মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ২০ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


"স্যাররা... পিতার সমান হয়। তা~ছাড়া এভাবে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলে নজর লাগবে ওনার। আর কখনো দেখবি না।"
অনন্যা নিজের কথায় নিজেই হতবাক হলো। পিতার সমান? সে নিজেই তো এই লোকটাকে বিয়ে করে বসে আছে।

নোহারা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
"কেনো দেখবো না? একশবার দেখবো! আর তোর পিতা নিয়ে তুই বসে থাক। স্যার আমার কোনো পিতা লাগে না,
সে আমার জানের জান, পরাণের পরাণ! নিরামিষ তুই! স্যারকে পিতা বলিস! যা আরণ্যকের প্রেমেই ডুবে থাক।‌ছ্যাকাখোর!"

নোহারার কথায় রাগে গর্জে উঠলো অনন্যা। এমনিই কয়দিন ধরে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না, তার মধ্যে নোহারা আরণ্যককে টেনে নিয়ে আসলো? ভরা ক্লাসে চিৎকার করে বসেছে অনন্যা, কী বড় ভুল! সবাই থমকে তাকিয়েছে তার দিকে। ধীরে ধীরে যখন রাগের ঝাপটা কমলো, তখন বুঝলো, কী অযথা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ভেতরটা সংকোচে ভরে গেল অনন্যার। 

কৌশিক নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো। চোখে কঠোর তীক্ষ্ণতা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে দৃঢ় গলায় বললো,
"স্ট্যান্ড আপ।"

অনন্যার বুক ধুকপুক করছে। মাঝেমধ্যে মস্তিষ্কটা আউলা ঝাউলা হয়ে গেলে চিৎকার চেঁচামেচির কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। তাই বলে ভরা ক্লাসে? ইতস্তত করতে করতে দাঁড়ালো সে। মাথা নিচু করে ধীরে চোখ তুলে তাকালো কৌশিকের দিকে।

কৌশিকের দৃষ্টি যেন তার মন পড়ে নিতে চাইছে। ঠান্ডা গলায় কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করছিল সে।
"এবার বলুন ,এমন আচরণের কারণ কী?"

অনন্যার মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হতে চাইছে না। নোহারা কিছু বলতে চাইলো তার আগেই কৌশিক বললো,
"ওকে , যেহেতু কোনো উত্তর নেই। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। উত্তর দিলে বসতে পারবেন নাহলে ব্যাগ নিয়ে ক্লাসের বাইরে...!"

অনন্যা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। কৌশিক প্রশ্ন করলো,
"মধ্যযুগে ‘মঙ্গোল আক্রমণ’ কেন এত বিখ্যাত? একটু আগেই আমি এটা সম্পর্কে বলেছিলাম। ঠিকমতো শুনে থাকলে পারার কথা।"

অনন্যা ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল, এ কি আক্রমণের কথা বলছে লোকটা? কখন পড়ালো এসব?

"পারেন না তাহলে?"

"মঙ্গলের জন্য করা হয়েছিল বলে অনেক বিখ্যাত হয়েছে এই আক্র'মণ।"
ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। অনন্যা তো লজ্জায় শেষ। মাথায় কয়েকবার চাপড় মারলো। কেনো যে উত্তরটা দিতে গেলো উফফ!

কৌশিক তার দৃঢ় গলায়ই বললো,
"এই হচ্ছে আপনার দশা? মঙ্গলের জন্য আক্রমণ কেনো করা হবে? জীবনে শুনেছেন কোনো আক্র'মণ মঙ্গলের জন্য করা হয়েছিল।

মনোযোগ কোথায় থাকে আপনার? কান কী বাসায় রেখে এসেছেন নাকি রাস্তায়?"

অনন্যা মাথা নিচু করে রইল। কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
"ওকে, গেট আউট!"

অনন্যা মুখ ফুলিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মনে পড়লো এটা উনার বাসা না, তাই চুপসে গেল সে। হাতে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে আরণ্যক দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। উত্তর বলতে শুরু করলো,
"মধ্যযুগে মঙ্গোল আক্রমণ বিখ্যাত কারণ এটি চেঙ্গিজ খানের নেতৃত্বে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংযুক্ত সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাদের উন্নত সামরিক কৌশল, ধ্বংসযজ্ঞ এবং প্যাক্স মঙ্গোলিকার মাধ্যমে সিল্ক রোডে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়। এই আক্রমণ বিশ্ব ইতিহাসে গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে।"

কৌশিক আরণ্যকের দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। চোখে খানিকটা প্রশ্ন আর বিরক্তির মিশ্রণ।
"এন্ড হু আর ইউ?"

আরণ্যক সামান্য হাসলো। নিজের সাইড ব্যাগটা আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললো,
"আমি আরণ্যক! আপনার স্টুডেন্ট। স্যরি ফর লেট কামিং!"

কৌশিক তার দৃষ্টি সরিয়ে না নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে রইলো। এই ফাঁকে অনন্যা চিন্তিত চোখে নোহারার দিকে তাকালো। নোহারা তার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"তোর এক্স আগের বার এই কোর্সটা নেয়নি। তাই এবার আমাদের সাথে করছে।"

অনন্যার মুখ শক্ত হয়ে গেল। নোহারার কথাগুলো যেন আরও জট পাকালো তার মাথায়।

কৌশিকের ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটিয়ে বললো,
"টুয়েন্টি মিনিটস লেইট! এখন এসে আর কি করবেন? ইউ আর নট ওয়েলকাম টু দিস ক্লাস।"

আরণ্যক বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললো,
"স্যরি টু সে, স্যার। বাট আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, এটা কোনো স্কুল না যে দেরি করলে ঢুকতে দেওয়া হবে না।"

ক্লাসে এক মুহূর্তের জন্য পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবাই আরণ্যকের সাহসের প্রশংসা আর আতঙ্কে একসাথে তাকিয়ে থাকলো।

কৌশিক হাসলো। মৃদু স্বরে বললো,
"কথা ঠিক বলেছেন যদিও! কিন্তু একজন প্রফেসর তার স্টুডেন্টকে সর্বোচ্চটা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। এভাবে দেরি করে আসলে আর কখনো এলাউ করা হবে না। মাইন্ড ইট! আজকের জন্য কনসিডার করলাম। বসুন।"

কৌশিক চোখ ঘুরিয়ে আবার অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনি বের হয়ে যেতে পারেন।"

অনন্যা কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। অনন্যার বেরিয়ে যাওয়া দেখে আরণ্যক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তিত গলায় বললো,
"থ্যাংক ইয়ু স্যার। আমি পরবর্তী ক্লাস থেকে নিয়মিত আসবো। আজকের জন্য আমিও বের হয়ে যাচ্ছি।"

কৌশিক কিছু বলতে চাইলো, তার পূর্বেই আরণ্যক চলে গেছে অনন্যার পিছনে পিছনে। পুরো ক্লাসে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে। কৌশিক 'সাইলেন্স' শব্দ উচ্চারণ করে সবাইকে শান্ত করলো, তারপর আবারো পড়ায় মনোযোগ দিলো।

অনন্যা ব্যাগ কাঁধে জড়িয়ে আনমনে হাঁটছে। কৌশিক স্যারের উপর এতো রাগ উঠছে যে বলে বোঝাতে পারবে না। নিশ্চয়ই অনন্যাকে সহ্য করতে পারে না বলে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে। নোহারাও তো কথা বলেছে। ওকে বের করলো না কেন! একটা চিৎকার দিয়েছে বলে এভাবে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে অপমান করবে।

আরণ্যক ছুটে এসে তার পাশে দাঁড়ালো, অনন্যা তার দিকে চোখ তুলে তাকালেও কিছু বললো না। আগের মতোই হাঁটতে লাগলো।

"কথা আছে!" আরণ্যকের কণ্ঠে কঠোরতা জড়িয়ে ছিল।

অনন্যা বুঝতে পেরে বললো,
"কিন্তু আমার নেই।"

"কিন্তু আমার আছে, অনন্যা। তুই বুঝিস! তুই আমাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছিস?"

অনন্যা দাঁড়িয়ে পড়লো, ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
"তুমি আমাকে যতোটা কষ্ট দিয়েছিলে তার থেকে কমটুকু ফিরিয়ে দিচ্ছি।"

"আচ্ছা আমি কি করেছি? স্পষ্ট করে তো বলবি! নাহলে বুঝবো কীভাবে? এভাবে কষ্ট দিয়ে কি পাচ্ছিস আসলে?"

অনন্যা নিজের ফোনটা বের করতে করতে বললো,
"ঠিক আছে! যখন জানতেই চাচ্ছ আজ বলেই দি, তুমি কি করেছো!"

অনন্যা ফোনের গ্যালারি খুলে একটা ছবি বের করলো অতঃপর আরণ্যকের মুখের সামনে তুলে ধরলো। আরণ্যক ফোনটা হাতে নিয়ে ঠিকমতো দেখলো। অনেকক্ষণ পর বললো,
"এখানে কী হয়েছে?"

"কি হয়েছে মানে? তুমি অন্য মেয়ের সাথে ঘোরাঘুরি করবে আর আমি চুপ করে বসে থাকবো?" অনন্যা রেগে উঠে বললো, "তোমার মন মানসিকতা এতো নীচ!"

আরণ্যক সোজা তাকালো, 
"কথা বলার আগে একটু বুঝে নে। আমি চরিত্রহীন নই যে টু টাইমিং করবো। ছবিতে যে মেয়েটা দেখাচ্ছিস, ও আমার কাজিন। অনেকদিন পর বিদেশ থেকে এসেছে, তাই রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলাম।"

অনন্যা ভ্রু উঁচিয়ে বললো, "ওহহো, তুমি বোঝাবে আর আমি সেটা বিশ্বাস করে নেবো? আমি আর ঈরা দুজনেই দেখেছিলাম তোমাদের কীরকম গলায় গলায় ভাব ছিল! গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি ছিল। তুমি এটাকে নরমাল বলবে আর আমি বিশ্বাস করবো?"

"একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তুই এতো বড় একটা ডিসিশন নিয়ে নিলি? আমি তোকে ম্যাচিউর ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ না বুঝলেও তুই অন্তত আমাকে বুঝবি। কিন্তু ভুল ছিলাম।"

ক্ষোভ জমে উঠেছে অনন্যার কণ্ঠে, 
"সিরিয়াসলি? যদি আমি ম্যাচিউর না হতাম, তোমার অসংখ্য ভুলগুলোকে মাফ করে দিতাম না। নোহারা সব সময় বলতো তুমি আমাকে কিছুই মনে করো না, তাও আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম। মনে পড়ে, একদিন তো? তোমার ব্যাচমেট কি যেন নাম, আমি ভুল করে তার নতুন ড্রেসে কলমের দাগ লাগিয়ে ফেলেছিলাম। সে এই সামান্য বিষয় নিয়ে সবার সামনে আমাকে অপমান করেছিল, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলে। একবারও আমার পাশে দাঁড়াওনি। ভীতুর ডিম! আমার ভাবতেও বিরক্ত লাগে এতো ভীতু একটা ছেলের সাথে আমি সম্পর্কে ছিলাম যে কিনা নিজের গার্লফ্রেন্ডের পক্ষে আওয়াজ তুলতে পারে না।‌জোর গলায় বলতে পারে না, এই মেয়েটা আমার। তাহলে ভালোবাসা, সম্পর্ক, সাপোর্ট, বিশ্বাসের মানে কী? পুরোনো কথা মনে পড়লেই তোমার প্রতি ভালোবাসা ধীরে ধীরে উঠে যায়। আর সেদিনের পর থেকে তো আরো নেই যখন এই মেয়েটার সাথে তোমার এতো মেলামেশা দেখেছিলাম।"

আরণ্যক হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ অনন্যার হাতের কব্জি চেপে ধরলো, চোখটা হঠাৎই ছলছল করে উঠলো ছেলেটার। মায়াভরা কণ্ঠে বললো,
"ভালোবাসা উঠে যায়, অনন্যা? কিন্তু আমারটা তো উঠে না। আমি এমনই। ভাই-বোনদের সাথে আমাদের অনেক পীড়িত থাকে, আমরা একে অপরের সাথে অনেক ফ্রি থাকি। 

ছবিতে ওটা আমার কাজিন। ওর নিজের বয়ফ্রেন্ড ও আছে। এখন তুই যদি বিশ্বাস না করিস , আমি ওকে বলে প্রমাণও দেখাতে পারবো। 

কিন্তু আমার তো দরকার নেই। কেনো ধোঁকা দিবো তোকে? আমি কি কখনো তোকে ব্যবহার করেছি বল? সবসময় তোকে নতুন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। সমস্যা হলে তোকে বুঝিয়ে দিতাম সেটা পড়াশোনা হোক অথবা অন্য কিছু। আমি শুধু তোকে চাই বলেই এমন উতলা হয়ে আছি।"

অনন্যা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। আরণ্যক আরো জোরে চেপে ধরে বললো,
"আচ্ছা! তোর কি এখনো বিশ্বাস হয় না? ঠিক আছে.....এক কাজ কর তুই আমার হৃদয়টা নিয়ে নে! দেখবি, এই হৃদয়টা শুধু তোর চিন্তা করে। "

অনন্যা আরণ্যকের কথায় খেই হারিয়ে ফেলছে। তাই আরণ্যক সুযোগ বুঝে অনন্যার আরেকটা হাত ও শক্ত করে ধরলো। দুজনের চোখ একে অপরে মিলিত হলো‌। আরণ্যক নরম গলায় বললো,
"আমি মানলাম, আমি ভীতু। কিন্তু এই ভীতু ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে।

আমি মানলাম, আমি তোর পাশে সেদিন দাঁড়াতে পারিনি। কিন্তু মনে মনে আমি সবসময় তোর পাশে ছিলাম।

আমি মানলাম, আমি...!"

আরণ্যকের মুখ থেকে পরবর্তী শব্দ বের হওয়ার পূর্বে অন্যজনের মুখ থেকে কর্কশ বাক্য বেরিয়ে গেছে। সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে অনন্যার কৌশিক স্যার। কৌশিক পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললো,
"অনন্যা শিকদার, কাম উইথ মি।"

অনন্যা দ্রুতগতিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাগী চোখে আরণ্যকের দিকে তাকালো। তারপর স্যারের পিছু হাঁটা ধরলো। আরণ্যক হাত ঝাড়লো। কখনোই মেয়েটার সাথে ঠিকঠাক মতো কথাও বলতে পারে না। কেউ না কেউ মাঝে এসেই পড়ে। কিন্তু আরণ্যক তো জানেই না, সেই কেউটা কেবল তাদের কথার মাঝেই নয়, বরং ধীরে ধীরে তাদের দুজনের জীবনের মাঝেও পা রেখে ফেলেছে। যেমন ছায়া নিঃশব্দে দিনের আলোকে গ্রাস করে, তেমন করেই সেই অচেনা উপস্থিতি তাদের সম্পর্কের গভীরে এক অদৃশ্য বিভাজন টেনে দিয়েছে।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp