কামিনী - পর্ব ০১ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


          রানি কামিনীকাঞ্চনের নামে একটা গুঞ্জন আছে তার রাজ্যে— রানি কামিনীর হাতে না-কি প্রাণ গিয়েছিলো রানির পিতার। রাজ্যে এখনো কেউ জানে না কেন রানি নিজের পিতাকে মেরেছিলেন। কেউ বলে রাজসিংহাসনে বসার জন্য রানি নিজের পিতাকে হ ত্যা করেছেন। ক্ষমতার লোভ, নাকি তার অন্তরালে কোনো গল্প আছে তা কেউ জানে না। তবে সকলেই রানিকে ভয় পায়। যে নারী নিজের পিতাকে মারতে দু'বার ভাবেন না সেই নারীর মন কতটা পাষাণ সেটা বোধকরি আর কাউকে বলতে হবে না। 

প্রাচ্যের একটি রাজ্য নাম— এ্যাজেলিয়া। বেশ ছোটখাটো আয়তনের একটি রাজ্য। সেই রাজ্যে রয়েছে প্রচন্ড শৌখিনতা। চারপাশ সুন্দর, পরিপাটি ধরণের। সেখানের রানি হলেন কামিনীকাঞ্চন। যার রূপের কাছে হার মানে মধুমালতি থেকে রজনীগন্ধা। রানির রূপ যতটা সুন্দর, ততটাই হিংস্র তার আচরণ। রাজ্যে কেউ বিধি লঙ্ঘন করলেই তার জন্য অবধারিত শাস্তি হয় মৃত্যু। রানির কাছে পুরুষ মানেই কেবল একটি খেলার গুটি। একটি মনোরঞ্জনের বস্তু। তাহলে, রানির ভবিতব্য ছিলো কী?

 ১.

বড়ো কক্ষটি থেকে ভেসে আসছে তবলা আর ঘুঙুরের শব্দ। রানির মহলে আজও বাইজি নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছে। অতিথি হিসেবে আছেন পাশের রাজ্যের রাজা— ইনান ণেকিতান।
রাজ প্রাসাদে দাস-দাসীদের ভেতর চলছে কানাঘুষো। রানির এহেন নির্লজ্জতার চর্চা রাজ্য জুড়েই চলে। 

 বিশাল একটি কক্ষ জুড়ে রয়েছে রাজকীয় সৌন্দর্যতা। যেটা রানির শয়নগৃহ। সেই শয়নগৃহের পশ্চিম দিকের বিশাল আরশিটির সামনে বসেই তৈরি হচ্ছেন রানি কামিনী। তাকে তৈরি হতে সাহায্য করছে তার সখী যামিনী এবং তার খাসদাসী- রেবেকা উযোয়ার। রানীর চুলের পাশটায় গোলাপ লাগিয়ে দিতে দিতে যামিনী বলল,
 "আজ সখী তোমার সৌন্দর্যে রাজা ইনান বৈরাগী না হয়, দেখো।"

রানি কুটিল হাসলো, "পুরুষ সৌন্দর্যে বৈরাগী হয় না, সখী। পুরুষ বৈরাগী হয় কামের তাড়নায়।"

"কাম না বলে প্রেমও তো বলতে পারতে, সখী!"

রানি কামিনীর কুটিল হাসি বদলে গেলো তাচ্ছিল্যে, "পুরুষ আর প্রেম দু'টো বড্ড বেমানান শব্দ যে! পুরুষের ভেতর প্রেম আছে নাকি আবার! হয় আছে ক্ষমতার লোভ নয় আছে কামের তাড়না। নারীর প্রতি তাদের যৌন আকর্ষণকেই তারা প্রেম বলে।"

 "সব পুরুষ কি আর এক হয়, সখী?"

"আমি যতজনকে খুঁজে দেখলাম, যৌন খিদে ছাড়া আর কিছুই তো পেলাম না! সবাই ছুঁতে চাইলো দেহ, চুম্বন করলো আমার পদযুগল, নিতে চাইলো আমাকে শয়নগৃহে। এমন কেউ তো ছিলো না যে আমার দেহ রেখে অন্তরের খোঁজ করেছে। যে পদযুগল রেখে চুম্বন করতে চেয়েছিলো ললাট। যেদিন এমন কোনো পুরুষকে পাবো সেদিন নাহয় আমি মেনে নিবো সখী যে, পুরুষের ভেতরেও প্রেম আছে।"

 "দেখো সখী, সেদিন যেন আবার রানি কামিনীকাঞ্চন না বৈরাগী হয়ে যায়!"

"সঠিক প্রেম পেলে আমি বৈরাগী না-হয় স্বেচ্ছায় হবো।"
কথা শেষ করেই হাসলো রানি কামিনী। সেই হাসিতে তাল মেলালো যামিনী ও রেবেকা। 

 তৈরি হয়েই রানি গেলো নৃত্যরত গৃহে। শরীর যেন তার সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন দুলছে। চোখে আঁকা সুরমার টানে কী এক মোহিনী মায়া ছড়াচ্ছো। গায়ে জড়ানো পোশাকটি হতে সুগন্ধিটা যেন মাদকের মতন টানছে সকলকে। দাস-দাসী প্রতিবারের ন্যায় এবারেও মুগ্ধ হয়ে বারে বারে লুকিয়ে তাকালো। ফিসফিসিয়ে একজন অপরজনকে বলল,
 "রানির মতন এমন সুন্দর রূপ মনেহয় কারো নেই।"

বাকিরাও তার কথাকে সমর্থন দিয়ে বলল, "সঠিক বলেছো। এমন কোনো রাজ্যের রাজা, রাজকুমার নেই যিনি রানিকে পেতে চান না। এমন সুন্দর রূপ আমরা নারীরাই তো ফিরে ফিরে দেখি। পুরুষ মানুষ গলে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।"

এই প্রশংসার বিপরীতেও আবার কণ্ঠ ভেসে আসে, "রূপ সুন্দর হয়েও বা লাভ কি যদি সওদা করেই বেড়ায়! চরিত্র বলতেও তো একটা ব্যাপার আছে!"

সবাই সেই দাসীকে সাবধান করে। কেউ কেউ শাসিয়ে বলে, "রানি শুনলে আর রক্ষে থাকবে না।" 
ঠিক তখনই বিপরীত থেকে আসা কণ্ঠটি থেমে যায়। একেক দাসদাসীর একেক মতবাদ। কেউ রানি বলতে পাগল আবার কেউবা রানির এই চালচলনকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। 

দাসীদের এই কথোপকথনের মাঝেই সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পাহারাদারটা বলল, "এমন রূপ যার আছে সে তো রূপের বড়াই করবেই। আমার যদি কোনো রাজ্য থাকতো তবে এই রানিকে একদিন আমি ছিঁড়ে খেতামই। মাথা ধরে যায় এর রূপে।"

সকলে পাহারাদারকে সাবধান করে। রানি শুনলে এই মুহূর্তে গর্দান যেতো। 

 রানি গৃহে ঢুকতেই রাজা ইনান ছুটে এলেন। যেন বহু সাধনার পর তিনি এই রূপদর্শন করতে পারলেন। রানিকে দেখেই চকচক করে উঠল তার চোখ। তার ইহজীবনে এত লাবাণ্যময় রূপ কোথাও দেখেছেন বলে তার মনে পড়ে না। এই রূপের নেশায় তিনি এতই বিমোহিত থাকেন যে তার শয়ন গৃহে রানির কতগুলো ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন। তেলরঙে আঁকা তৈলচিত্র সব। দেশ-বিদেশের সবচেয়ে বড়ো বড়ো অঙ্কন শিল্পী দিয়ে এই চিত্রগুলো আঁকিয়েছেন। চিত্রগুলো দেখে মোটেও ধারণা করবার জো নেই যে এগুলো নকল। বরং মনে হয় সত্যি সত্যি রানি কামিনী দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ মুখে তার সেই কুটিল হাসি। অঙ্গে সেই উত্তাল ঢেউ! 
এই গল্প অবগত রানির। 

 "কতদিন পর অবশেষে দেখা মিলল আপনার, রানি কামিনী। কতদিন পর অবশেষে আপনার মহলে আসার অনুমতি পেলাম।"
ইনানের মুগ্ধতা ভরা কণ্ঠ। চোখ যেন সরছেই না রানির দিক থেকে। রানি ইনানের প্রশংসায় গাল ভরে হাসলেন। ঠাট্টা করে বললেন, "বেশি দেখা পেলে যে মুগ্ধতা কেটে যাবে, রাজা। 

"তাই বলে এত অপেক্ষা করাবেন?"

 "সুন্দর কিছুর জন্য অপেক্ষা করতেই হয়। সহজলভ্য কিছু সুন্দর হয় না আর সুন্দর কিছু সহজলভ্য হয় না। জানেনই তো!"

রাজা ইনান সহমত পোষণ করলেন। রানির সব কথাকেই তিনি সঠিক বলেই মনে করেন। রানির প্রতি একনিষ্ঠ মুগ্ধতার জন্যই তার এই বোধের উদয়। 
রাজা ইনানকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে যামিনী ঠাট্টা করল, 
 "ও রাজা, চোখ দু'টোর পলক ফেলুন! জল জমে যাচ্ছে যে!”

যামিনীর ঠাট্টায় নজর ফেলে রাজা। লজ্জায় হাসি এসে পড়ে তার ঠোঁটে। 

কথোপকথন আগায় নিজ গতিতে। রাজ্য নিয়ে শলাপরামর্শ আদান-প্রদান হয়। কথার এক পর্যায়ে খুব গোপনে রানির কাছে আবদার পেশ করে রাজা ইনান, 
" আমি আপনার নিকট একটা আবদার রাখতেই এসেছিলাম।"

রানি খুব ভালো করেই জানেন কী সেই আবদার। তবুও শুধালেন, "বলুন। আমার সাধ্যে থাকলে পূরণ করবো।"

সাহসী রাজা ইনানের তখন কণ্ঠে কাঁপুনি দেখা দেয়। অনবরত ঠোঁট কাঁপে তার। মিহি কণ্ঠে বললেন, "আমার রাজ্যে আপনার পদধূলি চাই।"
কামিনী হাসেন, "ব্যস্, এতটুকুই?"

রাজা ইনান এবার চোখের ইশারায় তার মন্ত্রীকে কিছু বলেন। এরপর মিনিট একের মাথায় পুরো নৃত্যশালা ভরে যায় হীরে, জহরত দিয়ে। ঝলমল করে সেই অধিক মূল্যবান দ্রব্যাদি। রানি তা দেখে পলক ফেলে তাকায় যামিনীর দিকে। যামিনীর ঠোঁটে তখন গর্বের হাসি। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝায়, তার বলা কথাটি মিলেছে। রাজা ইনান সত্যিই বৈরাগী হতে প্রস্তুত। 

যামিনীর ইশারা বুঝতে অধিক সময় লাগে না রানির। তিনিও হাসেন। চোখের ভাষায় জবাব দেন, হোক বৈরাগী। আমিও দেখি কতজন বৈরাগী হয়!

বাইজীদের নৃত্য ততক্ষণে স্থগিত হয়ে যায়। প্রতিটা বাইজী নারী চোখ মেলে সবটা দেখে। বুক কাঁপে তাদের। জীবনে এত মূল্যবান জিনিস এই প্রথম দেখেছে বলে লোভ হয়। আফসোসও হয় সাথে। মনে মনে বিড়বিড় করে, অভিযোগ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে। কেন তারা রানি কামিনীর মতন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী হলো না- সেই অভিযোগ। 

রাজা ইনান একটি রূপোর থালা হাতে নেন। যেই থালায় হীরের একটি বিশাল গহনা ছিলো। সেই থালাটি এগিয়ে ধরেন রানির দিকে। দৃষ্টি তার নত। সংশয় ভরা কণ্ঠ। বললেন,
 "আপনাকে আমি আমার রাজ্যের রানি বানাতে চাই।"

রাজার এহেন প্রস্তাব শুনে রানি কামিনীর ভেতর কোনো ভাবাবেগ হলো না। কারণ সে জানতোই এমনটা হওয়ার ছিলো। যে মানুষ নিজের শয়নগৃহে রানির ছবি ঝুলিয়ে রাখে সে পুরুষ নিশ্চয় বিছানার পাশটাতে রক্ত মাংসের গড়া রানিকে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক।
 রানির নিস্তব্ধতায় রাজা ইনান কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেন। আমতা-আমতা করে বললেন, "আপনি ভেবে দেখুন। তারপর আমাকে বলবেন। কোনো তাড়া নেই।"
রানি কামিনী হেসেই জবাব দিলেন, "ঠিক আছে। চলুন এবার খাবার খেতে।"

রাজা ইনান যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। ভেবেছিলেন রানি বোধহয় রেগে যাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি বলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে খাবার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। রেবেকা উযোয়ারকে ইশারা করলেন রানি রাজাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। রেবেকা ইশারা বুঝেই নিয়ে গেলো।
বাইজিদেরও কক্ষ থেকে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন রানি। সবাই বের হতেই কক্ষ জুড়ে অবশিষ্ট রইলেন রানি এবং যামিনী। 
 সবাই বের হতেই যামিনী এগিয়ে এলো। রানির বাহুতে হাত রেখে বলল, "রাজা ইনানকেও তো তুমি বিয়ে করবে না, সখী। তবে কেন প্রস্তাব নাকচ করলে না? এ তোমার কেমন খেলা?"

কামিনীর ঠোঁটে ঘৃণাভরা হাসি ফুটে উঠল, "আমি দেখতে চাই আমাকে পাওয়ার জন্য কতকাল সবাই অপেক্ষা করে। সখী, ভালোবাসার এই নাটক দেখতেও ভালো লাগে যে!"

 "এ নিয়ে সাত চল্লিশটি রাজ্যের রাজা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাইশ জন বিবাহ করে নিয়েছে। তেরো জন প্রাণ দিয়েছে। আর কত সখী?"

 "যতদিন না অব্দি পুরুষ ও প্রেমকে আমি মেলাতে পারছি ততদিন অব্দি এটা চলবেই।"

যামিনী আর কিছু বলে না। কারণ প্রতিবার প্রস্তাব নাকচ করার পর রানিকে বিচলিত দেখা যায়। কীসের একটা ঘৃণা যেন তার চোখ-মুখে দেখা যায়। সেই সময় রানি কামিনী কীসের এক ঘোরে থাকেন যেন! 

 ২.

 নিস্তব্ধ রাজপ্রাসাদ। গোঙানোর শব্দ আসছে থেকে-থেকে। শব্দটির উৎস রানির কক্ষ। রানির কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে যামিনী। চোখ তার ছল ছল করছে। দাসী রেবেকা উত্তেজিত কণ্ঠে যামিনীকে বলল,
"আপনি একটু ডাকুন না, রানিকে। উনি কেন নিজেকে এভাবে প্রহার করছেন?"

যামিনীর চোখে বেদনা ফুটে উঠল, "প্রতিবার পুরুষদের প্রস্তাব নাকচ করার পরেই সখী নিজেকে আঘাত করে। চাবুক দিয়ে দেহে দাগ ফেলে দেয়। জানি না কী তার কারণ। কখনো বলেনি।"

 "আপনি একটু আটকান তাকে।"

"সখী থামবে না, রেবেকা। যতক্ষণ মনমতো নিজেকে কষ্ট না দিবে ততক্ষণ থামবে না। তুমি বরং রান্নার ঠাকুরকে গরম জল বসাতে বলো। আর বৈদ্যকে খবর দাও।"

রেবেকা বিচলিত নয়ন নিয়েই সরে গেলো। রানির ঘর থেকে তখনও শব্দ আসছে গোঙানির। সাথে চাবুকের শব্দ। কী নৃশংস ভাবে আঘাত করছে নিজেকে। 
যামিনী দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে এই নৃশংসতার শেষের। এই নারীকে সে সাথে থেকেও বুঝতে পারলো না আজও। প্রতিবার গর্বের সাথে পুরুষদের প্রত্যাখ্যান করে কেন নিজেকে আঘাত করেন তিনি? কী চলে উনার মনে? 

তখনই ঘরে বিকট শব্দ হলো। রানি কামিনী হার মেনে নিয়েছেন নিজের মারের কাছে। এবার তাকে সামলাতে হবে। তাকে যে একটু ভালোবেসে, যত্ন করার কেউ নেই। তা-ই বুঝি সে নিজের প্রতি এত অমানবিক? 
.
.
.
চলবে.........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন