হন্তদন্ত হয়ে নিজের ব্যাগের মধ্যে একটা কাগজ খুঁজছে শান্ত। কাগজটা মূলত তার পরবর্তী বইয়ের পান্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠা ছিল। শান্ত এতটা বেখেয়ালি হয়ে ওটাকে কিভাবে অতিথি নিবাস রেখে আসলো বুঝতে পারছে না। মাথায় হাত দিল শান্ত। এই প্রথম কেউ তাকে চিহ্নিত করতে পারছে তাও কিনা অরিন। শান্ত মেসেজ লিখল,
“ওটা আমার চাই।”
মেসেজ দেয়ার কিছু সময়ের মাঝে মেসেজের রিপ্লাই আসলো, “আর আমার আপনাকে চাই।”
মেসেজ দেখে চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল শান্তর এসব কি বলছে অরিন! শান্ত আর কিছু লিখল না। তার মধ্যে অরিন আবার লিখল, “বিকেল ঠিক চারটার সময় লাইব্রেরিতে দেখা করবেন। আমার আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।”
শান্ত হ্যাঁ না কিছুই লিখল না থ মেরে কতক্ষণ বসে রইল।
••••••••••••
অতিথি নিবাসের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। ঠোঁট ছোঁয়ানো তার মিষ্টি হাসি। কতক্ষণ আগে রাহেলার সাহায্য নিয়েই এই রুমের তালা খুলে ভিতরে ঢুকেছিল অরিন। কেন ঢুকেছিল নিজেও জানে না। তবে এখন মনে হচ্ছে হাসান মাহবুবকে জানার জন্যই বোধহয় তার এখানে আগমণ। বাড়ির ভিতর ঢুকে পুরো রুমে চোখ বুলানোর পরই অরিন লক্ষ্য করল টেবিলের ওপর থাকা এই কাগজটা৷ কাগজের ওপর একটা নাম আর নামের নিচে লেখা হাসান মাহবুব। তারপর পর্ব এক লিখে কাহিনি শুরু। কাগজটা দেখে কয়েক মুহূর্ত থ মেরে থাকে অরিন। শান্তর হাতের লেখা অরিন জানত। কারণ অরিন লাইব্রেরি বসে দেখেছে শান্ত বই পড়ার সময় যদি কোনো লেখকের লেখা বা লাইন তার পছন্দ হয় তবে সেটা ডাইরিতে লিখে রাখে। সে লেখা থেকেই মূলত চেনা অরিনের। অরিনের এত খুশি লাগছে। আবার দুঃখ লাগছে হাসান মাহবুব তার এতটা কাছে থেকেও সে চিনতে পারল না। অরিনের এখন মনে হচ্ছে শান্ত তার দূর্বলতা মানুষের সামনে না আনার জন্যই বোধহয় এতকাল লুকিয়ে ছিল। কিন্তু অরিন তো তাকে লুকিয়ে থাকতে দিবে না। কিছুতেই দিবে না। কেননা অরিন বিশ্বাস করে কারো শারীরিক দূর্বলতা কখনোই তার সফলতার বাঁধা হয়ে থাকতে পারে না। অরিন প্রথমে ভাবল ফাবিহাকে দৌড়ে গিয়ে বলবে হাসান মাহবুব আসলে শান্ত। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল না থাক। ফাবিহার জন্য কিছু একটা করতে হবে। তার আগে জানতে হবে আরহান ভাইয়ার মনে কি আছে! ফাবিহা কি তাকে কিছু বলেছে! ফাবিহা যা মেয়ে তাতে সাহস করে প্রপোজ করাটা এতটাও সহজ হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু না বললেও তো এভাবে কাঁদার কথা হয়। আরহান কি ফাবিহার প্রপোজাল ফিরিয়ে দিয়েছে। বেশক্ষণ ভাবল অরিন।
••••••••••••••
নিজের কক্ষের একটা চেয়ারে বসে ছিলেন তৌহিদের বাবা জাহিদ রহমান। চোখে মুখে খানিকটা বিষণ্ণ ভাব। সারাকাল টাকার পিছনে ছুটে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে জীবনে তিনি ঠিকভাবে বাঁচতে পারেননি। শুধু ছুটেই গেছেন। এত বড় বিজনেস, এত টাকা, এত সম্পত্তি, অথচ মানুষ তারা মাত্র দু'জন। দুজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এত অর্থ সম্পদের কি প্রয়োজন পড়ে! জাহিদ রহমান এখন বুঝেন টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ছেলেকে সময় দেয়া হয়নি। তার অবস্থা বুঝতে পারেননি। শৈশবটা স্মৃতিময় করে রাখতে পারেননি। তার মনেই পড়ে না ছেলের শৈশবটা কিভাবে কাটল! তৌহিদের মা মারা যাওয়ার পর তৌহিদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয় আলেয়া। একজন কাজের মহিলা। যিনি তৌহিদকে দাদির মতো ভালোবাসতেন। তিনি বছর ছয়েক আগে মারা যান। এরপর তৌহিদ পুরোপুরি একা হয়ে পরে। বাবার সাথে মনোমালিন্য ঘটে। আর বিশাল বাড়ি ছেড়ে তৌহিদ পা রাখে হল প্রাঙ্গণে। ভাগ্যের জোরে মিলে দু'দুটো কাছের মানুষ, প্রিয় বন্ধু।
দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। জাহিদ রহমান মৃদু স্বরে বললেন, “কে?”
তৌহিদের কণ্ঠ শোনা যায়। মলিনময় কণ্ঠ, “বাবা আমি।”
জাহিদ রহমান সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকালেন এবং সোজা হয়ে বসলেন। তৌহিদ এগিয়ে আসলো। খানিকটা জড়তা, বিশাল এক দূরত্ব অনুভব করছে তৌহিদ। দৃশ্যমান দূরত্ব যখন একহাত তৌহিদ তখন শুধায়, “কেমন আছেন বাবা?”
মৃদু হাসলেন জাহিদ রহমান। বললেন,
“ভালো।”
তৌহিদের খুব অদ্ভুত ঠেকছে। কতকিছু ভেবে এসেছিল বলবে। কিন্তু এখন বলতে পারছে না। জাহিদ রহমান বুঝি তৌহিদের অবস্থান টের পেলেন। তিনি বললেন,
“মাস্টার মশাই ভার্সিটির এত এত ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে পারে অথচ বাবার সাথে পারে না কেন?”
তৌহিদ আচমকাই নিচে বসে পড়ল। পা ধরল বাবার। জাহিদ রহমান থমকে গেলেন। প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছে তৌহিদ?”
“আমাকে ক্ষমা করে দিবেন বাবা। আমি নিজের দিকটা দেখতে দেখতে আপনাকে দেখতেই ভুলে গেলাম।”
জাহিদ রহমান মাথায় হাত রাখলেন তৌহিদের। শান্ত স্বরে বললেন, “তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি ঠিক করেছ। আমিই ভুল ছিলাম। জীবনটা শুধু টাকা পয়সা কামানোই নয়। জীবনে অনেক কিছুর দরকার আছে। তুমি ঠিক করেছ যা করেছ। তোমার পেশাটাকে আমি সম্মান করছি। তবে কি জানো তৌহিদ! আমার তো আর কোনো ছেলে নেই যাকে আমি আমার সমস্ত ব্যবসা বানিজ্য বুঝিয়ে দিব। তুমিই আমার একমাত্র ছেলে। আমার এখন বয়স হয়েছে। এতবড় বিজনেস আমি সামলাতে হিমশিম খাই। তাই আমি চেয়েছিলাম আমার পরে তুমিই এই বিজনেসের দায়িত্ব নেও। কিন্তু তুমি যখন নিতে চাও না সেক্ষেত্রে জোর করা ঠিক না। আমি দেখি কি করা যায়! আমি ভাবছি। তবে বর্তমানে আমার একটা চাওয়া হলো তুমি আমার সঙ্গে থাকো। একাকিত্ব নিয়ে আমি মরতে চাই না তৌহিদ। বহুকাল তো একা থাকলাম। এবার আমি তোমায় নিয়ে বাঁচতে চাই। বিজনেস তোমায় ধরতে হবে না, আমি ভাবছি কিছু একটা।”
তৌহিদ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বাবার কথা মন দিয়ে শুনল। বলল,
“কিছু ভাবতে হবে না বাবা, আমি দেখব বিজনেস।”
জাহিদ রহমান কিছুটা অবাক হয়ে চাইলেন তৌহিদের মুখপানে। তৌহিদ আরো বলল,
“শিক্ষকতা আমার পেশা নয় আমার শখ ছিল বাবা। শখ আমি অনেকটা পূরণ করে ফেলেছি। এবার ছেলের দায়িত্ব পালন করব। আপনি টেনশন নিবেন না।”
খুশি হলেন জাহিদ রহমান। বললেন,
“আর একটা কথা ছিল তৌহিদ।”
তৌহিদ বোধহয় বুঝল। বলল,
“আপনি যা ভালো মনে করেন। আমি তাতেই রাজি।”
“তোমার কোনো পছন্দ আছে থাকলে বলতে পারো।”
কথাটা শুনতেই মোহনার মুখখানা ভেসে উঠল তৌহিদের সামনে। মন শক্ত করল তৌহিদ। বলল, “তেমন কেউ নেই।”
••••••••••••••
“এ শহর বড্ড কাঁদে। কারণে, অকারণে, ভিন্নভাবে। আচ্ছা এই শহর কি মানুষের দুঃখ বোঝে। বুঝতে পারে মানুষের ব্যাথা, কষ্ট, অসহ্যতা। আমার এই হৃদয়ে বিশাল একখানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, “মানুষের এত দুঃখ কেন থাকে? দুঃখহীন কি জীবন পার করা যায় না। আবার কখনো কখনো মনে হয় জীবনে দুঃখ আছে বলেই সুখের এত অহংকার! আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? আপনারা শুনছেন রেডিও তরঙ্গ নাইনটি টু পয়েন্ট টু রেডিও এফএম। আপনাদের সঙ্গে আছি আমি আরজে আরহান।”
মাইক্রোফোনে বরাবরের মতো আরহানের কণ্ঠ শোনা গেল। খানিকটা বিষণ্ণ ভরা কণ্ঠ। সে শুধায়,
“আপনারা চাইলে আমায় মেসেজ করতে পারেন, কল করতে পারেন 82904 এই নম্বরে। এছাড়া কমেন্ট করতে পারেন আমাদের ফেসবুক লাইভে। যতখুশি তত। আপনার কলের অপেক্ষায় আমি আরজে আরহান।”
এরপরই একটা গান চালু হলো। আরহান কান থেকে হেডফোন সরাল। জোরে একটা নিশ্বাস ফেলল। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। সকালের ফাবিহার বিষণ্ণ ভরা চোখদুটোর কথা বারংবার মনে পড়ছে। মেয়েটাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আরহান। কষ্ট তো সে বিথীকেও দিয়েছিল। মেয়েটাও তার জন্য পাগল ছিল। আবারও দীর্ঘশ্বাস বের হলো আরহানের। গান থেমে গেল। কল চলে আসল ইতিমধ্যে। আরহান কানে হেডফোন লাগিয়ে মাইক্রোফোনে ঠোঁট ছোঁয়াল। শান্ত স্বরে বলল, “আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?”
