মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ১৪ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


বিয়ের পর মেয়েদের জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বলা হয়, স্বামীর বাড়িই নাকি তার দ্বিতীয় বাড়ি। পুরনো সবকিছু ভুলে নতুন জীবন, নতুন মানুষকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়াই নিয়তি। সমাজ বলে, অতীতকে পেছনে ফেলে বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হও। সুখ-দুঃখ, বাঁধা-বিপত্তি মেনে নিয়েই জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করো।

কিন্তু প্রশ্ন তখনই আসে, যখন বর্তমানের মানুষটাই তোমাকে গ্রহণ করতে পারে না। যখন তার আচরণ, তার চিন্তাভাবনা, তার প্রত্যাশা তোমাকে প্রতিনিয়ত ভুল প্রমাণ করতে চায়। তখন কী করা উচিত আসলে? দুই দিন ও গেলো না সামনের মানুষটি অনন্যাকে মানতে পারছে না। অনন্যার কী কষ্ট হয়নি? আরণ্যকের দেওয়া আঘাতে ডুবে ছিল তো কতদিন। কষ্ট সইতে না সইতে শুনতে পেলো তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার ভেবেছিল আরণ্যককে ফোন করে জানাক সব কথা। 

গর্ব করে বলুক, 
তুমি অন্যজনে সুখ খুঁজে পেয়েছো,
আমি নাহয় অন্যজনে ভবিষ্যত খুঁজে নিবো।

কিন্তু মনটা বড্ড অবুঝ, ফোনটা তুলে বলতে পারেনি। জানাতে ইচ্ছে হয়নি। মনে হয়েছিল, থাকুক যে যেখানে সুখে থাকতে পারে থাকুক। অনন্যার সুখ - দুঃখের কথা কেই বা চিন্তা করে? অনন্যার পরিবার কী এখনো জানতে পারেনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে? একবারও তো যেচে ফোন করলো না,জানতে চাইলো না সে কেমন আছে! বলেছিল, বিদেশে নিয়ে যাবে। এরপর তো এসব নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। তারা দিব্যি সেখানে ভালো আছে, অনন্যা তখনি বুঝে গিয়েছিলো তাকে নিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাদের। যা বলেছিলো সব কথার কথা। অনন্যার বাঁচা মরা নিয়ে কারো কোনো হম্বিতম্বি নেই। সবাই তাকে বিদায় দিলেই বাঁচে।

অনন্যা মুচকি হেসে এক ধাপ পিছনে সরে গেলো, মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকিয়ে নম্র কণ্ঠে বললো,
"দুঃখিত! আমি আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। না চাইতেও নিজের অধিকার দাবি করে ফেলেছি।"

অনন্যা আরো এক ধাপ পিছিয়ে গেলো। বড় করে শ্বাস নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিল। 
গলা উঁচিয়ে বললো,
"আপনি আজ কত ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছেন খেয়াল আছে? মশার কামড় খেতে খেতে আমার হাত পা ফুলে গেছে। তাও কিছু বলিনি। আপনি আসার পরে অযথাই জড়িয়ে ধরে ছিলাম। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। জানেন, লম্বা হলেও আপনি একটা ইঁদুর? আর ইঁদুরই থাকবেন। আর একটু আগে তো শকুনের খাতায় ও নাম লেখালেন।"

কৌশিক হতভম্ব হয়ে গেলো, বার কয়েক পলক ফেলে কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও বলতে পারলো না তার আগেই অনন্যা বলে উঠলো,
"কী ভুল করেছিলাম? একটা কিসই তো করেছি! নিজের হাসবেন্ডকে করা যায় না? ওকে! আই এম আউট! আপনার কথামতো সম্পর্ক শেষ করলাম। যান চলে যান! ভুলে যান আমাদের বিয়ে হয়েছে। শান্তিমতো থাকুন, ভালো থাকুন। আমার ও দরকার নেই। আমি নিজের রাস্তা নিজে খুঁজে নেবো।"

কৌশিক হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলে অনন্যা আরো এক ধাপ পিছিয়ে বললো,
"আপনি ঠিকই বলেছেন, মানুষ আবেগ অনুভূতির দেয়ালে আটকে পড়ে বোকা হয়ে যায়। আমিও আজ বড্ড অবুঝ কাজ করে ফেলেছি। বোকা হয়েছি।"

কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। অনন্যা দ্রুত এগিয়ে নিজের ব্যাগটা বের করে আনলো। অতঃপর স্যারের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
"কী হলো যাচ্ছেন না কেনো? যান! এই মুহূর্তে আপনাকে দেখতে একদমই ইচ্ছে করছে না আমার।"

কৌশিক এক আঙ্গুল তুলে বললো,
"তোমার তো সাহস কম না! স্যারের দিকে বড় চোখে তাকাও!"

অনন্যা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
"সকালে কী বলেছেন মনে নেই? এই রাস্তায় আপনি আমার স্যার নন। আমাদের বিয়ের সম্পর্ক ছিল, যেটা একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই যেভাবে ইচ্ছে তাকাতে পারি, যেভাবে ইচ্ছে কথা বলতে পারি।"

কথা শেষ করে অনন্যা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল। পেছনে আর ফিরে তাকায়নি। গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ কানে এলেও মন দিল না। হাঁটতে হাঁটতে গলির মুখে এসে থেমে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। হঠাৎ করেই চোখে অশ্রু জমে উঠল। এই সন্ধ্যায় কোথায় যাবে? জায়গাটা অচেনা, কী করবে ভেবেই কূল পাচ্ছিল না।

ধীরে ধীরে গলির ভেতর হাঁটা শুরু করল অনন্যা। মনে পড়ল, আজ টিউশন থেকে মাসিক বেতন পেয়েছে। মাথায় ঘুরছে, এই টাকায় কোনো বাসা ভাড়া নেওয়া যায় কি না। নোহারা তো ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকে তিনজন নিয়ে। ওর কাছে একটু জায়গা পাওয়া যেতে পারে।

ফোনটা বের করে নোহারার নম্বর খুঁজতে গিয়ে খেয়াল করল, একটা খয়েরি রঙের বিড়াল এসে পায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে। অনন্যা হাঁটু গেড়ে বসে বিড়ালের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
"কী রে পিচ্চি? কী চাই?"

বিড়াল মিউ মিউ করে সাড়া দিল। অনন্যা হাসি চাপতে না পেরে বলল,
"আমার কাছে এখন কিছু নেই। তবে সামনে কোনো দোকান পেলে খাবার কিনে দেব।"

বিড়াল যেন আরও কিছু বলতে চাইছে। অনন্যা মৃদু হাসল,
"জানিস? ওই লোকটা তোর সাথে বাঘের তুলনা করেছিল। তুই এতটুকুন, আর বাঘটা ইয়া বড়! তোর সাথে আবার ওর তুলনা? বাঘের লেজ নাড়ানো দেখলেই শরীর শিরশির করে। আর গর্জন শুনলে তুই হয়তো হার্ট অ্যাটাক করবি। আমিই তো ভয়ে কাঁপছিলাম।"

এ কথা বলেই হেসে ফেলল অনন্যা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, বললো,
"চল, দেখি কিছু পাই কিনা।"

অন্ধকার গলি। অনন্যা ধীরে ধীরে হাঁটছে, পাশেই বিড়ালটা নিচু মাথায় হেঁটে চলছে। আশপাশে বাড়িঘর ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, যেন একাকী নিস্তব্ধতা তার চারপাশে ঘিরে আছে। আরও কিছুটা এগিয়ে আরেকটা গলিতে ঢুকল সে।

হঠাৎ, অন্ধকার থেকে যেন ঝড়ের মতো একটা পাগল ভিখারি ছুটে এলো। অনন্যার গলা শুকিয়ে এলো। ভিখারি ময়লা-ঢাকা শরীর নিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে, আর তার ব্যাগের দিকে হাত বাড়িয়ে টানতে শুরু করল। গলায় ঘেনঘেনে কণ্ঠ, "পয়সা আছে না? বড়লোকি মাইয়া মনে হয়! পয়সা তো থাকবোই!"

অনন্যা আতঙ্কে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কাঁপা গলায় বলল, "না, কিছু নেই। আপনি যান।"

এদিকে বিড়ালটা ততক্ষণে পেছনে হাঁটা ধরেছে। পেছন ফিরে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আরও অসহায় মনে হলো অনন্যার। নিজের ব্যাগ শক্ত করে ধরে রাখল। কিন্তু ভিখারির শরীর থেকে আসা দুর্গন্ধ, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া লালা, আর লাল হয়ে থাকা চোখ ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ভিখারি ব্যাগ টানতে টানতে বলল, "ওই পোলাগুলো কই রে তোরা! মাইয়া খুঁইজা পাইছি।"

অনন্যা চিৎকার করে উঠল, "ছাড়ুন! ব্যাগ ছাড়ুন!"

ভিখারি এবার আরও জোরে ব্যাগ ধরে বলল, "পোলাগুলা আইবো এখনই। পয়সা দে!"

ব্যাগটা হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে অনন্যা হাত জোড় করল, "প্লিজ, ব্যাগ নিয়ে যান। যা টাকা আছে সব নিয়ে যান। কিন্তু আমাকে কিছু করবেন না।"

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই, আরও কয়েকজন লোক অন্ধকার থেকে ছুটে এলো। মুখে অদ্ভুত হাসি, চোখে শিকারির দৃষ্টি। পেছনে তাকিয়ে অনন্যা দেখল, সব পথ যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ভয় জমে বুক ভারী হয়ে গেল। আর দেরি না করে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করল অনন্যা।

অনন্যা ছুটতে ছুটতে আবারো এক নির্জন গলিতে এসে পড়েছে। পিছনে যাওয়ার কোনো পথ নেই, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর। ধীরে ধীরে পেছনে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকলো। পাঁচজনের মতো লোক সামনে এগিয়ে আসছে, মুখে শিকারির মতো লোভনীয় হাসি। অনন্যা দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল, ভয়ে শরীর কাঁপছে। আশেপাশে লোকদের খুসখুসে হাসি আর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু শরীরে কেউ স্পর্শ করছে না। তবে হাত দুটোতে কারো নিঃশ্বাস ফেলার আভাস পেয়েছে সে। অনন্যা দুই হাতের দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে মুখ তুলে তাকালো। সেই আকাশি মণি, কপালের উপর ঝোলানো চুল, অন্ধকারে ঢাকা উজ্জ্বল হলুদ চেহারা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে যাচ্ছে লোকটা। হঠাৎ কৌশিকের পিঠে একজন চাকু দিয়ে আঘাত করলো, কৌশিক দুই হাত দিয়ে শক্ত করে দেয়াল চেপে ধরলো, টুপ টুপ করে রক্ত ঝরে পড়লো। অনন্যা মুখ থেকে হাত সরিয়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলো। 

কৌশিক সাথে সাথেই উল্টো ঘুরে লোকটার হাত মুচড়ে দিলো। পায়ে আঘাত করে মাটিতে বসিয়ে দিলো তাকে। অতঃপর হাতের হাড় ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেলো আর শোনা গেলো লোকটার গগনবিদারী চিৎকার। লোকটার এই অবস্থা দেখে বাকি চারজন ছুটে আসলো। একে একে সবাইকে বিভিন্ন কায়দায় মা/রলো সে। অনন্যা চোখ বড় বড় করে দেখছে আর পাশে সরে যাচ্ছে। স্যারের পিঠে এখনো চাকুটা গেঁথে আছে, র/ক্ত ঝরছে অনবরত।

কৌশিক সবশেষে অনন্যার কাছে এসে দাঁড়ালো, বাম হাত বাড়িয়ে দিলো। অনন্যা হাত ধরলো না, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। 
কৌশিক হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
"কী? হাত ধরুন!"

কোনো কথা না বলে গলিতে জমে থাকা সুনসান নীরবতার মাঝে হালকা বাতাসের শব্দ কানে বাজলো।

অনন্যা বলল,
"পিছনে ঘুরুন।"

সন্দেহভরা দৃষ্টিতে কৌশিক ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরলো। মুহূর্তেই অনন্যা তার পিঠে হাত রাখলো। এক ঝটকায় চাকুটার হ্যান্ডেল ধরে পুরোপুরি টেনে বের করে আনলো। "শ্বাঁআক!" করে চাকুর ধাতব ফলা মাংস ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

কৌশিক দম আটকে শব্দ করার চেষ্টা করেও গলা চেপে ধরলো। ব্যথার তীব্রতায় "গ্র্র্র!" করে দাঁত চেপে ধীরে ধীরে কংক্রিটের রাস্তায় বসে পড়ল। ডান হাত দিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। মুখের শিরাগুলো ফুলে উঠে গিয়েছিল, তার মুখে তীব্র ব্যথারা ছড়িয়ে পড়েছে।

পিছনে চোখ ঘুরিয়ে কৌশিকের দৃষ্টি পড়লো অনন্যার উপর। কৌশিকের চোখে ছিল ভয়ংকর রাগ।
অনন্যা এক ঝটকায় চাকুটা ঝাড়লো। তাতে লেগে থাকা রক্তের ফোঁটাগুলো ছিটকে পড়লো কংক্রিটে। এক ঠাণ্ডা সুরে বলল,
"না বের করলে আরও বেশি ব্যথা লাগতো।"

চাকুটা নিচে ফেলে দিলো অনন্যা, ঝনঝন করে আওয়াজ হলো। অনন্যা ধীর পায়ে কৌশিকের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো, যেন কিছুই হয়নি। অন্ধকার গলির নিস্তব্ধতায় তার পদক্ষেপের শব্দ ঠক ঠক করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

কৌশিক পেছন থেকে হালকা কাঁপা গলায় ডাকল,
"কোথায় যাচ্ছেন?"

অনন্যা পেছন ফিরে তাকাল না। সোজা হেঁটে বলল,
"ব্যাগ খুঁজতে যাচ্ছি।"

কৌশিক এক মুহূর্ত থেমে নিজের পিঠে হাত রাখলো। আঙুলের ডগায় রক্তের উষ্ণ অনুভূতি পেলো। হাত সামনে এনে দেখলো রক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।

সে নিচু হয়ে গলিতে পড়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকাল। একজনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
"হেই! ওপেন ইউর আইস।"

কিন্তু কেউই কোনো সাড়া দিল না। তাদের নিথর দেহ দেখে কৌশিকের হতাশা বেড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্ষোভ চেপে রেখে উঠে দাঁড়াল।

অনন্যা তখনো এগিয়ে যাচ্ছিল। কৌশিক নিজের ভারসাম্য ঠিক করে বলল,
"দাঁড়ান। আসছি আমি।"
.
.
.
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp