প্রাণোদাহ - পর্ব ১৩ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


অবুঝ নক্ষত্র, আমাকে এত দারুণভাবে হারিয়ে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি ভালো থেকো..

ইতি
অতসী

চিঠিটা পড়ার পর নক্ষত্র অনুভূতিহীন হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। মেয়েটা ভালোবেসেছিল তাকে! এ কথা কেন সরাসরি বলেনি? নক্ষত্র মেয়েলি অনুভূতিদের সাথে পরিচিত নয়। প্রথম এতটা কাছাকাছি তো অতসীর সাথেই হয়েছিল। সে ভেবেছিল, মেয়েরা অমনই। এরকমই হয় সম্পর্কে। এফোর্ট জিনিসটার সাথে ছোট থেকে এ অবধি কখনো তার পরিচয় হয়নি। চাওয়ার আগে সব পেয়েছে বলে কখনো কোনো কিছুতে তার খুব একটা আগ্রহ আসেনি। অতসীর সাথেও হয়তো তাই...

বিষয়টা হজমের পর নক্ষত্র বেশ কয়েকবার অতসীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। ফলাফলে ব্যর্থতা ছাড়া কিছু পায়নি। সবখান থেকে ব্লক করে রেখেছে মেয়েটা। অন্যভাবেও তো যোগাযোগের চেষ্টা করে যেত। কিন্তু নক্ষত্রের কেন যেন তা করতে ইচ্ছে করেনি। সে বুঝতে পেরেছে, অতসী মুভঅন করেছে। সে এগিয়ে যাচ্ছে৷ যাত্রাপথে মানুষকে পেছন থেকে ডাক দেওয়া লাগে না। ধরে রাখার মতো পর্যাপ্ত সামর্থ্য না থাকলে, হাত বাড়ানো অনুচিত।

জীবনে এতটা হতাশ তার প্রথমবার হওয়া, তাও ভীষণ বাজেভাবে। সে এরপরের দেড়টা মাস ধরে ডিপ্রেশনে ভুগল। অতসীর কথা মনে পড়লেই নিঃশ্বাস আটকে আসে, প্রশ্বাসেরা শব্দ তুলে দীর্ঘ হয়। প্রশ্ন আসে, কখন কখন অতসীকে নক্ষত্রের মনে পড়তে লাগে? উত্তরে আসে, যখন যখন সে শ্বাস নেয়।

এমন না যে নক্ষত্র তাকে ভালোবেসেছিল। এমন না যে, নক্ষত্র তাকে আবারও ফিরে পেতে চায়। ব্যাপারটা এখানেই যে, নক্ষত্র প্রচণ্ডভাবে অনুতপ্ত৷ সে ক্ষমা চাইতেও লজ্জিত বোধ করে। 

তার অনুশোচনায় দগ্ধ হৃদয়টা এবার আক্ষরিকভাবেই হাতছাড়া হয়ে গেল। দেখা গেল, বেখেয়ালি নক্ষত্র এখন চিন্তিত হয়। বাবা-মার কথা ভাবে, ভাইয়ের কথা ভাবে, তার কোন কাজে কে কী মনে করতে পারে—সেসবের খেয়াল রাখে। কেউ কষ্ট পাবে, এমন কোনো কাজ করে না, এমন কিছু বলে না। এলাকার মোড় পাহারা দেওয়া কুকুরটার জন্যও সে দুশ্চিন্তা করে।

আমরা আত্মবাদী হতে গিয়ে যে স্বার্থপর হয়ে যাই, সেটা কখনো আমাদের চোখে পড়ে না। হ্যাঁ-কে হ্যাঁ এবং না-কে না বলতে পারাটা নিঃসন্দেহে চমৎকার একটা গুণ। নিজেকে সময় দেওয়া, নিজেকে ভাবা, নিজেকে নিয়ে পরে থাকা ও নিজেকে ভালোবাসা ভীষণ ভালো ব্যাপার। তবে যতটুকু ভালো, তা ঠিক ততক্ষণই—যতক্ষণ আমাদের কাজে বিপরীত ব্যক্তিটি কষ্ট না পাচ্ছে। আমরা খুব সহজভাবে বিপরীত ব্যক্তির মনে কষ্ট দেওয়ার মতো কাজ করে ফেলি। মুখের ওপর বলে দিই, মনের ভেতর যা আছে। এটাকে যদি জেনজিরা কুল ভেবে থাকে, তবে তাতে শতভাগ ভুল আছে। সত্যতা এ-ই, পূর্ববর্তী জেনারেশন এই বিষয়টাকে বেয়াদবি বলে গালমন্দ করত।

নক্ষত্র অতসীর সাথে যা করেছে, তা রীতিমতো অন্যায়। তার অপরিপক্ব হৃদয় অতসীর ভালোবাসা ধারণ করার মতো শক্ত-সামর্থ্য ছিল না কখনোই। মেয়েরা ভালোবাসার মানুষের কাছে যত্ন চায়, গুরুত্ব চায় আর ভালোবাসা চায়। তবে সেগুলো মুখে বলতে চায় না। তারা চায়, মানুষটা বুঝে নিক। এত অবুঝ নিশ্চয়ই প্রেমিকেরা হয় না! 

নক্ষত্র উপর্যুক্ত তিনটার কোনোটাই অতসীকে দিতে পারেনি। সে নিষ্ঠুর নয়, সে আসলে অবুঝ। অতসীর জায়গায় প্রীতি থাকলে, খুব চমৎকার হেসে বলতে, “ছাগলবতী নক্ষত্র, তুমি একটা জঘন্য রকমের বেকুব।”

নক্ষত্র তাতে মন খারাপ করত না মোটেও। কারণ যাই বলুক না কেন প্রীতি, তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে ও তাকে নিজের ভেবেই বলছে। নক্ষত্রের বুকের ভেতর একটা পাথর চাপা সত্য ছিল। সে যখন টের পেয়েছে যে, এক নারী হৃদয়ে আঘাত করার মতো দুঃসহ কাজ সে নির্দ্বিধায় করেছে এবং করার পর টেরও পায়নি—তখন থেকেই বুকেতে লালন করছে উটকো ব্যথা। 

সে সিগারেটের মায়ায় পড়েছে এবার। সেই সাথে বাজেভাবে ডুবেছে বাঁশির করুণ সুরে। ছোটবেলায় শখ করে শেখা হয়েছিল, সে শখকেও আগলে রাখতে চাইছে। তার ধারণা, এক নারীর দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে তার ভালোবাসা হারানোর শাপ। সে ভীত হয়। মধ্যরাতে উঠে অশান্ত মনে এদিক-ওদিক তাকায়। হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক গতিবিধি ও বুকের চাপা ব্যথা একসময় কমতে থাকে। সে শান্ত হতে থাকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সিলিং বরারব। চোখেতে ভাসে তার প্রিয় মানুষগুলো। 

সে অতসীকে কখনো স্পষ্ট মনে করতে পারে না। মেয়েটাকে সে খুব কমই দেখেছে। সরাসরি দুয়েকবার তাকিয়েছে। তাও লক্ষ করেনি কখনো। তার মুখটা গোল নাকি লম্বাটে এটুকু নক্ষত্র বলতে পারে না। 

তারা একটা প্রেম করেছিল। কয়দিন, কয়মাসের প্রেম, বিষয়টা একটু বিভ্রান্তিকর বটে, স্পষ্ট করে বলা যায় না। জন্ম পরিচয়ে তারা মামাতো-ফুপাতো ভাই-বোন। বড়ো হওয়ার পর প্রথম মুখোমুখি দেখা ও-ই কোনো এক শীতকালীন ছুটিতে। সেটাকে মুখোমুখি দেখাও বলা সম্ভব না, কারণ নক্ষত্র তাকায়নি। তারপর মেয়েটার গুটি গুটি পায়ে এগোনো। ওয়ান সাইডেড লাভ? তারপর?

তারপর মেয়েটা প্রপোজালই দিয়ে বসল। ছেলেটা রাজি হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। তাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হতে লাগল। খুবই ফর্মাল গল্প। কে কোন দেশের কোন কোন জায়গায় ঘুরেছে, কোন বই পড়েছে, জার্নাল বানানো এসব নিয়ে। একটা প্রেমময় সম্পর্কে যা যা বাড়তি হয়, তাদের মধ্যে সেসব কিছুই ছিল না, হয়নি। সম্পর্কটা না কাজিনদের মতো, না বন্ধুদের মতো, ভালোবাসার তো বলাই যায় না। সম্পূর্ণ অপরিচিত ও মার্জিত ব্যবহারে দুই ইন্ট্রোভার্ট মানুষের বিশেষ বিবেচনায় প্রেম হলো হয়তো চারমাস, পক্ষান্তরে সাড়ে পাঁচমাস। 

পক্ষান্তরের ব্যাপারটা আসলে ছেলেটার পক্ষ থেকে। তার বিশেষ বিবেচনার গার্লফ্রেন্ড কখন তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এটুকু সে পরে টের পেয়েছে। ধরা যায়, টের না পাওয়া সময়টা সে মনে মনে সম্পর্কে ছিল। তো এ-ই হলো। এখন তাদের মধ্যে কী ছিল? 

প্রেম?
না।
বন্ধুত্ব? 
না। 
সমঝোতা?
না।
কমিটমেন্ট?
না।
তবে?

অপ্রেম!

মধ্যরাতে আচমকা জাগ্রত নক্ষত্রের আর বাকিটা রাতে ঘুম হয় না। ওই-যে, হৃদয় ভাঙা নারীর দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল না? 

“তোমার মানুষটার কাছেও তোমার কোনো গুরুত্ব না থাকুক, সেও তোমায় অবহেলার আগুনে জ্বালিয়ে মারুক...”

___________

অতসী নক্ষত্রকে বড়ো আবেগে জড়িয়ে ধরেছে। তার কাছে জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা স্বাভাবিক। তবে বাকি মানুষের কাছে তা নয়। লোকে বাঁকা নজরে দেখা শুরু করেছে। বিষয়টা টের পেতেই অতসী ছেড়ে দাঁড়াল। 

প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যত্র ঘুরে দাঁড়াল। মনুষ্যহৃদয় বড়ো অদ্ভুত। তারা কখন কী করে বসে, আগে থেকে বলা যায় না। করার পরও মানা যায় না। সে মেনে নিল দ্রুত। তার সাথে এটা নতুন না। গতবারও একই ঘটনা ঘটেছিল। রাকিবের প্রতি যখনই তার অনুভূতিগুলো ডালপালা মেলার ইচ্ছে দেখাতে লাগল, ওমনিই যেন একশত আশি ডিগ্রী এঙ্গেলে সরলরেখায় এদিক-ওদিক হয়ে গেল সবটা। সেবারও মানতে কষ্ট হয়নি। এবারও হলো না। রাস্তার ধারে দাঁড়ানো রিকশা দেখে বলল,
-“মামা, যাবেন?”

ওপাশ থেকে রিকশাচালক বললেন, 
-“কই যাবেন, মামা?”
-“জানি না।”
-“তো যাব কই?”
-“মেইনরোডে দুইটা চক্কর দিতে পারবেন?”
-“তা পারুম, কিন্তু ভাড়া বেশি লাগব।”
-“সমস্যা নেই, মামা। চলেন।”

প্রীতি রিকশায় উঠে বসল। বেখেয়ালি বাতাস গায়ে মিশে যাচ্ছে। মোটামুটি শহরের রাস্তায় সবাই সোয়েটার পরে আছে। তার গায়ে সামান্য এক সুতির জামা। শীত করছে না একদমই। আবার কষ্টও লাগছে না। কী জানি! অনুভূতিহীন হয়ে পড়ল কি না পুরোদমে!

ওধারে অতসী আর নক্ষত্রের ছয় বছর পর দেখা। মেয়েটা এতদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে এক্টিভ ছিল না। কারো সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগও রাখেনি। একটু তো পালটেছে। হয়তো। তবে নক্ষত্র তা কখনো ধরতে পারবে না। সে তো প্রথমে চিনতেই পারেনি। এখন কিছুটা বুঝতে পারছে, কে এই মেয়েটা! কাঁধ অবধি চুল, ছোট্ট গোল মুখ, গায়ে একটা হাঁটু অবধি লং শার্ট আর জিনস। চাহনিতে কোমলতা। নক্ষত্র দু’সেকেন্ডের চাহনিতে এটুকু লক্ষ করল। মেয়েটা তার থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে আরও এক কদম পিছে সরে এলো। দৃষ্টি নত করল। যেটা বলার জন্য বুক ভারি হয়ে ছিল, সবার আগে সেটা বলল,
-“আ'ম সরি।”

অতসী প্রশ্ন করল, 
-“কেন?”
-“জানো না?”
-“জানি না?”

মেয়েটা আগের মতো কথার জালে খেলছে। নক্ষত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
-“জানো।”
-“তবু তোমার মুখে শুনতে চাইছি।”
-“কী?”

অতসী হাসল,
-“সর ফর হোয়াট?”

নক্ষত্র বড়ো করে শ্বাস টানল,
-“ফর মাই বিহেভিয়ার, ফর এভরিথিং আই হ্যাভ ডান টু ইউ। ফর এভরি সিঙ্গেল থিং আই শ্যুড হ্যাভ ডান উইদ ইউ, বাট আই ডিডন্ট...”

অতসী ঘাড় কাত করে তাকাল,
-“দেন ফিক্স ইট।”

নক্ষত্র তাকাল না অতসীর দিকে। নতমুখী হয়ে হাসল,
-“তুমি ভালো করেই জানো, সবকিছু শুধরে নেওয়া যায় না।”
-“কেন যায় না?”
-“তুমি জানো না?”
-“অবুঝ সাজতে দাও। যদি কোনো আশা পাই..”
-“কেন ফিরেছ?”
-“টান..”

অতসী পাশের সিঁড়িতে বসে পড়ল। দুই হাত দুইপাশে রেখে খানিকটা পেছনের দিকে ঝুঁকে বলা শুরু করল,
-“টান খেয়েছি, নক্ষত্র। অনেক তো চললাম, তোমাকে ছাড়া থাকার চেষ্টা করলাম। শেষমেষ আর ইগো ধরে রাখতে পারলাম না। মানে কেমন একটা ফিলিংস... আই কান্ট ডিস্ক্রাইব!”

অতসী এটুকু বলে থামল। বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে ফের বলল,
-“ভাবলাম যে, একবার না-হয় যা চাই তা মুখ ফুটে বলি, একবার অন্তত খোলশ ছেড়ে বের হই। আত্মমর্যাদা সাইডে রেখে নির্লজ্জ হই। কে জানে, যদি পেয়ে যাই? এই একটা ‘যদি’র লোভে আজ বেহায়া হতে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরত্বের পথ পারি দিয়ে এখানে এলাম। তোমার মুখোমুখি হলাম। একটা তুমির অভাব আমাকে কতটা হাহাকার করায় তা যদি জানতে...”

নক্ষত্র নিশ্চুপ হয়ে পাশে বসল। অতসী তার নিরূত্তর মুখের দিকে অল্প কিছু সময় তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। হেসে উঠল অগোছালোভাবে,
-“নতুন কেউ এসেছে?”

নক্ষত্র ওপর নিচ একবার মাথা নেড়ে বলল,
-“হ্যাঁ।”

অতসীর হাসি ভয়াবহ করুণ শোনাল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল এলো, গলার আওয়াজে শোনা গেল নিজের প্রতি ভীষণ চাপা ক্ষোভ,
-“তুমি আমার সবক্ষেত্রেই কী বিচ্ছিরি এক ভুল, নক্ষত্র!”
.
.
.
চলবে.................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন