কঠিন হ্যাং-ওভারের জন্য মাথাটা তখনো ভার ভার হয়ে আছে। চোখ মেলে তাকালেও অসহ্য মাথাব্যথার জন্য স্থির থাকতে পারছে না। দু'হাতে মাথার চুল খামচে আরো কিছুক্ষণ নিজের সাথে খামটি চালাল তিন ব্যক্তি। এরপরই কানে সরাসরি বিদ্ধ করল ইস্পাতের মতো শক্ত, অটল, নিরুদ্বেগ গলার গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠস্বর,
- লেমনোয়েডটা খেয়ে নিন জেন্টেলম্যান্স। চেষ্টা করবেন এতেই যেন আপনাদের সুদুরপ্রসারী কাজ হয়। আর না হলে যেই অ্যানাদার পন্থাটা আপনাদের উপর প্রসিকিউট করা হবে, সেটা আপনারা নিতে পারবেন না।
পায়ের উপর পা তুলে এলিট শ্রেণীর একজন ভদ্রলোকের মতো বসে আছে সুদর্শন গম্ভীর পুরুষটি। সাদা মখমলি কাপড়ের গদি বসানো সোফাটায় তার পুরুষ্ট বাঁ হাত রেখেছে সোফার বামদিকের হ্যান্ডেলটার উপর। ডানহাতের কনুইটা সোফার ডানদিকের হ্যান্ডেলটায় ঠেকা দিয়ে হাতটা ঠোঁটের কাছে ভাবুক ভঙ্গিতে রাখা। যেন হিংস্রসুলভ চোখদুটো দিয়ে ভেবে চলেছে কীভাবে এদের সাথে ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করা যায়। সোফার ঠিক উলটোদিকে, টানটান বিছানায় সদ্য হাতমুখ ধোয়া হাসিব, তপন ও শিহাব বসা। কালরাতের পোশাক কোনোরকমে বদলে টিশার্ট, ট্রাউজার পরে নিয়েছে তারা। হাসিব হাত বাড়িয়ে লেবুর ঘোলাটে পানির গ্লাসটা নিঃশব্দে তুলে নিল হাতে। এরপর একে একে তার ডানদিক থেকে আফিদের হাত এবং বামদিক থেকে শিহাবও চোখ লাল করা দৃষ্টিতে কাঁচের গ্লাসটা তুলে নেয় সাদরে। খোলা জানালা দিয়ে আসা একফালি সোনা রোদ গ্রিলের ভাঁজে ভাঁজে কাঠের টি টেবিলের উপর পরেছে। সারা ঘরময় এক অসহ্য নীরবতা ছেয়ে থাকলেও ' ঢকঢক ' পানি গেলার শব্দগুলো অনুরণিত হলো। একটা মৃদু ঢেঁকুরের শব্দে নীরব, স্তব্ধ অবস্থা কিছুটা ছিন্ন হলে এবার ঠোঁটের উপর থেকে হাত সরালো জুনায়েদ সাঈদ। গলাটা একটু স্বাভাবিক করে আলোচ্য ব্যাপারে কথা বলল সে,
- আপনারা সবার কাছে বিশ্রীভাবে ধরা খেয়েছেন। ধরাটা আমি-ই আপনাদের খাইয়েছি। কেন খাইয়েছি সেটার ব্যাখ্যা মনে হয় না নার্সারী শিশুদের মতো ভেঙে ভেঙে এখন বোঝাতে হবে। হ্যাংওভার কাটিয়ে যাদের কাছে মাফ চাওয়া দরকার, ভদ্রভাবে সেটা চেয়ে আসবেন। গাফিলতি দেখাবেন না একদম।
লজ্জায়, কুণ্ঠায়, বিব্রত হয়ে মাথানত করে রেখেছে তিনমূর্তি। এরকম একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা কাল ঘটবে এটা তারাও মূলত চায়নি। মান-সম্মান বলতে যেটুকু ছিল সেটাও পানির সাথে মিশে গেছে। বন্ধু দীপের সামনে কী মুখ নিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। একটু থেমে আবারও নিজের চিরচেনা ভূমিকাটা পালন করল জুনায়েদ সাঈদ,
- হাসিব সাহেব, আপনার বাবা নিশ্চয়ই আপনাকে মাতলামো করার জন্য আটদিনের ছুটি মন্ঞ্জুর করেননি। যদি আপনার বাবা হাবিব ইকবাল জানতে পারেন, আপনি এখানে কী লীলাটা দেখিয়েছেন, আমার মনে হয় না ‘ডিজিএম’ পদের চেয়ারটা আপনার জন্য ফাঁকা থাকবে।
হাসিব ইকবালের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল আরো। সূঁই দিয়ে বেলুনের টানটান চামড়ায় কে যেন ফাজলামি করে ফট্টাশ করে টাটকা বেলুনটা ফাটিয়ে দিয়েছে। ডানহাতে শূন্য গ্লাসটা নাড়াচাড়া করতেই সামনে রাখা টি টেবিলে গ্লাসটা রাখতে রাখতে বলল,
- সাঈদ সাহেব, কালকের ব্যপারটা নিয়ে..
হঠাৎ তীব্র কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরটা হাসিবকে চটান শুধরে দিয়ে বলল,
- অ্যাড্রেস ইট 'ভাই'। আমি আপনার বন্ধু সরফরাজ দীপের বড়ো। আপনাদেরও বড়ো। স্টে ফর্মাল উইথ মি।
হাসিব অপ্রত্যাশিত কুণ্ঠায় আরো মিইয়ে যেয়ে আমতা আমতা সুরে বলল,
- জজ্বী. . ভাই। আমি কালকের ব্যাপারটা নিয়ে নিজেও খুব লজ্জা ফিল করছি। এভাবে ওয়েডিং অকেশনে ব্যাপারটা ঘটে যাবে এটা আমরা কেউই জানতাম না। আমরা কখনো এতোটা হেভি ড্রিং° ক করি না যে মা° তাল হয়ে পুরোপুরি আউট হয়ে যাব। কাল যে কি থেকে কি হয়েছে, স্টিল কান্ট ফিগার আউট। স্যরি ভাই।
হাসিবের কথায় মনে মনে একটু সাহস পেয়ে আফিদও একটু অনুযোগ করে বলল,
- আমরা আসলে ব্যাচেলার পার্টি করতে চেয়েছিলাম। দীপের বাবা, দুলাল আঙ্কেল আমাদের পারমিশন দেননি। এদিকে আমরাও সবসময় ফ্রেন্ড-কলিগদের যেকোনো অকেশনে ড্রি° ঙ্ক করে এসেছি, ব্যাপারটা আমাদের জন্য পুরোপুরি নরমাল। তাই কালকের মতো ব্যস্ততা পেয়ে আমরাও আর লোভ সামলাতে পারিনি। জাস্ট একটু ‘আমরা-আমরা’ স্টাইলে এনজয় করতে চেয়েছিলাম। এছাড়া আর কিছু নয় ভাই।
দু'জনের কথা শেষ হতেই ভেতরে ভেতরে আকাশসম অস্বস্তি চেপে এই প্রথম মুখ খুলল শিহাব। সামনে বসা লোকটি বয়সের কোঠায় গুণে গুণে বেশ বড়ো হলেও আচরণটা খুবই মার্জিত এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। একজন কায়দাবাজ পুরুষের মতো প্রত্যেককে সে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে, যেটা অকাট্য প্রশংসার দাবীদার। এটুকু ব্যাপারে শিহাবও কিছুটা দোনোমনা ছেড়ে কালকের সমস্ত ঘটনা লাইনে লাইনে বুঝিয়ে বলল,
- ড্রিঙ্কের জন্য আমিই সবাইকে প্রেশারাইজ করেছি ভাই। আই নিড অ্যা° লকো° হল টু ফুলফিল মাই থ্রাস্ট। বাংলাদেশে এসব জিনিস নীচুচোখে দেখা হয় আর এটা এখানে অ্যালাউ না। কালকের মতো ব্যস্ততা সবার মধ্যে থাকবে না জেনেই পিসফুলি একটু ড্রি° ঙ্ক করতে চেয়েছিলাম। আই অ্যাকসেপ্ট মাই ফল্ট। অলসো ফিলিং স্যরি লাইক দেম।
পরপর তিনজনের মুখ থেকে সহজ অক্ষুন্ন স্বীকারোক্তি শুনে গম্ভীরভাবে শ্বাস ছাড়ল সাঈদ। তিনজন নিজেদের ব্যাপারটা নিজ নিজ বিবেকের দংশনে বুঝতে পেরেছে এটাই তার মূখ্য কাম্য। যা ঘটে গেছে তা যেহেতু এখন আগের মতো বদলানো যাবে না, তাই আপাত পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে সে বলল,
- নীচে সবাই খেতে বসেছে। এই ফাঁকে আপনারা নীচে যেয়ে সবার সামনে ম্যাটারটা স্যাটেল ডাউন করবেন। কোনো গ্রাজ রাখবেন না মনে। আমি এখানে রিভেন্ঞ্জ কম্পিটিশনে খেলতে নামিনি। যা বলেছি, যেভাবে বলেছি সেভাবে যদি করেন, কালকের ইন্সিডেন্টটা কারো কাছে পৌঁছাতে দেব না। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার জেন্টেলম্যান্স?
কাঁচুমাচু মুখটা নিয়ে তিনজনই একইসাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি বোঝাল। তারা কেউ চায় না বিশ্রী একটা ঘটনা পরিবার, পেশা, অন্য অবধি পৌঁছাক। এমন সময় চাপানো দরজার বাইরে থেকে 'ঠকঠক' কড়া নেড়ে প্রবেশ করল লাবিব। চোখের চাহনি দিয়ে সুক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত বুঝিয়ে এবার বাকিদের উদ্দেশ্যে সেও কিছুটা বলে উঠল,
- তোমাদের তিনজনকে নীচে ডাকা হয়েছে যাও। খেতে যাও। আজগর জেঠা কী বলতে চান সেটাও শুনে আসবে। কাল তোমরা যে যে কীর্তি করেছ সেটা কীভাবে মিটমাট করা যায়, সেটা নিজেরা নিজেরা ঠিক করে নাও। সম্ভবত তোমাদের বন্ধু আপসেট হয়ে আছে। সেটাও সলভ্ করে নিয়ো। যাও।
লাবিবের কথায় চুপচাপ তিনমূর্তি বিছানা ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এতোদিন যেই হৈ-হুল্লোড় আর ঠাট্টা-তামাশার হিড়িকটা ছিল, তা গতকালকের ঘটনায় একদম চুপটি হয়ে গেছে। ভালো হয়েছে। যদিও লাবিব প্রথম প্রথম চায়নি সাঈদ ওদের রুফটপ থেকে ওরকম করে সাহায্য করুক। এখন বুঝতে পেরেছে কেন তার চতুর বন্ধুটা এমন একটা চাল চেলেছে। যেখানে অবশ্য লাঠিও ভাঙেনি, সাপও মরেনি, শিক্ষা হয়ে গেছে সবগুলোর। লাবিব দরজাটা চাপিয়ে এসে ধপ করে বিছানার উপর বসলো। সামনের টি-টেবিলের উপর নিষ্পলক দৃষ্টি তাক করে বুকভরা দমটা ছাড়তে ছাড়তে বলল,
- সন্ধ্যায় দেখছি তোর ভাই বিরাট আয়োজন করেছে। ডিজে-ফিজে ডেকে বাম্পার আয়োজন। পাশের খোলা প্লটে বেশ ডেকোরেট করা চলছে। সন্ধ্যায় রিসেপশন পার্টির জন্য রেডি থাকিস।
কথার মর্মার্থ কিছুটা বুঝতে পারলেও ব্যাপারটা তখনো সাঈদের কাছে ঝাপসা। সে নিজের কাজে এতোটা বেশি মগ্ন ছিল যে সন্ধ্যের বিষয়টা তার কাছে অনেকটাই অজানা। এ নিয়ে কৌতুহলপ্রবণ মনটা সরাসরি প্রশ্ন করল তাকে,
- আমার আয়োজন সম্পর্কে কিছু জানা নেই লাবিব। কী ব্যাপারে বলতে চাচ্ছিস খুলে বল্।
- খোলাখুলির কিছুই নেই এখানে। যা আছে সব ফকফকা। সন্ধ্যায় সব একপ্রকার রিসেপশনে যুক্ত হচ্ছে, সেখানে তুইও আসছিস ব্যস্। নিজেকে কষ্ট করে ইজি কর। বারবার একই ডায়লগ দিতে মন চায় না।
- যেটা পারব না, সেটা নিয়ে জোড়াজুড়ি করাও ঠিক না। যদি মন চায় আসব, না চাইলে নেই। আমি ওসব পরিবেশে
- হ্যাঁ, মানাতে পারিস না জানি। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি একদম ভিন্ন। এমনিই মেয়েটা গতকালকের ঘটনা নিয়ে ছোটোখাটো ট্রমার ভেতর থাকতে পারে। সমস্যা হচ্ছে বাইরে থেকে ব্যাপারটা তোকে-আমাকে একদমই বুঝতে দিতে চাচ্ছে না। এটা-ওটা করে মাইন্ড ডাইভার্টের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি ওর সাইকোলজি প্যাটার্নটা এখন কেমন। ওদিকটা বিবেচনা করে আজকের মতো শেষ ফাংশনটা সুন্দরভাবে কাটানো উচিত। নিজের জন্য না, অন্যের জন্য কাটা।
স্বল্প পরিসরে কথাগুলো বুঝিয়ে দিয়ে লাবিব সেখান থেকে উঠে যায়। আর মনে হয় না টুকরো টুকরো করে বোঝাতে হবে বন্ধু সাঈদকে। নীচে ওই তিনজন কীরকম পরিস্থিতি সামলাচ্ছে সেটা দেখার জন্য বেরিয়ে যায় লাবিব। এদিকে সাঈদ দোটানার ভেতর যুঝতে যুঝতে একপর্যায়ে কিছু একটা ভেবে নেয় মনে। বসা থেকে চট করে দাঁড়িয়ে দ্রুততার সহিত মোবাইল, ওয়ালেট এবং গাড়ির রিমোটটা নিয়ে তাড়াহুড়োতে বেরিয়ে যায়।
•••••••••••••••
রুমের দরজা চাপিয়ে রাখলেও বারবার কেউ না কেউ এসে প্রাইভেসিটা ক্ষুণ্ণ করে। বিছানা ঝেড়ে আরাম করে একটু ঘুমোতে গেলে খট্টাশ করে খুলে ফেলে দরজাটা। এরপর এটা-ওটা জিনিস আনা নেওয়া করে দরজাটা হাঁ করে ওভাবেই খুলে রেখে যায়। এভাবে কী একটু বিশ্রাম নেওয়া সম্ভব? সবে ফাহাদের দেওয়া ঔষুধটা খেয়ে ঘুমোতে চেয়েছিল ফিহা। কিন্তু মানুষের মধ্যে নূন্যতম মনুষ্যত্বের এমন করুণ অবস্থা দেখে আর ঘুমোতে পারল না। কানের ব্যথাটা আবারও একটু একটু করে ফিরে আসছে। ভুল করেও সেখানে আঙুল স্পর্শ করা যায় না। কিন্ঞ্চিৎ যদি ছোঁয়া লাগে, তাহলে মনে হয় রূহটা বুঝি ওর বেরিয়েই গেল! জ্বালাময়ী এক যন্ত্রণা সহ্য করে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল পাশের বাড়ির শৈলী আন্টিদের ওখানে চলে যাবে। আপাতত ওই বাড়িতে মেহমানের গিজগিজ অবস্থা বলতে প্রায় শূন্য, আর সবাই এখন এখানে ভিড় জমিয়ে মাছির মতো ভনভন করে যাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে মোবাইল ফোনটা নিয়ে সরাসরি নিচতলার সেই রান্নাঘরটার ওখানে হাজির হয় ফিহা। ভেতরে দুই খালামণির পাশে মাকেও সঙ্গে কাটাকুটি করতে দেখে ফিহা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলল,
- মা? মা শোনো, আমি শৈলী আন্টিদের ওখানে যাই? এখানে প্রচুর হৈচৈ হচ্ছে আর রুমেও আমি শান্তিমতো বিশ্রাম নিতে পারছি না। আমার প্রচুর অসহ্য লাগছে। আমি শৈলী আন্টিদের ওখানে গেলে সমস্যা হবে কোনো?
বটিতে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে গিয়ে মুখ তুললেন নাজনীন। মেয়ে দরজার ত্রিসীমানায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ি শৈলী আপাদের ওখানে যেতে চাইছে। কালরাতে কোথায় পরে গিয়ে যে কানের অমন দুর্দশাটা করল, এটা নিয়ে এখনো মেয়ের প্রতি বেশ রাগ রাগ ভাব আছে তার। আবারও পেঁয়াজের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে প্রত্যুত্তর করলেন তিনি,
- নিজে নিজে তো পুরো দুনিয়া উলটে ফেলছ, এখন আমার কাছে ঢঙ দেখাতে আসছ কেন? যা খুশি তাই করো গে, আমি কি বলার কেউ? যাও এদিক থেকে তুমি। বিরক্ত করবে না কাজের সময়।
মাকে 'তুই' থেকে অন্য সম্বোধন করতে দেখে মুখটা প্রায় অসহায়ের মতো করে ফেলে ফিহা। আর কতো ঝামেলা পোহাবে বাবা? এমনিতে কী তার ছোট্ট সরল জীবনটাতে কম যন্ত্রণা হচ্ছে? রাতভর কানের অসহ্যকর টনটনে ব্যথায় চমকে চমকে উঠেছে, আর এর মধ্যে মায়ের ক্রোধপূর্ণ অভিমান। ফিহা মুখ তুলে শেষ আশা হিসেবে আফসানার দিকে বিষণ্ণমুখো চাহনিতেই চাইল। চোখে চোখে যেন বুঝিয়ে বলল, তোমার বোনকে একটু সামলে দাও। আমি আর নিতে পারছি না খালামণি। আফসানা চুলার কাছে সেমাই নাড়ানো বাদ দিয়ে সেকেন্ডের ভেতর এক হুংকার ছেড়ে বললেন,
- সমস্যা কী নাজু? মেয়ে কি বলছে শুনতে পাস না? ও শৈলী আপাদের ওখানে যেতে চাচ্ছে এখানে সমস্যা কোথায়? থম মেরে বসে আছিস কেন? জবাব দে।
- আপা, ওর ব্যাপার নিয়ে তুমি কিছু বোলো না। সারাদিন টইটই করে সারা দুনিয়া চষে খাবে আর ব্যথা-ট্যথা পেলে খবর হবে মায়ের, এ কেমন ফাজলামো? হাঁটতে গিয়ে নাকি অন্ধের মতো পরে যায়, বাঁকানের ঝুমকো বেঁকে কান কাটে, হাঁটু ছিলে, এগুলো কী গা জ্বালানো কথা না? সহ্য হবে এগুলো শুনলে? নতুন ওড়নাটা কিনে দিয়েছ, সেটা পর্যন্ত কোথায় ফাসিয়ে ছিঁড়ে এনেছে! এতো দামড়ি মেয়ে এখনো উশৃঙ্খল কাণ্ড করে বেড়ালে রাগ উঠবে না?
মনের ঝাঁজ মিটিয়ে কথাগুলো বলে উঠলেন নাজনীন মিলা। মেয়ের দুরন্তপণায় তিনি যে রীতিমতো বিরক্ত এবং অসহিষ্ণু হয়ে গিয়েছেন, তাই যেন বাক্যে বাক্যে স্ফুলিঙ্গের মতো ঝলসে উঠেছে। রান্নাঘরে থাকা বাকি মহিলারাও সামান্য একটু খুঁত পেয়ে বেশ মান্ঞ্জা মেরে কথা জমাতে শুরু করেছেন। আফসানা সবার চেহারা এক এক করে দেখে নিতেই দরজায় দাঁড়ানো ফিহার দিকে ছোট্ট ইশারায় বোঝালেন, ' তুই যা ওখানে। একদম মন খারাপ করবি না তুই। আমি তোর মাকে দেখছি। যা! '। রান্নাঘরের চৌকাঠ ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে দীপদের ত্রিসীমানা পেরিয়ে ডানের শৈলী আন্টিদের সেখানে প্রবেশ করে ফিহা।
••••••••••••••
ছোটো ছোটো দুটো ছেলে বাচ্চা নিয়ে দোতলা সুন্দর নান্দনিক বাড়িটায় থাকে শৈলী। স্বামী চাকরীর সুবাদে মালয়েশিয়া থাকায় গাজীপুরের এই ছিমছাম, ঠান্ডা, শব্দহীন এলাকাটা বেছে নিয়েছেন তিনি। ফুটফুটে সাদা রঙে শোভিত সুন্দর বাড়িটার প্রশস্ত বারান্দাটা ঘুরে দেখল ফিহা। বারান্দার ঠিক নীচেই ফুলে ফুলে সজ্জিত বাহারি রঙের মন মাতানো ফুলের বাগান। মুক্ত বাতাসের সাথে টাটকা, মনোরম গোলাপফুলের মন সম্মোহন করা সুগন্ধি সুভাষে জায়গাটা ভীষণ ভালো লেগে গেল। কী অপার শান্তি! কী অদ্ভুত মন জাগানো ভুলো ভুলো সুখ! শৈলী আন্টির দেওয়া গরম ধোঁয়া উঠা চা-টুকু বড্ড শ্রান্তি, বড্ড তৃপ্তি জোগাল মনের কোণে। ফোমের তুলতুলে বেডে বসে কাপের শেষ তলানিটুকু একচুমুকে খালি করতেই বাঁদিকে থাকা বেডসাইড টেবিলে ওটা রেখে দিল। ফলের খোলস ছাড়াতে কখনো আঙুল, কখনো ছুরি, কখনো ধারালো বস্তুর ব্যবহার করে। নরম ফলের ক্ষেত্রে আঙুল দিয়ে একটু একটু করে কমলার খোসা ছাড়াতে হয়, কখনো ছুরি দিয়ে কেটে কেটে আসল ফলটুকু বুঝে নেয় মানুষ। কিন্তু যার মনের আব্রুটা শত শত পর্দার নীচে বহুবছর ধরে ঢেকে আছে, তার মনের নির্মোচনটুকু কী করে খুলে আনবে? কী করে দুর্গম মনের একেকটি অন্ধকার পথ উজ্জ্বল করবে ও? যে পথে কখনো কোনো নারী-মন অনুভূতির শিখা জ্বালায়নি, যেখানে কখনো আছড়ে পরেনি আবেগের ঝড়, কোনোদিন বেরোতে পারেনি স্বতন্ত্র গাম্ভীর্যের খোলস থেকে, এমন এক ব্যক্তির জীবনে সত্যিই কী ফাহাদ ভাইয়ের মতো নির্মোচন সম্ভব? বাবার পর এই একটিমাত্র বহিরাগত পুরুষ, যে পুরুষ সেদিন তার কাঁটা হাতে গ্যারেজের ভাঙা দরজা রুখে দিয়েছিল, শক্ত বাহুবলে ভুলবশত পরতে যাওয়া থেকে আঁটকে নিয়েছিল, তার চোখের চাহনি মুখের ভাষার চেয়েও অর্থবহুল, নমনীয়। তার ওই চওড়া কাঁধ, তার বুকের উষ্ণতাটুকু রোমে রোমে যেন টের পাচ্ছে ও। স্পষ্ট এখন মনে পরছে, সেদিন গাড়ির ভেতর ব্যাকসীটের কোণে থরথর করে কাঁপুনি দেওয়া জ্বরতপ্ত শরীরটা নিজের বুকের ওমে পূর্ণ করে ধরেছিল। সারাটা পথে একফোঁটাও বুঝতে দেয়নি কতটা লম্বা জার্নি শেষে খালামণির দুয়ারে পৌঁছেছে। দু'চোখ বন্ধ করে এবার জ্বরের ঘোরের সবটুকু লোপাট স্মৃতি মনে করতে পারল ফিহা। এও বুঝতে পারল, বিগত দু'দিনে যত যত ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ওই মানুষটার একাকী, নিজের, আপনার মূহুর্ত বলতে কিছুই নেই। সে যে কতটা অস্থিরপ্রবণ, উৎকণ্ঠিত, বারবার ওর মনের দুয়ারে কড়া নেড়ে শূন্যমুখে ফিরে ফিরে গেছে, তা যেন অস্থিতি চিত্তে বুঝতে পারল ও। হঠাৎ পিনপতন নীরবতার মাঝে তিনটে 'ঠক ঠক' মৃদু করাঘাত হলো। বুজে রাখা চোখদুটো মেলে তাকাতেই চিত্রার্পিতের মতো ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পরল ফিহা! বিস্ময়ের ধাক্কায় মুখ ছিঁটকে অস্ফুটে বেরুল,
- আপনি এখানে কেন?
সাদা রঙ করা কাঠের নকশাকার দরজাটা খুলে গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল দীর্ঘকায় নীরব পুরুষটি। গায়ে তার ডার্ক নেভি ব্লু রঙের টিশার্ট, জগিংয়ের কালো ফর্মাল ট্রাউজার পরা, সূর্যের তাপে গায়ের চামড়া কিছুটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। তবু কী যেন এক ভুবন দোলানো আকর্ষণ তার সুদেহী চলনে, আম্ভরিক মুখজুড়ে, ওই একরাশ ঠান্ডা নির্মল চাহনিতে, যেখানে খোদাই করা আছে তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের পৌরুষ। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ফিহার পেছনে থাকা বিছানায় ফেলল দু'খানা ব্যাগ। ফিহার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ব্যাগের চাইতে এখন সামনে দাঁড়ানো এই নীরবে অটল মানুষটার প্রতি। চোখ ছিঁটকে চলে গেল মানুষটার কপালের ওই ব্যান্ডেজ বসানো কোণে। ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ। এখনো খুলেনি সেটা। রঙ চটে গিয়ে ময়লা, বিবর্ণ দেখাচ্ছে। কখন যে দু'জনের ভেতরকার অল্প ফাঁকটুকু কমিয়ে নিয়েছে মানুষটা, তা বুঝতে পারেনি সপ্তদশী বিস্ময় বিমূঢ়া ফিহা। হাত বাড়িয়ে সেই বিমূঢ়ার রক্তিম কানের আশপাশ থেকে সমস্ত চুল সরিয়ে দিল আস্তে আস্তে। ফিহা অনুভব করল, তার সমস্ত সত্তাটা যেন আপন করে নিয়েই কানের কাছে মুখ নীচু করল মানুষটা। পরপর দু'বার, ধীরে ধীরে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিল সেই ব্যথাতুর কানের কাছটুকুতে। এই প্রথম কোনো ব্যাকুল পরশে প্রচণ্ড বিহ্বল হয়ে মিইয়ে রইল ফিহা। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্দুরের মতো সমস্ত শরীর, হাত-পা, মস্তিষ্কের ভেতর তীব্র ছটফটানি বয়ে গেল। গলার কাছে সবটুকু নিঃশ্বাস নিষ্ঠুরভাবে মতো আঁটকে রাখলে সেই জ্বরদগ্ধ দিনের মতোই মদির স্বরে ফিসফিসিয়ে উঠল মানুষটা,
- আমি অপেক্ষা করব নাবিলা। এমন করে সেজে আসবেন, যেন এই অধম মানুষটা শুধু আপনাকে দেখেই স্থির হয়ে যায়। আর কিছুই চাই না আমি, চাইবও না . . আসি।
মুখ সরিয়ে নিজের কবোষ্ণ অস্তিত্বটুকু নিঃশব্দে হটিয়ে প্রস্থান করল সাঈদ। যখন ফিহা খিচুনি চোখের কপাটদুটো মেলে তাকাল, তখন রুমে কেউ নেই। ফাঁকা। তিরতিরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বিছানার পানে ফেলতেই সেখানে থাকা ব্যাগদুটো উপুড় করে ধরল সে। মচমচ শব্দ করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অত্যাশ্চর্য কিছু জিনিস! পাতলা ঠোঁটের আগায় আস্তে আস্তে ফুটে উঠল রৌদ্র ঝলমলে টুকলো হাসি। দু'চোখ জুড়ে ছেয়ে রইল কৌতুহলী আশ্চর্য।
•••••••••••••
বারবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে অবাধ্য, বেয়াড়া, অভদ্র ছেলের কীর্তিকাহিনি দেখছেন। হাতঘড়িতে ষোল মিনিট তেঁতত্রিশ সেকেন্ড পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো আলোচ্য বিষয়ে কথা উত্থাপন করেনি এই চূড়ান্ত খারাপ ছেলে। ছেলের এই ধরণের অমানুষিক কর্মকাণ্ড দেখলে মেজাজ ভীষণ খিঁচড়ে আসে, তবু নিজেকে কড়া কমাণ্ডে সাবধান করেন ভদ্রলোক সোয়াদ। নিজের অস্তিত্ব আরো একবার জানান দিতেই গলাটা ইচ্ছে করে জোরে খাকারি দিয়ে উঠলেন। শব্দটা নিস্তব্ধ রুমে বিশ্রী একটা প্রতিধ্বনি তুলে থেমে গেল। অথচ, যার জন্য তিনি শক্তি খরচ করে গলার অবস্থা চৌদ্দটা বাজিয়ে খুশখুশে করলেন, সেই মহাপণ্ডিত ছেলে তাকে পাত্তাই না দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের কাছে তেমনি তৈরি হতে ব্যস্ত। কী নিষ্ঠুর নৃশংস অপমান! ঝট করে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে দু'হাত কোমরের কাছে বাঁধলেন এস জাকির। এক কদম এগিয়ে এসে আয়নার ভেতর দিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে শুধিয়ে উঠেন,
- আমাকে বিশেষ প্রয়োজনে ডাকা হয়েছিল?
আয়নায় ফুটে উঠা কট্টর প্রশ্নকর্তার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করল না সাঈদ। ইস্ত্রি করা কালো রঙের শার্টটা উন্মুক্ত দেহে গলিয়ে নিতেই পারফিউমের বোতলটা ডানহাতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
- মনে হচ্ছে ডাকা হয়েছিল।
পুরোদস্তুর এমন ত্যাড়া ধরণের কথা শুনে ভ্রুঁদুটো কোঁচকালেন সোয়াদ। ধৈর্যটা আবারও প্রাণপণ সংযত করে শান্তসুরেই বলে উঠেন,
- সতের মিনিট যাবৎ আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছ। তোমার প্রতি কী বিরক্ত হওয়া উচিত না?
- আমার প্রতি আপনি জন্ম থেকেই বিরক্ত। নতুন করে বিরক্ত হওয়ার টপিক এখানে আসে না।
- তুমি কিন্তু আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে চলছ। ভালো করেই জানো তোমার এই ধরণের কথাবার্তা আমার মোটেই পছন্দ না।
- আপনার পছন্দ-অপছন্দ শুনে আমার কিছুই যায় আসে না। ধৈর্যের পরীক্ষা আপনার সেনানিবাসে দিবেন। আপনাকে যে কারণে ডাকা হয়েছে সেটা শুনে রাখুন। আপনি কীভাবে কী করবেন জানি না, আপনি আজই মার সাথে আলোচনা করে ছোটো আংকেলের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবেন। প্রস্তাবটা নাবিলা হকের জন্য। প্রস্তাবের সারাংশের হবে এই— কোনোপ্রকার যৌতুক মানা হবে না, বিয়েতে বখশিশও দেওয়া চলবে না, যতদিন ইচ্ছা ততদিন মেয়ের পড়ার স্বাধীনতা থাকবে, পড়াশোনা নিয়ে মেয়ের ইচ্ছা ব্যতীত অন্যকোনো ব্যক্তি, এমনকি আমিও আঙুল তুলতে যাব না। উনার দুই মেয়ের পড়াশোনার জন্য যে আর্থিক সংকটের ব্যাপারটা সামনে আসবে, সেটা আমি নিজ কাঁধে তুলে নিতে রাজি। কিন্তু এ কথাও স্পষ্ট করে বলে দিবেন, আমি কোনোদিনও ঘরজামাই হতে রাজি না। যদি ঘরজামাই বানানোর ইচ্ছে থাকে, সেটা বড়োটাকে দিয়ে বানাতে বলবেন। আপনার আঠার মিনিট খরচ করার পেছনে এই কারণই ছিল, এখন আপনি দায়িত্ব পালনে যেতে পারেন। যান।
সম্পূর্ণ কথা শুনতে শুনতে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেছে ভদ্রলোকের। ঘোর ধাক্কায় কখন যে কোমরের কাছ থেকে হাতদুটো আলগা হয়ে এসেছে তা নিজেও বলতে পারেন না। দু'কানে যা শুনল সব কী ঠিকঠাক, নির্ভুল, সত্য শুনেছে? গলাটা কাঠ কাঠ হয়ে গেছে ছেলের অমৃত বাক্য শুনে। হ্যাঁ, এই বাক্যই তো শুনতে চেয়েছিলেন তিনি! কিন্তু, তা এভাবে তো নয়। চরম আশ্চর্য হয়ে ভোম্বল দাসের মতো দরজার দিকে হাঁটা দিলেন সোয়াদ। হঠাৎ মুখটা পিছু ফিরিয়ে তুমুল উত্তেজনার স্বরে বলে উঠলেন,
- তুমি নাটক করছ না তো? যা বলেছ সব সত্যি? নিয়াজের মেয়েকে নিশ্চিত বিয়ে করবে?
বিরক্তি মাখা মুখটা বাঁয়ে ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল সাঈদ,
- আমাকে দেখে কী আপনার নাটক বলে মনে হচ্ছে?
সোয়াদ জাকির দ্রুত নিজেকে প্রস্তুত করে ছেলের সামনে সুউচ্চ অহং ফুটিয়ে বললেন,
- ঠিকআছে, ঠিকআছে বুঝেছি। আমি আজই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব। ভদ্রলোক বিষয়টা কেমন ভাবে নিবেন কে জানে। তোমাকে দিয়ে যদি সুশীলা গুণসম্পন্ন একটি মেয়ে আমার বাড়িতে আসে, তবে সেক্ষেত্রে কথা বলতে আপত্তি দেখছি না। কথা বলব।
- জ্বী। কথাটা এমনভাবেই বলবেন যেন আপনার প্রস্তাবটা তিনি ফিরিয়ে দিতে না পারেন। অলরেডি আপনার নিয়াজ সাহেব ‘বিসিএস ক্যাডারের মতো সুপাত্রের প্রস্তাব দু'দুবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাই—কথাবার্তায় সাবধান।
ছেলের ছোট্ট ইঙ্গিতে সজাগ হয়ে মনে মনে প্রস্তাবটা সাজাতে লাগলেন সোয়াদ। না না, প্রস্তাব উলটো পায়ে ফিরে আসবে কেন? কোন দুঃখে? যদিও তিনি আজ পর্যন্ত এমন কোনো কাজ করেননি, যেখানে সাফল্য ছাড়া অন্যকিছু এসেছে। তবু যদি হিতে বিপরীত হয়? এই প্রথমবার ভদ্রলোকের দুর্ধর্ষ-সাহসী কলিজাটা ভীতু সৈনিকের মতো চিপ মেরে রইল!
••••••••••••
সন্ধ্যা সাতটার ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে অনেকক্ষণ হলো। আকাশের কালো কুচকুচে অন্ধকার ঘনানো ঝাঁপিতে দুষ্টু দুষ্টু চোখে উঁকি দিচ্ছে নক্ষত্র। এখনো গাঢ় বেগুণির ছাঁচটা আকাশ থেকে পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। কড়া লাইটিংয়ের চমৎকার সুসজ্জায় মাঠখোলা প্লটটা এখন দারুণ দেখাচ্ছে! দলে দলে সেখানে সেজেগুজে ঢুকে পরছে আত্মীয়, মেহমান, প্রতিবেশীর দল। এবার যেন প্রচণ্ড বেশি বিরক্ত হয়েই পকেট থেকে সেলফোনটা বের করল সাঈদ। কলের জন্য ডায়ালে বসাতেই পাশ থেকে লাবিব হাসতে হাসতে একটা খোঁ° চা মারল,
- মেয়ে মানুষের লেট কী জিনিস এবার তুই বুঝবি শা° লা! এতোদিন খালি ছোঁয়ার ম্যাটারে শুধু শুধু দুষলি না? আজকে বুঝবি।
লাবিব নিজের বাগদত্তা ছোঁয়াকে নিয়ে ছোট্ট একটা তামাশা করলে ফাহাদও এবার আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বলল,
- কাকু, তোমার ট্রাউজারের ঘটনা কি মনে আছে? কোনদিক দিয়ে খুলে জানি কোন সাইড দিয়ে পরে গেছিল! মনে আছে না?
- হপ্ ব্যাটা, চুপ কর! কীসের মধ্যে কী লাগাস? তোকে আমি বলছি ওই টপিকে খুঁচায় খুঁচায় কথা বের করতে?
- তোর কপালটা আসলেই ভালো রে লাইব্বা! ওইদিন যদি নরমাল স্যান্ডেল না পরে খটখটা মার্কা জুতা পরতাম, তোর অবস্থা আজকে ল্যাং° ড়া ফাহিমের মতো প° ঙ্গু প° ঙ্গু হতো।
- ছিঃ! এখনো টিনেজ পোলাপানদের মতো আচরণ করোস। লজ্জা তো আগে থেকেই নেই, এখন আরো দুই ডিগ্রী বেশি বাড়ছোস।
- মেডিকেল লাইনে না° ঙ্গু কঙ্কাল নিয়ে যতবার থিসিস লিখছি, ততবার আইএসএসবি এক্সামও তুই দেস নাই। বুঝছস হিসাব?
তৎক্ষণাৎ লাবিব অবাক হয়ে ফাহাদের দিকে শুধাল,
- না° ঙ্গু কী?
দুই বন্ধুর যুক্তি ছাড়া কথায় ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড হাসি পেলেও সাঈদ তখন কল দিতেই মহাব্যস্ত। সাতটা পনেরো বেজে গেল এখনো কেন আসছে না? কলটা তো অন্তত ধরবে? অন্যদিকে ফাহাদ বিজ্ঞবান ডাক্তারের মতো দু'হাত বুকে ভাঁজ করে বলল,
- যেটা বলছিস ওটার লাস্টে প° ঙ্গু অ্যাডজাস্ট কর। তারপর বুঝবি কী মিনিং।
ফাহাদের ওই ক্লু পেয়ে ফট করে ব্যাপারটা বলে উঠল লাবিব,
- না° ঙ্গু প° ঙ্গু? মানে ক্যাকলাস ক°ঙ্কা° ল?
ফোনটা কানে চেপেই এবার ওদের দিকে তাকাল সাঈদ। দু'জনের উদ্দেশ্যেই কিছুটা মেজাজ তপ্ত করে বলল,
- দেরি হচ্ছে ভালো কথা, কলটা তো রিসিভ করবে? কল ধরছে না কেন? একটা দুটো কল দিয়েছি এই দশ মিনিটের মধ্যে? লাবিব, উপরে গিয়ে চেক দিয়ে আয় তো। অসহ্য লাগছে এখন! মেজাজটা . . .
ডায়ালকৃত ফোনটা কানে চাপা অবস্থাতেই আকস্মিকভাবে মুখের কথা আঁটকে গেছে তার। অখণ্ড আইসবার্গের মতো নিস্পন্দ হয়ে সামনেই দু'চোখ স্থির করে ফেলল সাঈদ! তার অপ্রত্যাশিত এমন অদ্ভুত আচরণে তৎক্ষণাৎ লাবিব আর ফাহাদ সেই দৃষ্টি লক্ষ করে সামনের পানে তাকাল। অবিশ্বাস্য চোখে চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলল দুই বন্ধু! তৎক্ষণাৎ একে অন্যের দিকে জুলজুল চাহনি বিনিময় করতেই আবারও ওরা অবাক-বিস্ময়ে সামনের দিকে মিটিমিটি হাসিতে তাকিয়ে রইল। যা দেখছে, তা সত্যি দেখছে তো? এবার কি স্থির থাকতে পারবে তাদের বন্ধু?
••••••••••••
ডায়ালকৃত ফোনটা কানে চাপা অবস্থায় আকস্মিকভাবে মুখের কথা আঁটকে গেল তার। অখণ্ড আইসবার্গের মতো নিস্পন্দ হয়ে সামনেই দু'চোখ স্থির করে ফেলল সাঈদ! তার অপ্রত্যাশিত এমন অদ্ভুত আচরণে তৎক্ষণাৎ লাবিব আর ফাহাদ সেই দৃষ্টি লক্ষ করে সামনের পানে তাকাল। অবিশ্বাস্য চোখে চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলল দুই বন্ধু! কী দেখছে তারা! তৎক্ষণাৎ একে অন্যের দিকে জুলজুল চাহনি বিনিময় করতেই আবারও তারা অবাক-বিস্ময়ে সামনের দিকে মিটিমিটি হাসিতে তাকিয়ে রইল। যা দেখছে, তা সত্যি দেখছে তো? এবার কি স্থির থাকতে পারবে তাদের বন্ধু? কানের কাছ থেকে স্লো মোশনে কখন যে হাতের ফোনটা নীচে নেমে গেছে সেদিকে হুঁশ নেই সাঈদের। লাইটের ফর্সা আলোয় দূর থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে সিল্কের কালো অন্ধকার রঙা শাড়িটি। কালো আব্রুর পরতে পরতে ফুটে উঠেছে বিপজ্জনক সৌন্দর্যের আশ্চর্য কঠিন উদাহরণ। চিন্তাও করেনি সাদামাটা বেশে ঘুরঘুর করা মেয়েটি আজকের এই সন্ধ্যাসজ্জায় তার মন, তার মস্তিষ্ক, তার দু'চোখের দৃষ্টিটুকু হরণ করে ফেলবে। লাবিব আস্তে করে ফাহাদের ডান হাতে ধাক্কা মেরে বলল,
- চল এখান থেকে। বিরিয়ানীর ভেতর দুষ্টু এলাচি হওয়ার দরকার নেই। স্পেস দিতে হবে।
ফাহাদ মৃদু ইঙ্গিতটা বুঝেও কেন জানি সরতে ইচ্ছে দেখাল না। জুনায়েদ সাঈদের মতো পাষণ্ড গোছের রোবট বন্ধুটা কীরকম প্রতিক্রিয়া দেয় সেটাই দেখার জন্য মন প্রচণ্ড আঁকুপাকুঁ করছিল। কিন্তু লাবিবের ওমন কঠিন তীব্র চাহনি দেখে ফাহাদ না পেরে অপ্রস্তুত হেসে বলল,
- আরে ব্যাটা যাচ্ছি তো। মশার মতো কানের কাছে ভনভনানি দিস না। চল, আস্তে আস্তে হাঁটা দে।
দুই বন্ধু নিঃশব্দে সেখান থেকে কেটে পড়ল ধীরেসুস্থে। বুঝতেও দিল না কখন, কোনদিক দিয়ে সটকে পরেছে তারা। প্রবাসী বাড়ির জনহীন প্রাঙ্গণে ওই একটিমাত্র নারীমূতির পদাঙ্ক, পদশব্দের তালে তালে হিলজুতোর ঠক্ ঠক্ করা দাম্ভিক শব্দতরঙ্গ হচ্ছে, সেই শব্দতরঙ্গের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মিষ্টি সুগন্ধি ফুলের সুভাষ। আজ বড়ো বড়ো হরিণী চক্ষুর চক্ষুপাতায় ব্ল্যাক স্মোকি আইশ্যাডের নিখুঁত আই মেকআপের সৌন্দর্য, রক্তে দামামা ছড়ানো মিষ্টি লোভী ঠোঁটদুটোতে লিপগ্লসের গোলাপী আভার জেল্লা, কোমল স্নিগ্ধ গালদুটোতে বুরুশের হালকা নিখুঁত গোলাপি পরশ। যেন গোলাপের নির্যাস থেকে নিংড়ে আনা রঙটুকু তুলতুলে গালদুটোতে হালকা করে ছুঁয়ে নিয়েছে। মাথার মধ্যখানে লম্বা সিঁথি তুলে কালো ঝরঝরে রেশম চুলটা অবলীলায় ছেড়ে দেওয়া। সেই রেশম কালো চুলগুলোতে মৃদু দোল লাগাচ্ছে শীত আগমনী বাতাস। উজ্জ্বল গলায় জ্বলজ্বল করে দ্যুতি ঠিকরাচ্ছে সাদা পাথরের চিকন একটি ক্লাসি নেকলেস, বাঁ'হাতের সরু কবজিতে সেই নেকলেস ম্যাচিং ব্রেসলেট। আরো একবার সেই ব্রেসলেটের ঢিলে হুকটা চেক করতে করতে কালো পার্সটার ভেতর ভাইব্রেট ফোনটা চটপট ঢুকিয়ে নিল ফিহা। এখনো খেয়াল করেনি তার দিকে দৃষ্টি থমকে তারই পরম পুরুষটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে এই সিল্কের শাড়িটি পরতে পরতে। বড়ো কোনো ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া এই প্রথমবার নিজহাতে শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন লজ্জা মেশানো ফুরফুরে অনুভূতি দিচ্ছে, তেমনি দিচ্ছে ঝামেলায় কিছুটা বিরক্ত হওয়া তেঁতো মন। দ্রুত পা চালানোর জন্যে ডানহাতে শাড়ির কুচিটা একটুখানি উঁচু করে ধরলে সুন্দর পাদুটোতে দৃশ্যমান হলো বেল্ট লাগানো কালো ফ্ল্যাট হিলের জুতা। চোখদুটো হিল ও কুচির দিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে দ্রুতবেগেই খোলা গেটটার বাইরে পা রাখল ফিহা। সঙ্গে সঙ্গে উত্তুরে হাওয়ার সপাটে এক চাবুক ওর নরম বুকে আছড়ে পড়ল! স্থির হয়ে গেল ওর দুটি নয়নও। চকচকে ঠোঁটদুটো সহসা মৃদু কেঁপেও উঠল কেন জানি। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুদেহী মানুষটির চক্ষুতারা, তার নিঃশব্দ গাম্ভীর্যের মুখায়ব, ডানহাতে থাকা মোবাইল ফোনটা ফর্মাল প্যান্টের ডান পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া, সবই ফিহার কোমল বুকটায় তীব্র কাঁপুনি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এজন্যই কী ঝলমলে একটা রঙিন অনুষ্ঠানে এই কালো রঙটা নির্বাচন করেছে সে? এই কুৎসিত কালো রঙটা এতোটাই প্রিয় তাঁর? চওড়া প্রশস্ত কাঁধদুটো তাঁর কালো শার্টের আব্রুতে ঢাকা, হাতঘড়িটি কালো রঙের হলেও গোলাকার চাকতিটা সিলভার রঙা, কবজির কাফড্ বাটনটা খুলে কালো হাতাটা গোটাতে গোটাতে বেশ মোটা করেই কনুইয়ের একটু আগেই ভাঁজ করে রেখেছে। এই অন্ধকার কালো রঙটি ছাড়া তাকে এখনো কোনো ঝলমলে রঙে দেখেনি ফিহা। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজের অভদ্র মনকে শেকল পরিয়ে দ্রুত দৃষ্টিজোড়া স্বাভাবিক করল ফিহা। মন্থরপায়ে হেঁটে হেঁটে আসলো মানুষটার কাছে। রাস্তা পার করে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতেই গলাটা একটু স্বচ্ছ করে বলল,
- দেরির জন্য অসম্ভব দুঃখিত। বড়ো কোনো ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া পরতে গিয়ে প্রচণ্ড বেশি দেরি করে ফেলেছি। আপনি এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবেন জানলে আমি হয়ত আগে থেকে আরেকটু সতর্ক হয়ে থাকতাম।
বলতে বলতে চোখদুটো সেই লোকটার চোখে নিবদ্ধ করে রাখল ফিহা। বুঁদ বুঁদ করে জমে উঠা রক্তিম অনুভূতিগুলো দু'ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরুতে দিল না। গায়ে শীত ধরানো মৃদু বাতাসটা এখনো কপালের চুলটা দুষ্টুভাবে উড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর, কিন্তু আম্ভরিক ছাঁচের ঠোঁটদুটো এ যাত্রাতেও কিছু ব্যক্ত করল না। কেমন মানুষ ইনি? কেউ কিছু বললে কি তার সোজা উত্তর দেওয়া যায় না? কেন ঠোঁটদুটো অদৃশ্য টেপ দিয়ে আঁটকে রেখে এরকম নির্যুত্তর ভঙ্গিতে চুপ করে থাকে? বিরক্তির আঁচটা চিকন চিকন ভ্রুঁদুটোতে কুন্ঞ্চন সৃষ্টি করলে ফিহার মুখটা নিষ্প্রভ ভঙ্গিতে শুধিয়ে উঠে,
- আমাকে কী খারাপ দেখাচ্ছে? কোনোভাবে কী মানাচ্ছে না আমায়?
বুকের অন্তঃকোণে তীব্র আকাঙ্ক্ষী মনটা তাঁর মুখ থেকে প্রশংসনীয় বাক্যটুকু শুনতে চাইছে। মরুর বুকে খাঁ খাঁ করা জল পিপাসার মতোই বড্ড আনচান করছে ওর অবুঝ ছোট্ট মনটা। বুকের কাছাকাছি থাকা ওই প্রশ্নাতুর চোখদুটো জবাবের উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থাকলে নিঃশব্দে মুচকি হাসিটা ঠোঁটে ফুটালো সাঈদ। মনের ভেতরটা দুলে উঠে ওই পাগল করা হাসিটা শেষমেশ বড্ড কাছ থেকে উপহার দিল প্রিয় মুখটিকে। কিচ্ছু বলল না সাঈদ। যেন শব্দালংকারের চাইতে নিঃশব্দ ওই অর্থপূর্ণ হৃদয় দোলানো হাসিটি বড্ড বেশি বাক্যময়। রাত ঘনানো আকাশে উঁকি দিয়ে উঠা চন্দ্রকিরণ এই অন্ধকার প্রিয় লোকটার জীবনে এভাবেই হয়ত জোৎস্নার আলো ফুটিয়ে দিবে। আর সেই মায়াময় আলোতে জীবনের টুকরো টুকরো সুখগুলো কুড়িয়ে নিবে এই স্বল্পভাষী লোকটি। ঠোঁটে সেই হাসিখানা জড়িয়ে রেখেই একটা হাত রাখল ফিহার ডান হাতে, ভীষণ আলতো এবং নরমভাবে। নির্দিষ্ট কথাটা স্রেফ ও-ই শুনতে পাক এমন একটা স্কেল বজায় রেখে মৃদুকণ্ঠে জানালো,
- আপনাকে লাগাম ছাড়া সুন্দর দেখাচ্ছে। এই লাগামহীন সৌন্দর্যের কাছে আমার ধৈর্যের বাঁধ মানছে না।
কিশোরী চন্ঞ্চল চোখের তারায় প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসটুকু ঝিলিক দিয়ে উঠল ফিহার। সারল্য হাসিতে ভরপুর ওই মেয়েলি নরম ঠোঁটজোড়া চওড়া হাসিতে প্রসন্ন হয়ে রইল। এতটুকু পরিমাণ জড়তার আঁচ বুকের কোনো কোণেই আজ টের পেল না ফিহা। এই যে পার্স ধরা ডানহাতের কবজিটা সে আলতো করে ছুঁয়ে ধরেছে, এতেও মন ও মস্তিষ্ক একটা সেকেন্ডের জন্যও সংকোচ অনুভব করল না। কিন্তু শরীরে ঠান্ডা ধরানো মৃদু মৃদু বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথেই চূড়ান্ত বাগড়া দিতে হাজির হলো ফোন। সশব্দে ভাইব্রেট হয়ে বড্ড বিশ্রীভাবে কাঁপিয়ে দিল ফিহার পার্স ধরা হাতটা। চটক ভেঙে স্বশরীরে ফিহা প্রচণ্ড কেঁপে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভের জন্য পার্স খুলে বের করতে লাগল। অন্যদিকে প্যান্টের পকেটে থাকা সাঈদের ফোনটাও ' ফাহাদ ইজ কলিং ' উঠে অনুষ্ঠানে দেরি করা নিয়ে মৃদু হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেলেছে। রেড আইকনে বৃদ্ধাঙুল বসিয়ে কলটা কাটতেই কথা বলতে থাকা ফিহার দিকে অনুষ্ঠানে পা বাড়ানোর জন্য চক্ষু ইশারা বোঝাল। ফিহা মাথাটা সম্মতির সুরে 'হ্যাঁ' বুঝিয়ে হাঁটা চালু করতেই আগে আগে ঢুকল ও। এরপর পাঁচ মিনিট অন্তর রেখে বেশ ধীরস্থিরভাবে প্রবেশ করল সাঈদ।
•••••••••••••
মাঝারি একটা প্যান্ডেল বাঁধিয়ে বেশ সুন্দর করে জায়গাটা সাজিয়ে রাখা। মানুষে মানুষে ভিড় হয়ে ভীষণ ভালোই লাগছে শেষ অনুষ্ঠানটা। আকাশের কালো ঝাঁপিতে দুষ্টু দুষ্টু নক্ষত্রের মাঝে গোল চাকতির মতো একখানা সুন্দর চাঁদ। চাঁদের মিঠে মিঠে আলোয় একীভূত হয়ে আছে ঝরঝরে গানের সুর-শব্দ-গলা। চোখ ঝলসে দেওয়া আলোকসজ্জার এই দারুণ সমাহার দেখে উপস্থিত সবার মনটাই কীরকম চনমনে হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলের অবস্থা দেখলে মনে হবে এ যেন ছোটোখাটো এক কন্সার্টের মতো ছোট্ট প্রয়াস। আর সেই প্রয়াসে প্রৌঢ় থেকে শুরু করে সবাই হাসি-ঠাট্টায় নব্বই দশক থেকে একেবারে হাল আমলের গান পর্যন্ত গেয়ে যাচ্ছে। কী উপচে পড়া হাসি, কী বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস! শরবতের গ্লাসে চুমুক দেওয়া ভদ্রলোক সোয়াদ পাশে থাকা স্ত্রীর দিকে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন,
- সানা, আমার মনে হয় তুমি একটা গান ধরতে পারো। তোমার দ্বিগুণ বয়সী মাজেদা আপা যদি গীত গেয়ে নিজের জন্য হাততালি নিতে পারে, আমার মনে হয় তুমি উনার চেয়ে ভালোই পারবে।
প্যান্ডেলে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকা আফসানা সেকেন্ডের ভেতর স্বামীর দিকে আগুনদৃষ্টিতে তাকালেন। বয়স বাড়তে বাড়তে এখন তলানির দিকে এসে পরেছে তাও ভদ্রলোকের রসবোধ যেন কমছেই না! তিনি কণ্ঠস্বর বেশ চৌকশ করে একটু আগের গুরুত্বপূর্ণ কথাটা শুধিয়ে উঠলেন,
- আপনি প্রস্তাবের বিষয় নিয়ে কি ভাবলেন? দেখুন মেজর সাহেব, একটা কথা আপনাকে পরিস্কার বলে রাখি। ছোটো বোনজামাই কিন্তু রোকসানার জামাইর মতো অর্থলোভী লোক না। খুবই সৎ আর ভালো মনের মানুষ। বিয়ের কথা মাথায় আসলেই কিন্তু পরিবারের উপর আর্থিক ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তার উপর বড়ো মেয়ে এখনো অবিবাহিতা। বড়ো মেয়ে রেখে ছোটো মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে নিশ্চিত প্রস্তাবটা ওরা ফিরিয়ে দিবে। কোনো বাবা-মাই চাইবে না সন্তানের মধ্যে এরকম একটা ভেদাভেদ হোক।
স্ত্রীর যুক্তি শুনে নিজেও একখণ্ড যুক্তি উপস্থাপন করলেন সোয়াদ,
- তোমার কথাবার্তার সাথে একমত হতে পারলাম না। তুমি সোসাইটির বানানো নিয়মকানুনের দিকে কেন ঝুঁকছো সাঈদের মা? বিয়েটা কী সোসাইটি নির্ধারণ করে দিবে, নাকি যার যার ব্যক্তিগত ধর্ম? ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে বিবেচনা করলে কখনো বড়ো মেয়ে, ছোটো মেয়ে এই ধরণের প্রসঙ্গ আসার কথা না। বরং ওদের মেয়ে সাবালিকা হয়েছে কিনা সেটা দেখো। কথাবার্তা আর বিচারবুদ্ধিতে যদি পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো ছাপ না থাকে তাহলে সেই মেয়েকে 'সাবালিকা' বলাই উচিত। কিন্তু আমার মনে হয় না তোমার বোনঝি নাবিলা অতোটা অবুঝ। সতেরো বছর বয়সী, জেলা শহরে বেড়ে উঠা বেশ নামীদামী একটা সরকারী কলেজ থেকে পড়ছে। সবদিক দিয়ে ওর বোন ফিমার সাথেও সমান তালে চলতে শিখেছে, তাহলে সেই মেয়ে অবশ্যই নাদান নয়।
- কিন্তু এখানেও একটা গুরুতর সমস্যা আছে মেজর সাহেব। আপনি সেটাতে কেন গুরুত্ব দিচ্ছেন না আমি একদম বুঝতে পারছি না। দেশের সরকারি আইন অনুসারে আঠারো বয়সের নীচে মেয়ে বিয়ে দেওয়া আইনগত অপরাধ। সেখানে আপনি আইনশৃঙ্খলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েও এই ধরণের ভুল বক্তব্য কেন রাখছেন জানি না।
- সবদিক বিবেচনা করে আমি আমার সঠিক অভিমত পোষণ করছি সানা। আরো একটা কথা মনে রাখবে, প্রস্তাব দেওয়া মানেই কোনো মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া না। দু'পক্ষ ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে সবটা বুঝে তারপর একটা পারস্পরিক সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর তারা কন্যা তুলে দেয়। ছেলে কিন্তু কবজি ডুবিয়ে মেহমানদারী করা নিয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। সে মেহমান খাওয়াবে না। তুমি তোমার জায়গা থেকে কীভাবে সব দেখভাল করবে দেখে নাও।
- আশ্চর্যজনক কথাবার্তা, একমাত্র ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে মানুষ দাওয়াত দিব না? আয়োজন করব না আমি? এগুলো কী ধরণের অসামাজিক আচরণ?
- বললাম তো, বিয়ে যে করছে তার সঙ্গে এসব বুঝো। আমি শুধু আমার তরফ থেকে দায়িত্বের কাজটা পালন করব। তাছাড়া আমিও চাই, আমাদের বাড়িটা আলোকিত করে ওই মিষ্টি স্বভাবী পুতুল মেয়েটা চলে আসুক। তোমার অভদ্র, ভাব নিয়ে থাকা ছেলেকে যদি সভ্যতার লাইনে আনতে পারে, তাহলে আমি কোনো ক্ষতি দেখছি না।
এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না আফসানা কাদির। সাঈদের বাবা একপ্রকার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছেন আজ রাতে তিনি খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটা রাখতে যাবেন। তারপর যা হয়, তা দেখা যাবে।
•••••••••••
প্যান্ডেলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বেশ মন মাতানো গান ধরেছে তপন। সঙ্গে গিটারের তারে সুরেলা শব্দ যুক্ত করে পরিবেশটা অদ্ভুত ভাবে বদলে দিয়েছে। দীপ তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে আগমনী অতিথিবৃন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত। আর বাকিরা যে যার যার কথায় এবং আড্ডায় নানাভাবে মগ্ন। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটার মতো বাজবে, কিন্তু ফিহার ইচ্ছে করছে শৈলীদের বাড়িতে গিয়ে পোশাক খুলে টানটান বিছানায় শুয়ে পরতে। অদ্ভুত একটা আলস্য ভাব সারা শরীর-মন জুড়ে ছেঁকে ধরেছে। মা আর খালামণিরা কী কী ব্যাপার নিয়ে আলোচনা আর হঠাৎ হঠাৎ হেসে উঠছে তা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। ফিমাও জর্জেটের একটা গোলাপি শাড়ি পরে বেশ চটকদার সাজ দিয়ে তার বয়সী মেয়েগুলোর সাথে কথাবার্তা বলছে। অন্যদিকে আরো একবার হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলাতেই লাবিব ইঙ্গিতপূর্ণ স্বরে বলল,
- আর দুই মিনিটের মতো বাকি। বেশিক্ষণ নেই। বিশ্বাস কর, আমি মারাত্মক এক্সাইটেড!
টানটান উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে ফাহাদের মধ্যেও একই অবস্থার সন্ঞ্চারণ ঘটেছে। ঠোঁটে বিশ্বজয়ীর মতো কাঙ্ক্ষিত হাসিটা ছুঁড়ে দিতেই প্রসন্ন কণ্ঠে বলে উঠল,
- এই ফার্স্ট টাইম মেবি আন্টির সামনে বো° মা ফা° টতে চলেছে তাই না? ওর মা কি ব্যাপারটা জানতো লাইব্বা?
- আরে না, লিটার্লি কেউই জানে না। আঙ্কেল জানে কিনা শিওর না। কিন্তু বাড়ির কোনো কাকপঙ্ক্ষি কিচ্ছু এখনো জানে না।
- আমার তো এখন মন চাইছে নিজেই একটা জোগাড় করে এই আনন্দে শামিল হই। ক-ত্ব-দিন এমন আনন্দের স্বাদ পাই না! লাস্ট সেই যে আমরা পাঁচজন মিলে 'রাতারগুল' ট্যুরের সময় আনন্দ করছিলাম, ওই দিনগুলো আর ক্যাচআপ করতেই পারলাম না।
ঘড়ি থেকে চোখ তুলে ফাহাদকে কিছু বলতে নিবে লাবিব, তার আগেই আকস্মিকভাবে লাইটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর খোলা আসমানের নক্ষত্ররা দুষ্টু হাসিতে যেন মজা লুটছে। যেন হৈ হৈ করা একদঙ্গল মানুষের উদ্দেশ্যে বলছে— “হে মনুষ্যদল! শান্ত হও। তোমরা এখন দেখবে এ রাতের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত। এমন এক অবর্ণিত মূহুর্ত, যে মূহুর্তের ব্যাপারে শুধু আমি জানি। তোমরা তো জানো না, এ পৃথিবীর বুকে কত কত গল্প লুকোনো থাকে। কত শত মর্মবেদনা তারা জানায় কালো আসমানের কাছে। কত কত হাহাকার, চিৎকার, নীরব ধ্বনি পৌঁছায় আমার নিকট। তোমরা কি জানো তারা আমার দিকে নীরবে কত অশ্রু ঝরায়? জানো কতটা দুঃখে থাকে তাদের ওই চোখ ঝরা বিন্দুতে? তোমরা যখন দু'চোখ বুজে শান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ো, তখন তোমাদের আশেপাশে, তোমাদেরই কাছে, তোমাদের নিকটে থাকা কোনো মনুষ্য চোখ এই আমার খুঁজে পায়। কী হাহাকার, গ্লানি, বিষণ্ণতা। হে মনুষ্য! তোমরা ভীষণ নিষ্ঠুর। হাসির নীচে লুকিয়ে থাকা দুঃখ তোমরা বুঝো না। অথচ, এই আমার নীচে লুকিয়ে থাকা রহস্য তোমরা খুঁজতে আসো।” প্রকৃতির এমন অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শোঁ শোঁ বাতাসে মিলিয়ে যেতেই মনে মনে “এক, দুই, তিন . . .” গুণতে শুরু করেছে দুই বন্ধু। জিভের আগায় 'দশ' উচ্চারণ করতে দেরি, অকস্মাৎ দপ করে জ্বলে উঠল সবক'টা লাইট। উজ্জ্বল হয়ে উঠল প্যান্ডেলের সমস্ত আলো, ঝলমলিয়ে উঠল কাঙ্ক্ষিত সেই অভিভূত পরিবেশ! লাবিব, ফাহাদ, দীপ বাদে প্রত্যেকের চোখে আশ্চর্যের বিচ্ছুরণ, কৌতুহলে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না, এমনই এক ধাঁধাপূর্ণ অবস্থার ভেতর প্যান্ডেলের চেয়ারটায় বসে গিটারটা হাতে তুলল সাঈদ। যেন পেশাদার একজন গিটারিস্ট তার শখের বস্তুটা যত্ন করে বুঝে নিল। ঠোঁটের কাছাকাছি স্ট্যান্ড মাইক, চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে পজিশনটা ঠিক করে ফেলেছে। এবার গিটারের তারে আঙুল ছোঁয়াতেই মৃদু সুরটা তুলে দু'চোখ বন্ধ করল সাঈদ। ঘন সুন্দর লম্বা পাপড়ির চোখদুটো ওভাবেই বুজে রেখে গানের বাক্যগুলো গেয়ে উঠল ধীরে ধীরে। সেই সকালে দেখা প্রথম ওই মুখ, লাল টকটকে নাকে ফোলা ফোলা চোখ,
কোনো এক সকালে,
তোকে প্রথম দেখেছি।
মনের এই গভীরে
তোকে আমার করেছি।
গলার কাছে কাঁটা আঁটকানোর মতো ঢোকটা তখুনি আঁটকে গেল ফিহার। রক্তের শিরাগুলো তীব্র টনের্ডোর মতো উত্তাল হয়ে উঠল ওর। নিজের দু'চোখ, দু'কান, কোনো ইন্দ্রীয়কেই ও এক সেকেন্ডের জন্য বিশ্বাস করতে পারছিল না। সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটাই ঘটিয়ে যেন নিজের ভঙ্গিতে ঘটিয়ে দিয়েছে সাঈদ। দক্ষপূর্ণ সাবলীল সুন্দর কণ্ঠে সে যেন মনের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে সুর ছেড়ে ধরলো,
গোধূলির রং আলতো ছোঁয়ায়
ছুঁয়ে দে আমায়,
চোখ খুলে সরাসরি শান্ত, প্রসন্ন, নির্মল দৃষ্টিটা প্রিয় মুখটির পানে তাক করে গাইল,
একটুখানি সাঁঝ নেমে অন্ধকারে,
হাতে হাত রেখে উড়ে বেড়াই . .
উড়ে বেড়াই,
ছেলের মাঝে এমন সুনিঁখুত কণ্ঠের সুর, এমন স্বাভাবিকত্ব, এমন অসাধারণ দৃশ্যপট দেখে ধাক্কাটা সামলাতেই পারলেন না আফসানা। ডানহাত দিয়ে সোয়াদের বাঁহাতটা সজোড়ে খামচে ধরলেন তিনি। যেন বলতে চাইছিলেন, “সাঈদের বাবা, এ আপনার ছেলেই তো? ঠিক দেখছি গো আমি? গান কবে গাইতে শিখলো? কি দেখছি গো সাঈদের বাবা!” শত শত কৌতুহলের মাঝেই হঠাৎ করে প্রত্যেকের মাঝে আনন্দের স্ফুরণ বয়ে গেল। সাঈদের গিটারের তারে আঙুল চালানো প্রতিটি সুর, ছন্দ, মন মাতানো তালটা সকলের মুখ, চোখ, ঠোঁটে, হাসিতে, খুশিতে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। চোখ বুজে তীব্র আকণ্ঠ অনুভূতি থেকে নিখাদ অবস্থাটুকুই যেন ব্যক্ত করে উঠল গানে, দ্রুততার তালে গিটারের তারগুলোতে তীব্র অস্থির ঝংকার তুলে গেয়ে উঠল সুর-কথা,
আজ ঘুরে ঘুরে মন উড়ে উড়ে,
তোকে চাই কাছে বারে বার।
মন দেওয়ানা, করে ছলনা
তোকে খুঁজে ফিরি বারবার।
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
আমি শুরু থেকে শেষ তোকে চাই।
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।
আমি শুরু থেকে শেষ তোকে চাই।
পঙকির সুর মাখানো কণ্ঠে প্রবল উৎকণ্ঠাটুকু দফায় দফায় বুঝিয়ে দিচ্ছে এই কট্টর পুরুষ। হৃদয়ের মণিকোঠায় জমে থাকা নরম অনুভূতির বাষ্পগুলো সে ছেড়ে দিচ্ছে অবলীলায়। তার সবচাইতে গোপনতম গুণ, তার গাওয়ার এই উৎসটুকু দিয়েই ব্যক্ত করছে সুকঠিন অবস্থা। দু'চোখ খুলে সামনের ওই মুখটির পানে চাইতেই কণ্ঠস্বর যেন আবারও দুষ্টু খোলসে ইঙ্গিত রেখে গাইলো,
দেখে লাগে জানি কেমন,
বোঝাতে পারিনি আমি তখন।
মায়াভরা চোখে চেয়ে,
আমাকে করেছে শেষ,
আমিও হয়েছি পাগল,
শেষ লাইনে যেন সত্যিকার অবস্থাই বলে উঠল সাঈদ। হুট করে এক পশলা বাতাসের ঢেউ তাঁর কপালে ছেয়ে থাকা জেলহীন চুলটাকে উড়িয়ে দিল। ভ্রুঁ ছুঁই ছুঁই করতে থাকা দুষ্টু চুলের কাণ্ড দেখে অজান্তেই হাসি ছলকে উঠল ফিহার। আকাশ সম মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকতে থাকতেই মাধূর্য ভরা কণ্ঠটার সাথে কখন যে এতোসংখ্যক কণ্ঠ মিলে একাকার হয়ে গেছে, তা খেয়াল করেনি ও। একসাথে অনেকগুলো কণ্ঠ একত্র হয়ে সমস্বরে সেই গানটার সাথে মন-প্রাণ-সুর মিলিয়ে গাইলো,
তোকে ছাড়া আমার কাটে না সময়
কীভাবে বোঝাই তোকে কত করে চাই
রাতদিন আমার কাটে নিরালায় ভেবে
কী জাদু চোখে, কী মায়া জড়ালে।
আজ উড়ে উড়ে মন ঘুরে ঘুরে
তোকে চাই কাছে বারে বার।
মন দেওয়ানা, করে ছলনা,
তোকে খুঁজে ফিরি বারবার।
এবার একটু থামল সাঈদ। থেমে গেল তার গিটারের তার, তার সুদক্ষ নিপুণ হাত, তার ঠান্ডা স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর। সমবেত কণ্ঠগুলো আচানক এমন কাণ্ডে কিছুই বুঝতে পারল না। মাঝপথে কী গানের লাইনটা ভুলে গেছে নাকি? এভাবে থামলো কেন? ফিহার মুখটা অন্যান্যদের মতো কৌতুহলে মাখো মাখো হলে এবার ঠোঁটে মুচকি হাসিটি জিইয়ে রেখে উচ্চ স্কেলে গেয়ে উঠল সাঈদ,
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
আমি শুরু থেকে শেষ তোকে চাই।
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।
'আমি শুধু যে তোমাকেই চাই'।
স্থায়ীভাবে গানটার সমাপ্তি টানতেই প্রচণ্ড কান ফাটানো শব্দে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা। সবাই 'ঠাস ঠাস' কঠিন করতালিতে ফেটে পরেছে। থামছেই না, থামলই না! যেন এই সুন্দর রাত্রির সবচাইতে জমকালো ব্যাপারটা উপভোগ করেছে তারা। যাকে এই বাড়িতে সবচেয়ে কম মাতামাতি করতে দেখা যেত, যাকে দেখা যেত নিরিবিলি, শান্ত, নিজের মতো করে থাকতে, সেই নীরবে থাকা পুরুষটিই যেন জ্বলজ্বলে তারার মতো সবার কাছে ধরা দিয়েছে। কী অদ্ভুত এক ব্যাপার!
.
.
.
চলবে....................................................................