মায়ের কথাটুকু শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল রিশা। আশফিক ভাইয়ের তো পছন্দের মানুষ আছে জেনিথ! রিশাকে কেন বিয়ে করতে চাইছে সে? নাকি মা আর খালামণির প্ল্যান এটা? শত ভাবনা রেখে ফোন খুঁজতে লাগলো রিশা। কয়েক মাস কেটে গেছে আশফিক ভাইয়ের আইডি তার দেখা হয় না। কোনোরকম ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে গিয়ে আশফিকের নাম সার্চ করতেই আইডি চলে আসলো। তবে লক করা। মুহূর্তেই হতাশ হয়ে গেল রিশা। মন বলছে কিছু তো একটা হয়েছে। যে ছেলের আইডিতে শতশত ফলোয়ার সে কেন হুট করে আইডি লক করে দিবে? সরাসরি আশফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না হলে জানা যাবে না। একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। সবমিলিয়ে হাপিয়ে উঠেছে রিশা। পুরোনো দিনগুলো মনে পড়লেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। আশফিকের গুড লুকিং, পরিপাটি চলাফেরা মূলত রিশাকে আকৃষ্ট করতো। চোখের ভালো লাগা তো আর মনকে ছুঁতে পারে না। ভালোবাসা তো অতকিছু দেখে বা ভেবে হয় না। ছোট বেলায় পছন্দের খেলনা না পেলে যেমন মন খারাপ করতো, আশফিককে পাবেনা ভেবেও রিশার ঠিক তেমনটাই খারাপ লেগেছিল। কিন্তু ভালোবাসার বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন! রাতিম ভাইকে পাওয়ার পর যেটা উপলব্ধি করেছে রিশা। যাকে ছাড়া বেঁচে থাকা চিন্তা করা যায় না। ভাবনার মাঝেই কুহুর আগমন ঘটলো। রিশাকে কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈষৎ রাগ হলো কুহু। ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিল। রিশা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। দরজা আঁটকে দিল। আনন্দ কিছুক্ষণ ফাঁকা ঘরে নাচলো কুহু। পরক্ষণে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেদিন আশফিককে ম্যাসেজ দিয়ে ভুল করেনি সে। বরং সবটা ঠিক করতে সক্ষম হয়েছে। রিশার ভালোবাসা সত্য, স্নিগ্ধ ছিল। তাইতো এত সহজে সব ঠিক হয়ে গেল। আশফিক আগে থেকেই জানতো রিশা তাকে পছন্দ করে, সেদিন কুহু ইচ্ছাকৃতই মিথ্যে ভালবাসে বলেছিল। ব্যাপারটা জানার পর খুব ভালো লাগছে কুহুর। অন্তত আশফিকের চোখে ছোট হয়ে রয়নি সে। রিশাকে বিয়ের কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল আশফিক। জোড় গলায়ই তো জেনিথের কথা বলে গিয়েছিল। এখন কোন মুখে সামনে এসে দাঁড়াবে? কুহু তার সমস্ত সংশয় দূর করে দিয়েছে। রিশা এখনো আশফিকের আশায় আছে জানাতেই একপ্রকার ছুটে আসছে আশফিক৷ বাইরে থেকে রওনকের ডাক আসতেই বেরিয়ে গেল কুহু।
•
ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে সবাই। কুহু দাঁড়িয়ে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। জুলেখা কয়েকদিন ছুটিতে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে রিশা আসলো মলিন মুখে। রাশেদ জামাল খাওয়ায় মনোযোগী। এই প্রস্তাবে তাকে খুব একটা উৎফুল্ল মনে হলো না। বেশ হাসিমুখেই কথা বলে যাচ্ছেন শারমিন বেগম। তার বোনের ছেলের প্রশংসায় মাতিয়ে রেখেছেন টেবিল। কোনো ভাবান্তর হলো না রাশেদ জামালের। আত্নীয়ের মধ্যে আত্নীয়তা পছন্দ নয় তার। আশফিক খুব যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলে। তবে মেয়েকে বিয়ে পর কানাডায় চলে যেতে হবে ভাবলেই বাবার বুক ফাঁকা হয়ে আসে। আশফিকের বাবা, মা জানিয়েছে ছেলে দেশে আসার পর একসঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিবে সবাই। কবে নাগাদ বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা যায়। রওনকের একটাই কথা রিশা যা বলবে তাই হবে। তবে খুব একটা যে তার পছন্দ এমন নয়। আশফিকের চলাফেরা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে তার। ফেইসবুকে প্রায়ই একটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবিতে দেখেছে। দেশে থাকাকালীন কলেজ জীবনে কতশত প্রেমই করেছে। খাবার নিয়ে অনেক্ক্ষণ যাবৎ নাড়াচাড়া করছে রিশা। মনে হচ্ছে এবারও তাকে নিজ থেকে রাতিম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। একটা মানুষ এতটা কঠোর কিভাবে হয়? তার কি সত্যিই মন নেই? নাকি রিশার জন্য তার অনুভূতিই ছিল না কখনো? থমথমে গলায় বলল রিশা,
"এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না বাবা। আগে পড়াশোনা শেষ হোক। তারপর ভেবে দেখবো।
মেয়ের এমন কথায় যেন খুশিই হলেন রাশেদ জামাল। রওনক জানাল এই নিয়ে রিশাকে যেন জোরজবরদস্তি করা না হয়। কুহু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কি সত্যি রিশার কথা? লজ্জায়ই কি এমনটা বলছে? মেয়ের কথায় খানিক অবাকই হলেন শারমিন বেগম। বোন তো তাকে জানিয়েছেন রিশা আর আশফিক দুজন দু'জনকে পছন্দ করে আগে থেকেই! তবে এখন তো দেখা যাচ্ছে মেয়ে উল্টো সুর গাইছে। অর্ধেকটা খাবার রেখেই চলে গেল রিশা। মেয়েকে আর ডাকলেন না শারমিন বেগম।
◼️
পরীক্ষার আর হাতে গোনা কয়েকদিন বাকি। কুহুকে বাড়িতে থেকে ভালোভাবে প্রিপারেশন নিতে বলল রওনক। একগাদা বই সামনে খোলা পড়ে আছে। মুখ ফুলিয়ে খাটের মধ্যিখানে বসে আছে কুহু। কাল রাতে পড়তে পড়তে কখন চোখ লেগেছিল টের পায়নি। রওনক তৈরি হচ্ছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। আয়নায় চোখ রেখে কুহুকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঈষৎ হাসি ফুটে উঠলো তার ওষ্ঠকোণে। গম্ভীর ভরাট স্বরে বলল,
" কালকে রাতের মতোই ভোলানোর ইচ্ছে হচ্ছে নাকি? তুমি যে এতখানি দুষ্টু আগে বুঝিনি! ফাকিবাজ মেয়ে। এসে যেন দেখি সব পড়া কমপ্লিট!
কাল রাতের কথা মনে হতেই লজ্জায় দৃষ্টি নামালো কুহু। একটুও পড়ার ইচ্ছে ছিল না তখন। শাড়ি পরেও তো এই জল্লাদটার মন গলানো গেল না রাতে! সারাক্ষণ পড়া আর পড়া! এলোমেলো শাড়ি নিয়ে উঠে চলে গেল ওয়াশরুমে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল রওনক।
•
আড়মোড়া ভেঙ্গে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠলো রিশা। পরিস্থিতি দিনদিন আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। আপাতত পরীক্ষার চিন্তা মাথায় রেখেছে। গতকাল আশফিক ভাই দেশে ফিরেছে। আজকে আসার কথা। রাতিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা না হওয়া পর্যন্ত আশফিককে কিছু বলাও সম্ভব নয় রিশার। সবমিলিয়ে এলোমেলো লাগছে সব। এদিকে কুহু বেশ আনন্দ নিয়েই আছে আশফিকের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার পর থেকে। সবকিছু খুলে না বলায় শান্তিও লাগছে না রিশার। মিথ্যে এক হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে সর্বক্ষণ।
•
বিকেল নাগাদ কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতে চলে গেল কুহু। আশফিকের অপেক্ষাতেই যেন ছিল এতক্ষণ যাবৎ। শাশুড়ির সঙ্গে আজ হাতে হাতে অনেক কিছুই রান্না করেছে। মনে মনে এই বাড়ির জামাই হিসেবেই ধরে নিয়েছে আশফিককে। কুহুর সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে, খালার খোজে ভেতরের রুমে চলে গেল আশফিক। বসার রুমেই বসে আছেন রাশেদ জামাল আর শারমিন বেগম। দুজনকে সালাম জানাল আশফিক। হাসিমুখে খোঁজখবর নিলেন রাশেদ জামাল। বারংবার এদিকসেদিক দৃষ্টি ফেলে রিশাকে খুঁজে যাচ্ছিল আশফিক। মেয়েটা কি তার আসার খবর পায়নি আজ? কিছু একটা বুঝতে পেরে আশফিককে নিয়ে ভেতরের রুমে চলে গেল কুহু। রুমে আসতেই দেখলো রিশা নেই। বিকেল দিকে সচরাচর ছাদেই থাকে মেয়েটা৷ আশফিককে ছাদে পাঠিয়ে দিয়ে টেবিলে খাবার গোছাতে চলে গেল কুহু।
মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। গাঢ় বেগুনি রঙা সুতির থ্রিপিস পরে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে রিশা। শুভ্র রঙা ওড়নাটা বাতাসে ভাসছে। আশফিক কিছু সময় মন দিয়ে তাকিয়ে দেখলো। অসম্ভব মায়াবী লাগছে! এতটা যত্ন নিয়ে ভালোলাগার দৃষ্টিতে কখনো দেখেছিল রিশ'কে? অজান্তেই মন ভালো হয়ে গেল তার। এই কদিন যাবৎ বিষাদে ডুবে ছিল। রিশ একদিন যত্ন নিয়ে সবটা কাটিয়ে দেবে এই বিশ্বাস আছে। ঠোঁটের কার্নিশে একটুখানি হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল আশফিক। ডাকলো রিশাকে। ভাবনার অলীক জগত থেকে বেরিয়ে আসলো রিশা। চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে এসেছে তার। অন্য সময় হলে আশফিক ভাইয়ের আগমন তাকে খুশি আর আনন্দ দিত। অথচ আজকে কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। সময় বদলায়। পৃথিবীর নিয়ম মতোই চলতে হয় আমাদের৷ মাঝেমধ্যে মন শুধু আঁটকে দেয় কিছু কিছু পরিস্থিতির কাছে। হাত ভাজ করে নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো রিশা,
"সব ছেড়েছুড়ে আমার কাছে চলে এসেছেন আশফিক ভাই?আপনার এতদিনের প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ, স্মৃতি ওসব?
রিশার প্রশ্নে থতমত খেল আশফিক। তাচ্ছিল্যই শোনালো কেমন। অপ্রস্তুত হয়ে বারকয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে বলল,
" আমি সেচ্ছায় ছাড়িনি। জেনিথ চিট করেছে। আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য দেয়নি। একেবারে ভেঙ্গে দিয়েছে আমাকে৷ আসলে আমরা যখন ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলি তখন এভাবেই তার দাম পাই। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি রিশ। তুই আমাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসতিস এটাও জানি।
তাচ্ছিল্য হেসে বলল রিশা,
"তাহলে তো জানেনই দেখছি। আপনার কি ধারণা আমি এখনো বোকার মতো আপনার আশা নিয়ে বসে থাকবো? জেনিথ প্রতারণা করেছে বলেই আপনি ফিরে এসেছেন। হৃদয় ভেঙ্গে গেছে আপনার! তার দায়ভার এখন আমি কেন নিব? ভালবাসতাম বলে? আপনি কি সত্যিই আমায় মন থেকে ভালোবাসেন আশফিক ভাই?
নির্বাক হয়ে রিশার কথা শুনছে আশফিক। কথাগুলো অবশ্যই যৌক্তিক। এটা ভেবেই আসতে চায়নি সে। কুহু তাকে পুনরায় না বোঝালে কখনই আসতো না। খুব ভালো করেই জানতো এই কথাগুলো তাকে শুনতে হবে। শক্ত গলায় বলল,
" আমি তোকে কখনও সেভাবে দেখিনি রিশ। কিন্তু তোর মনে আমি ছিলাম। সেটা বুঝতে পারি অনেকটা পরে। ততদিনে জেনিথ আমার জীবনে চলে আসে। আমি তোকে কোনো দায়ভার দিতে চাচ্ছি না। ভাঙ্গা আমিটা একটু সুখের সন্ধানে এসেছে এতটুকুই! তুই রাজি না থাকলে জোড় করার সাধ্য আমার নেই। তোর মনে কি অন্যকেউ আছে?
আচমকাই ভেতর অস্থির হয়ে উঠলো রিশার। হাত ছেড়ে উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়াল সে। শিরশিরে বাতাসটা দম বন্ধ করে দিতে চাইলো। মাথায় জমলো ঘাম বিন্দু। অনিশ্চিত পরিস্থিতির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে কি করে রাতিম ভাইয়ের নামটা বলবে? বারংবার যে ফিরিয়েই দিয়েছে তাকে। কন্ঠনালী যেন চেপে ধরলো কেউ। ঢোক গিলতে কষ্ট হলো। উত্তরের অপেক্ষায় চাতকের মতো তাকিয়ে রইল আশফিক। চোখ বুজে ফেলল রিশা। দুফোঁটা জল গাল ভেজালো। ঠোঁট কাঁপলো তিরতির করে। কাঁপা স্বরে কোনোরকম বলল,
"না, কেউ নেই।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল আশফিক। তার প্রতি রিশার অভিমান জমেছে খুব করে বুঝতে পারলো। বাকি আর কথা বাড়ালো না। চলে গেল। রিশা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাতিমের উপর প্রচন্ড রাগ, ক্ষোভ জন্মালো। কেন কয়েকটাদিনের জন্য তার জীবনে এসে সব এলোমেলো করে দিল? নয়তো আজকের দিনটা খুব সুন্দরও হতো!
•
ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টায়। সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময় কখন চলে গেল খেয়ালই করেনি।আচমকা রওনকের কথা মনে পড়লো তার। লোকটা এখনো ফিরলো না! দ্রুত রুমে গেল দৌড়ে। খাটের উপর পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। দ্রুত ওপেন করলো সেটা। সম্পূর্ণ ম্যাসেজ পড়ে যেন কুহুর মাথায় বাজ পড়লো! রওনক আর শাহিনূর মাহি ম্যাম নাকি একত্রে একটা রিসোর্টে গিয়েছেন। তার ঠিকানাটা আর রুম নাম্বারটাও লেখা আছে স্পষ্ট ভাবে! মুহূর্তেই হাত কাঁপতে লাগলো কুহুর। এই জন্যই কি তবে রওনক ভাই আজকে ভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করেছে তাকে? ভেতর ঠেলেঠুলে কান্না আসতে চাইলো। এলোমেলো ভাবে কোনোমতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল কুহু।
.
.
.
চলবে...................................................