড় মারতে পারে!
তুশির শরীর ঝাঁকি দিলো। যেন এক্ষুনি সটান বিদ্যুৎ-এ হাত দিয়েছে।
সচেতন চিত্তে ভাবল,
“ নো নো তুশি, টুমোরো থেকে তোকে আরো উওয়ার(aware) থাকতে হবে। আবার ওই বদ পুলিশের আই-তে পড়ে গেলে ফিনিশ। আপাতত ওসব পুলিশ-টুলিশের পকেট কাটা যাবে না।”
হাসনা বানু বিরক্ত চোখে চেয়ে।
তুশি এরকমই। মারলেও,বকলেও ওর কিচ্ছু এসে যায় না। অথচ মেয়ে মানুষ হয় কাদার মতো নরম। কাঁদে,দুঃখ পায়,খিলখিল করে হাসে। আর এটা! এটার মাঝে ওসবের কিচ্ছু নেই। কাঁদেও না কখনো। চুলগুলোতে হাসনা জোর করে তেল দিয়ে দেন। বেঁধেও দেন রোজ সকালে। তুশিতো জামাকাপড় পরেই খালাশ। নিজের দিকে কখনো তাকায় ভালো করে? কোনোদিন ঠোঁটে একটু লিপস্টিকও পরেনি। ক্রিম লাগায় ঠিকঠাক? নাহ, তাও না। মেয়েটা বড্ড ডানপিটে। যেন ভুল করে ছেলের জায়গায় মেয়ে জন্মেছে। হাসনা বানু ভাবেন, খুব ভাবেন এই মেয়েটাকে নিয়ে। দেখতে সুন্দর। যত্ন নিলে রূপখানা চাঁদের মতো দেখাত। কিন্তু তাতো আর হয় না। আচ্ছা,তুশিকে তিনি শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন কী করে? একটা ভালো বর জুটবে ওর? কে বিয়ে করবে ওকে!
ততক্ষণে সামনে থেকে সরে গেছে তুশি। কাঠের আলনার যেখানে ওরা জামাকাপড় রাখে? সেখানের ওপর একটা প্লাস্টিকের হুক টানানো। তুশির শার্ট ওতেই থাকে। ও পরনেরটা খুলে চেয়ারে রাখল। নিচে এখন ঢোলা টিশার্ট আর জিন্স।
ফরসা মুখটা দেখে হাসনা বানুর মায়া হলো। আর কিছু বললেন না এ নিয়ে।
চুপচাপ গিয়ে খিচুড়ি বেড়ে আনলেন। তুশি হাত-মুখ ধুয়ে এসেছে। পুরোনো, পাতলা গামছা দিয়ে চোখেমুখের জল মুছল। ভেবেছিল কাল বেলা অবধি ঘুমাবে। কিন্তু তা আর হবে না। ধরা পড়ায় সব শেষ। আবার সকাল সকাল নামতে হবে কাজে!
ও পাটি বিছিয়ে বসল মেঝেতে। হাসনা থালা এনে সামনে রাখলেন। পাশে স্টিলের গ্লাস ভরতি জল। খিচুড়ি আর মুরগীর মাংস।
তুশি অবিলম্বে হাত ডোবায় তাতে। সেই সন্ধে থেকে পেটে কিছু পড়েনি। এত খিদে পেয়েছে এখন! ও খেল গপাগপ। আর পাঁচটা মেয়ের মতো আতুপুতু করে খায় না তুশি। চিকণ হাতে বড়ো করে ভাতের লোকমা তোলে। খুব অগোছালো, তাড়াহুড়ো ভাব। যেন এক্ষুনি কেটে আসা টিকিটের ট্রেন ছুটে যাবে।
পুরোটা সময় হাসনা বানু ওকে মন দিয়ে দেখলেন। দৃষ্টি নরম,কাতরের মতো। আচমকা মানস্পটে ভিন্ন কিছু ভেসে উঠল তার। একটা রাত,একটা জঙ্গল। যার মধ্যে দিয়ে প্রানপণে ছুটছেন এক রমণী। পরনের ময়লা শাড়ির আলুথালু দশা। কোলে তোয়ালে প্যাঁচানো এক নবজাতক। বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে হয়ত। নিস্তব্ধ,সুনসান রাতে রমণীর ঘন শ্বাস,যেন অদূর হতে ভেসে আসা সাপের ফোসফোস শব্দ।
এত ভয়ানক,এত ভারি!
“ ও দাদি! আরে ও দাদি!”
হাসনা চমকে উঠলেন৷ শীর্ণ দেহ নড়ল একটু। চোখটা মারবেল,বুকে ঘন শ্বাস দেখে কপাল কোঁচকায় তুশি।
কণ্ঠে বিভ্রম,
“ কী হলো? চমকে উঠলে কেন?”
এক চোট ঢোক গিললেন তিনি। কোচকানো চামড়ার খাঁজে অল্প ঘাম জমেছে। হাসনা চোখ বুজে সামলালেন নিজেকে। ওসব ভেবে খেই হারালে চলবে না। মুখটা সাবলীল রাখার চেষ্টা করলেন খুব!
তুশি উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ ওমা,হট হিপিন?(হ্যাপেন্ড)
হট ইউ থিং দাদি?”
প্রৌঢ়া চ সূচক শব্দ করে বললেন,
“ আবার শুরু?
আমি লেহাপড়া জানি,তুশি? তোর ইংজিরি তো দূর, ভুল কস না ঠিক কস হেইডাই বুঝমু না। বাংলায় কইতে পারলে ক। নাইলে খা চুপচাপ।”
“ আচ্ছা আচ্ছা,কী ভাবছিলে?”
“ কিছু না। খা জলদি। ঘুম পাইছে আমার।”
“ আহহা, তুমি গিয়ে স্লিপ করো না। আমার দেরি হবে তো।”
হাসনা বানু উঠলেন না।
বসে রইলেন অমন। প্রশ্ন ছুড়লেন হঠাৎ ,
“ তুশি,তোর খারাপ লাগে না রে?”
ও চোখ তুলে চাইল। কণ্ঠে বিস্ময়,
“ খারাপ! কেন?”
“ আমি তো তোরে ভালো কিছু দিতে পারি না। পড়তে চাইছিলি তাও হয়নাই। কী করছি তোর লাইগা! উলটা তোর আমারে টানোন লাগে। আমার কামে তো আর তেমন কিছু হয় না। এই ঘরের ভাড়া দিয়াই অদ্ধেক শ্যাষ।”
হাসনা বানুর চোখেমুখে বেদনা।
অথচ ব্যথাতুর কণ্ঠের বিপরীতে তুশি হা হা করে হাসল। যাতে ছন্দ নেই,আরাম নেই। রাখ-ঢাকহীন হাসি বলা যায়।
বলল ভ্রু উঁচিয়ে,
“ শাবানার সিনেমা দেখে এসছো?
এত ইমুশোনাল কথা কেন?
এসব ভেবে রাতের ঘুম হারাম কোরো না দাদি। যাও, ঘুমাও গিয়ে। আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমার জীবন বিন্দাস যাচ্ছে। অল গুড। ভেরি গুড। আই গুড,ইউ গুড। এভ্রিথিং ইজ গুড গুড।”
হাসনার কপালের ভাঁজ দেখে বলল,
“ ওহ,তুমি তো আবার ইংলিশ বুঝবে না। এটার মানে হলো আমি সব কিছুতে ভালো আছি। যাও এখন,তাড়াতাড়ি যাও।”
ফোস করে শ্বাস ঝেড়ে উঠে গেলেন বৃদ্ধা। তুশি খেতে থাকে। ওর একটা স্মার্টফোন আছে। এটাও চুরির মাল। ডিসপ্লের চার দিকের কাচ ফাটা। স্পিকারের
কথাও প্রায়ই কেটে কেটে আসে। তুশি ইউটিউব ছাড়ে। ভয়েস রেকর্ডারকে হুকুম দেয়,
“ দেবের ডিসকো গান।” স্ক্রিনে কয়েকটা গান ভেসে উঠল অমনি।
লে পাগলু ডান্সটায় ক্লিক করল তুশি।
গান চলছে। সাথে ওর জ্বিভ।
হঠাৎ কিছু একটা হলো। কীরকম যেন পাল্টাল সময়। রাতের অন্ধকারের মতো নিস্তেজ হলো মেয়েটার শুভ্র রাঙা মুখ। তুশি ওদের আশকারা দেয় না। এক পাশে ঠেলে,ফের খাবার তোলে গালে। কিন্তু না! কোনো এক সূক্ষ্ণ পীড়ার তোড়ে ওটুকুও গলা মাড়াতে ব্যর্থ।
কেন, কীজন্য? কীসের এই ব্যথা তুশির? কে জানে!
****
মোটামুটি পুরোনো একটা দোতলা বাড়ি। পাকা চুন-সুরকির গাঁথুনিতে তৈরি দেওয়াল মেটে রঙে মোড়ানো। সফেদ ছাদের কার্নিশ তৈরি রাজকীয় নকশায়। খিলান আকৃতির মূল ফটকদ্বার ঠিক লোহার মতো ভারি।
পাশের নেমপ্লেটে লেখা
“ সৈয়দ ভবন।” যেখানে দুই ভাই সৈয়দ শওকত আলী, আর সৈয়দ সাইফুল ইসলামের পুরো পরিবারসহ একচ্ছত্র বাস।
শওকত আলীর মেজো ছেলে ইয়াসির।
পুরো নাম,সৈয়দ ইয়াসির আবরার সার্থ। তবে ছেলেটা বাইরের জগতে এই টাইটেল ব্যবহার করে না বললেই চলে!
ইয়াসিরের বাড়ি ফিরতে রাত হয়। দৈনন্দিন একই রুটিন,একই জীবন। এতে নতুন আহামরি কিচ্ছু নেই। মতিঝিলের রাস্তায় যা জ্যাম! যতই আগে বের হোক,ফিরতে ফিরতে সেই বারোটা ছাড়াবেই।
কিন্তু ওই অবধি জেগে থাকেন মা,মিসেস তনিমা বেগম।
ছেলেকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দেন,পাশে বসে থাকেন। তারপর সব গুছিয়ে শুতে যান তিনি।
ইয়াসির মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়। মাঝে মাঝে হাসে। মাঝে মাঝে রাগ দেখায়,মাঝে মাঝে মাকে পাশে বসিয়ে খায় চুপচাপ।
এর কোনোটা হয়ত আজকেও হবে।
হাজার টন ক্লান্তি,আর এক চোট ভারি মাথাব্যথা নিয়ে দরজা খুলে ঢুকল ইয়াসির।
বসার ঘর তখন আলোয় মাখা সূর্যের মতো চঞ্চল।
ও একটু থমকাল তাতে। ভেবেছিল প্রত্যেকদিনের মতো গোটা বাড়ি অন্ধকার,আর সবাই ঘুমে কাদা হয়ে থাকবে। কিন্তু না! মুখোমুখি সোফাসেট ভরতি করে বসে আছে তারা।
ইয়াসির ঢুকতেই যাদের সতর্ক চাউনী বর্তাল এদিকে। মা থেকে শুরু করে ঘরের সবথেকে ছোটো মিন্তু অবধি সজাগ। এক পাশের চেয়ারটায় বৃদ্ধা জয়নবও বসে।
ইয়াসিরের কপালে ভাঁজ পড়ল।
ধীর পায়ের গতি বাড়িয়ে এগোলো সামনে। কিছু বলতে হাঁ করবে,ছোটোরা চ্যাঁচাল আচমকা…
“ কংগ্রাচুলেশনস!”
ইয়াসিরের গোটানো ভ্রু গেল না। দৃষ্টিতে প্রশ্ন মেখে এক পল মাকে দেখল সে। সকালের শিশিরের মতো হাসছেন তনিমা।
ও শুধাল,
“ কী হয়েছে?”
সাইফুল ইসলাম উঠে এলেন। ঠোঁটে হাসির জোয়ার নিয়ে জাপটে ধরলেন ওকে। বুকে বুক মিলিয়ে বললেন,
“ কংগ্রাচুলেশনস আমার বাপ। তুই তো আমাদের বংশের নাম পুরো ইতিহাসে তুলে দিবি।”
ইয়াসির বোঝেনি। ওর চোখে প্রশ্ন। ইউশা লাফিয়ে-চড়িয়ে বলল,
“ ভাইয়া, তোমাকে নিয়ে তো পুরো টিভি-চ্যানেলে হইচই পড়ে গেছে। সেই সন্ধ্যে থেকে সব চ্যানেলে তোমার খবর।”
ইয়াসির চেহারায় টান বসল। কৌতূহল মিটে যাওয়ার প্রলেপ হিসেবে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল শুধু। নিষ্প্রভ আওড়াল,
“ ওহ!
এই সামান্য কারণে সবাই এত রাত অবধি জেগেছিলে?”
সাইফুলের স্ত্রী রেহনূমা,তিনি বললেন,
“ এটা তোর কাছে সামান্য, সার্থ? তুই জানিস,তোকে এভাবে দেখে আমাদের কত আনন্দ হচ্ছে?”
দাদুন বললেন,
“ মেজো ভাই,আমার কাছে এসে বোসো তো একটু। যে মার মারলে ছেলেটাকে। হাত-টাত ব্যথা করলে টিপে দেই!”
ইয়াসির হাসল। গিয়ে বসল দাদুর পাশে। জয়নব হাতটা ওর চুলে রাখলেন। পরম মমতায় বোলালেন কয়েকবার। ইয়াসিরের গায়ের রং হলদে। মাথা ভরতি ঘন চুল, তবে ডিউটির তাগিদে ছোটো করে কাটে। কুচকুচে চোখ দুটো ক্ষুরের মতো ধারালো। সব থেকে আকর্ষণীয় তার লম্বা-উঁচু নাক।
তুলনায় অবর্ণনীয় মানুষটার পানে এক যোগে চেয়ে রইল আইরিন। ও ইয়াসিরের ফুপুর মেয়ে । বেড়াতে এসেছে কিছুদিন হোলো। কিন্তু এর মাঝের এক আমূল সত্যি,আইরিনের নিবিষ্ট মনের আবিষ্ট ধ্যানের পুরোটা জুড়ে ইয়াসির। যাকে ও মন থেকে চায়। সব সময়, সবক্ষণে। কিন্তু কোথাও যেন হাইফেনের মতো একটা লম্বা বাধা। আইরিন চাইলেও মুখ খুলতে পারে না। এই যে ওর সামনে ইয়াসিরের জন্যে মেয়ে দেখা হোলো,হাহুতাশে ভেতর ভেতর বুক চাপড়াল মেয়েটা! সেসব কী ও কাউকে বোঝাতে পারবে কখনো?
মুখোমুখি সোফায় বসেছিল অয়ন। ও মেডিকেলের ছাত্র। পাকাপোক্ত পেডিয়াট্রিসিয়ান হওয়ার পথে! এইত, পোস্ট গ্যাজুয়েশানের মাত্র এক বছর বাকি। খুব আনন্দ নিয়ে বলল,
“ আমি তো আজ সব কাজ বাদ দিয়ে টিভির সামনেই বসেছিলাম,ভাইয়া। তোমাকে নিয়ে যা আলোচনা হচ্ছে না! সাংবাদিকরা সবাই প্রসংশায় একাকার।”
ইয়াসির হাসল একটু।
সৌজন্যতায় টেনে আনা হাসি। ক্লান্ত লাগছে খুব! তারওপর রুহানকে কোর্টে তোলার সমস্ত ব্যবস্থা করে এসেছে। কিন্তু রুস্তম যা ধূর্ত,আবার কমিশনারও সাথে আছেন। শেষ অবধি জয় হবে কী না! সে নিয়ে এখনো চিন্তা মেটেনি।
তনিমা বললেন,
“ তুই ফ্রেশ হ,আমি ভাত বাড়ছি।
রেহণুমা বললেন,
“ আপা,পরে যাও না। আগে ঐ আলাপটা সাড়ি?”
আইরিনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। বুকটায় দুম করে লাগল কিছু।
তনিমা ছেলের দিকে চাইলেন। ইয়াসিরের মুখায়বে শ্রান্তি। পক্ষান্তরে বাকিদের চেহারায় উচ্ছ্বাস ততটাই। তাই
মানাও করতে পারলেন না। এর মাঝেই প্রশ্ন করল ইয়াসির,
“ আবার কী হয়েছে?”
ইউশা লাফিয়ে উঠল,
“ ভাইয়া,আমরা তোমার জন্যে একটা দারুণ মেয়ে দেখে এসেছি। এত মিষ্টি মেয়েটা! কী যে সুন্দর! তোমার সাথে খুব ভালো মানাবে!”
ইউশা সাইফুলের বড়ো মেয়ে। খুব চঞ্চল,বোকা। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ার, অথচ এখনো কোথায় কী বলতে হয় তাই জানে না। এই যে,সবার মাঝে ফটাকসে বলে ফেলল,
“ তোমার সাথে মানাবে।”
ইয়াসির বিরক্ত হলেও শব্দ নেই। ওর স্বভাবে ধমকা-ধমকি বিরল। ছোটো ভাইবোনগুলোকে সে ধমকায় না। কখনো উচ্চস্বরে কথাও বলেনি৷ এমন নয় ও খুব শান্ত মেজাজের। কিন্তু কোনো এক কারণে ভাইবোনদের রাগ দেখাতে ইচ্ছে হয় না তার। তাই এখনো কিছু বলল না। শুধু জিজ্ঞেস করল,
“ কাল ক্লাস নেই?”
ইউশার হাসি থমকায়। তার উল্লাসের সাথে ব্যাপারটা মেলেনি। এক পল বিভ্রান্ত চোখ বোলায় বাকিদের দিকে।
“ আছে।”
“ ঘুমাতে যা।”
ইউশা ঠোঁট উল্টাল। বুঝতে পারল ভাইয়া এই আলাপ ওর সাথে করতে চাইছে না।
মাথা নুইয়ে উঠে গেল চুপচাপ। সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে কয়েকবার দেখল অয়নকে। তখনই কানে এলো ইয়াসিরের পরের কথা,
“ তোরাও যা। বড়োদের আলোচনায় তোদের কোনো কাজ নেই।”
আইরিন উঠল সবার আগে। ওর এমনিতেও এই আলাপ শোনার ইচ্ছে নেই। দুভাগ হওয়া বুক নিয়ে প্রিয় পুরুষের বিয়ের কথা শোনা যায় কখনো? মিন্তুর চোখে ঘুম। মেজো ভাইয়াকে অভিনন্দন জানাতে ওসব জলাঞ্জলি দিয়ে বসেছিল এতক্ষণ। জানানো হয়ে গেছে,এবার আরামসে ঘুমানো যাবে। গায়ের টিশার্টটা টেনেটুনে, হাই তুলে রওনা করল সেও।
শুধু বসে রইল অয়ন। আইরিন,ইউশা, মিন্তু ওদের মতো সেও ইয়াসিরের ছোটো।
যদিও হিসেবে ম্যাচিউরড। কিন্তু বড়োদের আলাপে বসে থাকার মত পক্ব হয়েছে কী?
একটু দ্বিধায় ছেলেটা৷ এখন কি উঠে চলে যাবে?
মুখ ফস্কে বলেই ফেলল,
“ আমি কি থাকব,ভাইয়া?”
ইয়াসির হেসে ফেলল।
“ এখনো ছোটো ভাবিস নিজেকে?”
“ না মানে,তুমি বললে আর কী…তাই।”
রেহণুমার ঠোঁটে চকচকে হাসি। হৃষ্ট চিত্তে বললেন ,
“ সার্থ,শোন না আমরা তো মেয়েটাকে দেখে এলাম আজ। আমাদের সবার খুব পছন্দ হয়েছে জানিস। তুই একবার কথা বলবি? তোরও ভাল্লাগবে।”
“ আমি কেন? তোমরা বলছো তো।”
জয়নব বললেন,
“ কেন মেজো ভাই,তুমি দেখবে না? সংসার তো তুমি করবে।”
সাইফুল ইসলাম কী বলবেন? এর মাঝে ওনার কোনো কথা নেই। চুপচাপ বসে রইলেন তাই।
তনিমা বললেন,
“ মেয়ের ছবি আছে না, অয়ন? দেখা ভাইকে।”
“ হ্যাঁ, ইউশা পাঠিয়েছিল আমায়।”
অয়ন ফোন বের করল। ইয়াসিরের লম্বা মুখটায় অস্বস্তি ভিড়েছে। এ ধরণের আলাপ ওর সাথে এর আগে হয়নি।
নিশ্চুপ ফোনটা হাতে নিলো তাও। স্ক্রিনে একটা সুশ্রী-স্নিগ্ধ মুখ। পুরন্ত ঠোঁট হাসিহাসি খুব। ছোটো চোখে কাজল টানা। স্ট্রেইট করা লম্বা চুল পিঠ অবধি ছড়ানো। পরনে শাড়ি! হাতে কিছু একটা কাগজ। বোধ হয়,ভার্সিটি চত্বরে দাঁডিয়ে তোলা এটা।
সবাই ইয়াসিরের দিক চেয়ে। দৃষ্টিতে আগ্রহ। কিন্তু ওর চেহারা দেখে কিছু বোঝা গেল না। কয়েক সেকেন্ড দেখে ফোনটাকে টেবিলের ওপর রেখে দিলো আবার।
তনিমার কণ্ঠে দোটানা,
“ পছন্দ হয়নি?”
রেহণুমা বললেন,
“ দেখতে ভালো নয়?”
দাদু শুধালেন,
“ মনে লাগেনি, মেজ ভাই?”
অয়ন,সাইফুল দুজনেই উৎসুক। শুধু প্রশ্ন ছুড়লেন না।
ইয়াসির সব জিজ্ঞাসার একটা উত্তর দিলো। ভীষণ সংক্ষেপে জানাল,
“ ঠিকঠাক।”
তনিমা স্বস্তি পেলেন। চোখ বুজে শ্বাস নিলেন এক চোট।
রেহণুমা, জয়নব বলেই ফেললেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! এতদিনে পছন্দ হলো কাউকে।”
অয়ন আগ বাড়িয়ে জানাল,
“ ওনার নাম তুশি। ইনস্টা আইডি পাঠাব তোমায়?”
ইয়াসিরের ভ্রু বেঁকে গেল । তুশি! এই নাম কোথাও শুনেছে হয়ত। কিন্তু সারাদিনের ব্যস্ততায় চট করে মাথায় এলো না।
মাকে বলল,
“ আমি ফ্রেশ হই। খাবার দাও। এসব নিয়ে পরে কথা হবে।”
ছেলেটা ঘরের পথ ধরল । সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় হঠাৎ সামনে পড়লেন শওকত। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে তিনি।
ইয়াসির বাবার পা জোড়া দেখল। অথচ চোখ তুলল না। থামল না। শওকত কিছু বলতে চাইছিলেন। মুখায়বে সেই ছাপ পরিষ্কার। কিন্তু
ইয়াসির পাশ কাটাল এমন ভাবে, যেন কেউ নেই। কিচ্ছু নেই এখানে।
শওকতের মুখটা শুকিয়ে যায়। হতাশার প্রলেপ স্পষ্ট।
ছেলেকে সন্ধ্যা থেকে টিভিতে দেখেছেন,নিকটস্থ কত মানুষ প্রশংশা করল ওর সাহসিকতার! এ ফোন করছে,ও ফোন করছে।
ভদ্রলোক খুব ছটফট করছিলেন একটু কথা বলার আশায়। অন্তত একটা অভিনন্দন জানাতেন ইয়াসিরকে। কিন্তু…
শওকত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হঠাৎ চোখ পড়ল নিচে। তনিমা এদিকেই চেয়ে। মুখটা কালো। স্বামীর চোখের নিশানায় সেটুকু বাড়ল বৈ কমেনি। তবে বললেন না কিছু। মাথা নুইয়ে চুপচাপ খাবার ঘরে গেলেন। তার পেছনে রেহণুমা গিয়েছেন সাহায্য করার তাগিদে।
শওকতের বুকের ব্যথা বাড়ল। কিলবিল করল অকথ্য কিছু। ইদ,কোরবানি প্রত্যেকটা জায়গায় যখন বাবা ছেলের মিলন দেখেন? তার এই ব্যথা পাহাড় ছাপিয়ে যায়। অয়ন কাছে আসে,কথা বলে। খায় বাবার সাথে। কিন্তু ইয়াসির? আজ ঠিক ক বছর ধরে শওকতের সাথে মুখ বন্ধ ওর? হিসেব নেই। কোনো হিসেব নেই।
.
.
.
চলবে.........................................................................