দুচোখ থমকে সামনের দৃশ্যটুকুর দিকে নির্বাকভাবে চেয়ে আছে। অবিশ্বাস্যকর দৃশ্য! সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যিই তার একাকী নিঃশব্দ ঘরে এরকম কোনো অর্থবহ দৃশ্যপট ধরা দেবে। বুক মথিত শ্বাসটা আস্তে করে ছেড়ে দিতেই রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল। রুমে লাইট জ্বলছে না। তবে বাইরে থেকে আসা এমুখো নিয়ন আলোয় ড্রিমলাইটের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে রুম। সারা ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো জায়গা গ্রহণ করেছে অসংখ্য অনেক ছবি। পাশেই রাখা ঢাউস সাইজের ফটো অ্যালবাম। সেখান থেকে খুলে খুলে নেওয়া ছবিগুলো যে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ঘুমন্ত বউ দেখেছে, তা অবস্থা দেখে অনুমানযোগ্য। দুপুরের গোলাপি শাড়িটা পড়ণে। শুকনো শরীরটা শীত নিবারণ করার জন্যে গায়ে জড়িয়েছে সবুজ রঙা চাদর। সটান সাবধানে রাখা ডান পায়ের নীচে ছোট্ট কুশনের অস্তিত্ব। মুখ কোঁচকানো প্যাঁচার মতো দেখাচ্ছে কুশনটা। বরফ ঠাণ্ডা ফ্লোরে বসা অবস্থায় গা ঘেঁষা দেওয়া বিছানার ওপর রেখে দিয়েছে মাথা। ঘন কালো সমান ঝলমলে চুলগুলো ঢেকে রেখেছে ওর ঘুমন্ত সরল মুখ। নিঃশ্বাসের ঘুমন্ত ভারি ভারি ছন্দে উঁচু নীচু হচ্ছে মসৃণ পিঠের উপরিতল। ইচ্ছে করছে বুকের ভেতরে ছোট্ট পুত্তলির মতো লুকিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। নির্নিশেষ চোখে ব্যাপারটুকু দেখার পর পোশাক পালটে, হাতমুখ ধুয়ে ওর কাছটায় এসে বসলো সাঈদ। কোলের উপর থেকে সরিয়ে নিল দু চারটা আয়তাকার ছবি। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পর আর কোনো ছবি শোভা পায়নি শৈশবের এই ছবিগুলোর ভেতর। সে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে এই অ্যালবাম নামক স্মৃতি থেকেও। তবু দেখে বড্ড অবাক লাগল যে তার স্ত্রী, তার পরমা প্রিয় রমণীরত্ন ঘরের আনাচে কানাচে ঘুরঘুর করে খুঁজে নিয়েছে এই নিভৃত লুকোনো অ্যালবামটি। কতটা দুরন্ত হলে পূর্ণ রেস্ট বাদ দিয়ে অ্যালবাম খুঁজে সময় কাটাতে যায়! ব্যাপারটা ভেবে হাসি পেল তার। সেই সঙ্গে ভর করল অকথিত এক ভয়। এই যে কৌতুহলপ্রবণ ঝোঁক থেকে একটু একটু করে তার ধূলো ভরা জীবনের বন্ধ দরজাগুলো খুলতে শুরু করেছে, এর শেষ পরিণতিটা কেমন করুণ হবে? কেমন হবে সবটা জানার পর? মনুষ্য জীবনে কিছু কিছু সত্য যে সবসময় আড়ালে থাকতে হয়! এ যে প্রকৃতিরই বানানো নিয়ম! আজও কী মানুষ গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছে? পেরেছে কী সূর্যের বুকে কখনো চাঁদের মতো পদচারণ করার সুযোগ? সমস্ত ছবি একত্র করে সেগুলো আলমারির সবচেয়ে উঁচু জায়গায় রেখে ওর সংলগ্নে এসে বসলো সাঈদ। মুখের ওপর রাশি রাশি চুলগুলো ডানহাতে সরিয়ে ঘুমে বিভোর মুখটা নীরব স্পর্শে উন্মোচন করল। চক্ষু শীতল করা ওই শান্ত স্বস্তিদায়ক মুখ, বুকের ভেতরে দখিনা হাওয়ার মতো শীতলতা জুড়োনো দৃশ্য, সে দৃশ্যপটের কাছে বড়ো দুর্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। ঠাণ্ডা খসখসে হাত দিয়ে কবোষ্ণ গালটা ছুঁয়ে ধরতেই বুকের ভেতরে কেমন ঝনঝন করে ঝংকার দিয়ে উঠে! রক্তে লাগে মদিরা টান। মনে মনে সে অনুভব করে বড়ো ভুল করেছে ওকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে। সে তো পারতো একটুখানি স্ক্যাজিউল এদিক ওদিক করে নিজেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু তা সে করেনি মোটেও। সবসময়ের মতো অগ্রাধিকার দিয়েছে সে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনকেই। ঘুমের ঘোরে ওর রূপসুধা পানের আকণ্ঠ তীব্র বাসনায় নিজের মনের ভেতরে বাঁধনছাড়া অনুভব করল সাঈদ। যেন অতি অমানবিক নৃশংসতা শেষে একটুখানি ফুলের পরশে গা ডুবোতে বড্ড নির্মল ইচ্ছে জেগেছে। দুঠোঁট এগিয়ে নরম উষ্ণসূচক গালে ছোট্ট ছোট্ট আদর ছুঁয়ে দিতেই নিঁখুত দুটি গোলাপী ওষ্ঠযুগল স্পর্শ করল সাঈদ। মূহুর্ত্তের মধ্যেই ওর সম্পূর্ণ শরীরটুকু বুকের মধ্যে চেপে ফ্লোর থেকে কোলের মধ্যে রেখে দেয় সে। ঝটিতি কাণ্ডে ফিহার দুচোখের গভীর তন্দ্রা ভেঙে যেতেই চক্ষু কপাট মেলে আবিষ্কার করে আদররত এই পুরুষটিকে। তার উন্মত্ত বিভোর ভালোবাসা . . তার উত্তাল সমুদ্রের মতো সম্মোহন করা আবেগ প্রাবল্য . . তার নিঃশ্বাসের ঘনিষ্ঠতায় লুকিয়ে থাকা বিচিত্র কোনো আপন ভাব . . ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যায় ফিহা। অর্ধঘুমে জড়ানো চোখদুটি মুদিয়ে ফেলে। তার আবেগের সংসর্গে আবদ্ধ হয়ে নীরব সময়টুকু ওভাবেই স্মৃতি স্পর্শে পেরুতে দেয় ও। অনুভব করে তার এই বিভোর পুরুষটি চার দেয়ালের মাঝে বড্ড বিহ্বল, বড্ড ডুবো ডুবো হয়ে পরেছে। তার পেশিবহুল বুকের ভেতরে ভীষণ ধ্বক ধ্বক করছে অস্থির পাঁজি হৃৎপিণ্ড। ফিহা নিজেকে মুক্ত করে তার মদিরপিপাসু চোখদুটিতে অশান্ত নয়ন বিদ্ধ করে বলল,
- আপনার হার্টবিট ...
কোনো প্রত্যুত্তর করল না সাঈদ। চিন্তিত চোখদুটোকে উপেক্ষা করে সে বরং বুকের ভেতরে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরল প্রিয় মানুষীর পালক নরম দেহ। চুল সরিয়ে ডান কাঁধের কাছে ছোট্ট বাচ্চার মতো লুকিয়ে রাখল নিজের মুখ। যেন বোঝাতে চাইল, আমি আমার মতো করে এই সুন্দর মূহুর্তটুকু অনুভব করতে চাই নাবিলা। আমার বুকের মধ্যে চূড়ান্ত ভাবে মিশে থাকুন। আমার ভালো লাগছে। আপনার গায়ের খুশবু, আপনার গায়ের কোমল তাপ . . স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুম এসে যাচ্ছে। ফিহা তার মেয়েসুলভ ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় দ্বারা অনুমান করল মানুষটার অন্দরমহল। সে যে মন ভরা তিঁতকুটে ক্লান্তিগুলো ঝেড়ে মুছে ওর দরবারে খুঁজছে সোনালী ক্ষণ, একটুখানি ঘুম ঘুম সান্নিধ্য তা বুঝতে একটুও দেরি হল না ওর। ডানকাঁধে থাকা মুখটার কাছে নিজের বাঁ গালটা খানিক স্পর্শ করে বলল,
- কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ? গভীর রাতেও হুটহাট অদ্ভুত সময়ে ডিউটি পরে?
গভীর দমটুকু ছেড়ে চোখ বুজে রাখল সাঈদ। নিষ্প্রভ স্বরে জানালো,
- আপনি আমাকে এতো মিস করবেন জানলে বেরুনোর আগে চিন্তা করতাম। বাইরে যাওয়ার আগে এ ধরণের ভয়েস রেকর্ড টেক্সট কাউকে পাঠাইনি। আপনি-ই প্রথম।
প্রথম কথাটি শুনে স্বস্তির হাওয়ায় ঠাণ্ডা হয়ে আসে ফিহার অন্তঃস্থল। কোনো অনুযোগ, অভিযোগ, বুক মথিত করা খারাপ লাগা আর ছুঁতে পারে না ওকে। দুঠোঁটের কোণ দুদিকে চওড়া হয়ে মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠে। আকণ্ঠ ভালোলাগায় চোখ মুদিয়ে রাখলে আবারও তাকে গভীরভাবে নিজ সত্তায় অনুভব করে বলল ও,
- আপনার অনুমতি ছাড়া অ্যালবাম ধরার জন্য দুঃখিত। পায়ের জন্য এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুমে একা একা যেহেতু সময় কাটছিল না, তখন আলমারির একটু নীচের দিক থেকে আপনার অ্যালবামটা খুঁজে পেয়েছি। বলতে হবে, আপনি ছোট্টবেলায় বেশ নাদুসনুদুস বাচ্চা ছিলেন। ইংরেজ বাচ্চাদের মতো টকটকে ফর্সা। মাথাভর্তি পাতলা চুল। দুটো টুকটুক করে তাকিয়ে থাকা চোখ। ভীষণ মায়া মায়া মুখ।
ফিহার ওমন সরল সহজ বাচনভঙ্গিতে এমন কিছু অভিব্যক্তি মেশানো ছিল, যা শুনে মহাগম্ভীর পুরুষটিও চাপা অস্ফুট হাসিতে হেসে দেয়। কখনো নিজেকে নিয়ে বিশদ বিবরণ তেমন একটা শোনেনি সে। এভাবে নিজের নবজাতক দিনের কথা স্ত্রীর মুখে শুনতে পেয়ে ব্যাপারটা ভীষণ হাসিসুলভ লেগেছে। দুকানে সম্পূর্ণ শুনল ফিহা, জাঁদরেল লোকটির অত্যন্ত চাপাসুলভ হাসি। ধন্য অনুভব করল নিজেকে, এই অন্তর্মুখো মানুষটাকে নিজের জীবনে ভীষণ আপন ভাবতে পেরে। তার হৃদয় ভরা সমুদ্র সম ভালোবাসা, তার বুকের ভেতরে জমে থাকা কলকল স্রোতের মতো আবেগ সম্পূর্ণই নির্মল, স্বচ্ছ, ঝরঝরে শিশিরের মতো পবিত্র সম্মোহন। চোখ তুলে অদূর দেয়ালে থাকা রেডিয়াম ঘড়িতে একপলক সময় দেখে গাল ছুঁয়ে থাকা মানুষটির কানের নিকটে বলল,
- রাত গভীর হচ্ছে জনাব। ঘড়িতে আড়াইটার কাছাকাছি সময়। এখন শুয়ে পরলে বোধহয় ভালো হয়। আপনি ভোরে উঠবেন?
- হুঁ।
- তাহলে উঠে পরুন। ঠাণ্ডাটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ঘরের ভেতরে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছি বলে অতো ঠাণ্ডা অনুভব করছেন না। ফ্লোর কিন্তু ভীষণ বরফ! বিছানায় উঠে পরুন। উঠুন।
নাছোড় ভঙ্গিতে বলে ওঠা ফিহা আরেকবার তাকে তাগাদা দিতেই সাঈদ উঠে পড়ল বসা থেকে। স্পষ্ট অনুভব করল, ওকেও বসা থেকে পাঁজকোলে তুলে শূন্য বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে।
••••••••••••••••
গৎবাঁধা সময়কে পাল্লা দিয়ে আপামর জীবনে ব্যস্ত সংকীর্ণ দিন ঘনিয়ে আসে। ঘনিয়ে আসে ভবিষ্যৎ দিনের অজস্র অনেক বিঘ্নসংকুল ঘটনা। ধানমন্ডির ওই একমাত্র বাড়িটিকে ঘিরে কতজন প্রহরী পাহারায় আছে তা অনুমান করাসাদা চোখে সহজ নয়। ছদ্ম পোশাকে থাকা দুজন কট্টর প্রহরী সর্বক্ষণ যে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে এ ঘটনা কারো না কারো চোখে পরবার কথা। তবে যার চোখে না পড়লেই ব্যাপারটা সমীচিন হতো তার নজরেই এক দুপুরে ঘটনাটা ধরা পড়ল। ডানপায়ে চলাচল করার প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ব্যথা ও ফোলা ভাব ক্রমশ কমে এসেছে। বারটা মঙ্গলবার। এ নিস্তব্ধ বাড়িতে বধূরূপী বিচরণ করার ঠিক পন্ঞ্চমদিন। পন্ঞ্চমদিন হলেও নিজেকে কোনো অংশে মনে হয়নি খাপছাড়া সদস্য বা নবাগত কেউ। বরং এ বাড়ির মানুষজন এতোই নীরব, এতোই ব্যস্তমুখর দিন গুজরান করে যে একমাত্র রাতের প্রহরে দেখা মেলে সকলের। বড়োই অসংলগ্ন সময় কাটে ফিহার। জানে না বাকি ছাব্বিশটি দিন কী করে কাটবে। তার কর্ণেল শ্বশুরের ছুটি শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি। নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার তাগিদে তিনি বৃহস্পতিবারের জন্য আগাম প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছিলেন সেদিন। খোলা বারান্দায় দূর আকাশে একজোড়া পাখিকে ডানা মেলে উড়ে যেতে দেখে ফিহাও ছিল সে দৃশ্যপটে মন্ত্রমুগ্ধ। কিন্তু তখনই অদূরে থাকা আরেকটি দৃশ্যপটে ওর নজরবন্দি হয়ে যায়। কৌতুহল বিদ্ধ চোখে দুটো অজ্ঞাত লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা চিপ খেয়ে আসে। ও জানে না এ দুটো লোক আদৌ সৎ উদ্দেশ্যে এসেছে কিনা, কিন্তু নারায়ণগঞ্জ শহরে নিজ বাসাবাড়িতে যে দৃশ্যটা ও একদিন রাতে দেখেছিল আবারও সে ভয়টা ওকে তাড়া করে বেড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে সাবধানে পা চালিয়ে ফিহা চলে আসে সোয়াদ জাকিরের রুমে। এসেই হাঁপানি রোগীর মতো লম্বা লম্বা দম নিতে থাকলে ইজিচেয়ারে বসা সোয়াদ তৎক্ষণাৎ নিউজপেপার বন্ধ করে উত্তেজিত স্বরে বললেন,
- মা, কিছু হয়েছে তোমার? ওরকম হাঁপাচ্ছ কেন? আসো ভেতরে আসো। এক্ষুণি ভেতরে এসে বসো।
পায়ের গোড়ালি ভাগে চাপ না দিয়ে সমুখভাগে ভর দিয়ে হাঁটতে পারে ফিহা। সেভাবেই আস্তে আস্তে পা চালিয়ে সোয়াদের বিপরীতমুখো একটা চেয়ারে এসে বসল। ডানহাতের উলটো পিঠে নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামটুকু মুছে কিছুটা ধাতস্থ স্বরে বলল,
- বাসায় কেউ নেই দেখে সরাসরি আপনার কাছে চলে এসেছি খালু। সুফিয়া খালা বাজারে গিয়েছেন। আমি দুঃখিত যে দরজায় নক করতে মনে নেই।
সোয়াদ কোলে ভাঁজ করা পেপারটা আরো একপ্রস্থ ভাঁজ করে সেটা পাশের বিছানার ওপর রেখে তিনি বললেন,
- তুমি ওসব ফরমালিটিতে না গেলে আমি বরং খুশি হব মা। তুমি এখন খুলে বলো কী হয়েছে তোমার। তুমি ওরকম অস্থির মুখে কেন নেমে এলে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
চিন্তাকীর্ণ চোখদুটো সেনা শ্বশুরের দিকে নিক্ষেপ করে সবটুকুই বলল ফিহা,
- আমার মনে হচ্ছে বাড়ির বাইরে কেউ নজর রাখছে খালু। দুটো বেঢপ লোক কিছুদিন ধরে বারান্দা বরাবর দূরের রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে থাকে। এরকম যদি হতো যে শুধু একবেলা দাঁড়াচ্ছে তাও না। আমি রাতের দিকেও যখন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, তখনো দেখতে পাচ্ছি ওদের। আমি আসলে বুঝতে পারছি না এরা ভালো লোক কিনা।
পুরো ব্যাপারটা শোনার পর তেমন কোনো বিকার ঘটেনি না সোয়াদের। বরং তিনি শান্তমুখে জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে বললেন,
- শুধু কী দাঁড়িয়ে থাকে নাকি অন্য অঙ্গীভঙ্গী দ্বারা বাঁকা কাজও করছে?
ফিহা সজোড়ে মাথাটা ডায়ে বাঁয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
- না একদম না। শুধু রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম দেখলে মনে হবে রাস্তার ওধারে এমনিই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় ও দুটো স্বাভাবিক লোক নয়।
ফিহার সরল অবোধ ভাবভঙ্গিতে মুচকি হাসেন সোয়াদ জাকির। তিনি বুঝে গেছেন আসল ব্যাপারটা। পানির গ্লাসটা আদরের বউমার দিকে বাড়িয়ে তিনি বললেন,
- ওসব নিয়ে টেনশন কোরো না তুমি। যদি মনে করো খালি বাড়িতে কোনো বিপদ বা অঘটন ঘটবে, তাহলে এ কথা মনে রেখো তোমার শ্বশুর এখনো জীবিত। সে থাকতে এ বাড়ির আশপাশে কোনো ঝামেলা ভিড়বে না। তোমার বাবা কিন্তু এ ভরসাতেই আমার সাথে যোগাযোগ করে প্রথমবার তোমাদের দুবোনকে থাকতে পাঠিয়েছিল। আর এখন তো তুমি অন্য ব্যক্তির দায়িত্ব হয়ে গেছ। আমার মনে হয় না বিপদের আঁচ ওই অবধি সে আসতে দিবে। বুঝতে পারছ তো কার কথা বলছি? নিশ্চিন্ত থাকো। পানিটা খেয়ে নাও মা।
শ্বশুরের আশ্বস্ত ভরা কথায় মন কিছুটা শান্ত হলেও ফিহার আবারও প্রশ্নের স্তুপ জমা হচ্ছে মনে। পানির গ্লাসটা টেনে নিয়ে চুমুক দিতেই খট করে একটা কথা মাথায় বিঁধল। কী এমন নিরাপত্তা চর্তুদিকে দিয়ে রেখেছে যে ওর শ্বশুর মশাইটা একেবারে নির্ভার হয়ে আছে? উনি কী তবে জানেন এ বাড়ির বাইরে দুটো অজ্ঞাত লোকের কথা? জানেন বলেই কী ফিহাকে এখন নিশ্চিন্ত থাকতে বলছেন? সাধারণ হলেও স্বাভাবিক নয় ব্যাপারটা। দুঢোক খাওয়া পানির গ্লাসটা নামিয়ে রাখতেই ফিহা ' আসি খালু ' বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন। কিন্তু হুট করে একখানা প্রশ্ন বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে ত্রস্তস্বরে শুধালো,
- আপনি কী জানেন ও দুটো লোক কেন, কীজন্য চব্বিশ ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে? আপনার হয়ত জানার কথা।
আবারও পেপার হাতে তুলে নেওয়া সোয়াদ জাকির কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম শান্তমূর্তি ধারণ করলেন। হয়ত ছেলের মতোই মনে মনে ভেবে নিচ্ছেন কোন শব্দগুলো ব্যবহার করলে অল্পকথায় ব্যাপারটা সমাধা হয়। তিনি রিডিং গ্লাসের ফাঁক দিয়ে পেশাসুলভ দৃঢ়কণ্ঠে কাঙ্ক্ষিত জবাবটা রাখলেন শেষমেশ,
- আমাকে এ বিষয়ে এটাই জানানো হয়েছিল বাড়ির বাইরে কোনো অচেনা মুখ দেখলে চিন্তা না করতে। নিরাপত্তা নিয়ে অযথা কোনো কথা না তুলতে। এর বাইরে আমি কিছুই তেমন জানি না।
মুখ বিবর্ণ করা অন্ধকার মানসপটে ফিহা কিছুই বলার মতো চিন্তাভাবনায় রইল না। মাথার ভেতরে ভাঙা কাঁচের মতো ঝনঝন শব্দে বিহ্বল অনুভব করল ও। বুঝতে এতটুকু বাকি রইল না এ গোপনতম কাজটায় একজন মাত্র লোকের অদৃশ্য হাত রয়েছে। সে আর দ্বিতীয় কেউ নয়, স্বয়ং সাঈদ-ই। কিন্তু তার মতো সাধারণ একজন পুরুষের পক্ষে এতোদূর স্পর্ধা গেল কীভাবে? কীভাবে এটা সম্ভব!
•••••••••••••
রাতের অন্ধকারে খু° ন হয়ে যাওয়া ছোকরাটির লাশ নিয়ে তেমন কিছুই খবরে ছাপানো হয়নি। উলটে পালটে আরো ক'পাতা পরোখ করে অবশেষে টুকরো টুকরো করে খবরের কাগজটা ছিঁড়ে পেপার বিনে ফেলল লাবিব। একটু আগে গোপন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছে রাঙামাটির কিছু এলাকায় সন্দেহজনক চলাফেরা পরিলক্ষিত। ব্যাপারটাকে পু° লি শি তৎপরতায় সামাল দেওয়া গেলেও লাবিবের মনে হচ্ছে দেশের ভেতরে খুবই ভয়ানক একটা পরিস্থিতি ঘটতে চলেছে। যার হাওয়া প্রকৃতির মাঝে রহস্যভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঠিকই, শুধু স্পষ্টচোখে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। তার উপর ছত্রিশ ঘণ্টা আগে আরো একটি সূত্রে অদ্ভুত একটা তথ্য পেয়েছে ও। টেবিল থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে সরাসরি কল করল সে ইয়ামিন আদিবের কাছে। ফোনটা দুবার রিংটোন বেজে ওপাশ থেকে রিসিভের সুর ভেসে আসতেই লাবিব উৎকণ্ঠা মেশানো স্বরে বলল,
- কী খবর দোস্তো? খবর যেটা শুনলাম ওটা কী সত্যি? আসলেই কী গু ম হইছে?
আদিবের কণ্ঠে কেমন যেন হতাশা জড়ানো সুর,
- নিউজ সত্যি লাবিব। সরফরাজ দীপ ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে নিখোঁজ। ওর বাড়ির কেউ এখনো জানে না দীপ সম্পূর্ণ লাপাত্তা। বাড়ি থেকে যদিও বলে আসছে সিলেটের ওইদিকে কাজের সূত্রে ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু দীপ গু ম! সিসিটিভির ঝাপসা ফুটেজে এটাই বুঝলাম ওকে দিয়ে কিছু করানোর উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে গেছে। কাজ হাসিলের আগপর্যন্ত জ° বা° ই° করবে না।
ভয়ংকর কথাটা শুনে টনক নড়ে উঠল লাবিবের। সে তৎক্ষণাৎ আদিবের উদ্দেশ্যে অস্থিরচিত্তে বলে উঠল,
- দীপের মাধ্যমে সাঈদের ফাঁসার চান্স আছে মামা? ওরা দুজন যে খালাতো ভাই এমন তথ্য ওইদিকে লিক হইছে?
- লিক হলে এতোক্ষণে সব তছনছ যেতো! আপাতত মনে হয় না ওই রাস্তায় কোনো ভয় আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সাঈদের কপালটা আসলেই খারাপ। শা° লা সবার লাস্টে বিয়েটা করল ঠিকই, কিন্তু এখনো স্বাভাবিক স্ক্যাজিউল নিয়ে নাবিলারে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারল না।
- তার চেয়ে বড়ো কথা ওরা একজন কম্পিউটার ইন্ঞ্জিনিয়ারকে, একজন সাইবার বিশেষজ্ঞকে, একজন চেনাশোনা লোকের খালাতো ভাইকে নিয়ে গেছে। ওরা দীপকে দিয়ে কোন কোন জায়গায় ব্যবহার করতে পারে আদিব, এটা চিন্তা করতেও আমার আত্মা কেঁপে উঠতেছে। আল্লাহ না করুক ওরকম কিছু হোক। দুআ করতেছি কোনো ক্লু বের হয়ে আসুক। নাহলে সামনের দিন খুবই খারাপ আসতে যাচ্ছে . .
.
.
.
চলবে....................................................................