"স্যাররা... পিতার সমান হয়। তাছাড়া এভাবে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলে নজর লাগবে ওনার। আর কখনো দেখবি না।"
অনন্যা নিজের কথায় নিজেই হতবাক হলো। পিতার সমান? সে নিজেই তো এই লোকটাকে বিয়ে করে বসে আছে।
নোহারা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
"কেনো দেখবো না? একশবার দেখবো! আর তোর পিতা নিয়ে তুই বসে থাক। স্যার আমার কোনো পিতা লাগে না,
সে আমার জানের জান, পরাণের পরাণ! নিরামিষ তুই! স্যারকে পিতা বলিস! যা আরণ্যকের প্রেমেই ডুবে থাক।ছ্যাকাখোর!"
নোহারার কথায় রাগে গর্জে উঠলো অনন্যা। এমনিই কয়দিন ধরে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না, তার মধ্যে নোহারা আরণ্যককে টেনে নিয়ে আসলো? ভরা ক্লাসে চিৎকার করে বসেছে অনন্যা, কী বড় ভুল! সবাই থমকে তাকিয়েছে তার দিকে। ধীরে ধীরে যখন রাগের ঝাপটা কমলো, তখন বুঝলো, কী অযথা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ভেতরটা সংকোচে ভরে গেল অনন্যার।
কৌশিক নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো। চোখে কঠোর তীক্ষ্ণতা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে দৃঢ় গলায় বললো,
"স্ট্যান্ড আপ।"
অনন্যার বুক ধুকপুক করছে। মাঝেমধ্যে মস্তিষ্কটা আউলা ঝাউলা হয়ে গেলে চিৎকার চেঁচামেচির কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। তাই বলে ভরা ক্লাসে? ইতস্তত করতে করতে দাঁড়ালো সে। মাথা নিচু করে ধীরে চোখ তুলে তাকালো কৌশিকের দিকে।
কৌশিকের দৃষ্টি যেন তার মন পড়ে নিতে চাইছে। ঠান্ডা গলায় কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করছিল সে।
"এবার বলুন ,এমন আচরণের কারণ কী?"
অনন্যার মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হতে চাইছে না। নোহারা কিছু বলতে চাইলো তার আগেই কৌশিক বললো,
"ওকে , যেহেতু কোনো উত্তর নেই। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। উত্তর দিলে বসতে পারবেন নাহলে ব্যাগ নিয়ে ক্লাসের বাইরে...!"
অনন্যা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। কৌশিক প্রশ্ন করলো,
"মধ্যযুগে ‘মঙ্গোল আক্রমণ’ কেন এত বিখ্যাত? একটু আগেই আমি এটা সম্পর্কে বলেছিলাম। ঠিকমতো শুনে থাকলে পারার কথা।"
অনন্যা ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল, এ কি আক্রমণের কথা বলছে লোকটা? কখন পড়ালো এসব?
"পারেন না তাহলে?"
"মঙ্গলের জন্য করা হয়েছিল বলে অনেক বিখ্যাত হয়েছে এই আক্র'মণ।"
ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। অনন্যা তো লজ্জায় শেষ। মাথায় কয়েকবার চাপড় মারলো। কেনো যে উত্তরটা দিতে গেলো উফফ!
কৌশিক তার দৃঢ় গলায়ই বললো,
"এই হচ্ছে আপনার দশা? মঙ্গলের জন্য আক্রমণ কেনো করা হবে? জীবনে শুনেছেন কোনো আক্র'মণ মঙ্গলের জন্য করা হয়েছিল।
মনোযোগ কোথায় থাকে আপনার? কান কী বাসায় রেখে এসেছেন নাকি রাস্তায়?"
অনন্যা মাথা নিচু করে রইল। কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"ওকে, গেট আউট!"
অনন্যা মুখ ফুলিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মনে পড়লো এটা উনার বাসা না, তাই চুপসে গেল সে। হাতে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে আরণ্যক দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। উত্তর বলতে শুরু করলো,
"মধ্যযুগে মঙ্গোল আক্রমণ বিখ্যাত কারণ এটি চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্বে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংযুক্ত সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাদের উন্নত সামরিক কৌশল, ধ্বংসযজ্ঞ এবং প্যাক্স মঙ্গোলিকার মাধ্যমে সিল্ক রোডে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়। এই আক্রমণ বিশ্ব ইতিহাসে গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে।"
কৌশিক আরণ্যকের দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। চোখে খানিকটা প্রশ্ন আর বিরক্তির মিশ্রণ।
"এন্ড হু আর ইউ?"
আরণ্যক সামান্য হাসলো। নিজের সাইড ব্যাগটা আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললো,
"আমি আরণ্যক! আপনার স্টুডেন্ট। স্যরি ফর লেট কামিং!"
কৌশিক তার দৃষ্টি সরিয়ে না নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে রইলো। এই ফাঁকে অনন্যা চিন্তিত চোখে নোহারার দিকে তাকালো। নোহারা তার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"তোর এক্স আগের বার এই কোর্সটা নেয়নি। তাই এবার আমাদের সাথে করছে।"
অনন্যার মুখ শক্ত হয়ে গেল। নোহারার কথাগুলো যেন আরও জট পাকালো তার মাথায়।
কৌশিকের ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটিয়ে বললো,
"টুয়েন্টি মিনিটস লেইট! এখন এসে আর কি করবেন? ইউ আর নট ওয়েলকাম টু দিস ক্লাস।"
আরণ্যক বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললো,
"স্যরি টু সে, স্যার। বাট আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, এটা কোনো স্কুল না যে দেরি করলে ঢুকতে দেওয়া হবে না।"
ক্লাসে এক মুহূর্তের জন্য পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবাই আরণ্যকের সাহসের প্রশংসা আর আতঙ্কে একসাথে তাকিয়ে থাকলো।
কৌশিক হাসলো। মৃদু স্বরে বললো,
"কথা ঠিক বলেছেন যদিও! কিন্তু একজন প্রফেসর তার স্টুডেন্টকে সর্বোচ্চটা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। এভাবে দেরি করে আসলে আর কখনো এলাউ করা হবে না। মাইন্ড ইট! আজকের জন্য কনসিডার করলাম। বসুন।"
কৌশিক চোখ ঘুরিয়ে আবার অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনি বের হয়ে যেতে পারেন।"
অনন্যা কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। অনন্যার বেরিয়ে যাওয়া দেখে আরণ্যক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তিত গলায় বললো,
"থ্যাংক ইয়ু স্যার। আমি পরবর্তী ক্লাস থেকে নিয়মিত আসবো। আজকের জন্য আমিও বের হয়ে যাচ্ছি।"
কৌশিক কিছু বলতে চাইলো, তার পূর্বেই আরণ্যক চলে গেছে অনন্যার পিছনে পিছনে। পুরো ক্লাসে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে। কৌশিক 'সাইলেন্স' শব্দ উচ্চারণ করে সবাইকে শান্ত করলো, তারপর আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো।
অনন্যা ব্যাগ কাঁধে জড়িয়ে আনমনে হাঁটছে। কৌশিক স্যারের উপর এতো রাগ উঠছে যে বলে বোঝাতে পারবে না। নিশ্চয়ই অনন্যাকে সহ্য করতে পারে না বলে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে। নোহারাও তো কথা বলেছে। ওকে বের করলো না কেন! একটা চিৎকার দিয়েছে বলে এভাবে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে অপমান করবে।
আরণ্যক ছুটে এসে তার পাশে দাঁড়ালো, অনন্যা তার দিকে চোখ তুলে তাকালেও কিছু বললো না। আগের মতোই হাঁটতে লাগলো।
"কথা আছে!" আরণ্যকের কণ্ঠে কঠোরতা জড়িয়ে ছিল।
অনন্যা বুঝতে পেরে বললো,
"কিন্তু আমার নেই।"
"কিন্তু আমার আছে, অনন্যা। তুই বুঝিস! তুই আমাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছিস?"
অনন্যা দাঁড়িয়ে পড়লো, ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
"তুমি আমাকে যতোটা কষ্ট দিয়েছিলে তার থেকে কমটুকু ফিরিয়ে দিচ্ছি।"
"আচ্ছা আমি কি করেছি? স্পষ্ট করে তো বলবি! নাহলে বুঝবো কীভাবে? এভাবে কষ্ট দিয়ে কি পাচ্ছিস আসলে?"
অনন্যা নিজের ফোনটা বের করতে করতে বললো,
"ঠিক আছে! যখন জানতেই চাচ্ছ আজ বলেই দি, তুমি কি করেছো!"
অনন্যা ফোনের গ্যালারি খুলে একটা ছবি বের করলো অতঃপর আরণ্যকের মুখের সামনে তুলে ধরলো। আরণ্যক ফোনটা হাতে নিয়ে ঠিকমতো দেখলো। অনেকক্ষণ পর বললো,
"এখানে কী হয়েছে?"
"কি হয়েছে মানে? তুমি অন্য মেয়ের সাথে ঘোরাঘুরি করবে আর আমি চুপ করে বসে থাকবো?" অনন্যা রেগে উঠে বললো, "তোমার মন মানসিকতা এতো নীচ!"
আরণ্যক সোজা তাকালো,
"কথা বলার আগে একটু বুঝে নে। আমি চরিত্রহীন নই যে টু টাইমিং করবো। ছবিতে যে মেয়েটা দেখাচ্ছিস, ও আমার কাজিন। অনেকদিন পর বিদেশ থেকে এসেছে, তাই রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলাম।"
অনন্যা ভ্রু উঁচিয়ে বললো, "ওহহো, তুমি বোঝাবে আর আমি সেটা বিশ্বাস করে নেবো? আমি আর ঈরা দুজনেই দেখেছিলাম তোমাদের কীরকম গলায় গলায় ভাব ছিল! গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি ছিল। তুমি এটাকে নরমাল বলবে আর আমি বিশ্বাস করবো?"
"একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তুই এতো বড় একটা ডিসিশন নিয়ে নিলি? আমি তোকে ম্যাচিউর ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ না বুঝলেও তুই অন্তত আমাকে বুঝবি। কিন্তু ভুল ছিলাম।"
ক্ষোভ জমে উঠেছে অনন্যার কণ্ঠে,
"সিরিয়াসলি? যদি আমি ম্যাচিউর না হতাম, তোমার অসংখ্য ভুলগুলোকে মাফ করে দিতাম না। নোহারা সব সময় বলতো তুমি আমাকে কিছুই মনে করো না, তাও আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম। মনে পড়ে, একদিন তো? তোমার ব্যাচমেট কি যেন নাম, আমি ভুল করে তার নতুন ড্রেসে কলমের দাগ লাগিয়ে ফেলেছিলাম। সে এই সামান্য বিষয় নিয়ে সবার সামনে আমাকে অপমান করেছিল, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলে। একবারও আমার পাশে দাঁড়াওনি। ভীতুর ডিম! আমার ভাবতেও বিরক্ত লাগে এতো ভীতু একটা ছেলের সাথে আমি সম্পর্কে ছিলাম যে কিনা নিজের গার্লফ্রেন্ডের পক্ষে আওয়াজ তুলতে পারে না।জোর গলায় বলতে পারে না, এই মেয়েটা আমার। তাহলে ভালোবাসা, সম্পর্ক, সাপোর্ট, বিশ্বাসের মানে কী? পুরোনো কথা মনে পড়লেই তোমার প্রতি ভালোবাসা ধীরে ধীরে উঠে যায়। আর সেদিনের পর থেকে তো আরো নেই যখন এই মেয়েটার সাথে তোমার এতো মেলামেশা দেখেছিলাম।"
আরণ্যক হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ অনন্যার হাতের কব্জি চেপে ধরলো, চোখটা হঠাৎই ছলছল করে উঠলো ছেলেটার। মায়াভরা কণ্ঠে বললো,
"ভালোবাসা উঠে যায়, অনন্যা? কিন্তু আমারটা তো উঠে না। আমি এমনই। ভাই-বোনদের সাথে আমাদের অনেক পীড়িত থাকে, আমরা একে অপরের সাথে অনেক ফ্রি থাকি।
ছবিতে ওটা আমার কাজিন। ওর নিজের বয়ফ্রেন্ড ও আছে। এখন তুই যদি বিশ্বাস না করিস , আমি ওকে বলে প্রমাণও দেখাতে পারবো।
কিন্তু আমার তো দরকার নেই। কেনো ধোঁকা দিবো তোকে? আমি কি কখনো তোকে ব্যবহার করেছি বল? সবসময় তোকে নতুন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। সমস্যা হলে তোকে বুঝিয়ে দিতাম সেটা পড়াশোনা হোক অথবা অন্য কিছু। আমি শুধু তোকে চাই বলেই এমন উতলা হয়ে আছি।"
অনন্যা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। আরণ্যক আরো জোরে চেপে ধরে বললো,
"আচ্ছা! তোর কি এখনো বিশ্বাস হয় না? ঠিক আছে.....এক কাজ কর তুই আমার হৃদয়টা নিয়ে নে! দেখবি, এই হৃদয়টা শুধু তোর চিন্তা করে। "
অনন্যা আরণ্যকের কথায় খেই হারিয়ে ফেলছে। তাই আরণ্যক সুযোগ বুঝে অনন্যার আরেকটা হাত ও শক্ত করে ধরলো। দুজনের চোখ একে অপরে মিলিত হলো। আরণ্যক নরম গলায় বললো,
"আমি মানলাম, আমি ভীতু। কিন্তু এই ভীতু ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে।
আমি মানলাম, আমি তোর পাশে সেদিন দাঁড়াতে পারিনি। কিন্তু মনে মনে আমি সবসময় তোর পাশে ছিলাম।
আমি মানলাম, আমি...!"
আরণ্যকের মুখ থেকে পরবর্তী শব্দ বের হওয়ার পূর্বে অন্যজনের মুখ থেকে কর্কশ বাক্য বেরিয়ে গেছে। সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে অনন্যার কৌশিক স্যার। কৌশিক পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললো,
"অনন্যা শিকদার, কাম উইথ মি।"
অনন্যা দ্রুতগতিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাগী চোখে আরণ্যকের দিকে তাকালো। তারপর স্যারের পিছু হাঁটা ধরলো। আরণ্যক হাত ঝাড়লো। কখনোই মেয়েটার সাথে ঠিকঠাক মতো কথাও বলতে পারে না। কেউ না কেউ মাঝে এসেই পড়ে। কিন্তু আরণ্যক তো জানেই না, সেই কেউটা কেবল তাদের কথার মাঝেই নয়, বরং ধীরে ধীরে তাদের দুজনের জীবনের মাঝেও পা রেখে ফেলেছে। যেমন ছায়া নিঃশব্দে দিনের আলোকে গ্রাস করে, তেমন করেই সেই অচেনা উপস্থিতি তাদের সম্পর্কের গভীরে এক অদৃশ্য বিভাজন টেনে দিয়েছে।
★★★★★
অনন্যার মন এখন দোটানায় ভুগছে। জীবনে আগেও অনেকের প্রতি মুগ্ধতা অনুভব করেছে, কিন্তু আরণ্যক, সে ছিল বিশেষ কিছু। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর দিন প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গিয়েছিল আরণ্যককে। এক অদ্ভুত মায়া জড়ানো কন্ঠ, মন ভোলানো হাসি, স্ট্রং পার্সোনালিটি, সর্বক্ষেত্রে আরণ্যকের সাফল্য, সবকিছু অনন্যাকে প্রবলভাবে আকর্ষিত করতো।
দীর্ঘ দুই বছরের সম্পর্ক, অথচ তারা একসাথে কাটিয়েছে কেবল কিছু চুপচাপ মুহূর্ত। ক্যাম্পাসে আরণ্যকের পরিচিতি থাকার কারণে চাইলেও কখনোই অতোটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে উঠেনি। আরণ্যকের ভয় ছিল,যদি কেউ জেনে যায়? সেই ভয় তাকে ঘিরে রাখত, আর দূরত্ব তৈরি করত। অনন্যাও মুক্ত ছিল না। মামার রাগী মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠত, ভয় হতো যদি কিছু জানাজানি হয়, ঘরের ভেতর অশান্তির ঝড় বইবে। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত মেয়ে, অনন্যা। তার খাওয়া-পরার হিসেবেই মাঝেমধ্যে খোঁটা শুনতে হয়। এর মধ্যে যদি এসব কথা জানা যায়, তাহলে আত্মীয়স্বজনের চোখে অপমানিত হতে হবে, আর সেই গুঞ্জন পৌঁছাবে বিদেশে থাকা বাবা-মায়ের কানেও। এইসব আশঙ্কা তাদের মাঝের দূরত্বকে আরও গভীর করত। আরণ্যক চুপচাপ নিজেকে গুটিয়ে নিত, আর অনন্যা সেই নীরবতাকে মেনে নিয়ে নিজেও দূরে সরে যেত।
আর কৌশিক স্যার? দেখা হওয়ার প্রথম দিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে লাইব্রেরীতে আটকে পড়েছিল দুজন। আরণ্যক এসেছিল তাদের বের করতে। কিন্তু সাথে সাথেই করতে পারেনি। চাবি নিয়ে আসতে তার দুই ঘণ্টা সময় লেগে গিয়েছিল। লাইব্রেরী স্যার ভুলবশত নিজের পকেটে চাবি ভরে নিয়ে বাসায় চলে গিয়েছিলেন সেদিন। সেই চাবি আনতে স্যারের বাসায় ছুটতে হয়েছে আরণ্যককে। নতুন বিদেশি প্রফেসরের সাথে অনন্যা অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে ছিল সেদিন। সময় কাটানো বলতে অন্ধকার রুমে আলো ফেলে বইয়ে মনোযোগ দেওয়া। সেদিন স্যারের সামনে বসে মনের কথারা জানালা ধরে পালিয়ে ছিলো একটা সময়। দুজনে বইয়ের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বসেছিল। তাও সেটা দুজনের মনের ভুল। তারা বইয়ে মুখ গুঁজে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল একে অপরকে।
এক দিকে প্রথম দেখায় ভালোবাসা আর অপর দিকে একজন রহস্য মানব! একদিকে ঘৃণার উদ্রেক হতে শুরু করেছে অপরদিকে রহস্যের মায়াজালে আবদ্ধ হতে হতে মনটা সেদিকেই চলে যাচ্ছে অনন্যার।
অনন্যা পাঁচ মিনিট ধরে কৌশিক স্যারের পাশে হাঁটছে, অথচ লোকটার যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চেহারায় সেই চিরচেনা নির্লিপ্ত ভঙ্গি, যেন পাশে কেউ হাঁটছে কি না, সেটাই তার খেয়াল নেই।
অনন্যা বিরক্ত হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
"আপনার ক্লাস এতো তাড়াতাড়ি শেষ?"
"মনোযোগ তো দাও না। বিশ-পঁচিশ মিনিটে কত কিছু পড়িয়ে ফেলেছি, বুঝবে কী করে!"
"ওও হুম! আপনিও তো আমার দিকে মনোযোগ দেননি," অনন্যা একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলল।
কৌশিক থমকে দাঁড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"কী বললে?"
"কিছু না।" অনন্যা অনুচ্চ স্বরে জবাব দিলো, মুখে এক চিলতে রহস্যময় হাসি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর হঠাৎ কৌশিক স্যার বলে উঠলো,
"ছেলেটা কে?"
প্রশ্ন শুনে অনন্যা চমকে দাঁড়িয়ে গেলো। মুখের হাসিটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো। কৌশিক স্যার ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। অনন্যা এক পা, দু’ পা পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে ছুটে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াল।
একটু দুষ্টু স্বরে, মিষ্টি হেসে বলল,
"বয়ফ্রেন্ড।"
কৌশিক নিজের হাতের ল্যাপটপটা অনন্যার হাতে ধরিয়ে দিলো। গম্ভীর স্বরেই বললো,
"আমাকে বোকা পেয়েছো? ভুলভাল বোঝাবে না। ছেলেটা তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড। রাইট?"
"হু! সেই তো একি। "
দুজনে ধীরে ধীরে পঞ্চম তলায় উঠে যাচ্ছে। কৌশিক স্যার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
"ছেলেটার ভীতু ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। সামনে বড় কিছু করতে পারে। সো এর মাঝে আমার নাম যাতে না আসে, এটা খেয়াল রাখবে। তারপর যা ইচ্ছে করো।"
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
"এর মানে কী? আমি যদি আবারও আরণ্যকের গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাই, তাহলে আপনার কোনো সমস্যা হবে না?"
কৌশিক মাথা নিচু করে একটু হেসে নিলো, তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
"সমস্যা? অবশ্যই সমস্যা হবে। ভদ্রতার খাতিরে আমার বাড়িতে থাকতে দিয়েছি তোমাকে। আরণ্যককে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে বাসায় যখন-তখন আনলে, সমস্যা তো হবেই। সো এই ব্যাপারে স্পষ্টভাবে ডিসএগ্রি করছি আমি।"
অনন্যার মুখ গোমড়া হয়ে গেলো। ভদ্রতার খাতিরে থাকতে দিয়েছে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎই অনন্যা গলার স্বর নামিয়ে বলল,
"সেদিন রাতে আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন, সব কিন্তু আমার মনে আছে।"
কৌশিক থমকে দাঁড়ালো, তার মুখের নির্লিপ্ত ভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে গেল। চোখে একধরনের চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠল। সে অনন্যার দিকে তাকালো,
"কোন দিন রাতে?" , কৌশিক চিন্তিত হয়ে মনে করার ভঙ্গিতে বললো।
"এতো গভীর মুহূর্তের কথা কীভাবে ভুলে যেতে পারেন আপনি?"
অনন্যা বেশ জোরেশোরেই বলে উঠল, তার কথাগুলো দেওয়ালের ওপারেও প্রতিধ্বনি তুলতে চাইছিল।
কৌশিক থামলো না, বরং মুহূর্তের মধ্যে অনন্যার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতে লাগল। তার দৃঢ় মুঠোর শক্তি এতটাই ছিল যে, অনন্যা ল্যাপটপটা অন্য হাতে সামলে রাখতে গিয়ে খানিকটা হোঁচট খেয়ে পড়ল।
কৌশিকের চোখে যেন আগুনের ঝলক। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ পেরোনোর সময় তার পায়ের গতি বেড়ে যাচ্ছিল। ছয় তলায় উঠে একটা ফাঁকা রুমের সামনে থেমে গেলো সে। রুমটা অনেকক্ষণ থেকেই খালি ছিল, এই তথ্য তার নজর এড়ায়নি।
অনন্যা বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। কৌশিক তাড়াতাড়ি তাকে টেনে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। দরজা বন্ধ করে যখন সে লক করলো, তখন অনন্যার চোখে এক ঝলক শীতল আতঙ্কের ছায়া লক্ষ্য করা গেল। চারপাশে একবার শান্ত নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে নিল কৌশিক। এটা ছয় তলার কমন রুম, এখন ফাঁকা। সবার ক্লাস চলছে, আর সৌভাগ্যক্রমে এখানে সিসিটিভি নেই। কৌশিকের চোখ অন্ধকারে জ্বলছে বলে মনে হলো। অনন্যা নিজের ভিতরে এক অজানা আতঙ্কের স্রোত অনুভব করল।
কৌশিক ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো। ঠোঁটে একপ্রকার রহস্যময় হাসি। আর চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক। অনন্যা ল্যাপটপটা বুকের কাছে শক্ত করে চেপে ধরল। সেদিন রাতের বিভীষিকা তার মনের গভীরে এখনও দগদগে ক্ষতের মতো রয়েছে। আজ কি সেই রাতের চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটবে?
"লুক অ্যাট মি, শিকদার।" কৌশিকের গলা শীতল, অথচ তাতে এমন এক শাসনের সুর যা হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়।
অনন্যা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। তার মুখ নিচু, চোখ মাটিতে।
কৌশিক এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল, "সেদিনের অসমাপ্ত কাজ আজ শেষ করতে হবে আমাকে।"
"কী করতে চান আপনি?" অনন্যার কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠলো, কিন্তু অন্তরে লুকানো ভয়েরা লাফাচ্ছে, উত্যক্ত করছে তাকে।
কৌশিক ধীরে ধীরে হাত উঠালো। তার হাতের আঙুল স্পর্শ করল অনন্যার মাথার চুলে। খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মেয়েটার মাথার চুল। টেনে মুখ উপরে তুললো অনন্যার।
"তোমার কিছু স্মৃতি আমি মুছে ফেলবো। সেদিনের রাতের স্মৃতি! যা কখনো হওয়া উচিত ছিল না, তা মুছে ফেলাই ভালো তাই না?
সেদিন তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই করতে পারিনি, কিন্তু আজ পুরোপুরি সজ্ঞানে আছ।"
অনন্যা দ্রুত মাথা নাড়ল, নিজের অস্বীকারটা সুরক্ষিত করতে চাইল। কিন্তু কৌশিক থেমে থাকেনি। সে অনন্যার চিবুক ধরে তার মুখ আরো উপরে তুলল। চোখে চোখ রাখল। অনন্যার চোখ তখনো নিচে স্থির করা।
কৌশিক ঠোঁটে এক ঠাণ্ডা বিদ্রূপ নিয়ে বলল,
"এতো জেদ করে লাভ নেই। বেশিক্ষণ টিকবে না। তাকাও আমার দিকে...... আই সেইড লুক অ্যাট মি।"
অনন্যা আবারও মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাল। লোকটা কী জাদু জানে? সেদিনের স্মৃতি মুছে নিতে চাইছে কেন আর কীভাবে মুছবে? কিন্তু কৌশিকের ধৈর্য্য যেন ফুরিয়ে এসেছিল। সে হঠাৎ অনন্যার গাল চেপে ধরে তার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। চোখে চোখ পড়তেই যেন অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে ধরল দুজনকেই। অনন্যার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল, সে আর নিজের মধ্যে নেই, নিষ্পলক চাহনি নিয়ে কাটিয়ে দিলো কয়েক সেকেন্ড। কৌশিকের ঠান্ডা আকাশি চোখ ধীরে ধীরে অনন্যাকে গ্রাস করে ফেলছে। অদ্ভুত শক্তি অনন্যার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
কিয়ৎক্ষণ পর কৌশিক অনন্যার চুল, মুখ এক ঝটকায় ছেড়ে দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, "ল্যাপটপটা আমার ডেস্কে রেখে আসো। আর হ্যাঁ, ডেস্কের দুই নম্বর ড্রয়ারটা স্পর্শ করবে না।"
অনন্যা ভেতরে ভেতরে অসাড় অনুভব করছিল। হঠাৎ বাস্তবতার দমকা হাওয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে সব বুঝিয়ে দিল। দু'মিনিট সময় লেগেছিল পুরোপুরি বাস্তবে ফিরে আসতে। তখনই সে শুনতে পেল কৌশিকের কণ্ঠস্বর। অনন্যা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে যা ঘটলো তা মনে করতে পারলো না।
কৌশিক দ্রুত রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো, আর অনন্যাও একদম শান্তভাবে, যেন কিছুই হয়নি, রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। টিচার্স রুমে পৌঁছে অনন্যাকে বেশ কিছু সময় খুঁজতে হলো কৌশিকের ডেস্ক। অবশেষে ল্যাপটপটা ডেস্কে রেখে, হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো, কৌশিক দুই নম্বর ড্রয়ারটা স্পর্শ করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু কেনো? অনন্যা কেন ড্রয়ারটা খুলতে যাবে? ভাবতে ভাবতে অনন্যা একটু দ্বিধায় দুই নম্বর ড্রয়ারটা খুলে ফেললো। তবে মুহূর্তেই তার মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। ড্রয়ারে ছিল ছোট ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট, যার মধ্যে অনেকগুলো রাবার ব্যান্ড এবং চুল বাঁধার ডিজাইনেবল ক্লিপ ছিল। অনন্যা হাসি চাপতে পারলো না, খুশিতে তার চোখ ঝিলমিল করছিল।
লোকটা আসলেই একটা ইঁদুর! কী ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে। অনন্যা একটি রাবার ব্যান্ড নিয়ে নিজের খোলা চুলগুলো বেঁধে ফেললো। তারপর বাকিগুলো নিজের ব্যাগে রেখে দিলো। টিচার্স রুম থেকে বের হতে হতে অনন্যা ভাবছিল, সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া মুহূর্তের কথা, প্রিন্সেস আরিসা আর স্যারের চোখের সেই অদ্ভুত আলো এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার কথা ছিল কৌশিক স্যারকে। একটু আগে তো কথা হয়েছিল তখন কি জিজ্ঞেস করেছিল লোকটাকে? কিছুই তো মনে পড়ছে না এখন। কেমন মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
•
নোহারা কসমেটিক শপে কাজ করে। কাজটা বেশ পছন্দ ওর, যদিও শপের মালিক একটু কড়া স্বভাবের। দেরি হলে বকাঝকা অবশ্য অনিবার্য, তবে মাসের শেষে ঠিক সময়ে টাকা হাতে তুলে দেন তিনি। এই কড়া মেজাজের আড়ালেই একধরনের স্নেহ লুকিয়ে থাকে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কখনোই অবহেলা পছন্দ করেন না উনি, বরং মাঝেমধ্যে ফ্রিতে কিছু খাবার দেন এবং মাঝেমধ্যে ভালো ভালো ব্র্যান্ডের কসমেটিকস দিয়ে দেন। নোহারা মনে মনে হাসে, মহিলার মধ্যে একটা মা মা ভাব আছে। এজন্য বেশ ভালো লাগে।
আজও কাজ শেষে নিজের ছোট ব্যাগটা গুছিয়ে নোহারা শপ থেকে বের হলো। রাস্তার বাতিগুলো মৃদু আলো ছড়াচ্ছে, আর শহরের ব্যস্ততাও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে। প্রতিদিনের মতোই নোহারা শান্ত মনে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। কসমেটিকস শপ থেকে ওর বাসা দশ মিনিটের রাস্তা। বেশিরভাগ সময় হেঁটেই যাওয়া হয়। বাসায় ফেরার শর্টকাট রাস্তাটা নোহারার চেনা। এক সরু গলি, যেখানে আবর্জনার স্তুপে ঢাকা পরিবেশ। কেউই সহজে এই গলিতে যেতে চায় না। কিন্তু নোহারার অভ্যাস হয়ে গেছে, প্রতিদিন এই রাস্তা পেরিয়েই সে বাড়ি ফেরে।
আজও সেই পথ ধরতে গলির মুখে পৌঁছে থেমে গেল নোহারা। কয়েক কদম এগিয়ে চোখ আটকাল এক অদ্ভুত দৃশ্যে। আবছা আলোয় দেখল এক যুবক-যুবতী, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আচরণটা কেমন অদ্ভুত ঠেকলো নোহারার কাছে। সে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
"এহহে! ছে! বাংলাদেশ আর আগের জায়গায় নেই। মানুষ রাস্তাতেই...!"
কথা সম্পূর্ণ না করেই সরু চোখে ঠিকমতো তাকালো নোহারা। সোডিয়াম বাতির আলোতে জড়িয়ে ধরা যুবকটির মুখমণ্ডল হলুদ দেখাচ্ছে, কিন্তু লোকটার চোখ দুটোর মণি লাল ঝিলিক দিচ্ছে, চোখে লাগছে নোহারার। হঠাৎ লোকটার দাঁত বড় হয়ে দংশন করলো জড়িয়ে থাকা যুবতীর ঘাড়ে। যুবতী স্বল্প চিৎকার করলো।
বিষয়টি দেখে সারা শরীর কেঁপে উঠলো নোহারার। সে মুখ চেপে পিছনে দৌড় দিতে গেলে পায়ের আওয়াজ হলো। যার কারণে সামনে থাকা যুবক যুবতীর ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে গেলো। নোহারা আবারো পিছনে তাকিয়ে ছুটতে লাগলো। এদিকে আঘাত পাওয়া যুবতী ছুটে পালিয়েছে। যুবকটা উপায় না পেয়ে নোহারার পিছনে আসছে।
নোহারার বুকের ভেতর যেন ড্রাম বাজছে। দুরুদুরু কাঁপছে পুরো শরীর। মাথায় কিছুই কাজ করছে না,কী করবে, কোথায় যাবে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিজের বাসার উল্টো দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কেউ আসছে না। সামনে তাকাতেই নোহারার ভেতর থেকে যেন আত্মা বেরিয়ে যেতে চাইলো।
তার সামনে, রাস্তার আলো-আধারিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই যুবক। চোখে অদ্ভুত স্থিরতা, ঠোঁটে এক ঠাণ্ডা হাসি। নোহারা ভয়ে তৎক্ষণাৎ উল্টো দিকে ছুটতে চাইলে পা হড়কিয়ে ব্যাগসহ রাস্তায় পড়ে গেল।
মুহূর্তে সমস্ত শরীরে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। মনে হলো, এইবার হয়তো সব শেষ।
যুবকটি হাঁটু গেড়ে বসলো নোহারার সামনে। শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
"রিলেক্স, বেইব!"
নোহারার মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যুবকটির দিকে তাকালো। একদম বিদেশিদের মতো দেখতে লম্বা, ফর্সা আর চোখের মণি এখন স্বাভাবিক। দাঁতগুলোও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিন্তু নোহারার মনের ভয় কমল না। খুব দ্রুত গলায় কথা ফসকে বেরিয়ে এলো,
"আপনি... আপনি ভ্যাম্পায়ার, তাই না?"
যুবকটি ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল না কিছু। হালকা হেসে রাস্তায় পড়ে থাকা নোহারার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আশেপাশে মানুষজন পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, যেন কিছুই দেখছে না।
নোহারা একটু দ্বিধা নিয়ে হাত ধরল। উঠে দাঁড়িয়েই পা সরিয়ে বেশ কয়েকটা পদক্ষেপ দূরে গিয়ে দাঁড়াল, যুবকের থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে। মনে হলো, কখন না জানি লোকটা তার শিরা চিরে রক্ত চুষে নেয়।
যুবকটি মৃদু হাসি ধরে রেখে বলল, ব্রিটিশদের মতো পরিশীলিত ইংরেজিতে,
"হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। আমি ভ্যাম্পায়ার। কিন্তু তুমি আমার পরিচয় এত তাড়াতাড়ি জেনে গেলে, ব্যাপারটা মজার হলো না।"
নোহারার মুখে বিস্ময়। যুবকটি ধীর স্বরে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিল, "আমি নিকোলাই ভেস্পার, দ্য গ্রেটেস্ট এমোঙ অল ভ্যাম্পায়ার।"
"ভেস্পার? মানে সন্ধ্যা!"
নোহারা দ্রুত স্বরে বলে উঠলো। নিক হাত তালি দিয়ে বললো,
"বাহ, অনেকেই এই বিষয়টা জানে না। বাট আই এম ইমপ্রেসড।"
নোহারা ভয়ের মধ্যে হেসে ফেললো, চুল ঠিক করে বললো,
"আমার ভোকাবুলারি মোটামুটি ভালো আর কি!"
"হাসছো? ব্যাপারটা সন্দেহের মনে হচ্ছে। কেউ যদি জানে আমি ভ্যাম্পায়ার তাহলে কতক্ষণে পালাবে সেই চিন্তা করে।"
নোহারার হাসি একটু কৃত্রিম মনে হলেও, সে জবাব দিল,
"আমিও তো তাই চিন্তা করছিলাম। আর হাসি হলো আমার সেফটি মেকানিজম।"
নিকের মুখে এবার এক মৃদু হাসি ফুটল, তবে তা ছলনার মতো। তার চোখের দৃষ্টি বদলে গেল। ঠান্ডা, মজার ভঙ্গি থেকে এক ঝাঁক কঠোরতার প্রভাব ভারী হয়ে উঠল। সে কঠোর স্বরে বললো,
"হুম! তো আমার শিকারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছো তুমি, এখন কীভাবে নতুন শিকার খুঁজবো? নাকি তুমিই আমার পরবর্তী টার্গেট হবে? কোনটা? এন্সার মি!"
নোহারার গলা শুকিয়ে এল। মুখের রং উধাও হয়ে গেল, চোখে সোঁদা আতঙ্কের ছায়া। রাতেবিরাতে এ কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো সে!
★★★★★
নোহারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে কোনো জন্তু জানোয়ার নয়, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ভ্যাম্পায়ার, যে দেখতে অবিকল মানুষের মতো, কিন্তু আদতে মানুষ নয়। রূপকথার গল্প যে বাস্তবে এভাবে তার জীবনে এসে হাজির হবে, তা সে কখনো ভাবেনি।
নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় না দেখে, নোহারা নিঃশ্বাস চেপে নিজের হাত দুটো মুঠ করে নিকের সামনে তুলে ধরল। চোখ বন্ধ করে কাঁপা গলায় বলল,
"স্যরি... আমি জানতাম না এমন কিছু হবে। আপনি চাইলে... আমাকে নিজের শিকার মনে করতে পারেন।"
নিক তার দিকে সরু চোখে তাকাল। নোহারার কাঁধ অবধি ছড়ানো সিল্কি চুল সামান্য বাতাসে নড়ছে। মেয়েটার মসৃণ ত্বক ঘামে ভেজা, কপাল থেকে ছোট ছোট ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। টানা টানা চোখ পিটপিট করছে, যা ভয় আর অপেক্ষায় ভরপুর। মেয়েটার এই সরল ভঙ্গি আর অবর্ণনীয় কিউটনেস নিকের চোখ এড়ালো না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিক মাথা ঘুরিয়ে নোহারার হাত সরিয়ে দিল। ঠোঁটের কোণে একধরনের মৃদু বিদ্রুপ হাসি টেনে বলল,
"উফফ! এতো কিউটভাবে কেউ কথা বললে আমি আর কিছু করতে পারি না। গলে যাই একেবারে।"
নোহারা দ্রুত চোখ খুলল। তার মুখে ফুটে উঠল এক ঝলক খুশি, দমবন্ধ করা ভয়ের অন্ধকার থেকে আলো খুঁজে পেয়েছে মনে হলো। যাক, বড় বাঁচা বেঁচে গেলো। এখনো তো অনেক কিছু দেখার বাকি। জীবনের এত সুন্দর মুহূর্তগুলো এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না। আকাশের তারা, দিগন্তে সূর্যাস্ত, মিষ্টি শীতের ভোর, আর নিজের স্বপ্নগুলো সবই তো সামনে পড়ে আছে। একটা ভ্যাম্পায়ারের হাতে জীবনের এই গল্প থামানোর ইচ্ছা নোহারার একদমই নেই।
নিক গম্ভীর মুখে আরো যোগ করলো,
"কিন্তু… আমার রক্ত পিপাসা বেড়েছে। নতুন শিকার কে খুঁজে দেবে? কে? এখানে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই। সুতরাং, লিটল গার্ল, লেটস গো উইথ মি।"
নোহারা হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে অসহায় ভাব এনে বলল,
"আমি… আমি কীভাবে খুঁজব?"
নিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
"আমি শিখিয়ে দেব। খুব সহজ। তুমি শুধু তরুণী মেয়েদের ডেকে বলবে, আমি কিছু কথা বলতে চাই। তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবে। এরপর যা করার আমি করব।"
নোহারার চোখ কুঁচকে গেল। সে নিকের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস করে বলল,
"শুধু মেয়েদেরই কেন? পুরুষদের কী দোষ?"
নিক হঠাৎ থেমে গেল। একদম কাছে এসে নোহারার কপালে টোকা মারল। নোহারার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল, সে এক কদম পেছনে সরে গেল। নিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"পুরুষরা আমার কাছে আসতে চাইবে কেন? তাদের দিয়ে কাজ হবে না, মেয়ে লাগবে মেয়ে।"
নোহারা হালকা গলায় বলল,
"বুঝতে পেরেছি।"
নোহারার কাজ শুরু হলো। সে একের পর এক চেষ্টা করল। কিন্তু তরুণী মেয়েরা তার কথায় কানই দিচ্ছে না। কেউ বিরক্ত মুখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না।
নিক গলির এক প্রান্তে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অস্বস্তি আর রাগ ফুটে উঠেছে। তার ধৈর্য কমছে, ভ্রু কুঁচকে গেছে। নোহারার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে, কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
নোহারার কপালে ঘাম জমে গেল। চুল ভেজা ভেজা হয়ে উঠল। যখনই নিকের দিকে তাকাচ্ছে লোকটা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আর নোহারা তাতেই অসাড় হয়ে পড়ছে। নোহারা মনে মনে ভাবল, এ লোকটা কীভাবে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে? এটা তো কোনো সহজ ব্যাপার নয়। আমি যে এখন কী করব!
নিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নোহারার দিকে এগিয়ে আসলো, ক্ষুব্ধ স্বরে বললো,
"হ্যাঁ, অনেক উপকার হলো আমার। আর করা লাগবে না।"
নোহারা ঠোঁট উল্টে বললো,
"সন্ধ্যা ব্রো! স্যরি।"
নিক থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"হেই লিটিল গার্ল, ডোন্ট আই লুক স্কেয়ারি? তুমি ভয় পাচ্ছো না কেন?"
নোহারা ঠোঁট চেপে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে কিছুটা মৃদু হাসি মুখে এনে বলল,
"নো, আপনি দেখতে হ্যান্ডসাম। একটুও ভয়ংকর নন। তাছাড়া বয়সই বা কতো হবে আপনার? ২৫/২৬? আমার থেকে বেশি বড় না আপনি। তাই এতক্ষণ ভয় পেলেও এখন ভয় পাওয়ার কারণ দেখছি না।"
নিক দ্রুত এগিয়ে এসে নোহারার সামনে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে সে নোহারাকে তার উপস্থিতির অদৃশ্য শক্তি দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। নিক গুরুতর কণ্ঠে বললো,
"আমার বয়স ৫০ এর কাছাকাছি।"
নোহারা শ্বাস রোধ করে দাঁড়িয়ে গেল, তার হেঁচকি এসে গেল। একের পর এক হেঁচকি দিতে দিতে সে নিকের দিকে চোখ বড় করে তাকালো, যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। নিকের মুখে কোনো অনুভূতি ছিল না, চোখ দুটোয় কেবল নিষ্ঠুর বাস্তবতা ছিল যা নোহারা একটু আগেও অনুভব করতে পারেনি।
নিক ইশারা করে বললো,
"বাসায় যাও। রাত হচ্ছে।"
নোহারা নিষ্পলক তাকিয়ে রইল নিকের যাওয়ার পানে। ডাকতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ডাকলো না। মনে হলো লোকটা কতো কতো প্রশ্ন রেখে গেলো, যেগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে নোহারার হৃদয়।
•
"স্যার!"
কৌশিক কম্পিউটারের স্ক্রীনে চোখ রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল। অনন্যা উনার রুমের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ সময় স্যারের রুমের দরজা বন্ধই থাকে। কিন্তু আজ সৌভাগ্যক্রমে খোলাই পায় অনন্যা। তাই রুম প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যদিও তার গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল স্যারের সাথে।
কৌশিক কোনো উত্তর দিলো না। অনন্যা বাধ্য হয়ে টেবিলে হাত দিয়ে বারি মেরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবারো বললো,
"স্যার, শুনছেন?"
কৌশিক স্ক্রীনেই চোখ রেখে, নিজের কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে একটু ক্ষীণ হাসি দিয়ে বললো, "আমার কান তোমার মতো নয়, যে একেক সময় একেক জায়গায় রেখে দিই। বলো, শুনছি!"
" রাবার ব্যান্ড আর ক্লিপ গুলো আমার জন্যই রেখেছিলেন তাই না?"
কৌশিক চোখ তুলে অনন্যার দিকে তাকালো। মেয়েটা যে সেগুলো পেয়ে খুশি তা অনন্যার চোখ ই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, চকচক করছিল চোখ দুটো। কৌশিক আবারো কম্পিউটারে মনোনিবেশ করে উত্তর দিলো,
"না। তোমাকে তো দুই নাম্বার ড্রয়ার খুলতে না বলেছিলাম। কিন্তু জিনিসগুলো যেহেতু পেয়েই গেছো ব্যবহার করতে পারো।"
অনন্যা মন খারাপ করে ফেললো। মুখ গোমড়া করে বললো,
"থাক! আমার জন্য যেহেতু কিনেননি। ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।"
"দরকার নেই। রেখে দাও। তোমার এমনিতেও লাগবে। আর কী কী লাগবে তামং কে জানিয়ে দিও। ও সব নিয়ে আসবে।"
"হ্যাঁ! সব তামংকেই বলবো। বিয়েটা তামংয়ের সাথে হলেই ভালো ছিল। অন্তত আপনার মতো ঘাড়ত্যাড়ামি তো করতো না। চুপচাপ আমি যা বলতো মেনে নিতো।"
রাগান্বিত স্বরে বললো অনন্যা।
"তামং অলরেডি ম্যারিড। ওকে বিয়ে করতে চাইলে প্রথমে লারার সাথে কথা বলতে হবে।"
অনন্যা রাগে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কৌশিক বুঝতে পেরে বললো,
"যাও লারার সাথে কথা বলো গিয়ে।"
অনন্যা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ একটানে রাখতে পারছিল না। একটু অবসন্ন মনে পাশ থেকে আরেকটা চেয়ার টেনে কৌশিকের পাশে বসলো। কৌশিক তখন স্টুডেন্টদের পড়াশোনার জন্য ডকুমেন্ট তৈরি করছিল, তার মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ কাজে। অনন্যা একটু বিরতি নিয়ে বড় করে শ্বাস টেনে বলতে শুরু করলো,
"আরণ্যক সম্পর্কে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।"
কৌশিকের হাত টাইপিং করতে করতে হঠাৎ থেমে গেলো। চোখ ঘুরিয়ে অনন্যার দিকে তাকালো। অনন্যা তার ইচ্ছেটা সোজা বলে ফেললো,
"আমি আরণ্যককে নিয়ে আজ অনেক ভেবেছি। আসলে ওর সাথে সাথে ভুলটা আমারও ছিল। আমি সেদিন একটা মেয়ের সাথে ওকে রেস্টুরেন্টে দেখেছিলাম, তারপর বিষয়টা কনফার্ম করার জন্য ওর সাথে কথা বলা উচিত ছিল, কিন্তু আমি বলিনি। এত পরিমাণ রাগ উঠেছিল যে আরণ্যকের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আজ আরণ্যক দাবি করছে মেয়েটা ওর গার্লফ্রেন্ড না কাজিন ছিল। তখন আমি নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। কিন্তু সমস্যা সেটা না, সমস্যা হচ্ছে আরণ্যক যখন সেসব বলছিল, তখন আমার কষ্ট হচ্ছিল কারণ আমি ওকে ভুল বুঝেছি। এখন জানি না ওর কথাটা কতটা সত্যি, কিন্তু ভুল বোঝা ছাড়াও আরণ্যকের কথায় আমি ফিল পাচ্ছিলাম না। মানে, আগে যেরকম হতো, আরণ্যকের সাথে কথা বলে ভালো লাগতো, রাত হলে ফোনকল করা একটা অন্য ধরনের অনুভূতি হতো। কিন্তু আজ নেই। মনে হচ্ছিল, আরণ্যক না থাকলে আমার জীবন থেমে থাকবে না, বা ও ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না এমন মনে হচ্ছিল না।"
কৌশিকের মুখাবয়বে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো না।
অনন্যা আরো বললো,
"আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। আরণ্যকের ছলছল চোখ দেখে মনে হচ্ছিল খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। আমি আমাদের বিয়ের কথা বলে দিতে চাই কিন্তু আপনি না করেছেন তাই বলতে পারছি না। আমি আরো ভাবছি বিয়ের দিন যদি আমি আরণ্যককে ফোন করে জানাতাম তাহলে কী বিয়েটা তখন আরণ্যকের সাথে হতো?"
কৌশিক মৃদু হেসে বললো,
"আরণ্যকের জন্য যদি খারাপ লেগে থাকে, তুমি ওর কাছে ফিরে যেতে পারো।"
কথাটা হেসে বললেও কৌশিক শান্ত হতে পারছিলো না।
অনন্যা কৌশিকের কথায় পাত্তা দিলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
"স্যার জানেন?
মানুষ প্রথমে ভালোবাসায় হারায় না। মানুষ হারায় মায়ায়। কথার মায়ায়, শব্দের মায়ায়, চোখের মায়ায়, অন্তরের মায়ায়। ভালোবাসা হয় ধীরে ধীরে, খুব আস্তে। কখনো মনে হয় কিছুই ঘটছে না, কিন্তু একদিন হঠাৎ অনুভব করা যায়, কিছু তো হচ্ছে, কিছু বদলে যাচ্ছে। আমরা বুঝি না কখন ভালোবাসা আসে, কখনো মনে হয় ভালোবাসা কি শুধু এক মুহূর্তের ঘটনা? আসলে ভালোবাসা কখনোই ধরা যায় না। যতই আমরা চাই, যতই তাকে আঁকড়ে ধরতে চাই, সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আরো রহস্যময় হয়ে ওঠে।
অনেকে বলে ভালোবাসা বলে কিছু নেই। তারা বলে, এটি শুধু একটা আবেগ, এক ধরনের প্রশংসা যা কিছুদিন পরে ম্লান হয়ে যায়। আমি যদি সত্যি বলি, আমি নিজেও জানি না, ভালোবাসা আছে কিনা। আপনি যখন ভালোবাসায় পড়বেন বুঝবেন না তখন। আপনার মন কোটি কোটি মানুষের মধ্যে শুধু একজনকে খুঁজে পেতে চাইবে, তার মায়াভরা চাহনি দেখার জন্য আপনি পাগল হয়ে উঠবেন। সেদিন হয়তো বুঝবেন এটাই ভালোবাসা। তখনই আপনি বুঝবেন, ভালোবাসা আসলে কি!
কিন্তু আমি না এখন আর খুঁজি না আরণ্যককে। আগে খুঁজতাম। প্রথম প্রথম! যখন মন নতুন করে প্রেমে পড়েছিল তখন খুঁজতাম কিন্তু এখন আর এমন হয় না কেনো বলুন তো? আমার পক্ষ থেকে কি এটা ভালোবাসা ছিল না? কি ছিল তাহলে?"
কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে ছিল, মেয়েটার কথায় এক প্রকার হারিয়ে যাচ্ছিলো। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল দুজনের প্রথম দেখা হওয়া! তারপর দ্বিতীয় দেখায় বিয়ে! তৃতীয় দেখায় অনন্যার নদীতে পড়ে যাওয়া। কৌশিকের মনে পড়ে, সেদিন নদীতে অনন্যাকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীরের অনেকটুকু শক্তি ব্যবহার করে ফেলেছিল। এর ফলস্বরূপ তার শরীর পুড়ে গিয়েছিল। নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই সহজ ছিল না। কিন্তু সেদিন নদীতে ঘটে যাওয়া আরেকটা ঘটনা কৌশিককে চিন্তায় ফেলে দেয়, যার কারণে সে অনন্যাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় না। কাছে রাখতে চায়। তার জানতে হবে সেটা কি ছিল! অনন্যা হয়তো কৌশিকের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় খুলে দেওয়ার জন্য এসেছে। আর সেটা কী! এর উত্তর শুধু একজনই দিতে পারবে। কৌশিকের বান্ধবী ভেনোরা!
★★★★★
অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে ভাবনায় ডুবে ছিল। কৌশিক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর গভীর স্বরে বলল,
"তুমি কি চাও?"
কথাটা শুনে অনন্যা পিলে চমকে উঠলো, হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলো সে। এক মুহূর্ত কৌশিকের দিকে চেয়ে থেকে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
"জ্বি? কী বললেন?"
কক্ষে একমাত্র বাল্বটি ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলো অন্ধকারকে ভেদ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। টেবিলের দিকটা অন্ধকারই বটে, শুধু মাঝের অংশে আলো পড়ে কৌশিকের মুখটাকে স্পষ্ট করে রেখেছে। কৌশিকের আকাশি চোখে মাদকতার এক অদ্ভুত ছোঁয়া। অনন্যা হঠাৎ অন্যরকম অনুভব করতে শুরু করলো। মনে হলো লোকটার চোখ অন্য কথা বলছে আজ যা এই পর্যন্ত একবার ও মনে হয়নি।
আচমকা কৌশিক তার দৃঢ় হাতে অনন্যার বসে থাকা স্লাইডিং চেয়ারটি একদম পায়ের কাছে টেনে আনলো। অনন্যা হতবাক হলো, অনবরত চোখের পলক ফেলছে সে। অন্ধকার ঘরে একমাত্র ম্লান আলোর আভা দুজনের মুখের উপর পড়ে অব্যক্ত অনুভূতির পসরা সাজিয়ে যাচ্ছে। কাছে আসতেই অনন্যার মনটা আনচান শুরু করে দিয়েছে। সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যাচ্ছে।
দুজনের মাঝখানে মাত্র কয়েক ইঞ্চির ফাঁক। তবু সেই অল্প দূরত্বে এক উত্তেজনার ঢেউ খেলা করছে যার ফলে দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠেছে। বুকের ধুকপুকানির আওয়াজ এত স্পষ্ট যে মনে হচ্ছে একে অপরের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। অনন্যা চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছুটা দূরত্ব টেনে আনলো।
কৌশিক তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নরম গলায় বললো,
" আমায় ছেড়ে চলে যেতে চাও?"
"এ কথা কখন বললাম! কিন্তু...."
কৌশিক অনন্যাকে শেষ করতে না দিয়ে উচ্চারণ করলো,
"আরণ্যকের কথা এতো মনে করছো কেনো?"
"খারাপ লাগছে।"
"খারাপ লাগছে এর মানে তুমি তাকে মনে করছো। মানে মিস করছো।"
"হুম!"
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো।
"ঠিক আছে যদি চলে যেতে চাও দরজা খোলা আছে। তবে আমি শুনেছিলাম.... বাঙালি মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী ভক্ত হয়। তুমি চলে গেলে কথাটা ভুল প্রমাণিত হবে।"
অনন্যা কাছে এসে মুখ ফুলিয়ে বললো,
"আমি বলেছি চলে যাবো? তাহলে উল্টাপাল্টা বলছেন কেনো? তাছাড়া ওই ডাক্তারকে বিয়ে না করে আপনাকে করেছি। এখন যদি চলে যাই, আত্মীয় স্বজন যারা জানে তারা কী বলবে? আমাকে তো খারাপ মেয়ে বানিয়ে দেবে।"
কৌশিক মাথা নিচু করে হাসলো। সাদা রঙের ডিজাইন করা ভারী সোয়েটার জাতীয় পোশাক পড়েছিল সে। এই পোশাকে লোকটাকে একদম সুন্দর মানিয়েছে। অনন্যা মুগ্ধ হয়ে স্যারকে দেখতে লাগলো। কৌশিক মাথা তুলে বললো,
"ওকে,তাহলে এই কথাই রইলো।"
কৌশিক চেয়ার ঘুরিয়ে কাজে মনোযোগ দিলো। অনন্যা কিছুক্ষণ পর আবার বললো,
"আপনি কেমন জানি!"
কৌশিক আবারো টাইপিংয়ে ব্যস্ত, সে উত্তর দিল,
"কেমন?"
"প্রথমে বললেন, আপনি বিয়ে মানেন না। তারপর নিজেই বাড়িতে থাকতে দিলেন। শর্ত দিলেন তিনটা। একটাও মানতে পারিনি নাকি! তারপর বকাঝকা করে বললেন চলে যেতে। আমি চলে গেলাম। আবার নিজের হাতে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন এখানে। রাতে যা করলেন, সেটাকে কী বলবো? এখন বলছেন ছেড়ে যেতে না! সবার সামনে এমন ভান করেন যেন চেনেনই না, অথচ হঠাৎ ডেকে কথা বলেন। আপনাকে আমি বুঝি না। কেমন রহস্য নিয়ে ঘোরেন। ঠিক করে বলুন কি চাইছেন আসলে?"
কৌশিকের ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সে টেবিল হতে হাত নামিয়ে চেয়ার ঘোরালো, অনন্যার বরাবর একদম কাছাকাছি দেখা গেলো তাকে। কৌশিক অনন্যার সামনের চুলগুলো পাশে সরিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল, অতঃপর ফিসফিস করে নেশালো কণ্ঠে বললো,
"প্রিটি!"
অনন্যা চমকে উঠলো, বুকে ধ্বক করে আওয়াজ হলো। তারপর প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে স্যারের দিকে তাকালো। কৌশিক মেয়েটার ঘাড়ে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনলো।তার স্পর্শে অনন্যার শরীরে এক অজানা শিহরণ জেগে উঠল। সন্তপর্ণে অনন্যার গালের উপর চুপটি করে বসে থাকা নিষ্পাপ তিলে ঠোঁট বসালো। ধীরে ধীরে সেখানে নাকের আগা স্পর্শ করে নিচে নেমে ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো অনন্যার। বোকা বনে গেলো অনন্যা। নিজেকে সামলে নিতে বেশ বেগ পেতে হলো তাকে। ধাক্কা দিলো স্যারের বুকে। কিন্তু কৌশিকের কোনো হেলদোল নেই।
ধীরে ধীরে, কৌশিকের নাকের আগা, ঠোঁট এবং গভীর চুম্বনে সবকিছু এক অদ্ভুত অনুভূতির মোড়কে মোড়া হয়ে গেল। বেকায়দায় পড়লো অনন্যা। কৌশিকের কাঁধে আপনাআপনিই অনন্যার হাত চলে গেলো। শক্ত করে খামচে ধরলো স্যারের কাঁধ। কৌশিক চেয়ার ছেড়ে একটু উঠে আরো গভীর চুম্বন করলো অনন্যার ঠোঁটে। অনন্যার হাতের নখ কৌশিকের ভারী পোশাকের উপরেই পিঠে আঁচড় বসালো নরমসরম করে। বেশ অনেকক্ষণ স্থায়ী হলো চুম্বন। দীর্ঘ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটলো কয়েকদিন পূর্বে বিয়ে হওয়া দম্পতির মাঝে। কিন্তু অনন্যার নখের আঁচড়, কৌশিকের পিঠের পুরনো ক্ষতগুলোর ওপর পড়ল, আর তা আবারো রক্তক্ষরণে পরিণত হল।
অনন্যা আসার পর কৌশিকের জীবনে যেন এক অদ্ভুত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। যেই কৌশিক এতদিন ধরে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অন্য মানুষের শক্তি গ্রহণ করত, সে আচমকাই তা বন্ধ করে দিয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে, তার শরীরে ক্ষত বাড়ছে, আঘাতের গভীরতা বাড়ছে। অথচ এসব নিয়ে কোনো উদ্বেগের ছাপ নেই তার চোখে-মুখে।
বদলে, তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ থাকছে অনন্যার দিকে। যেন মেয়েটির প্রতি এক অজানা আকর্ষণ তাকে প্রতিনিয়ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে সে অনন্যাকে খেয়াল করে, অনন্যার হাসি, অনন্যার অভিব্যক্তি সবকিছুই।
প্রচণ্ড ব্যথায় কৌশিক অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। শ্বাস আটকে, অস্থির হয়ে দ্রুত নিজের পিঠে হাত রাখল। তার হাতে কিছু ভেজা ভেজা অনুভূতি এলো, পোশাকের ওপর দিয়ে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল। এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা শ্বাস নিয়েই, তার মুখটা অল্প খুলে গেল। অনন্যাও কিছুটা মুক্তি পেল, শ্বাস নিতে অনেকটা কষ্ট হচ্ছিল তার, কিন্তু কৌশিকের কোমল চুম্বন, তবুও, তাকে খারাপ লাগায়নি। কেন? সে নিজেও পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না।
অনন্যা চোখ তুলে কৌশিকের দিকে তাকাল, স্যারের চমকিত চোখ ও মুখ দেখে এক মুহূর্তের জন্য ভ্রু কুঁচকে গেল অনন্যার। অনন্যা সেখান থেকে উঠে এসে স্যারের হাত ধরল। কৌশিকের হাতে রক্ত দেখে সে আঁতকে উঠল, আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
"এটা কীভাবে হলো? কোথা থেকে এসেছে রক্ত?"
কৌশিক কোনো উত্তর দিল না, এক ঝটকায় অনন্যার হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানার দিকে চলে গেল। কৌশিকের সাদা সোয়েটারের পেছন দিকে রক্তের দাগ দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অনন্যা। তার পিছু পিছু হেঁটে গেলো। কৌশিক শান্ত হয়ে বিছানায় বসলো। অনন্যা স্যারকে একবার দেখে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলো। কিয়ৎক্ষণ পর আবারো ফিরে আসলো সে। হাতে তার ফার্স্ট এইড বক্স।
বিছানায় রাখা বক্সটা দেখিয়ে অনন্যা বলল,
"খুলুন।"
কৌশিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
"কী?"
"পোশাক!"
"ছিঃ! কেনো?"
কৌশিক নিজের শরীর ঢেকে বললো।
"আরেহ! ব্যান্ডেজ করবো।"
"লাগবে না।"
কৌশিক হাত সরিয়ে ফেললো।
"হু, দেখতেই পাচ্ছি। খুলবেন, নাকি আমি খুলে দেবো?"
কৌশিক বিরক্ত স্বরে বলল,
"প্লিজ যাও।"
অনন্যা নিরুত্তর। এক ধাপে এগিয়ে এল। কৌশিকের পোশাকে হাত বাড়াতেই কৌশিক নিজেই উপরের জামাটা খুলে ফেলল। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো কৌশিকের। কিন্তু এভাবে এলোমেলো দেখতে খুব ভালো লাগছিল অনন্যার কাছে।
অনন্যা বিছানায় উঠে বসল। কৌশিকের পিঠে গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ভেতরের কষ্ট গলায় লেপটে বলল,
"এত বড় ক্ষত কীভাবে হলো?"
কৌশিক প্রতিউত্তর দিলো না। কোনো উত্তর না পেয়ে, অনন্যা নিজেই বক্সটা খুলল। তুলো নিয়ে আলতো করে ক্ষতটা পরিষ্কার করতে লাগল। তুলোর ছোঁয়ায় কৌশিকের শরীর খানিকটা কেঁপে উঠল। অনন্যা থেমে গেল না। যত্নের এক অনুচ্চারিত সুরে কাজ চালিয়ে গেল।
পিঠে অনন্যার আলতো স্পর্শ আরাম দিচ্ছে কৌশিককে। মেয়েটার মুখের নিঃশ্বাস শরীরে পড়তেই মনে হলো শরীরটা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। অনন্যা সুন্দরমতো ব্যান্ডেজ করে দিলো। বক্স গুছিয়ে কিছুক্ষণ কৌশিকের ফর্সা হলুদ চওড়া পিঠে তাকিয়ে রইল। নিজের হাত আস্তে করে পিঠে রেখে ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বরাবরের মতোই স্যারের শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। কিন্তু অনন্যার ছোঁয়া পেতেই গায়ের ঠান্ডা বরফের মতো অনুভূতি ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছিল। অনন্যার নিজের মনেও একটা অদ্ভুত ভালো লাগার ঢেউ এসে লাগছিল। কতক্ষণ কেটে গেলো কেউ বলতে পারলো না। কৌশিক ও নিশ্চুপ হয়ে অনন্যার স্পর্শ অনুভব করছিল।
কিছুক্ষণ আগের চুম্বনের কথা মনে হতেই কৌশিক মৃদু হেসে ফেললো।
অনেকক্ষণ পর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
"প্রিটি! ডু ইউ নো ইউ আর সো প্রিটি? ইউর লিপস....দে আর জাস্ট লাইক মাই পার্সোনাল স্ট্রবেরি। আই থিংক.... দে হ্যাভ বিকাম মাই অবশেসন। যখনি কোনো কারণ ছাড়া তোমার আশেপাশে যাই, এভাবে কাছে টেনে ফেলো তুমি। কেনো?"
অনন্যার কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না। মেয়েটার হাত ও থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কৌশিক পিছু ফিরে দেখলো অনন্যা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হেসে ফেললো কৌশিক। এটা কোন ধরনের ঘুম? মেয়েটা সত্যিই ঘুমপাগল। কৌশিক আস্তেধীরে সরে আসলো তার ফলে অনন্যা বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। মিনমিনিয়ে কিছু একটা বলতে লাগলো, কৌশিক নিচু হয়ে কান পেতে শুনলো। অনন্যা মিনমিনিয়ে কাঁপা গলায় বললো,
"স্যার... কে আ~পনি? আপনি কি ম্যাজিশিয়ান? নাকি বইয়ে লেখা রূপকথার কোনো চরিত্র? কোনটা আপনি? বাট যাই হন আই লাইক ইউ।"
কথাগুলো শুনে কৌশিক চমকে উঠল। চোখের দৃষ্টিতে যেন সামান্য কাঁপন লেগে গেল। সে এক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে মাথার অগোছালো চুলে হাত চালাল। সামনের চুলগুলো ঠিক করল যেন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। বড় করে শ্বাস ছেড়ে নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে চাপা দিতে চাইল।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিজের উপর প্রবল বিরক্তি বাড়ছিল। এসব কী করছে সে? কেন এমনভাবে অনন্যার সাথে জড়িয়ে পড়ছে?মানুষ অনুভূতির ফাঁদে আটকে পড়ে, কিন্তু সে তো মানুষ নয়। তাহলে কেন এই অদ্ভুত টান? কেন এই অপরিচিত অনুভূতি তাকে গ্রাস করছে?
কৌশিকের মনের গভীরে এক তীক্ষ্ণ প্রশ্ন জেগে উঠল, যদি একদিন জানতে পারে যে অনন্যা তার শত্রু? তখন কী হবে? সবসময়ের মতো অনন্যার শরীরকে কি সে বিনষ্ট করে দিতে পারবে?
কৌশিক কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশের নীরবতা তার মনের অশান্তিকে আরও প্রকট করে তুলল।
হঠাৎ কৌশিক থমকে দাঁড়াল। তার সামনে অন্ধকারের বুক চিরে এক অবয়ব ধীরে ধীরে ফুটে উঠল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, আর কৌশিকের বুকের ধুকপুকানি যেন ক্রমশ বাড়তে লাগল। অবয়বটি অন্ধকারে ঢাকা ছিল, তার চেহারা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছিল না। তবে তার উপস্থিতি কৌশিকের শরীরে এক অদ্ভুত শীতল স্রোত বইয়ে দিল।
দরাজ গলায় অবয়বটি বলল,
"তুমি ভুলে গেছো। তুমি একসময় মানুষ ছিলে। এখনো তোমার মনুষ্যত্ব পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। এখনো তোমার ভেতরে সেই মন আছে। এখনো তুমি অনুভব করতে পারো, যেমন আজ অনুভব করছ।"
কৌশিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।
অবয়বটি আবার বলল,
"তুমি মানুষের মতোই কিছু দিক এখনো ধরে রেখেছ। তোমার শুধু বয়সটা থেমে গেছে। ভালোবাসা, দ্বিধা এসব কোনো অযৌক্তিক ব্যাপার নয়। তুমিও ভালোবাসায় পড়বে। দ্বিধায় ভুগবে। সামনের দিনগুলো অনেক কঠিন, তোমাকে নিজেই চিন্তা করতে হবে তুমি কোন পথে হাঁটবে।"
অবয়বের কণ্ঠে ছিল এক ধরনের অমোঘ সত্যের ওজন। কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার ভেতরে একটা ঝড় উঠলেও মুখে তা প্রকাশ করতে দিল না। গভীর নিশ্বাস ফেলে সে জোর গলায় বলল,
"নাহ, এসব মিথ্যে। আমি কারো জন্য অনুভব করার ক্ষমতা রাখি না। ভুল বলছো তুমি। আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই। আয়ু থেমে গেছে আমার। আমার শরীরে এমন শক্তি আছে যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আর মানুষের মতো দেহে মন থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমার অস্তিত্বই ভিন্ন।"
অবয়বটি হালকা হেসে উঠল, যেন কৌশিকের কথা তেমন গুরুত্বই পেল না। তার দরাজ কণ্ঠ আবার বেজে উঠল,
"দেহ আছে তো মন ও আছে। মন আছে তো অনুভূতিও আছে। অনুভূতি আছে তো সবই আছে। যতই অস্বীকার করো না কেন, অনুভূতি ছাড়া কেউ সম্পূর্ণ হয় না। তোমার শক্তি যত অদ্ভুতই হোক, তা তোমার মনুষ্যত্বকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি।"
কৌশিক অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ধুলিসাৎ হয়ে হাওয়ায় উড়ে গেলো সেই অবয়ব। কৌশিক ব্যথিত হয়ে অনন্যার দিকে তাকালো।
.
.
.
চলবে...................................................................