স্বামীর কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না জোবেদা বেগম। উত্তর তাঁর কাছে থাকা শর্তেও চুপ করে রইলেন। সময় না হয় সঠিক জবাব দেবে! ছেলে কি দেখতে শুনতে ফেলনা নাকি? সংসারী হলে ঠিকই কাজে মনোযোগ দিবে। আশফাক সাহেবের ঝাঁঝাল স্বর শুনে ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন রাজিয়া বেগম। প্রসঙ্গ খুব ভাল করেই জানা তাঁর। জুবরানের ট্যুরে যাওয়া নিয়ে এরকম ঝগড়াঝাটি প্রায়শই হয়ে থাকে। অবশ্য সে না হয় ছেলে। এই বয়সে একটুআধটু ঘুরবেই। এদিকে নিজের মেয়েটাকে ঘরে আঁটকে রাখতে পারেন না রাজিয়া। রাত নেই দিন নেই এখানে সেখানে চলে যায়। কবে যে শোধরাতে পারবে এই মেয়েকে কে জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে,খালি পানির বোতল নিয়ে রান্নাঘরে আসতেই ছোট জা তানিয়ার মুখোমুখি হলো রাজিয়া। যৌথ পরিবার তাদের। কোনো কিছু নিয়ে জগড়া হলে সেটা সবার কানেই পৌঁছায়।তপ্ত শ্বাস ফেলে পানির জগ ভরে নিয়ে বলল তানিয়া,
"দু'দিন পর পর নতুন তামাশা শুরু হয় এই বাড়িতে।আজ এর ছেলে চলে যায়,তো কাল ওর মেয়ে! এভাবে না চেঁচিয়ে ছেলেমেয়েকে শাষণ করলেই তো হয়।অযথা রাতবিরেতে অন্যের ঘুম নষ্ট করছে।
কথাটুকু যেন দ্রুত বলেই প্রস্থান করলো তানিয়া। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন রাজিয়া।এমন কিছু যে শুনতে হবে বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। মুখে কোনো কথাই আঁটকায় না ছোট জা এর। নিজের মেয়েকে বলায় রাগে গাঁ জ্বলে যাচ্ছে । কিছু না বলা অব্ধি শান্তি মিলবে না।জবাবটা সকালেরঝ গদ জন্য'ই বরং তোলা থাক!
◼️
ঘড়ি'তে সময় রাত দুটো একত্রিশ মিনিট! স্থির হয়ে বসে আছে জুবরান। পাশের মেয়েটি ঘুমের ঘোরে তাঁর কাঁধে গাঁ এলিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা খুবই অসস্থিতে ফেলেছে তাকে। বাসের ঝাঁকিতে মাথা নড়ছে বেগতিক। হাত দিয়ে আগলে না নিলে যে কোনো সময় কাঁধ থেকে মাথা নুইয়ে পড়বে। ডাক দিতে গিয়েও কেমন বিবেকে বাঁধল জুবরানের। খানিক্ষন আগেই বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার কান্নাটাও বন্ধ হয়েছে! তক্ষুনি ঘুমিয়ে পরেছে।মনে হচ্ছে,তীব্র কোনো ক-ষ্ট,যন্ত্র-ণা বয়ে নিয়ে এসেছে এই মেয়ে।সেটুকু হদিস করার কোনো ইচ্ছে নেই জুবরানে'র।তাঁর ট্যুর জার্নি'র জীবনে এই প্রথম বোধহয় পাশে কোনো মেয়ে বসেছে।দূরের জার্নি হিসেবে ব্যাপার'টা খুব একটা ভাল লাগেনি তাঁর।অসস্থিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।পকেটে ফোন ভাইব্রেশন করে কেঁপে উঠলো।হাতড়ে ফোন নিয়ে দেখলো ফারাজ ফোন করেছে।কারণ'টা বেশ ভাল করে'ই জানা জুবরানে'র।রিসিভ করে কানে জড়াল।ওপাশ থেকে আফসোসে'র স্বর শোনা গেল,
"এটা কি করলে ব্রো? সাজেক যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা ছিল।আর তুমি একা'ই চলে গেলে?আমি বাসায় ম্যানেজ করে ফেলেছিলাম রীতিমতো।
ক্ষীণ স্বরে ফিরফিস করে বলল জুবরান,
" আমি এই নিয়ে পরে কথা বলছি তোর সাথে।
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে সন্দিহান গলায় বলল ফারাজ,
"একমিনিট!একমিনিট!তুমি এমন চোরের মতো কথা বলছো কেন?কোথায় আছো তুমি?
জুবরানে'র মাথায় জমেছে ঘামবিন্দু!বিশ্রিরকম এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।পাশে থাকা মেয়ে'টার ঘুম না ভাঙ্গানো'র জন্য'ই নিভু স্বরে কথা বলছিল সে।এটা এখন ফারাজ'কে কিভাবে বোঝাবে?পাশাপাশি বসা একজন মধ্যবয়স্ক লোক জুবরান'কে ডেকে বলল,
" এই যে ইয়াং ম্যান তুমি যে ফোনালাপে ব্যস্ত,ওদিকে তোমার ওয়াইফ তো ঘুমের ঘোরে কাঁধ থেকে পরে গেছে!
তাৎক্ষণিক অগ্নিলার দিকে দৃষ্টিপাত করলো জুবরান।মেয়ে'টা নুইয়ে গিয়ে একেবারে তার বক্ষস্থলে ঠাঁই নিয়েছে!তীব্র অসস্থি তাঁকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো যেন।এদিকে লোক'টাও তো ভুল ভেবে বসে আছে!ফোনের ওপাশ থেকে বেশ অবাক স্বরে বলল ফারাজ,
"ওয়াইফ!কার?ব্রো তুমি কি সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়েছো?
বাকি কথা না বলে লাইন কেটে দিল জুবরান।এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করার মতো অবস্থায় নেই সে।আগে এই অদ্ভুত ধাঁচের মেয়ে'কে এখান থেকে সরাতে হবে।এত বেঘোর ঘুম কারো হয়,জানা ছিল না জুবরানে'র।এক'ই কাজ'টা যদি তাঁর দ্বারা হতো,তাহলে নির্ঘাত এতক্ষণে পাবলিকে'র গণ-পিটু-নি'তে অবস্থা নাজেহাল হয়ে যেত!সবে অগ্নিলার মাথায় হাত ছোঁয়াতে'ই বাস ব্রেক কষলো।ঘুম ছুটে যেতে'ই ধরফরিয়ে সরে আসলো অগ্নিলা।নিজেকে জড়োসরো করে নিয়ে সন্দিহান দৃষ্টি'তে তাকাল জুবরানে'র পানে।হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে জুবরান।চোখেমুখে রাগ ঠিকরে ঝড়ছে অগ্নিলার।পাশ থেকে সে'ই ভদ্রলোক একগাল হেঁসে বললেন,
" সারা রাস্তা তো একা'ই ঘুমালে মেয়ে।নিজের হাসবেন্ড'কে একটু ঘুমাবার সুযোগ দিলে না।আসলে পুরুষ মানুষ এমন'ই!শক্তপোক্ত হাত দিয়ে নারী'কে আগলে রাখে,আর বলবান বুকে দেয় ঠাঁই!পরের জন্য'ই তাদের জীবন বাঁচে।
কথাটুকু বলে'ই বাস থেকে নেমে গেলেন ভদ্রলোক।অগ্নিলার বিস্মিত দৃষ্টি জুবরানে'র পানে।প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না তার।একটু চোখ লাগতে'ই গভীর নিদ্রা চোরাবালি তাঁকে টেনে নিয়েছিল।সে'ই সুযোগ গ্রহন করেনি তো ছেলে'টা?ভাবতে'ই বক্ষস্থল শুকিয়ে এলো।কাঁপা স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,
"কি করেছেন আপনি?শুরু থেকে'ই আপনাকে দেখে সন্দেহ লাগছিল আমার।ওই লোক'কে কি বলেছেন?সাহস থাকলে আমি সজাগ থাকা অবস্থায় বলতেন।কি ভেবেছেন মেয়ে মানুষ মানে দূর্বল?যা খুশি বলা যায়,করা যায়?খুন করে ফেলবো।আমাকে চেনেন না আপনি......
কথার মাঝে ধমকে থামিয়ে দিল জুবরান।বিরক্তি তাঁর চরমে!মাথামোটা মেয়ে অনর্গল বাজে বকে'ই যাচ্ছে!চোয়াল শক্ত করে আশপাশে তাকিয়ে নিয়ে,যতেষ্ট স্বাভাবিক হয়ে বলল সে,
"নিজেকে এতটাও স্পেশাল ভাবার প্রয়োজন নেই!কখনো নিজের চেহারা দেখেছেন ভালমতো?ঘুমাবার সময় হুস থাকে না।অন্যের বুকে ঢলে পরেন।আর একটা নির্দোষ,নিষ্পাপ ছেলের চরিত্রে আঙ্গুল তোলেন!ভিডিও করে রাখা উচিৎ ছিল!
মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল অগ্নিলার।রাগে নাকের পাটা ফুলে উঠলো।টিশার্ট ঝেড়ে,উঠে হনহন করে বাস থেকে নেমে গেল জুবরান।সিটে বসে চোখ বুজে ফের তাকাল অগ্নিলা।ঘনঘন দম ফেলে জানালার কাঁচ খুলে দিল।সে এতটাও বেখেয়ালি নয়,যে ঘুমের ঘোরে আরেক ছেলের গাঁয়ে ঢলে পরবে!শুনতেও কি বিশ্রী লাগছে!বাইরে এখনো বেশ রাত।তারমানে বাস যাত্রা বিরতি দিয়েছে।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জায়গাটা ঠিক কোথায় বোঝা'র চেষ্টা করলো অগ্নিলা।সাজেক পৌঁছাতে আর কতক্ষণ সেটাও জানা নেই!মনে এবার সত্যি'ই ভয় কাজ করছে।রুহি'র কথায় হুট করে'ই এতদূর আসা উচিৎ হয়নি।এভাবে ট্যুরে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই তাঁর।তারউপর বাজে এক ছেলের সাথে বসেছে।যদি বিপদ হয়?কোনোভাবে বুঝতে দেওয়া যাবে না,অগ্নিলা না জেনে-বুঝে'ই এতদূর চলে এসেছে!ভাবনার মাঝে দূরে দৃষ্টি থমকে গেল অগ্নিলার।এক হাত পকেটে পুরে নিয়ে,অপর হাতে সিগারেট ফুঁকছে জুবরান।এই ছেলে যে ভাল নয়,এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো অগ্নিলা।ভদ্র ছেলে'রা ধুমপান করে না।পাশে'র সেই ভদ্রলোক কিছু শুকনো খাবার সমেত বাসে উঠলো।অগ্নিলার চোখে চোখ পরতে'ই একটুখানি হাঁসলো।পাল্টা হাঁসার চেষ্টা করলো অগ্নিলা।মনে হচ্ছে এই লোক'কে কৌশলে জিগ্যেস করলে কিছু জানা যাবে।লোকটা চিপ্সের প্যাকেট খুলে খাওয়ায় মনোযোগী হলো।অগ্নিলা জিগ্যেস করলো,
"আচ্ছা আমার হাসবেন্ড কি বলেছে আপনা'কে?মানে আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন।
লোকটা তড়াৎ করে দৃষ্টি ফেলে পাশে।অধরোষ্ঠে সে'ই হাসিটা নিয়ে বলল,
"কিছু'ই বলেনি।তোমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে বলে কথা'ই বলেনি।ফোনে কথা বলার সময়'ও যথাসম্ভব নিভু স্বরে বলছিল।যতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলে ছেলেটা ধৈর্য্য নিয়ে বসে ছিল।গাঁয়ে পর্যন্ত হাত দেয়নি জেগে যাবে বলে।খুব কেয়ারিং!লাভ ম্যারেজ নিশ্চয়ই?
থতমত খেল অগ্নিলা।কোনোরকম মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।পরক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ফের জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখলো।ছেলে'টা তাহলে ঠিক'ই বলেছে!আর অযথা'ই সে কতকিছু শুনিয়ে দিয়েছে।ছেলে'টাকে নিয়ে সন্দেহ তবুও গেল না।মনে হচ্ছে রুহি'কে একটা ফোন করে সব বলতে হবে।যদি কোনো বিপদ ঘটে'ই যায় তাহলে অন্তত রুহি জানবে।বন্ধ মোবাইল টা চালু করলো অগ্নিলা।ডায়াল করলো রুহি'র নাম্বারে।বেশ কয়েক'বার বাজতে'ই রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে ঘুমুঘুমু স্বরে বলল রুহি,
" হ্যাঁ অগ্নি বলো?
বাইরে দৃষ্টি রেখে'ই বলল অগ্নিলা,
"আমি খুব ভয়ে আছি রুহি।আমার পাশে একটা ছেলে বসেছে।তাঁকে কেমন সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না।যদি আমার কোনো খোঁজ না পাও,তাহলে ভেবে নিও এই ছেলে'টা আমাকে কিড-ন্যাপ করে নিয়েছে।
মধ্য রাতে অগ্নিলার আজগুবি কথা শুনে ঘুম ছুটে গেল রুহির।উঠে বসে হাই তুলে বলল সে,
" মানে?কোনো বাজে আচরণ করেছে তোমার সাথে?বাস ড্রাইভার বা কন্ট্রাক্টর'কে বলো।চুপ করে আছো কেন?এত দূর থেকে বোকার মতো আমার কাছে সাহায্য চাইছ?
আমতাআমতা করে বলল অগ্নিলা,
"না মানে,আমার সঙ্গে বাজে আচরণ করেনি।কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে।
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল রুহি,
" আরে লম্বা জার্নি'তে পাশে কোনো মেয়ে বসলে, ছেলে'রা একটুআধটু আলাপ জমাতে চায়'ই।তুমি ভয় পেয়ো না।আর যদি অতিরিক্ত কিছু করে ফেলে,তাহলে অবশ্যই চুপ করে থেকো না।আচ্ছা ছেলে'টা দেখতে কেমন শুনি?
বাইরে ফের জুবরানে'র পানে তাকাল অগ্নিলা।পরক্ষণে বলল,
"লম্বা চওড়া।ফর্সা গাঁয়ের রঙ।মাথায় কালো টুপি।কালো টিশার্ট আর জিন্স পরেছে।কাঁধে একটা ব্যাগ।গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে।চেহারা ভাল মতো খেয়াল করিনি।এখন দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে!
" বর্ননা শুনে তো বাটপার বা বাজে মনে হচ্ছে না।এই যুগে ছেলে'রা একটুআধটু স্মোক করে'ই।আচ্ছা তারপরও সাবধানে থেকো।সমস্যা হলে আমায় জানিয়ো।
জুবরান বাসে উঠতে'ই কান থেকে ফোন নামিয়ে নিল অগ্নিলা।সিটে এসে বসতে'ই ওই লোক'টা জুবরানে'র উদ্দেশ্য বলল,
"প্রেমে'র বিয়ে বলে'ই বউয়ের প্রতি এত ভালবাসা!তা তুমি একা গেলে ওয়াইফ'কে সঙ্গে নিলে না?বেচারি জানালা দিয়ে তোমাকে কতক্ষণ যাবৎ দেখছিল!এখন মান ভাঙ্গাও!আসলে পুরুষদের জন্ম'ই হয়েছে বিনা দোষে বউয়ের রাগ ভাঙ্গানো,জারিজুরি শোনার জন্য!আমার জীবনটাও এভাবে'ই চলছে।
কথাটা শোনা মাত্র তড়াৎ করে অগ্নিলার পানে তাকাল জুবরান।বিস্ফোরিত দৃষ্টি'তে ভদ্রলোক'কে দেখছে অগ্নিলা।এ তো জলজ্যান্ত সিসিটিভি!তারউপর বর্বর!একটা মানুষ অন্য অপরিচিত মানুষ'কে নিয়ে এত কথা কিভাবে বলতে পারে?কোনোরকম বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় অগ্নিলা।তুতলে কোনোরকম জুবরান'কে বলে,
" স.....সরুন।আমি বের হবো।
জুবরান সরে যেতে'ই হনহন করে নেমে গেল অগ্নিলা।সিটে পরে থাকা ফোন'টা বেজে উঠতেই ভাবনার ঘোর কাটলো জুবরানে'র।অগ্নিলা ফোন ফেলে চলে গেছে।স্ক্রিনে ভেসে আছে ‘মামিমা’ নাম।নামটা বেশ অদ্ভুত লাগলো জুবরানে'র।পাশ থেকে লোকটা ফের বলল,
"আরে বউ তো অভিমান করে একাই চলে গেল!তাড়াতাড়ি যাও বৎস!
.
.
.
চলবে....................................................................