প্রাণসখা - পর্ব ০৪ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা অতিক্রম করে বাস চলছে বিরতিহীনভাবে।যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল ঘন জঙ্গলের ন্যায় গাছপালা!অনেকক্ষণ আগে'ই আকাশ ঘোলাটে হয়ে এসেছে!ভোর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ধরিত্রী!ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিল জুবরান।ভোর পাঁচটা বিশ মিনিট!আর বেশি পথ নেই খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে।পাশের সিটে'ই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে অগ্নিলা।মাথা এলিয়ে দিয়েছে পাশে থাকা বলিষ্ঠ দেহি পুরুষে'র কাঁধে!চৈতন্যহীন গভীর নিদ্রা বলে দিচ্ছে,কতখানি ভরসায় আছে মেয়ে'টা!ইতিমধ্যে অম্বর স্বচ্ছ হয়ে এলো।প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ক্রমে'ই চোখ ধাঁধিয়ে উঠছে যেন!আর তো কিছু'টা পথ।তারপরে'ই ছুঁয়ে দেওয়া হবে মেঘ!পাহাড় জুবরানে'র খুব পছন্দের।সাজেক এই নিয়ে সে ঠিক কতবার এসেছে হিসেব নেই!তবে অগ্নিলার তো এই প্রথম!মেয়েটা ভোরে'র এই অপার সৌন্দর্যটুকু যে দেখতে'ই পাচ্ছে না ঘুমের জন্য।ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত অগ্নিলার পানে তাকাল জুবরান।একগুচ্ছ উষ্ণ শ্বাসপ্রশ্বাস সর্ব মুখে আছড়ে পরলো তাঁর!মৃদু স্বরে বার কয়েক ডাকল সে,
"মিস অগ্নি?ঘুমটাকে এবার ছুটি দিন।নয়তো অনেক কিছু মিস করে ফেলবেন।শুনছেন অগ্নি?

জুবরানে'র ডাকে ইষৎ নড়েচড়ে উঠলো অগ্নিলা।পিটপিট করে তাকাতে'ই চোখাচোখি হলো দু'জনের!দ্রুত নিজের জায়গা'য় সরে আসলো অগ্নিলা।গাঁয়ের ওড়না ঠিক করতে ব্যস্ত হলো।আচমকা বাইরে তাকাতেই দেখলো ভোর হয়ে গেছে!রাস্তা'র দুপাশে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে।দূরে'ই মেঘেদের আনাগোনা!যেন আরেকটুখানি কাছে গেলে'ই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে অনায়সে!অগ্নিলা ভাল মতো তাকাতে'ই বুঝতে পারলো,বাস সমতল ভূমি থেকে বেশ খানিক'টা উপরে।তারমানে পাহাড়ে'র উপর তাঁরা?চারদিকে'র এত সৌন্দর্য দেখে শীতল হয়ে এলো তাঁর চোখ!নিজের চেনা গন্ডি পেরিয়ে কখনো বাইরে'র জগৎ'টা দেখা হয়নি!দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে জুবরানে'র পানে তাকিয়ে বলল,
" আমরা কি সাজেক চলে এসেছি?

বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অগ্নিলার পানে তাকাল জুবরান।

"নাহ।আরো অনেক'টা পথ বাকি আছে।আপাতত এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটুকু উপভোগ করতে থাকুন।

পাল্টা আর কিছু বলল না অগ্নিলা।বাসে উঠার আগে রুহি বলেছিল খাগড়াছড়ি পৌঁছালে বাকি'টা পথ কি করে যেতে হবে সে বলে দিবে।অবশ্য এখন তো পাশে জুবরান আছে।বাকিপথটুকু না হয় তাকে'ই অনুসরণ করা যাক!পাহাড়ি অসমতল পথ অতিক্রম করে বাস চলছে।জানালা গলিয়ে মাথা বের করে দিল অগ্নিলা।চোখ বুজে প্রলম্বিত শ্বাস নিল!একদম বিশুদ্ধ,স্নিগ্ধ হাওয়া!চোখ মেলে তাকাতে'ই রাশিরাশি মেঘমালা!পাহাড়ের মাথায় মাথায় তাদের বিচরণ!হুট করে'ই অগ্নিলার মনে হলো,সে যদি মেঘ হতো?এভাবে ছোটাছুটি করতো পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে!তাহলে জীবন'টা বোধহয় এতটা নরক হতো না!আচমকাই মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর।একদম নিশ্চুপ হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।রাতে মামি কল করেছিল।ধরতে পারেনি বিধায় পাল্টা আর কল করার সাহস করে উঠতে পারেনি।কি পরিস্থিতি হয়েছে ওদিকে'র কে জানে।খানিক্ষণ পর বাস থামতে'ই হাত ঘড়ি'তে চোখ বুলাল জুবরান।সকাল ছয়টা বেজে উনিশ মিনিট।খাগড়াছড়ির শাপলাচত্বর চলে এসেছে গাড়ি।অগ্নিলা ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুড়লো,
"আপনি না বললেন আরো অনেক'টা পথ বাকি?তাহলে বাস এখানে থামল যে?

ব্যাগপত্র কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল জুবরান,
" বাসের গন্তব্যে এখান অব্ধি'ই।বাকিটা পথ আবার অন্য গাড়ি করে যেতে হবে।চলুন।

অগ্নিলা কিছু বলল না।কেবল অনুসরণ করলো জুবরান'কে।সময় ভোর হলেও আশেপাশে বেশ লোক সমাগম!সামনে'র একটা হোটেলে গিয়ে সকালের নাশতা অর্ডার করলো জুবরান।অগ্নিলা'র মনে কতশত প্রশ্ন!অথচ কিছু বলতে পারছে না সে।নাশতা আসতে'ই চুপচাপ খেয়ে নিল।অবশ্য কাল থেকে বলতে গেলে না খাওয়া সে।খাবারের বিল পরিশোধ করে গাড়ি ঠিক করতে চলে এল জুবরান।কয়েক'টা সিএনজি'র সাথে দরকষাকষি করতে লাগল।আড় চোখে সব'ই পর্যবেক্ষণ করছিল অগ্নিলা।যতদূর শুনেছে রুহি'রা চাঁদের গাড়ি করে সাজেক ঘুরেছিল।কিন্তু এখানে তো দেখছে জুবরান সিএনজি নিচ্ছে!মতলব খারাপ নয়তো?সন্দেহ আবারো শিকড়ে'র ন্যায় বিস্তার হলো।শুকনো ঢোক গিলে বলল সে,
"আপনি সিএনজি নিচ্ছেন কেন?সবাই তো চাঁদের গাড়ি করে যাচ্ছে।

অগ্নিলার কথায় পিছু ফিরে তাকাল জুবরান।চোয়াল শক্ত করে বলল,
" আপনাকে কিডন্যাপ করে ঝোপঝাড়ে নিয়ে যাব।তাই সিএনজি নিচ্ছি।কেমন উদ্ভট প্রশ্ন করেন বলুন তো!যে জিনিস নিয়ে অভিজ্ঞতা নেই,সেটা আগ বাড়িয়ে বলতে যাবেন না।চাঁদের গাড়ি'র ভাড়া আসবে নয় থেকে দশ হাজার টাকা।সম্পূর্ণ ভাড়া'টা আপনি পরিশোধ করলে,গাড়ি নিতে সমস্যা নেই আমার।

জুবরানে'র কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল অগ্নিলা।আগ বাড়িয়ে আর কিছু বলল না।মনে হচ্ছে চুপ থাকা'ই মঙ্গল এই মুহূর্তে!যতটা ঠান্ডা মেজাজের মনে হয়েছে,এই ছেলে তো তারচেয়ে দ্বিগুণ বদরাগী!পাশে অগ্নিলা'কে কি সহ্য হচ্ছে না?উটকো ঝামেলা ভাবছে?জুবরান ডাকতে'ই সিএনজি'তে উঠে বসলো সে।গাড়ি চলতে'ই ফের বাইরে দৃষ্টি ফেলল অগ্নিলা।চারিদিকে যেন সৌন্দর্যের সমারোহ!মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত চলে যাচ্ছে সে।শীতল বাতাস ক্রমেই শরীর হীম করে দিচ্ছে যেন!

"স্যরি।

থমথমে গম্ভীর ভরাট স্বর পেতে'ই তড়াৎ করে জুবরানে'র পানে তাকাল অগ্নিলা।বাইরে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে জুবরান।ফের গম্ভীর স্বরে বলল,
" আপনার চোখেমুখে এখনো স্পষ্ট সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে!তখন একগাদা লোকে'র সামনে এটা কিরকম প্রশ্ন করেছিলেন?আপনি সহজ হতে না পারলে খুবই বিব্রতবোধ হচ্ছে আমার।পাশে মেয়ে নিয়ে কখনো এভাবে ট্যুরে যাওয়া হয়নি আমার।যতটা ভয় নিয়ে আছেন আপনি তারচেয়ে দ্বিগুণ অসস্থি নিয়ে আছি আমি।

বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে,অপ্রস্তুত হয়ে বলল অগ্নিলা,
"না,মানে আমি সন্দেহ করলে এতদূর আসতাম না আপনার সঙ্গে।তখন প্রশ্নটা করা আমার'ই ভুল ছিল।আসলে মেয়ে মানুষ তো!

পাল্টা আর কিছু বলল না জুবরান।ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গাড়ি গন্তব্যে আসলো।হাত ঘড়ি'তে সময় দেখে নিচ্ছিল জুবরান।সকাল নয়টা বেজে পনের মিনিট।একেবারে ঠিকঠাক সময় নিয়ে'ই পৌছেছে তাঁরা।নেমে অগ্নিলাকে তাড়া দিয়ে,দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল জুবরান।আচমকা এরকম তাড়াহুড়ো করার কোনো মানে খুঁজে পেল না অগ্নিলা।তবে পাছে আর কোনো প্রশ্ন করলো না সে।পাশ ফিরে অগ্নিলার উদ্দেশ্য বলল জুবরান,
" আপনাকে বলে রাখি,এটা বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্প।এখান থেকে সিরিয়াল নেব আমরা।তারপর'ই সাজেক প্রবেশ করতে পারব।সেনাবাহিনী'র প্রথম স্কট দশটায় সাজেক যাবে।জলদি আসুন।আর হ্যাঁ এই নিয়ে আর কোনোরকম উদ্ভট প্রশ্ন করবেন না জনসম্মুখে।

মাথা কাত করে সায় জানাল অগ্নিলা।কালকে থেকে জার্নি হওয়ায় তার শরীর যেন চলতে চাইছে না।মাথা ভার লাগছে।জুবরান চলে গেল সিরিয়ালে'র জন্য।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল অগ্নিলা।চোখদুটো'ও কেমন ঝাপসা লাগছে।এখনো আকাশে রোদের দেখা নেই।ভাল'ই শীত অনুভব হচ্ছে।খানিকক্ষণ বাদে এসে গাড়ি'তে উঠা'র জন্য তাড়া দিল জুবরান।চোখেমুখে বিষন্নতা নিয়ে উঠে বসলো অগ্নিলা।পাশে জুবরান উঠে বসতে'ই কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল।ভয়ানক চমকে পাশ ফিরে তাকাল জুবরান।ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।অগ্নিলার কপাল জুবরানে'র গাল স্পর্শ করতে'ই আৎকে উঠলো সে!শরীরের তাপমাত্রা বেড়েছে অনেক!মেয়েটা জ্বর বাঁধিয়ে নিয়েছে!এতক্ষণ নিশ্চয়ই খারাপ লাগছিল?তাহলে বলল না কেন?ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে'ই দেখল চোখ বুজে আছে অগ্নিলা।নরম গলায় ডাকল সে,
"মিস অগ্নি?খারাপ লাগছে আপনার?শুনতে পাচ্ছেন?

কোনো হেলদোল নেই অগ্নিলার!একটুখানি নড়েচড়ে বসলো জুবরান।আলগোছে অগ্নিলার মাথা'টা নামিয়ে কোলে রাখল।ঘোমটা খসে পড়লো।চোখের পাতা বেগতিক ফুলে আছে মেয়ে'টার।সর্ব মুখে এক ক্লান্তি ছাপ!পাতলা অধরযুগল শুষ্ক হয়ে কাঁপছে!দ্বিধা নিয়ে কপালে হাত ছোঁয়াল জুবরান।এইটুকু সময়ের মধ্যে গাঁয়ের উত্তাপ এতটা ছড়ালো কি করে?একটু আগে কি সে মেয়ে'টার দিকে ভাল ভাবে খেয়াল করেছিল?করলে হয়তো দেখতে পেত!গাড়ি যতদূর এগিয়ে যাচ্ছে চারিপাশে'র হাওয়া আরো শীতল হচ্ছে!ক্রমে'ই কুঁকড়ে যাচ্ছিল অগ্নিলা।চোয়াল লেগে আসতে চাইছে!বাকি আর কিছু ভাবনা মস্তিষ্কে আসল না জুবরানে'র।স্বীয় বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত বক্ষস্থলে টেনে নিল অগ্নিলা'কে।চৈতন্য হারায়নি অগ্নিলা।সম্মুখে থাকা পুরুষের বুকে লেপ্টে থাকা কৃত্রিম সুভাস নাসিকা ঠিক'ই উপলব্ধি করছে।সরে আসার ইচ্ছে থাকলেও পারল না সে।এক গভীর তন্দ্রা তাকে ধীরে ধীরে ঘ্রাস করে নিল তার অতল গহ্বরে!সরে আসার পরিবর্তে আরো গুটিসুটি হয়ে রইল সে।

◼️

সারা শরীর ব্যাথায় বিবশ হয়ে আছে আকলিমা বেগমের।এতক্ষণ বুঝি চৈতন্য ছিল না তাঁর!শেষ রাতে বেধড়ক মার-ধর করেছে নেশাগ্রস্ত স্বামী আলম।গাঁয়ে'র সর্ব শক্তি সঞ্চয় করে'ও উঠতে ব্যর্থ হলো আকলিমা।হাতে'র উপরিভাগের চামড়া কে-টে র-ক্ত শুকিয়ে আছে।পিঠে বোধহয় সহস্র দা-গ পরে গেছে!ভেতরের ঘর থেকে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে আসল আলম।স্ত্রী'র নিথর দেহে সজোড়ে লাথি মেরে বলল,
" মাইয়াটা কই আছে জলদি বল।নয়তো তোরে আজ জি-ন্দা ক-বর দিব।

চোখ টেনে তাকাতে চেষ্টা করলো আকলিমা।শরীরের আঘাতের চেয়েও ঢের চিন্তা,কষ্ট হচ্ছে অগ্নিলার জন্য!মেয়ে'টা যেখানে'ই থাকুক যেন ভাল থাকে।মেঝেতে বসে স্ত্রী'র চুল মুষ্টি বদ্ধ করে ধরে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল আলম,
"ওই মাইয়ার জন্য এত দরদ ক্যান তোর?তুই পেটে ধরছিলি?আমার'ই ভুল হইছে তোর মতো বাঁজা মহিলারে নিয়া সংসার করা।তার মাশুল গুনতাছি অহন।দুইদিন পর যহন না খাইতে পাইয়া মরবি,তহন তোর এই ভালবাসা,মায়ামহাব্বত কই থাকে আমিও দেখব।আমি তপন'রে কথা দিছি সাতদিনে'র মাঝে অগ্নিলা'রে তাঁর কাছে ফিরা'ই দিব।আমারে তুই সর্বহারা করিস না।

চোখ গড়িয়ে জল পরছে আকলিমার।ব্যা-থায় সর্বাঙ্গ টনটন করছে!শুকনো ঢোক গিলে কা-টা কা-টা শব্দে বলল সে,
" যদি ম-ইরাও যাই তাও আপনি অগ্নিলার খোঁজ পাইবেন না।নেশার জন্য নিজের মাইয়া বিক্রি কইরা দেয় কোন পাষাণ বাপ?জন্ম দিলেই কি বাপ,মা হয়?পেটে না ধরলে মা হওয়া যায় না?আপনার তো ভাগ্নি!এতটুকুও কি মায়াদয়া নাই অন্তরে?

ক্রোধে'র রোষানলে ফেটে পড়লো আলম।ফের স্ত্রী'র চুলের মুঠি ধরে বলল,
"নাহ কোনো দয়ামায়া নাই আমার।তোর পেটের বাচ্চা হইলে মায়া লাগতো।যে মাইয়ার জন্মের ঠিক নাই,ওই মাইয়া'রে আমরা না দেখলে ভাইসা যাইতো!অগ্নিলা ভাল কইরাই জানে তোরে আমি ইচ্ছামত মারবো।তবুও কেমন পাষানের মতো তোরে ফেলায় চইলা গেছে দ্যাখ!
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp