এক হাজার টাকা - পর্ব ১৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


পুকুরের উপর বাঁশ দিয়ে মাচা বানানো। ছনের ছাউনি দেয়া আছে যাতে রোদ না লাগে। বরশি ফেলে মাছ ধরার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা। কমল আর আমি পাশাপাশি ছিপ ফেলে বসে রয়েছি। পুকুরের উপর এরকম আরও কয়েকটি মাচা আছে। সেসব মাচায় কমলের কাজিনরা রয়েছে। আমাদেরকে প্রাইভেসি দেয়ার জন্যই হয়তো তারা কেউই আমাদের মাচায় আসেনি। ঘন্টাখানেক হলো ছিপ ফেলেছি। একটাও মাছ পাইনি অথচ আমার পাশে বসে কমল তিনটা বড় তেলাপিয়া, একটা বেশ বড় বোয়াল আর একটা ছোট সাইজের শোল মাছ পেয়েছে। প্রথমদিকে আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল আমি মাছ পাইনি বলে। এখনো ঠোঁট উলটে বসে আছি। কিন্তু সত্যি বলতে এখন আর খারাপ লাগাটা নেই। মাছ পেয়েই বাচ্চাদের মত আনন্দে উচ্ছসিত হওয়া কমলের মুখটা দেখার মত। আমাকে আবার ভেঙাচ্ছে আমি পাইনি বলে! আমিও উলটো ভেঙাচ্ছি। কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে এই ভেবে যে আমি তার কাছে হবু স্ত্রীর চেয়ে বেশি বন্ধু। আমরা এখন গাজীপুরে একটা রিসোর্টে আছি কমলদের ফ্যামিলি পিকনিকে। সেই রিসোর্টের সীমানার মধ্যেই এই পুকু রটা। তারাই এখানে মাছ ধরার ব্যবস্থা রেখেছে। এখানে আসার আগে যখন আমার হবু শ্বশরবাড়ির লোকজন আমাকে আনতে চাচ্ছিল তখন মা অনুমতি দিচ্ছিল না যেহেতু বিয়ে এখনো হয়নি। পরে কমলের বাবা আমাদের সবাইকে ইনভাইট করলেন। দাদাজান, বাবা আর মা এলেন না। ছোটচাচ্চু আর মিন্নিকে পাঠালেন। ছোটচাচ্চু সাথে থাকলে মা নিশ্চিন্ত। রোদটা পড়ে গেছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। বাতাসে পুকুরের পানিতে ছোট ছোট ঠেউ খেলে যাচ্ছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি।

হঠাৎ কমল বলল,
"জানো তিন্নি, প্রথম প্রথম আমি একটু ভয়ে ছিলাম।"

আমি আর কমল পাশাপাশি বসা। ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
"কী নিয়ে ভয়?"

"এই যে আমাদের মধ্যে বয়সের এত ডিফারেন্স। এডজাস্টমেন্ট হবে কিনা এই নিয়ে ভয়ে ছিলাম।"

আমি হেসে জানতে চাইলাম,
"এখন কী মনে হচ্ছে?"

সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জবাব দিল,
"এখন তো মনে হচ্ছে পারফেক্ট ম্যাচ। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষের সাথে কীভাবে থাকবো ভেবেই বুকে ব্যথা শুরু হয়ে যেত। আর এখন বিয়ের দিন গুনছি।"

আমি এবার শব্দ করে হেসে ফেললাম। সে বলল,
"এই প্রফেশনে এসে এত ডিভোর্স দেখেছি যে বিয়ে বিষয়েই ভয় ঢুকে গিয়েছিল মনে। আর এরেঞ্জ ম্যারেজ নিয়ে আগে থেকেই একটা ভীতি কাজ করতো। কখনোই ভাবিনি এই আমি এরেঞ্জ ম্যারেন করব!"

"তাহলে করছ যে?"

আমার এই প্রশ্নে সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"প্রেম টেকেনি। ফ্যামিলি থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমাদেরই এডজাস্ট করতে সমস্যা হচ্ছিল। একসময় সে ব্রেকাপ চাইলো। আমিও আটকাতে চাইনি।"

"কবে ব্রেকাপ হলো?"

"অনেক দিন প্রায় ৪ বছর।"

"অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল?"

"না দু/তিন মাসের। আমার কোনো প্রেমই তিন মাসের বেশি টেকেনি। কোনো না কোনো একটা ভেজাল লেগেই যায়।"

আমি অবাক হয়ে বললাম,
"কতগুলো প্রেম করেছো?"

কমল হেসে বলল,
"কলেজে পড়ার সময় পাশের বাসার এক বড় আপুর প্রেমে পড়েছিলাম। সে কিছুদিন নাচিয়ে ছেড়ে দিল। ছোট ছিলাম বুঝতে পারিনি। খুব কষ্ট পেলাম। এরপর ভার্সিটিতে উঠে আবার এক সিনিয়রের প্রেমে পড়লাম। সিনিয়র জুনিয়র বেশিরভাগ প্রেমই টিকে না। জানোই তো। আর তারপর একটু আগে যার কথা বললাম। সব মিলিয়ে তিনটা।"

আমি হেসে বললাম,
"আচ্ছা এই তাহলে বিষয়। বড়দের উপর দূর্বলতা বলেই আমাদের বয়সে এত গ্যাপ দেখে ভয় পাচ্ছিলে!"

কমলও হেসে দিল। তারপর বলল,
"আরে না। ওই বয়সে সিনিয়রদের ভালো লাগে না এমন ছেলে হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাবে না। তবে আমার ভালো লাগার মানুষগুলো আমাকে সুযোগ দিয়েছিল বলে সম্পর্ক হয়েছিল। সবার ভালোবাসার মানুষ সুযোগ দেয় না। পার্থক্যটা এখানেই।"

"ভালোই হলো কথা উঠে। আমিও তবে আমার অতীতের কথা বলার সুযোগ পেলাম।"

কমল বরশি তুলে ফেলল। গুছিয়ে পাশে রাখতে রাখতে বলল,
"আমার অতীত নিয়ে এত মাথাব্যথা নেই। জানার আগ্রহও নেই। অতীতের কোনো ক্যাচাল এখন নেই বলেই নিশ্চয়ই বিয়েতে রাজী হয়েছ।"

"আর যদি আমি জানাতে চাই?"

"তাহলে শুনব। শুনতেও সমস্যা নেই।"

"আমি বলতে চাই। ক্লিয়ার থাকা ভালো।"

"আচ্ছা বলো।"

"আমি একজনকে ভালোবাসতাম। বেশি আগের কথা না মাত্র ৬ মাস আগের কথা। জীবনে এটাই প্রথম। সম্পর্কের কোনো নাম ছিল না। কখনো দেখাও হয়নি কারণ সে দেশের বাইরে থাকে। অনেক কথা হত এই পর্যন্তই। সেও কখনো ভালোবাসার কথা বলেনি আর আমিও বলিনি। পরিচয়ের ৫ মাস পর একদিন শুনি সে বিবাহিত। তারপর থেকে আর কথা বলিনি।"

কমল হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরল নিজের।

বলল,
"এই তোমার অতীত?"

"তুমি মজা নিচ্ছ যে?"

একটু রাগ হলো আমার। এত কষ্ট পেয়েছি আমি যে অতীতটা নিয়ে সেটা নিয়ে সে হাসছে!

হাসতে হাসতেই বলল,
"এটা তো প্রেম বলা যায় না তিন্নি। যে কথা হবু স্বামীকে বলে ক্লিয়ার হতে হবে।"

"হয়তো। কিন্তু আমার অনুভূতিটা প্রখর ছিল। প্রেমের থেকেও বেশি ছিল। ভালোবাসতাম আমি তাকে।"

কমল বোধহয় বুঝলো আমার মন খারাপ হয়েছে। সে কাছে এসে আমার একটা হাত তার দুহাতের মধ্যে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো। আমিও তাকালাম।

সে বলল,
"মন খারাপ করো না। আমাদের সবারই এমন হয়ে না ওঠা প্রেম, খুচরো ভালোবাসা থাকে। জীবনে চলার পথে এগুলোকে সাথে করে আগানো যায় না। পথের পাশে রেখে আগাতে হয় তার মানে এই না ওই সময়ের অনুভূতিটা প্রখর ছিল না। সব ভালোবাসার অনুভূতিই প্রখর থাকে। দিন গেলে দূরত্ব এলে ফিকে হয়ে যায়। একদিন তুমি আমাকেও অনেক ভালোবাসবে দেখে নিও।"

এই প্রথম, হ্যাঁ এই প্রথম আমি মুগ্ধ হলাম এই মানুষটাতে। এর আগে কেবল ভালো লেগেছে এবার আমি মুগ্ধ। কি ভাবছেন তার এমন সুন্দর কথায় মুগ্ধ হয়েছি? তাহলে ভুল ভাবছেন। এইযে পুরোনো ভালোবাসার কথা ভেবে মন খারাপ করায় মাইন্ড না করে আমার কাছে এসে আমাকে বন্ধুর মত বোঝাচ্ছে, এতে আমি মুগ্ধ। এটা কজন পুরুষের পক্ষে সম্ভব? সে তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। আমিও তাকিয়ে আছি তার দিকে।

এবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"তুমি কি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো?"

"হ্যাঁ বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু তুমি অলরেডি খুব স্পেশাল হয়ে গেছো আমার জন্য। যে কোনো মুহূর্তে ভালোবেসে ফেলতে পারি।"

আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। একটু সরে বসলাম। কখন এত কাছাকাছি চলে গেছি বুঝতেই পারিনি। সেও সরে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে সব গুছাতে লাগলো ফেরার জন্য। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্যরা আগেই ফিরে গেছে। আমি মাছের আশায় একটু বেশিক্ষণ বসে ছিলাম। আমার জন্য বসে ছিলো কমল। তাছাড়া বলতে দ্বিধা নেই এখানে কমলের সাথে একা থাকতে ভালোই লাগছিল। পুকুরটা মূল রিসোর্ট থেকে বেশ দূরে। আমরা হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম। মাঝপথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। ভিজেই ফিরছি। কারণ পথের এই জংলায় বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করার মত কোনো জায়গা নেই। মাচায় থাকতে বৃষ্টি শুরু হলে সেখানে অপেক্ষা করা যেত। বাঁশের তৈরি একটা ঝু রিতে আমাদের মাছগুলো কমলের এক হাতে। মাছ নেয়ার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি এই ঝুরিগুলো। আরেক হাতে বরশি। আমার হাতে কিছু নেই। এই কাদার রাস্তায় আমি নিজেকে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম। যাতে না পড়ি তাই কমলকে খামচে ধরলাম। আমি তো পড়লামই, সেও পড়ে গেল। আমাদের মাছগুলোও পড়ে গেল। দুজনে কাদায় পড়ে গিয়ে হাসতে হাসতে হুটোপুটি খেলাম। কমল একসময় হাসি থামিয়ে মাছগুলো ধরে ধরে তুলে ঝুড়িতে রাখছিল।

আমি নাক সিটকে বললাম,
"এহহে! ছি কাচা মাছগুলো হাত দিয়ে ধরছো! পড়ে গেছে যাক। চলো আমরা চলে যাই।"

"পাগল তুমি এত কষ্ট করে ধরলাম। আর ফেলে যাব নাকি?"

কমল সবগুলো মাছই তুলল। তখনও আমি নাক সিটকাচ্ছিলাম। আর সেটাই কাল হলো।

কমল মাছধরা হাত নিয়ে তেড়ে আসতে আসতে বলল,
"মাছকে নাক সিটকানি! দাঁড়া আজকে তোর গায়ে মাছ মাখবো।"

"ছি না প্লিজ।"

আমি দৌড় দিলাম কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। কাদায় পা পিছলে পড়ে গেলাম আবার। কমল সত্যিই তার মাছধরা হাত আমার গায়ে মুছলো। সেই হাতেই আমাকে ধরে ওঠালো। এবং সে জয়যুক্ত হওয়াতে হো হো করে হাসলো। আমি তার হাসির দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম। এত সুন্দর মুহূর্ত আমার জীবনে কখনোই আসেনি আগে!
.
.
.
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন