মৃদু সুরের তালে কৌশিক স্যারের বাহুতে বাঁধা পড়ে নোহারা মগ্ন হয়ে নাচছিল। স্যারের হাতে তার হাত জড়িয়ে, গানের তালে পা চলছে দুজনের। স্যার পড়েছেন কালো ফরমাল ড্রেস আর নোহারা পড়েছে সাদা গাউন। হাত নাড়ানো হচ্ছে, চোখে চোখে রোমান্টিক এক্সপ্রেশন আর স্যারের ঠোঁটের কোণে থাকা মারাত্মক হাসি! হায়! একদম মাখনের মত গলে পড়ছে নোহারা। কৌশিক স্যারের প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি হালকা ছোঁয়া নোহারাকে আরও গভীরে টেনে নিচ্ছে। সম্পূর্ণ পরিবেশ এক মোহময় আবহ তৈরি হয়েছে, আর সেই আবহে অজানা উৎস থেকে ভেসে আসছে সালমান খান আর জ্যাকুলিনের একটি মিষ্টি গান।
jaane kab hothon pe dil ne rakh di dil ki baatein
samjha nahi yeh dil isko hum toh rahe samjhaate
jaane kab hothon pe dil ne rakh di dil ki baatein
samjha nahi yeh dil isko hum toh rahe samjhaate
maine dekha tujhe bhula ke har ek tarqeeb laga ke
har nuskhe ko aazma ke par dil se kabhi na utre utre utre
কিন্তু নোহারার দিল থেকে ধীরে ধীরে সমস্ত অনুভূতি উৎরে যেতে লাগলো যখন মোটা ভ্রুওয়ালা ভেস্পার সাহেব চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নোহারা আর কৌশিক স্যারের মোহময় নৃত্যের সমাপ্তি এদিকেই ঘটে গেল। তাদের এতোক্ষণের নৃত্য দেখে সন্ধ্যা ব্রোর মোটা ভ্রু দুটো কুঞ্চিত হয়ে গেলো মুহূর্তেই, হঠাৎ চোখ দুটো থেকে লাল রশ্মি নির্গত হতে লাগলো যার তীব্রতা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভস্ম করে দিলো নোহারাকে। নোহারা ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া অবস্থাতেই চিৎকার করে বলে উঠলো,
"কি করলেন, সন্ধ্যা ব্রো? আপনার কী সমস্যা?"
কথাটা বলে আরো জোরে চিৎকার করে উঠলো নোহারা। কৌশিক স্যার ও এক পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। দুজনের হাসি ঠাট্টা দেখে মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নোহারার। বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে বিরক্ত হয়ে বসলো সে। মাথার আউলা ঝাউলা চুলগুলো ঠিক করলো। ঘুমঘুম চোখে মুখ গোমড়া করে রইলো। একদম বিরক্ত লাগছে! কি সুন্দর স্বপ্ন ছিল! কৌশিক স্যারের সাথে রোমান্টিক ডান্স! বাস্তবে না হোক স্বপ্নে তো হচ্ছিল কিন্তু ওই সাদা চামড়ার ভেস্পার নামের সাদা ভাল্লুকটা সব মজা নষ্ট করে দিলো। কয়েক দিন যাবত স্যারের সুন্দর হ্যান্ডসাম মুখখানা দেখার সুযোগ হচ্ছে না, আর যাকে দেখতে চায় না তার সাথে প্রতিদিন দেখা হয়ে যাচ্ছে। কি বিরক্তিকর তাই না? সন্ধ্যা ব্রো সন্ধ্যা হলেই কোথা থেকে যেনো উড়াল দিয়ে আসে, আর নোহারাকে নিয়েই আরেকবার উড়াল দিতে চায় এই তার নিত্যদিনের একমাত্র ইচ্ছে। প্রতিনিয়ত এতে বিরক্ত হয় নোহারা। লোকটা নোহারাকে একেবারে মেরে ফেললেই তো পারে!
ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিল নোহারা। রুমমেটরা আগেই বের হয়ে গেছে, সে একটু দেরি করে ফেলেছে। দ্রুত ড্রেস চেঞ্জ করে মুখে হালকা প্রসাধনী মেখে তাড়াহুড়ো করে বিল্ডিং থেকে বের হলো। মিশুকে চেপে ক্যাম্পাসে পৌঁছে ধীর পায়ে হেলেদুলে হাঁটছিল নোহারা। মনটা ভারী হয়ে আছে, সকালে দেখা অদ্ভুত স্বপ্নটা এখনও মাথায় ঘুরছে।
হঠাৎই তার পা থেমে গেলো। কিছু দূরে অনন্যাকে দৌড়াতে দেখলো সে। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে দ্রুত ছুটলো তার পেছনে।
"অনন্যা!" ডেকে উঠলো নোহারা।
অনন্যা থেমে পেছনে তাকালো, ভ্রু কুঁচকে।
নোহারা সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, "কী? এত ছুটছিস কেন?"
"আজ তো উনার ক্লাস! দেরি হলে আমাকে আবার বাইরে বের করে দিবে! তাই দৌড়াচ্ছি। তুই ও আয়!"
"কে উনি? কার ক্লাস?"
"আরে মাইয়া! কৌশিক ব্যাটার ক্লাস!"
"ছিঃ ছিঃ! এভাবে ডাকিস কেন? উনি ইয়ং ম্যান।"
"ওই চুপ থাক! ইয়ং ম্যান নাকি বুড়ো ম্যান আমার জেনে লাভ নাই। আমি যাই।"
নোহারা হেসে বললো, "শুধু শুধু দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নাই। স্যার কয়দিন আসবে না। এই দুই দিন ও তো আসেনি। এতো দ্রুত সব ভুলে যাস তুই!"
অনন্যার পা হঠাৎ থেমে গেল। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন আসবে না? এই কদিন কেনো আসেনি?"
নোহারা সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো, "ক্লাসের কয়জন বললো স্যার ট্রিপে গেছে। শরীর-মন নাকি খারাপ, তাই কয়দিন ছুটি নিয়েছে।"
"ওহ!"
অনন্যার মুখ শুকিয়ে গেল। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, তার সমস্ত উচ্ছ্বাস এক মুহূর্তে মাটি হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে কোথাও যেন একটা জেদ চেপে বসেছে। মন বারবার বলছে, আজ স্যার আসবে। একবার হলেও তার দেখা পাবে। আকাশি মণির মতো উজ্জ্বল সেই চোখ দুটো বারবার ভাসছে অনন্যার মনে। না, কৌশিক স্যারকে মাফ করেনি সে। যারা তাকে কষ্ট দেয়, তাদের পাশে ঘেঁষতেও চায় না অনন্যা। শতবার ফোন করতে চাইলেও রাগের কাছে সে মাথা নত করে আর যোগাযোগ সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন! স্যারকে পছন্দ করে ফেলেছিল অনন্যা! কেনো? ওই যে কয়েকবার বাঁচিয়ে ছিল অনন্যাকে। কিন্তু তার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছে যখন মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তবু কেন যেন একটা টান তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
কয়েকদিন ধরে স্যারের দেখা নেই। বাসায়ও তাকে দেখা যায়নি। একদিন তো অনন্যার ইচ্ছে হলো, সব ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এই বাসা, এই মানুষগুলো, কিছুই তার নয়। এই বিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে কেউ মানে না! না আছে কোনো ভালো সম্পর্ক আর না আছে কোনো ভাব! আর ভালোবাসা তো শত হাত দূরে থাক! টিচার স্টুডেন্ট হিসেবেও দুজন দুজনের শত্রু! তাই অনন্যা ভেবেছিল সব শর্ত ভুলে নিজের মতো অন্যত্র চলে যাবে। কৌশিক স্যারের পরিচয় জানার চেষ্টা করবে না, আর না তার সম্পর্কে ঘাটার চেষ্টা করবে। স্যারকে স্বাভাবিকভাবেই নেবে ভেবেছিল অনন্যা। কিন্তু পারছে না! হচ্ছে না! এই পর্যন্ত স্যারের প্রতিটি কর্মকাণ্ড অনন্যার মনে হাজারো সূত্র খোঁজার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিয়ে গেছে। চোখের অন্তরে লুকিয়ে থাকা রহস্য, আচরণের আনখশির ভিন্নতা, সবকিছু অনন্যাকে এক অদৃশ্য জালে বেঁধে ফেলেছে। তাই সে রয়ে গেছে।
কৌশিক স্যারের অদ্ভুত আচরণগুলো ছায়ার মতো তাড়া করে বেড়ায় তাকে। এক মুহূর্তের জন্যও মনে শান্তি নেই। তাকে যে সত্যটা জানতেই হবে! কিন্তু স্যার! উনি কোথায় গেলেন?
অনন্যা নিক ভাইয়া আর অন্যদের কাছে বারবার জানতে চেয়েছে স্যারের খবর। কেউ কিছু বলতে পারেনি। অনন্যার মনে পড়ে, সেদিন স্যার বলেছিলেন, তার মুখ আর দেখাবে না অনন্যাকে। তাহলে কি এই কারণেই সে লাপাত্তা?
অনন্যা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ আবারো ছুটতে শুরু করলো।নোহারা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর সেও ছুটলো। অনন্যা ক্লাসের সামনে এসে প্রচন্ড হাঁপাতে লাগলো। মুখ তুলে সামনের প্রফেসরকে দেখে মুখ বিমূঢ় করে ফেললো।নোহারাও কিছুক্ষণের মধ্যে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। গোমড়া মুখেই বললো,
"দেখলি বললাম না। সে আসবে না। চল!"
ফিজিক্স ক্লাসে বসে মনোযোগ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে অনন্যা। অথচ মাথার ভেতর কেবলই কৌশিক স্যারের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সবসময় ব্যাচের মেধাবীদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে থাকা অনন্যার আজ মনে হচ্ছে, ফোকাস যেন তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কীভাবে কৌশিক স্যার আবারো তার চোখে ধরা দেবে। আপনমনে চিন্তা করতে করতে অনন্যার হঠাৎ মাথায় আসলো, স্যারের নাম্বারের কথা। অনন্যা ফোন নাম্বার নিয়ে তো ছিল কিন্তু একবারও কাজে লাগায়নি। আজ সেটা কাজে লাগানো যায় কী?
মনের দ্বিধা আর কৌতূহল একসঙ্গে চেপে ধরলো। অনন্যা ধীরে ধীরে ব্যাগের তলায় হাত বাড়িয়ে ফোনটা বের করলো। মেসেজ অপশনে গিয়ে স্যারের ইনবক্স খুলল। কিন্তু এবার নতুন এক দ্বন্দ্ব,কী পাঠাবে? কীভাবে শুরু করবে?
অনন্যা কিছুক্ষণ মেসেজ অপশনে তাকিয়ে থেকে টাইপ করলো,
"স্যার, কোথায় চলে গেছেন আপনি?"
মুহূর্তেই আবার মাথা নেড়ে ডিলিট করে দিলো। এটা শুনলে মনে হবে, অনন্যা স্যারকে নিয়ে দারুণ চিন্তিত। না, এমনটা হওয়া চলবে না। অন্য কিছু লিখতে হবে।
দ্বিতীয়বার টাইপ করলো,
"স্যার, কেমন আছেন?"
পাঠানোর আগেই আবারো শব্দগুলো ডিলিট করে ফেলল। মনে হচ্ছে, স্যারকে নিয়ে সে খুব বেশি ভাবছে। না, এটাই সঠিক নয়।
অনেকক্ষণ ভাবার পর অবশেষে কিছু কঠোর শব্দ টাইপ করলো অনন্যা,
"আমি আপনাকে আমার সামনে মুখ না দেখাতে বলেছিলাম। তাই বলে ক্লাসেও আসবেন না? এটা কেমন কথা! প্রফেশনাল মানুষদের এসব মানায় না! আমি ভেবেছিলাম, আপনি ব্যক্তিগত আর প্রফেশনাল জীবন আলাদা রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু কয়েকদিন ধরে যা দেখছি, মনে হচ্ছে আমি ভুল ভেবেছি!"
মেসেজটা একবার পড়ে নিয়ে নিজেই হতবাক হয়ে গেল অনন্যা। এটা কি একটু বেশিই রূঢ় হয়ে গেল? মাথার ভেতর নানা চিন্তা ঘুরতে লাগলো। তবে সবকিছু ভুলে নিজের অজান্তেই সেন্ড অপশনে চাপ দিয়ে বসলো সে।
মেসেজটা পাঠানো মাত্রই অনন্যার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মুখ হাত চেপে ধরলো সে! উফফ! দ্বিতীয়বার চিন্তা করার সুযোগ ও পেলো না পাঠিয়ে দিলো? এ কি বড় ভুল! এখন স্যার এটা পড়ে কী ভাববে? হয়তো মনে করবে, অনন্যা স্যারের ক্লাসে না আসা নিয়ে খুব বিরক্ত, তাই রাগের মাথায় বকাঝকা করে এমন মেসেজ পাঠিয়েছে। ইশশ! লোকটা কী ভাববে!
অনন্যার মুখ থেকে বিরক্তিকর আওয়াজ ছুটলো। মাথায় কয়েকবার আঘাত করে বসলো সে। প্রফেসরের চোখে বিষয়টা গেলে সে পুরো ক্লাসের মাঝে অনন্যা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
"অনন্যা, কি করছো তুমি?"
পুরো ক্লাস স্থির হয়ে অনন্যার দিকে তাকালো। অনন্যা দ্রুত ফোনটা ব্যাগে রেখে হতচকিত হয়ে বললো,
"স্যরি স্যরি স্যার। আর কখনো হবে না।"
"মনোযোগ দাও।"
"জ্বি! জ্বি স্যার!"
•••••••••••
"অনন্যা, কৌশিক স্যারকে আমি খুব মিস করছি!" কথাটা বলতে বলতে এক মুহূর্তের জন্য পিছু হটলো নোহারা।
অনন্যা বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,
"আহ! চুপ থাক! সারাক্ষণ ওই লোকটার নাম যপ করতে থাকিস! বিরক্ত লাগে একদম।"
"হু! ঢং করিস না। তুই ক্যাম্পাসে ঢুকে যেভাবে ছুটছিলি দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুই ও স্যারকে মিস করছিলি। সত্যি না বল?" নোহারা মজা করতে করতেই হেসে উঠলো।
"না একদম না। আমার এসব বিদেশি লোক পছন্দ না। আমার এমন ছেলে পছন্দ যার মুখে দাড়ি থাকবে, দেখতে ভোলাভালা হবে। যাদের কোনটাই ওই স্যারের মধ্যে নেই।"
"দাড়ি নেই! ওইটাও আরেক ধরনের সৌন্দর্য,বস! আর এমনভাবে বলছিস যেন স্যারকে তোর বয়ফ্রেন্ড অথবা জামাই বানাতে বলেছি! স্যার হিসেবে পছন্দ তো করতেই পারিস!"
"মোটেও না। সবার পছন্দ এক হয় না, নোহারা। তাই স্যারকে তোর পছন্দ হলেও যে আমার হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই?"
কথাগুলো বলে মুখ গোমড়া করে একেবারে নীরব হয়ে গেলো অনন্যা।
"হু,তোর তো আরণ্যকের মতো চকলেট বয় ভালো লাগে তাই না?" নোহারা এবার একটু খোঁচা দিয়ে কথা বললো।
অনন্যা বিরক্ত হয়ে যাওয়ার আগে নোহারা আবারো বললো,
"শুনলাম, আরণ্যকের মানসিক অবস্থা ভালো না।"
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
"কী হয়েছে? "
"শরীর আর মনে জ্বর উঠেছে। আমাদের ক্লাসের এক-দুই জন বলাবলি করছিলো।"
নোহারা হেসে ফেললো।
"ওহ! তাতে আমি কী করবো?"
"ছেলেটাকে আরেকটা সুযোগ দে। এছাড়া কিছু বলার নেই।"
"উঁহু, আরো কষ্ট পাবে। শুধু শুধু আমি কষ্ট বাড়াতে চাই না।"
"কেনো পাবে? তুই এখন পিওর সিংগেল।"
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নোহারা তো জানেই না সে বিশুদ্ধ সিংগেলের সাথে সাথে বিশুদ্ধ বিবাহিত। সে মৃদু হেসে বললো,
"তাতে কী? আরণ্যক তো ভীতু! আরেকটা সুযোগ দিলেও আরণ্যক ভীতু থাকবে, না দিলেও থাকবে। আর আমাকে একপাশে চুপচাপ সহ্য করে মরতে হবে।"
কথাটা বলে অনন্যা দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। নোহারা পিছনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পরে, সন্দেহভরা গলায় বললো,
"তুই গাড়িতে যাস? আগে তো তোর এই গাড়িটা দেখিনি।"
অনন্যা সচকিত হয়ে একটু থমকে গেলো। মিথ্যা বলতে তার একদম ভালো লাগে না, কিন্তু এখন বলতেই হবে। যদি নোহারা পরে সত্যি জানতে পারে, তখন কী হবে, কে জানে!
অনন্যা একটু ইতস্তত করে বললো,
"মামার গাড়ি। নতুন কিনেছে! কয়দিন ধরে ব্যবহার করছি। টিউশনি করতে যাই, হয়তো তাই দেখিসনি।"
নোহারা চোখ ছোট করে বললো,
"তোর মামা ইদানিং এত ভালো হয়ে গেলেন? ব্যাপারটা কী?"
"বাবা টাকা পাঠিয়েছে," অনন্যা ধীরে ধীরে আরো একটা মিথ্যা রটালো।
"তোর বাবা টাকা পাঠানো শুরু করলো? সেটা আবার কবে থেকে?"
"একবারই পাঠিয়েছে।"
নোহারা মুচকি হেসে বললো,
"কনগ্র্যাটস। তোর মামার বাড়ি একদিন হুট করে গিয়ে সবাইকে সারপ্রাইজ করে দিবো। অনেকদিন যাই না।"
অনন্যার বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেলো। যদি নোহারা তার মামার বাড়ি গিয়ে সব জেনে ফেলে? দ্রুত পরিস্থিতি সামলাতে গলাটা নরম করে বললো,
"সারপ্রাইজ বাদ দে! কয়েকদিনের মধ্যে আমরা দুজন একসঙ্গে যাবো। তুই একা কষ্ট করে যাবি কেন?"
"হুম, সেটাও করা যায়। আচ্ছা যা তুই, আমি আসছি।"
নোহারার কথায় একটু স্বস্তি পেলেও, ভিতরে ভিতরে অনন্যা তীব্র এক আতঙ্কে পুড়ে যাচ্ছিল। এসব মিথ্যা একদিন যদি প্রকাশ পায় নোহারা নিশ্চিত অনেক কষ্ট পাবে। অনন্যা কীভাবে সামলাবে তাকে? মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো কিন্তু ওর পরিস্থিতি কী বুঝবে?"
••••••••••••
অনন্যা ব্যাক সিটে বসেছে। জানালার সাইডে মাথা ঠেকিয়ে আনমনেই কতকিছু চিন্তা করে যাচ্ছে। কেমন করে সময় চলে যাচ্ছে। আগের অনন্যা আর এখনকার মধ্যে অনেকটা তফাৎ। এখন পড়াশোনায় সহজে মনোযোগ আসে না। কি খারাপ জীবন পার করছে যেখানে কাছের বলতে কাউকে পাচ্ছে না অনন্যা। যাকে কাছের বলছে তাকে সব বলা যাচ্ছে না। কি করা উচিত আসলে? হঠাৎ বিয়ে তারপর একের পর এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তো যাচ্ছে। কয়দিন আবার কিছু ঘটছে না বলে অনন্যার ভালো লাগছে না। কৌশিক স্যার দূরে গেছেন বলে চিন্তায় অতি চিন্তিত অনন্যা। কৌশিক স্যার কাছে আসলে একটা সুন্দর গন্ধ নাকে ভেসে আসতো। সেই ঘ্রাণ মিস করছে, অনন্যা। ফোনটা খুলে মেসেজবক্সটা দেখে নিলো সে। না, কোনো ফিরতি মেসেজ তো আসেনি স্যারের পক্ষ থেকে। এই পর্যন্ত কতবার যে দেখা হয়ে গেছে ইয়ত্তা নেই অনন্যার।
হঠাৎ তীব্র চিৎকার আর চেঁচামেচি ভেসে এলো চারপাশ থেকে। সামনের সিটে বসা ড্রাইভার তামং আচমকাই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটা অন্যদিকে নিয়ে গেলো। অনন্যা চমকে উঠে বললো,
"কি হলো? কেন ঘুরালেন?"
তামং দ্রুততার সঙ্গে বললো,
"ম্যাম! একটা গাড়ির ব্রেক ফেল হয়েছে। আমাদের গাড়ির সামনে আসছিল।"
অনন্যা শ্বাস আটকে বললো,
"তাহলে রাস্তার সাইডে রেখে দিন!"
তামং কপাল মুছতে মুছতে বললো,
"ম্যাম! গাড়িটার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অবাধে ছুটছে।"
অনন্যা দ্রুত পিছনের কাঁচ দিয়ে তাকালো। তার চোখ বড় হয়ে গেলো। সত্যিই, একটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসছে! চারপাশের অন্যান্য গাড়িও আতঙ্কে উল্টো দিকের ড্রাইভ শুরু করে দিয়েছে।
গাড়িটা প্রচণ্ড গতিতে কয়েকটা গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে উল্টে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চারপাশের চিৎকার, হর্ণের কর্কশ আওয়াজ আর আতঙ্কিত মানুষের মুখ দেখে অনন্যা বুঝতে পারছিল না, কি করা উচিত। সবাই আতঙ্কে সেদিকে তাকিয়ে ছিল, আর রাস্তার মাঝখানটা দেখে মনে হচ্ছিল একটা জমজমাট কার রেসের ট্র্যাক হয়ে উঠেছে।
অনন্যা নিজের ব্যাগটা শক্ত করে ধরলো। কী করবে? মাথায় কোনো পরিকল্পনা আসছে না। হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
তামং সঙ্কল্প নিয়ে বলে উঠল,
"ম্যাম, আমি গাড়িটা স্লো করব। আপনি বাম সাইডের দরজা খুলে নেমে যাবেন। আমি যতদূর সম্ভব চালাবো, প্রয়োজন হলে ধাক্কা খাবো। দেখি কি করা যায়।"
অনন্যা হতবাক হয়ে বললো,
"না! কী বলছেন এসব? আমি একা কখনোই নামবো না। আপনি ও নামবেন।"
তামং এক মুহূর্ত থেমে অন্যমনস্কভাবে বলল,
"ম্যাম, গাড়িগুলো স্যারের প্রিয়। একটা স্ক্র্যাচ পড়লেও স্যার প্রচণ্ড রেগে যান। আর যদি গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে যায়, সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।"
অনন্যার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বললো,
"আমি কিছু জানি না! আপনি নামবেন! নাহলে লারাকে কী বলবো আমি?"
অনন্যা বসে রইল। তামং আবার ও বললো,
"প্লিজ, ম্যাম!"
পেছনের গাড়িটা সামনের গাড়িগুলোকে উল্টে ফেলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে তাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। অনন্যা আতঙ্কিত কণ্ঠে সামনের সিট শক্ত করে চেপে ধরে চিৎকার করলো,
"আরেকটু জোরে চালান! জোরে!"
তামং নিজের সর্বোচ্চ দক্ষতায় গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি বারবার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আচমকা, অনন্যা কাঁচ ভেদ করে পেছনে তাকালো। মুহূর্তেই তার শরীর শীতল হয়ে গেল।
আচমকাই দেখা গেলো, পেছনের গাড়ির সামনে, রাস্তার মাঝখানে, এক হালকা গড়নের পুরুষ দাঁড়িয়ে। তার পায়ে দৃঢ় ভর দিয়ে, হাত দুটো সামনের দিকে প্রসারিত করে পুরুষটি গাড়িটা ঠেলে থামানোর চেষ্টা করছিল। গাড়ির টায়ারগুলো সড়কের সাথে ঘর্ষণে চিৎকার করছিল, ধোঁয়া উড়ছিল চারদিকে। তার পায়ের নিচে মাটির কাঁপন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, মনে হলো পুরো পৃথিবী আজ তার শক্তির পরীক্ষা নিচ্ছিল।
অনন্যা নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিল না। লোকটা অবাস্তব কোনো শক্তিতে ভর করে, গাড়ির গতিকে পরাস্ত করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণহীন গাড়িটা পুরুষটির সম্মুখে থেমে দাঁড়ালো। তামং কোনো ঝুঁকি না নিয়ে গাড়িটা দ্রুত সরিয়ে নিয়ে অনেকটা দূর চালিয়ে নিয়ে গেলো। কিন্তু অনন্যা সেদিকে মনোযোগ দিতে পারলো না। তার চোখ স্থির হয়ে গেল সেই পুরুষটির দিকে। এক ঝলকেই অনন্যা তাকে চিনে ফেললো। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল অনন্যার। সেই পুরুষটি অনন্যার রহস্যময় মানব ছাড়া আর কে হতে পারে? তাহলে অনন্যার ধারণা সঠিক ছিল! দেখা হয়েই গেলো স্যারের সাথে!
.
.
.
চলবে........................................................................