অপর প্রান্ত থেকে কণ্ঠ শোনা গেল। মেয়ের কণ্ঠ। সে বলল, “ওলাইকুম আসসালাম। আপনার কি আজ মন খারাপ আরজে সাহেব?”
আরহান খানিকটা চমকে উঠল। বলল,
“না সেরকম কোনো ব্যাপার নেই।”
“আপনার গলাটা বড্ড বিষণ্ণ বিষণ্ণ ঠেকছে। রোজকারের চাঞ্চল্যতা আজ খানিকটা দূরে। অন্যদের মন ভালো করার মানুষটার যদি মন খারাপ থাকে তবে কেমন লাগে বলুন তো?”
“খুবই বাজে লাগে। আমার মন খারাপ নেই। তবে ভীষণ ক্লান্ত আমি।”
“মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে।”
“না কিছু বিষয় থেকে পালাতে পালাতে।”
“যখন পালাতে চাচ্ছেন না তখন পালাচ্ছেন কেন?”
“আমি বড্ড উড়োলো স্বভাবের মানুষ। আর আমার মতো মানুষদের পালাতেই হয়।”
“অদ্ভুত কথা।”
খানিকটা হাসল আরহান। বলল,
“কোনো গান শুনবেন?”
“জি।”
“কি গান?”
“ছাড়ুন একটা আপনার পছন্দের।”
কল কেটে গেল। এর কিছু সময় পরই গান বেজে উঠল, ❝Sorry Dipannita❞
জানালার ফাঁক দিয়ে দুপুরের কড়া রোদ্দুর তখন গায়ে এসে লাগে। বিছানায় বসা কানে ইয়ারফুন গোঁজা ফাবিহা নিঃশব্দে কাঁদে। মনে হয় তার জন্যই বোধহয় করুণা করে গানটা ছাড়ে আরহান, “Sorry Dipannita”
••••••••••••••
লাইব্রেরিতে প্রায় আধঘন্টা আগে থেকে বসে আছে শান্ত। চোখে মুখে বিস্ময়। অরিন কেন আসছে না ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সে। এতবড় একটা ভুল কি করে হয়ে গেল শান্তের বুঝতে পারছে না। এবার অরিনকে কি করে বোঝাবে বিষয়টা। মেয়েটা যদি সবাইকে সবটা বলে দেয়। শান্ত তার চোখের চশমা খুলল। এত বেশি হতাশ আর দুশ্চিন্তা লাগছে বোঝানো যাচ্ছে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে বসল। হাতঘড়ি দেখল চারটা দুই বাজছে। মেয়েটা এখনও কেন আসে না! অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটল। অরিন এলো পরনে তার কালো রঙের শাড়ি। চুলগুলো খোঁপা করে সাদা রঙের ফুল দেয়া। মুখ ভর্তি মেকাপের সাজ। শান্ত হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল তার পানে। মস্তিষ্কে প্রশ্নরা হানা দিল, “মেয়েটা এভাবে এল কেন?”
শান্ত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লাইব্রেরিতে তখন মানুষসংখ্যা সবে সাত। অরিনকে নিয়ে আট। সবার দৃষ্টিই তখন অরিনের দিকে। অরিন কোনোদিক তাকাল না। সোজা শান্তর সামনে এসে তার হাত ধরে বসল। চোখের ইশারায় বোঝাল,
“আমার সঙ্গে চলুন।”
শান্ত কোনোরূপ বাঁধা দিল না। দাঁড়ালও না। শুধু বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেল অরিনের পিছু পিছু।
শহরের যানজট থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিরিবিলি পরিবেশ। বিশাল একটা গাছ। গাছের নিচটা গোল আকারের সিমেন্ট নিয়ে বাঁধানো। দূর সীমানায় ফসলের জমি দেখা যায়। শান্ত বেশ বিস্ময় নিয়ে আশপাশটা দেখল। ঢাকার শহরের ভিতরে এত সুন্দর গ্রামীণ পরিবেশ আছে সে তো জানতই না। অরিনের গাড়ি তাদের থেকে অনেকটা দূরে। এখান থেকে দেখা যায় না। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে শান্তকে গাড়িতে চড়িয়ে এখানে নিয়ে আসে অরিন। গাড়িতে বসেও পুরোটা সময় শান্তর হাত ধরে ছিল সে। শান্ত কিছুই বলেনি। হয়তো বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। অরিন হাত ছাড়ল শান্তর। ব্যাগের ভেতর জমিয়ে রাখা পাণ্ডুর কাগজটা এগিয়ে দিল। শান্ত দেখল। নিল। মোবাইলে মেসেজ দিয়ে জানাল, “ধন্যবাদ।”
অরিন দেখল। মোবাইল সরিয়ে আবারও হাত ধরল শান্তর। বলল, “এখানে বসি আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”
শান্ত এ কথা বুঝতে পারল। কারণ সে মানুষের ঠোঁট নাড়ানো শিখছে। এবার হাতের ভাষায় কোনোকিছু না বললেও সে অনেককিছু বুঝতে পারে। শান্ত বসল। অরিন হাতের ইশারায় তাকে বোঝাল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।”
শান্তর থমথমে চেহারা। বিস্ময় ভরা মুখ। সে মেসেজে লেখে, “আপনার মাথা ঠিক আছে।”
অরিন মেসেজ দেখে। লেখে, “আমি আপনার হাতের ভাষাও বুঝতে পারব। আমি শিখেছি এটা। শুধুমাত্র আপনার জন্য।”
শান্ত এবার তাকাল অরিনের চোখের দিকে। হাত দিয়েই বোঝাল,
“এটা হয় না অরিন। আপনার মাথা ঠিক নেই।”
“দেখুন আমার মাথা ঠিক আছে।”
এ বলে ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে ধরিয়ে দিল শান্তর হাতে। শান্ত দেখল। সেখানে লেখা—
“আমি আপনাকে ভালোবাসি শান্ত। আমি জীবনে কখনো কারো প্রেমে পড়েনি। ভালোবাসিনি। আপনিই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি চাইছি। তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনি হাসান মাহবুব শোনার পর বা জানার পর থেকে আমি আপনায় চাইছি। তাহলে আপনি আমায় ভুল ভাবছেন। আমি বিগত অনেকদিন যাবৎ থেকেই আপনায় চাই। আমার পরিবারকে আপনার কথা বলা হয়ে গেছে। তারা রাজি। এখন শুধু আপনি রাজি হলেই হয়। অবশ্য আপনি রাজি না হলেও কিছু যায় আসবে না কারণ বিয়ে তো আমি আপনাকেই করব। আমার বাবা আমার মাকে বিয়ের আসর থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে বিয়ে করেছিল। আমি তার মেয়ে। বুঝতেই পারছেন সাহসীকতা আমার রক্তে মিশে আছে। তাই ভালোই ভালো বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন। আপনি রাজি হলেই আমি আপনি আপনার বাড়িতে যাব। আপনার পরিবারকে মানাতে। আর রইল হাসান মাহবুবের কথা। হাসান মাহবুবকে আমি খুব পছন্দ করি। তবে আমি ভালোবেসেছি শান্তকে।” — ইতি... 'অরিন।'
চিঠি পড়ে শান্তর রিয়েকশন কেমন হওয়া উচিত বুঝতে পারছে না। কি সাংঘাতিক মেয়ে— বিয়েতে রাজি না হলে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। শান্ত কি করবে বুঝতে পারছে না! সে তাকাল। অরিন লাজুক বনে মাথা নুইয়ে বসে। শান্ত কাশির শব্দ করল। অরিন তাকাল। শান্ত বোঝাল,
“আমি কথা বলতে পারি না।”
“সমস্যা নেই আমি বলতে পারি তো।”
“আমায় নিয়ে আপনি সবসময় বিপদে পড়বেন।”
“বিপদ দেয়ার মালিক আল্লাহ, আবার বিপদ সরিয়ে নেয়ার মালিকও আল্লাহ। আপনি চিন্তা করবেন না আপনি সাথে থাকলে আমি সামলে নিতে পারব। আপনার দূর্বলতা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি সব জেনেই আপনায় ভালোবেসেছি।”
“আমি যে হাসান মাহবুব এটা কাউকে বলা যাবে না।”
“কেন?”
“আমি চাই না। আর এটা আপনাকে মানতে হবে কোনো ত্রুটি করবেন না।”
অরিন ভেবেছিল উল্টোটা কিন্তু এখন যখন শান্ত বারণ করছে তাহলে মেনে নিল। তবে বলল,
“পরিবারকে অবশ্যই জানাতে হবে।”
“তবে বন্ধু বান্ধবকে জানানো যাবে না আমি কি করি?”
“ঠিক আছে।”
আর কিছু বলল না শান্ত। বুকের ভেতর আচমকাই কেমন কেমন করে উঠল। ধকধক করছে। অনুভূতিরা কি টগবগিয়ে বের হচ্ছে। শান্ত এবার নিজ থেকে হাত ধরল অরিনের। অরিন মাথা রাখল শান্তর কাঁধে। শান্ত অবাক। প্রকৃতি সন্ধ্যা নামার পথে। শান্ত ভাবে, “সবটা এত দ্রুত হচ্ছে কেন? প্রেমাজালে এত দ্রুত আঁটকে পড়া কি সত্যিই সম্ভব!”
••••••••••••
দিন পনের পরের কথা। সকাল থেকে মোহনাদের বাড়িতে বিয়ে বাড়ির মতো তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আজকে পাত্রপক্ষ মোহনাকে দেখতে আসবে। অবশ্য দেখতে আসবে বললে ভুল হবে কাজী ডেকে বিয়েও পড়ানো হবে। কি অদ্ভুত! একটা ছেলে যার সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ হলো না, সাক্ষাৎ হলো না। অথচ কয়েকঘন্টা পরই তার সাথে সারাজীবন থাকার প্রতিজ্ঞা করবে মোহনা। মোহনার অনুভূতি এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তৌহিদের সাথে সাক্ষাৎ নেই আজ প্রায় তের দিন। তের দিন আগে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল খুবই সামান্য সময়ের জন্য। তৌহিদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা এতটাই দ্রুত ঘটল যে কেউ কিছু বুঝতেই পারল না কি হলো কেন হলো— লাস্ট ক্লাস শেষ করে তৌহিদ স্যার বললেন, “আজই আমার তোমাদের সাথে শেষ ক্লাস। আমি শিক্ষকতা ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরা নিজেদের প্রতি যত্নশীল হবে, আর পড়াশোনা করে বাবা মায়ের নাম উজ্জ্বল করবে। আর হ্যাঁ সবাই ভালো থেকো। পথে ঘাটে দেখা হলে অবশ্যই কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ।”
এই বলে তৌহিদ স্যার বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য মোহনার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। হয়তো করুণায় নয়তো অন্যকিছু ভেবে! ক্লাসের সবাই থমকে গিয়েছিল এমন কথায়। কেউ পাল্টা কিছু বলার আগেই তৌহিদ চলে গেল। আর এল না। মনখারাপ হলো ক্লাসের সবার। মোহনার অনুভূতি ঠিক কেমন ছিল সে জানে না। যেমনটা এখন ধরতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে না। তার সাথে ঘটছে তাতে তার খারাপ লাগছে নাকি ভালো লাগছে। তবে মোহনা ভেবে ফেলেছে যার সাথে তার বিয়ে হবে তাকে অবশ্যই তৌহিদ স্যারের কথা বলবে। বলবে তার জীবনের একতরফার প্রেমের কথা। সামান্যতম গল্পের কথা।
“কেমন আছো মোহনা?”
আচমকাই অরিনের কণ্ঠখানা শুনে ঘুরে তাকাল মোহনা। উর্মি আপার পাশে অরিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে উঠে আসলো। বলল,
“কেমন আছো তুমি?”
অরিনের ঠোঁট ছোঁয়ানো লাজুক হাসি। সে বলল,
“ভালো। তুমি?”
“আমিও ভালো। ফাবিহা আসেনি?”
“ওর শরীরটা খানিকটা খারাপ তাই আসেনি। তবে ওর বদলে আমি এসেছি। তোমার বিয়ে বলে কথা আসতেই তো হয় বলো।”
উত্তরে মৃদু হাসল অরিন।
হঠাৎ বাহিরে শোরগোল শোনা গেল। কয়েকজন পুরুষ মানুষের কণ্ঠ। মোহনার বুকখানা ধক করে উঠল। চিনচিনে ব্যাথা উঠল কেমন যেন। অরিন বলল, “দুলাভাই বোধহয় চলে এসেছে।”
অরিন সরে গেল। উর্মি বলল,
“আয় তোকে সাজিয়ে দেই।”
মোহনা বিনা-বাক্যে দাঁড়িয়ে রইল। বিছানায় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা লাল টুকটুকে একখানা শাড়ি, সঙ্গে কিছু গহনাগাটি। মোহনা বলল,
“আহির ভাইয়া আসবে না আপা?”
উর্মি হাল্কা হেঁসে জানাল,
“আসবে। ও রাস্তায়। আসছে।”
•••••••••••••
বাড়ির ভিতর ঢুকতে না ঢুকতেই চরম অবাক হলো তৌহিদ আর শান্ত। কারণ এখানে তারা এর আগেও এসেছিল ওই যে আহিরের বিয়ের সময়। তৌহিদ বুঝল না বাবা তাকে এখানে নিয়ে এল কেন! তার বউও কি তবে এখানে থাকে? মোহনার কথা চট করে মাথায় এল তৌহিদের। কোনোভাবে সে আবার মোহনাকেই দেখতে এল নাকি। চোখ মুখ আপনা-আপনি বিস্মিত হয়ে গেল। আরহান আশপাশ দেখতে দেখতে ভিতরে ঢুকছিল। আচমকাই তার নজর গেল সোফার এ কর্ণারে বসে থাকা ফাবিহার বাবার দিকে। আরহান অবাক স্বরে বলল, “আঙ্কেল আপনি এখানে?”
মাসুদ উদ্দিন ঘুরে তাকালেন। তিনি নিচের দিকে তাকানো ছিলেন আচমকাই আরহানের কণ্ঠ শুনে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। উঠে দাঁড়ালেন তক্ষৎণাৎ। বললেন, “আরহান তুমি এখানে?”
সবাই যেন বিস্মিত হলো। মোহনার বাবাও অবাক হলেন এদের দেখে। জাহিদ রহমান বললেন,
“আপনারা ওদের চেনেন নাকি?”
মোহনার বাবা বললেন,
“তোর ছেলে কোনটা রে?”
তৌহিদকে দেখালেন জাহিদ রহমান। খানিকটা হাসলেন মোহনার বাবা। বললেন,
“আরেহ ওদের তো আমি চিনি।”
“কিন্তু কিভাবে?”
পুরো বিষয়টা খোলামেলা করে বলল আরহান। উপস্থিত সবাই বেশ অবাক। কি সাংঘাতিক একটা ব্যাপার। তৌহিদের এবার অসস্থি লাগল। সে কি সত্যি সত্যি মোহনাকে বিয়ে করতে এল নাকি। এবার কি হবে? একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে তৌহিদ একবার মেয়েটার চেহারা দেখা উচিত ছিল।
তৌহিদের হাবভাবটা খেয়াল করল আরহান। নিচু স্বরে বলল, “কি হয়েছে তোর?”
অসয়হায় দৃষ্টি নিয়ে তাকাল তৌহিদ। বলল,
“আমি বোধহয় মোহনাকেই বিয়ে করতে এসেছি আরহান?”
আরহান অবাক হয়ে বলল,
“কোন মোহনা? যে মেয়েটা তোকে প্রপোজ করেছিল।”
মাথা নাড়াল তৌহিদ। আরহানের আচমকাই হাসি পেল। কিন্তু সে হাসল না। বলল,
“ভালোই তো। মেয়েটা তো খারাপ না।”
“আমি ওর টিচার আরহান।”
“ছিলি এখন আর নেই।”
“তবুও।”
“দেখ তৌহিদ তুই নিজেও যে মোহনা মেয়েটাকে পছন্দ করিস এটা কিন্তু আমি জানি। শুধুমাত্র শিক্ষক, স্টুডেন্ট বলে মেনে নিসনি। তাও জানি। তবে দেখ নিয়তি যখন তোদের এক করতে চাচ্ছে তাহলে সমস্যা কই! শান্তকে দেখেছিস ওর নিয়তিতে কে ছিল অরিন। আমার কি মনে হয় জানিস আমরা তিন বন্ধু তিন নারীকে ভালোবাসব বলেই অতিথি নিবাসে ভাড়ায় গিয়েছিলাম। আমরাটা পূর্ণতা পায়নি ঠিক আছে। কিন্তু তোদেরটা তো পূর্ণতা পাক। তোর বিয়ের পরই শান্তর বিয়ের প্রস্তুতি নিব।”
প্রতিউত্তরে তৌহিদ কিছু বলল না। এটা তো সত্যি তৌহিদ নিজেও মোহনাকে পছন্দ করত। শুধুমাত্র শিক্ষক ছাত্রী সম্পর্কের জন্য মেনে নেয়নি। তবে ভালোবেসেছিল কিনা জানে না। কিন্তু নিয়তি যখন তাদের এক করতে চাচ্ছে তাহলে অবশ্যই তৌহিদ মোহনাকে ভালোবাসবে। অবশ্যই বাসবে। মনে মনে হঠাৎ ভীষণ খুশি লাগছে তৌহিদের। ক'দিন যাবৎ কেমন দ্বিধাদ্বন্দে ছিল জীবনটা। আজ আচমকাই কেমন সব জটিলতা দূর হয়ে গেল। সবাই গোল হয়ে বসল সোফায়। শুধু দাঁড়িয়ে রইল আরহান।
হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে অরিন তাকিয়ে আছে সবার দিকে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ফাবিহা আসতে না চেয়ে সাংঘাতিক ভুল করেছে। মেয়েটা খামোখাই আসেনি। রিনা বেগম বেরিয়ে আসলেন হঠাৎ। ঠোঁটে উজ্জ্বলতার হাসি নিয়ে বললেন, “আরে আরহান,
আরহান তাকাল। দেখল। বলল,
“কেমন আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“আপনাদের সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি।”
উত্তরে মিষ্টি হাসলেন রিনা বেগম। আরহান এবার আশপাশ দেখল। এনারা যখন এসেছে ফাবিহাও নিশ্চয়ই এসেছে। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল ফাবিহার সাথে সাক্ষাৎ নেই। তবে আরহান জানে মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে তার আরজে শো দেখে, শোনে, কল করে কিন্তু কথা বলে না। মাসুদ উদ্দিন বললেন, “আরহান বসছ না কেন?”
সঙ্গে সঙ্গে আরহান বসল।
লালশাড়ি চুড়ি পড়িয়ে মোহনাকে আনা হলো। তার মাথা নিচু করা। তৌহিদ তাকে দেখল সবটা কেমন অদ্ভুত ঠেকছে স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। এই বাচাল মেয়েটা তার বউ হবে। ভয়ংকর কথা! জাহিদ রহমান বললেন, “মোহনা মা কেমন আছো তুমি?”
মোহনা হাল্কা একটু মাথাটা উঁচকিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?”
উত্তরে জাহিদ রহমান মোহনার মুখখানা দেখে বললেন, “মাশাল্লাহ।”
কিছুসময় ওভাবেই চলে গেল। আরহান বলল,
“আঙ্কেল আমার মনে হয় ওদের দুজনকে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে দেয়া উচিত।”
জাহিদ রহমান বললেন, “ঠিক ঠিক। তৌহিদ যাও বউমার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে এসো।”
প্রথমে আরহানের কণ্ঠ আর দ্বিতীয়বার তৌহিদ নামটা শুনে বেশ অবাক হলো মোহনা। তাকাবে তাও পারছে না কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
•••••••••••••
বাড়ির ছাদের ওপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তৌহিদ আর মোহনা। মোহনা চুপচাপ। তৌহিদই বলল আগে, “আমাকে দেখার ইচ্ছে নেই আপনার?”
মোহনা তক্ষৎণাৎ চমকে উঠল। তাকাল। দেখল তার সামনে তৌহিদ দাঁড়িয়ে। ভীমড়ি খেল মোহনা। অবাক স্বরে বলল, “স্যার আপনি?”
মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ বিগড়ে গেল তৌহিদের। ঠিক এই শব্দটা শুনবে না বলে মোহনাকে না করে দিয়েছিল তৌহিদ। অথচ শেষে কিনা। তৌহিদ চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“এই একদম স্যার ডাকবে না। আমি তোমার উডবি হাসবেন্ড একদমই স্যার ডাকবে না।”
“কিন্তু স্যার।”
সঙ্গে সঙ্গে মুখ চেপে ধরল তৌহিদ। মোহনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে। তৌহিদ বলল,
“তুমি জানো আমি তোমার প্রপোজাল কেন একসেপ্ট করিনি শুধুমাত্র স্যারের জন্য। ভালো তো আমারও তোমায় লেগেছিল। কিন্তু এই স্যার শব্দটা জন্য আমি মানা করে দিলাম। তোমার হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ার স্বভাবটা আমায় কতটা দুঃখ দিয়েছিল জানো তুমি?”
আচমকাই হাতে ব্যাথা অনুভব করল তৌহিদ। আহ্ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করল সে। কারণ তার হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছে মোহনা। তৌহিদ হতভম্ব হয়ে বলল, “এই তুমি মেয়ে নাকি অন্যকিছু।”
মোহনা রাগে ফুঁসছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে সে বলল, “শুধুমাত্র এই কারণে আপনি আমায় দুঃখ দিয়েছেন। আপনি জানেন আপনার জন্য আমি কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। বিষণ্ণ হয়ে স্যাড সং শুনেছি। হিরো আলমের গান শুনেছি। আর আজ আসছেন আপনি...”
এই বলে নানা কিছু বলতে শুরু করে দিল মোহনা। তৌহিদ কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরেহ আল্লাহ, এই মেয়ে দেখি পুরোই চটে গেছে। এই মেয়ের সাথে সারাজীবন কিভাবে থাকবে তৌহিদ!
••••••••••••••
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে আরহান।”
বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল আরহান। হঠাৎই মাসুদ উদ্দিনের কণ্ঠটা শুনে সেদিকে ঘুরে তাকাল। কলটা কেটে মোবাইলটা পকেটে রেখে শান্ত স্বরে বলল,
“জি আঙ্কেল বলুন।”
“আজকাল আঙ্কেলের থেকে নিজের ভিতরকার কথা লুকিয়ে ফেলতে ভালোই শিখেছো তাই না।”
আরহান অবাক হলো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“ঠিক বুঝলাম না।”
“আমার মেয়েটাকে এত দুঃখ কেন দিলে আরহান?”
আরহান দু'পা পিছিয়ে গেল। আতঙ্কিত হলো শরীর। আরহান মাথা নুইয়ে ফেলল। বলল,
“আঙ্কেল..”
“তুমিও তো আমার মেয়েটাকে পছন্দ করো, তাহলে ফিরিয়ে কেন দিলে?”
আরহান কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাসুদ আঙ্কেল এসব কোথা থেকে জানল। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল হঠাৎ। মাসুদ উদ্দিন হাসলেন। চমৎকার একটা হাসি। তিনি বললেন,
“তোমার বাবার মায়ের সাথে খুব শীঘ্রই আমি কথা বলব আরহান। তোমার আর ফাবিহার বিয়ে নিয়ে। তোমার মতো একটা ছেলেকে আমি অবশ্যই জামাই হিসেবে চাইব। এটা সত্য অতিথি নিবাস তোমাদের ভাড়া দেয়ার আগে আমি বলেছিলাম আমার একটা মেয়ে আছে। কিন্তু এটা তো বলিনি তোমায় জামাই হিসেবে আমি মানব না। আর যেখানে আমার মেয়েটাও তোমায় চায়। সেখানে তো আমি তোমাদের বাঁধা হতে পারিনা। আমার ছেলের ক্ষেত্রেও বাঁধা দেইনি। উর্মি যথেষ্ট ভালো মেয়ে। তাই মেনে নিয়েছি। আর তোমাকে আমি কত আগে থেকে চিনি, জানি তোমাকে মানব না এটা তুমি ভাবলে কি করে! যুগ অনেক বদলে গেছে আরহান। যাও ফাবিহা তোমার জন্য অপেক্ষায় বসে আছে।”
এই বলে মাসুদ উদ্দিন ভিতরে ঢুকে গেলেন। আরহানের সবটা যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। কি হলো, কেন হলো, বুঝতে তার সময় লাগল। আরহান কি করবে ভেবে না পেয়ে কল করল তৌহিদকে। তৌহিদ তখনও ছাঁদে দাঁড়িয়ে। মোহনা কথা বলছে আর সে শুনছে। তৌহিদ বলল, “এক সেকেন্ড দাঁড়াও।”
মোহনা থেমে গেল। তৌহিদ ফোন কানে নিয়ে বলল,
“হুম বল।”
“তৌহিদ আমি যদি তোর বিয়েতে না থাকি তোর কি কোনো সমস্যা আছে?”
“কেন কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“অতিথি নিবাস।”
“মাসুদ আঙ্কেল সব বলে দিল নাকি তোকে?”
“এর মানে তোরাই সবটা করেছিস।”
“তাহলে আবার কারা। কালকে আমি আর শান্ত গিয়েছিলাম অতিথি নিবাস। সবটা বলে এসেছি। আঙ্কেল শুরুতে থ মেরে থাকলেও পরে মেনে নিলেন।”
আরহান খুশি হলো। খুব খুশি হলো। বলল,
“আমি কি যাব তাহলে?”
“যা। আর শোন বিয়েটা আজ করছি না কাজী আসলে তাকে পাঠিয়ে দিব। আমরা তিনবন্ধু একসাথেই বিয়ে করব। আজ আপাতত আংটি পড়িয়ে যাব। তুই যা। যা তোর রৌদ্রময়ীর কাছে।”
কল কেটে দিল তৌহিদ। মোবাইলটা পকেটে রেখে হাত দিয়ে কান চেপে ধরল। তারপর ইশারায় মোহনাকে বলল, “শুরু করো।”
মোহনা আবার চেঁচাতে শুরু করল। বিগত কয়েক মাস যাবৎ গুম হয়ে থাকা মেয়েটা আজ হঠাৎই চাঞ্চল্যতায় ভরে উঠল। তৌহিদ আপন মনে তার দিকে তাকিয়ে হাসল। ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, “ভালোবাসি।”
মোহনা শুনল কিনা বোঝা গেল না। কারণ সে চেঁচিয়েই যাচ্ছে, চেঁচিয়ে যাচ্ছে, শুধুই চেঁচিয়েই যাচ্ছে।
•••••••••••••
আরহান কিছু সময় বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই ছুট লাগাল। তার এত খুশি লাগছে। কখন পৌঁছাবে অতিথি নিবাস? কখন যাবে তার রৌদ্রময়ীর কাছে?
আরহান বের হতেই মোহনাদের বাড়ির দরজার মুখে দাঁড়াল অরিন আর শান্ত। অরিন বলল,
“আরহান ভাই ছুটছে কেন?”
শান্ত অরিনের গাল ধরে নিজের দিকে আনল। ইশারায় বলল, “বোধহয় ভালোবাসার জন্য।”
উত্তরের হাসল অরিন। শান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমিও ভালোবাসি লেখক সাহেব।”
শান্ত তাকাল। চশমার আড়ালে তার চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল। মনে মনে বোধহয় সেও উচ্চারণ করল, “আমিও।”
•••••••••••
“বাবা আমার কি বিয়ে হবে না? বাবা আমার কি হবে না?”
টিভিতে গান ছেড়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে গানটা গাইছে রাহেলা। আজ সে অনেক খুশি। কারণ তার ফাবিহা আপা আবার আগের মতো হয়ে গেছে। কালকে আরহান ভাইজানের সাথে ফাবিহা আপা সাক্ষাৎ করতে যাবে তারপর সবটা ঠিক হয়ে যাবে। বাড়ির কলিংবেল বাজল। রাহেলা বিরক্ত মুখে এগিয়ে গেল। দরজা খুলেই আরহানকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “ভাইজান আপনে?”
আরহানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর,
“ফাবিহা কোথায় রাহেলা?”
“আপায় তো অতিথি নিবাসে।”
আর দাঁড়াল না আরহান। তক্ষৎণাৎ ছুট লাগাল অতিথি নিবাসের দিকে। রাহেলা বোধহয় বুঝতে পারল ব্যাপারটা। একা মনে বলল, “দেখছেন আপা, চাচায় সত্যিই সত্যিই আপনার বিয়া ঠিক করল। তয় তিনডা পোলার লগে না একটা পোলার লগে।”
খটখট শব্দে হেঁসে উঠল রাহেলা। ঘরে ভিতর যেতে যেতে শুধাল, “চাচা আমার কি বিয়ে হবে না?”
••••••••••••
আচমকাই অতিথি নিবাসের কপাটটা তীব্র শব্দে খুলে গেল। বাড়ির পিছনের বারান্দায় বসে থাকা ফাবিহা ঘাবড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। আরহান উত্তেজিত কণ্ঠ নিয়ে বলল, “রৌদ্রময়ী।”
ফাবিহা থমথমে পায়ে এগিয়ে আসলো। এটা তো আরহানের কণ্ঠ। অতঃপর দীর্ঘ পনের দিন পর একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ হলো আরহান আর ফাবিহা। ফাবিহা বলল, “আরহান আপনি?”
আরহান কিছুই বলল না। সে তক্ষৎণাৎ ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ফাবিহাকে। ফাবিহা হতভাগ। আরহান বলল, “আমি দুঃখিত রৌদ্রময়ী, আমি দুঃখিত।”
ফাবিহা কিছু বলে না। আরহান বলে,
“আমাকে ক্ষমা করবেন তো?”
“কবেই করে দিয়েছি। যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ক্ষমাও করা যায়।”
আরহান কপালে কপাল ঠেকাল ফাবিহার। ফাবিহা চোখ বন্ধ করে নিল। আরহান বলল,
“ভীষণ ভালোবাসি আপনায়।”
“আমিও।”
অতঃপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার মাধ্যমে মিলন ঘটল আরহান আর ফাবিহার। সময়টা তখন বিকেলের ছুঁই ছুঁই। আকাশটা ভীষণ সুন্দর। নীলময়। বাতাসের ধাক্কায় নিবাসের কপাট যায় আঁটকে। বাড়ির দেয়াল জুড়ে জ্বলজ্বল করে একটি নাম— "অতিথি নিবাস। অতিথির ছোঁয়ায় এসে ভালোবাসা দিয়ে যাওয়ার নিবাস। অতিথি নিবাস।”
.
.
.
সমাপ্ত.......................................................................