মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ১৪ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


বিয়ের পর মেয়েদের জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বলা হয়, স্বামীর বাড়িই নাকি তার দ্বিতীয় বাড়ি। পুরনো সবকিছু ভুলে নতুন জীবন, নতুন মানুষকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়াই নিয়তি। সমাজ বলে, অতীতকে পেছনে ফেলে বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হও। সুখ-দুঃখ, বাঁধা-বিপত্তি মেনে নিয়েই জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করো।

কিন্তু প্রশ্ন তখনই আসে, যখন বর্তমানের মানুষটাই তোমাকে গ্রহণ করতে পারে না। যখন তার আচরণ, তার চিন্তাভাবনা, তার প্রত্যাশা তোমাকে প্রতিনিয়ত ভুল প্রমাণ করতে চায়। তখন কী করা উচিত আসলে? দুই দিন ও গেলো না সামনের মানুষটি অনন্যাকে মানতে পারছে না। অনন্যার কী কষ্ট হয়নি? আরণ্যকের দেওয়া আঘাতে ডুবে ছিল তো কতদিন। কষ্ট সইতে না সইতে শুনতে পেলো তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার ভেবেছিল আরণ্যককে ফোন করে জানাক সব কথা। 

গর্ব করে বলুক, 
তুমি অন্যজনে সুখ খুঁজে পেয়েছো,
আমি নাহয় অন্যজনে ভবিষ্যত খুঁজে নিবো।

কিন্তু মনটা বড্ড অবুঝ, ফোনটা তুলে বলতে পারেনি। জানাতে ইচ্ছে হয়নি। মনে হয়েছিল, থাকুক যে যেখানে সুখে থাকতে পারে থাকুক। অনন্যার সুখ - দুঃখের কথা কেই বা চিন্তা করে? অনন্যার পরিবার কী এখনো জানতে পারেনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে? একবারও তো যেচে ফোন করলো না,জানতে চাইলো না সে কেমন আছে! বলেছিল, বিদেশে নিয়ে যাবে। এরপর তো এসব নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। তারা দিব্যি সেখানে ভালো আছে, অনন্যা তখনি বুঝে গিয়েছিলো তাকে নিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাদের। যা বলেছিলো সব কথার কথা। অনন্যার বাঁচা মরা নিয়ে কারো কোনো হম্বিতম্বি নেই। সবাই তাকে বিদায় দিলেই বাঁচে।

অনন্যা মুচকি হেসে এক ধাপ পিছনে সরে গেলো, মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকিয়ে নম্র কণ্ঠে বললো,
"দুঃখিত! আমি আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। না চাইতেও নিজের অধিকার দাবি করে ফেলেছি।"

অনন্যা আরো এক ধাপ পিছিয়ে গেলো। বড় করে শ্বাস নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিল। 
গলা উঁচিয়ে বললো,
"আপনি আজ কত ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছেন খেয়াল আছে? মশার কামড় খেতে খেতে আমার হাত পা ফুলে গেছে। তাও কিছু বলিনি। আপনি আসার পরে অযথাই জড়িয়ে ধরে ছিলাম। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। জানেন, লম্বা হলেও আপনি একটা ইঁদুর? আর ইঁদুরই থাকবেন। আর একটু আগে তো শকুনের খাতায় ও নাম লেখালেন।"

কৌশিক হতভম্ব হয়ে গেলো, বার কয়েক পলক ফেলে কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও বলতে পারলো না তার আগেই অনন্যা বলে উঠলো,
"কী ভুল করেছিলাম? একটা কিসই তো করেছি! নিজের হাসবেন্ডকে করা যায় না? ওকে! আই এম আউট! আপনার কথামতো সম্পর্ক শেষ করলাম। যান চলে যান! ভুলে যান আমাদের বিয়ে হয়েছে। শান্তিমতো থাকুন, ভালো থাকুন। আমার ও দরকার নেই। আমি নিজের রাস্তা নিজে খুঁজে নেবো।"

কৌশিক হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলে অনন্যা আরো এক ধাপ পিছিয়ে বললো,
"আপনি ঠিকই বলেছেন, মানুষ আবেগ অনুভূতির দেয়ালে আটকে পড়ে বোকা হয়ে যায়। আমিও আজ বড্ড অবুঝ কাজ করে ফেলেছি। বোকা হয়েছি।"

কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। অনন্যা দ্রুত এগিয়ে নিজের ব্যাগটা বের করে আনলো। অতঃপর স্যারের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
"কী হলো যাচ্ছেন না কেনো? যান! এই মুহূর্তে আপনাকে দেখতে একদমই ইচ্ছে করছে না আমার।"

কৌশিক এক আঙ্গুল তুলে বললো,
"তোমার তো সাহস কম না! স্যারের দিকে বড় চোখে তাকাও!"

অনন্যা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
"সকালে কী বলেছেন মনে নেই? এই রাস্তায় আপনি আমার স্যার নন। আমাদের বিয়ের সম্পর্ক ছিল, যেটা একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই যেভাবে ইচ্ছে তাকাতে পারি, যেভাবে ইচ্ছে কথা বলতে পারি।"

কথা শেষ করে অনন্যা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল। পেছনে আর ফিরে তাকায়নি। গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ কানে এলেও মন দিল না। হাঁটতে হাঁটতে গলির মুখে এসে থেমে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। হঠাৎ করেই চোখে অশ্রু জমে উঠল। এই সন্ধ্যায় কোথায় যাবে? জায়গাটা অচেনা, কী করবে ভেবেই কূল পাচ্ছিল না।

ধীরে ধীরে গলির ভেতর হাঁটা শুরু করল অনন্যা। মনে পড়ল, আজ টিউশন থেকে মাসিক বেতন পেয়েছে। মাথায় ঘুরছে, এই টাকায় কোনো বাসা ভাড়া নেওয়া যায় কি না। নোহারা তো ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকে তিনজন নিয়ে। ওর কাছে একটু জায়গা পাওয়া যেতে পারে।

ফোনটা বের করে নোহারার নম্বর খুঁজতে গিয়ে খেয়াল করল, একটা খয়েরি রঙের বিড়াল এসে পায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে। অনন্যা হাঁটু গেড়ে বসে বিড়ালের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
"কী রে পিচ্চি? কী চাই?"

বিড়াল মিউ মিউ করে সাড়া দিল। অনন্যা হাসি চাপতে না পেরে বলল,
"আমার কাছে এখন কিছু নেই। তবে সামনে কোনো দোকান পেলে খাবার কিনে দেব।"

বিড়াল যেন আরও কিছু বলতে চাইছে। অনন্যা মৃদু হাসল,
"জানিস? ওই লোকটা তোর সাথে বাঘের তুলনা করেছিল। তুই এতটুকুন, আর বাঘটা ইয়া বড়! তোর সাথে আবার ওর তুলনা? বাঘের লেজ নাড়ানো দেখলেই শরীর শিরশির করে। আর গর্জন শুনলে তুই হয়তো হার্ট অ্যাটাক করবি। আমিই তো ভয়ে কাঁপছিলাম।"

এ কথা বলেই হেসে ফেলল অনন্যা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো, বললো,
"চল, দেখি কিছু পাই কিনা।"

অন্ধকার গলি। অনন্যা ধীরে ধীরে হাঁটছে, পাশেই বিড়ালটা নিচু মাথায় হেঁটে চলছে। আশপাশে বাড়িঘর ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, যেন একাকী নিস্তব্ধতা তার চারপাশে ঘিরে আছে। আরও কিছুটা এগিয়ে আরেকটা গলিতে ঢুকল সে।

হঠাৎ, অন্ধকার থেকে যেন ঝড়ের মতো একটা পাগল ভিখারি ছুটে এলো। অনন্যার গলা শুকিয়ে এলো। ভিখারি ময়লা-ঢাকা শরীর নিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে, আর তার ব্যাগের দিকে হাত বাড়িয়ে টানতে শুরু করল। গলায় ঘেনঘেনে কণ্ঠ, "পয়সা আছে না? বড়লোকি মাইয়া মনে হয়! পয়সা তো থাকবোই!"

অনন্যা আতঙ্কে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কাঁপা গলায় বলল, "না, কিছু নেই। আপনি যান।"

এদিকে বিড়ালটা ততক্ষণে পেছনে হাঁটা ধরেছে। পেছন ফিরে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আরও অসহায় মনে হলো অনন্যার। নিজের ব্যাগ শক্ত করে ধরে রাখল। কিন্তু ভিখারির শরীর থেকে আসা দুর্গন্ধ, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া লালা, আর লাল হয়ে থাকা চোখ ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ভিখারি ব্যাগ টানতে টানতে বলল, "ওই পোলাগুলো কই রে তোরা! মাইয়া খুঁইজা পাইছি।"

অনন্যা চিৎকার করে উঠল, "ছাড়ুন! ব্যাগ ছাড়ুন!"

ভিখারি এবার আরও জোরে ব্যাগ ধরে বলল, "পোলাগুলা আইবো এখনই। পয়সা দে!"

ব্যাগটা হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে অনন্যা হাত জোড় করল, "প্লিজ, ব্যাগ নিয়ে যান। যা টাকা আছে সব নিয়ে যান। কিন্তু আমাকে কিছু করবেন না।"

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই, আরও কয়েকজন লোক অন্ধকার থেকে ছুটে এলো। মুখে অদ্ভুত হাসি, চোখে শিকারির দৃষ্টি। পেছনে তাকিয়ে অনন্যা দেখল, সব পথ যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ভয় জমে বুক ভারী হয়ে গেল। আর দেরি না করে উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করল অনন্যা।

অনন্যা ছুটতে ছুটতে আবারো এক নির্জন গলিতে এসে পড়েছে। পিছনে যাওয়ার কোনো পথ নেই, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর। ধীরে ধীরে পেছনে যেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকলো। পাঁচজনের মতো লোক সামনে এগিয়ে আসছে, মুখে শিকারির মতো লোভনীয় হাসি। অনন্যা দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল, ভয়ে শরীর কাঁপছে। আশেপাশে লোকদের খুসখুসে হাসি আর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু শরীরে কেউ স্পর্শ করছে না। তবে হাত দুটোতে কারো নিঃশ্বাস ফেলার আভাস পেয়েছে সে। অনন্যা দুই হাতের দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে মুখ তুলে তাকালো। সেই আকাশি মণি, কপালের উপর ঝোলানো চুল, অন্ধকারে ঢাকা উজ্জ্বল হলুদ চেহারা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে যাচ্ছে লোকটা। হঠাৎ কৌশিকের পিঠে একজন চাকু দিয়ে আঘাত করলো, কৌশিক দুই হাত দিয়ে শক্ত করে দেয়াল চেপে ধরলো, টুপ টুপ করে রক্ত ঝরে পড়লো। অনন্যা মুখ থেকে হাত সরিয়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলো। 

কৌশিক সাথে সাথেই উল্টো ঘুরে লোকটার হাত মুচড়ে দিলো। পায়ে আঘাত করে মাটিতে বসিয়ে দিলো তাকে। অতঃপর হাতের হাড় ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেলো আর শোনা গেলো লোকটার গগনবিদারী চিৎকার। লোকটার এই অবস্থা দেখে বাকি চারজন ছুটে আসলো। একে একে সবাইকে বিভিন্ন কায়দায় মা/রলো সে। অনন্যা চোখ বড় বড় করে দেখছে আর পাশে সরে যাচ্ছে। স্যারের পিঠে এখনো চাকুটা গেঁথে আছে, র/ক্ত ঝরছে অনবরত।

কৌশিক সবশেষে অনন্যার কাছে এসে দাঁড়ালো, বাম হাত বাড়িয়ে দিলো। অনন্যা হাত ধরলো না, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। 
কৌশিক হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
"কী? হাত ধরুন!"

কোনো কথা না বলে গলিতে জমে থাকা সুনসান নীরবতার মাঝে হালকা বাতাসের শব্দ কানে বাজলো।

অনন্যা বলল,
"পিছনে ঘুরুন।"

সন্দেহভরা দৃষ্টিতে কৌশিক ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরলো। মুহূর্তেই অনন্যা তার পিঠে হাত রাখলো। এক ঝটকায় চাকুটার হ্যান্ডেল ধরে পুরোপুরি টেনে বের করে আনলো। "শ্বাঁআক!" করে চাকুর ধাতব ফলা মাংস ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

কৌশিক দম আটকে শব্দ করার চেষ্টা করেও গলা চেপে ধরলো। ব্যথার তীব্রতায় "গ্র্র্র!" করে দাঁত চেপে ধীরে ধীরে কংক্রিটের রাস্তায় বসে পড়ল। ডান হাত দিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। মুখের শিরাগুলো ফুলে উঠে গিয়েছিল, তার মুখে তীব্র ব্যথারা ছড়িয়ে পড়েছে।

পিছনে চোখ ঘুরিয়ে কৌশিকের দৃষ্টি পড়লো অনন্যার উপর। কৌশিকের চোখে ছিল ভয়ংকর রাগ।
অনন্যা এক ঝটকায় চাকুটা ঝাড়লো। তাতে লেগে থাকা রক্তের ফোঁটাগুলো ছিটকে পড়লো কংক্রিটে। এক ঠাণ্ডা সুরে বলল,
"না বের করলে আরও বেশি ব্যথা লাগতো।"

চাকুটা নিচে ফেলে দিলো অনন্যা, ঝনঝন করে আওয়াজ হলো। অনন্যা ধীর পায়ে কৌশিকের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো, যেন কিছুই হয়নি। অন্ধকার গলির নিস্তব্ধতায় তার পদক্ষেপের শব্দ ঠক ঠক করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

কৌশিক পেছন থেকে হালকা কাঁপা গলায় ডাকল,
"কোথায় যাচ্ছেন?"

অনন্যা পেছন ফিরে তাকাল না। সোজা হেঁটে বলল,
"ব্যাগ খুঁজতে যাচ্ছি।"

কৌশিক এক মুহূর্ত থেমে নিজের পিঠে হাত রাখলো। আঙুলের ডগায় রক্তের উষ্ণ অনুভূতি পেলো। হাত সামনে এনে দেখলো রক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।

সে নিচু হয়ে গলিতে পড়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকাল। একজনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
"হেই! ওপেন ইউর আইস।"

কিন্তু কেউই কোনো সাড়া দিল না। তাদের নিথর দেহ দেখে কৌশিকের হতাশা বেড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্ষোভ চেপে রেখে উঠে দাঁড়াল।

অনন্যা তখনো এগিয়ে যাচ্ছিল। কৌশিক নিজের ভারসাম্য ঠিক করে বলল,
"দাঁড়ান। আসছি আমি।"

★★★★★

কৌশিক ধীরে ধীরে উঠে অনন্যার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। পিঠের ব্যথা তাকে ভারাক্রান্ত করলেও মেয়েটার অদ্ভুত আচরণ তাকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুললো। অনন্যা হঠাৎ গলি থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করলো, যেন কোনো উদ্দেশ্যহীন খোঁজ চলছে। কখনো এক গলিতে ঢুকলো, তো কখনো আরেক গলিতে। তার ছুটোছুটি দেখে কৌশিকের কপালে ভাঁজ পড়লো।

মুহূর্ত পরে অনন্যা হঠাৎ একটি নির্জন গলির সামনে থেমে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে গলির ভেতর অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

কৌশিক পিঠে হাত দিয়ে নিজেকে সামলাতে সামলাতে সেই গলির সামনে পৌঁছাল। থেমে কিছুক্ষণ চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। কেমন অন্ধকার সবকিছু! রাস্তায় এক লোকের কাছে শুনেছিলো এখানে প্রায়ই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি হয়ে থাকে। তাই মানুষেরা শব্দ শুনলেও বাসা থেকে বের হয় না। কিন্তু সবাই যদি এভাবে বাসায় বসে থাকে চুরি, ডাকাতির পরিমাণ আরো বাড়তে থাকবে। এই সামান্যতম জ্ঞান কী তাদের নেই!

গলির মধ্যে কিছু দূর যাওয়ার পর কৌশিক দেখলো, অনন্যা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের ব্যাগের ভেতর কিছু খুঁজছে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো।

অনন্যা ততক্ষণে ব্যাগের থেকে ল্যাপটপটা বের করে পরীক্ষা করছিল। চোখে একরাশ উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। সে একবার ল্যাপটপ দেখে নিলো, তারপর ফোন। দুটো জিনিস ঠিকঠাক পেয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। আজ ঈরা অনন্যার ল্যাপটপটা ওর কাছে দিয়ে গিয়েছিল। পাগল ভিখারিটি ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার সময় মুহূর্তের জন্য অনন্যার মনে পড়েছিল ল্যাপটপটার কথা। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তখন কিছু করার উপায় ছিল না।

ল্যাপটপটি কেনার জন্য কত কষ্টই না করেছে অনন্যা। দিনের পর দিন নিজের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলোকে দমিয়ে রেখেছিল, টাকা বাঁচিয়ে চলতে হয়েছিল অনেক মাস। ঈরার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার জন্য কতবার সে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। মামীর রাগ আর ঝগড়ার মুখে পড়েও নিজের অতি প্রয়োজনীয় ল্যাপটপটা কেনার জন্য অটল ছিল। অবশেষে হাতে পেয়েছিল তার পরিশ্রম আর জেদের ফল।

ব্যাগ খুলে যখন টাকার অংশটা দেখল, তখন হতাশ হলো অনন্যা। এক টাকাও নেই সেখানে, মনে হলো এই মাসের সব কষ্ট যমুনায় গেল। মাসের বেতনের পাঁচ হাজার টাকা এভাবেই হারিয়ে গেল! কপালে গভীর ভাঁজ পড়ল তার। রাগ আর হতাশার ঢেউ বয়ে যেতে লাগল মনে।

চোখ তুলে কৌশিক স্যারের দিকে তাকাতেই তার গাল ফোলানো রাগ স্পষ্ট দেখা গেল। গোলাপি ঠোঁট কাঁপছিল, আর চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত লাভার মতো রাগে ফুটছিল।

কৌশিক পিঠের ব্যথা সামলে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে শান্ত গলায় বলল,
"কী? সব ঠিক আছে তো?"

"টাকা নেই।"

"ব্যাপার না। ব্যাগ গোছান আর উঠুন।"

অনন্যা জেদ ধরে বসে রইলো, আক্রোশ মাখা কন্ঠে বলল,
"আপনার কাছে এসব ব্যাপার তুচ্ছ হতেই পারে, কিন্তু আমার কাছে অনেক বড় কিছু! (কিছুক্ষণ থেমে) 
চলে যান আপনি। আমাকে বাঁচানোর জন্য আরেকবার ধন্যবাদ দিলাম।"

কৌশিক গম্ভীর গলায় বলল,
"আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।"

"যাবো না।"
অনন্যার জেদি সুর। ব্যাগ গুছিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।

কৌশিক একটু ঝুঁকে সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
"আপনার জন্য আমি ব্যথা পেয়েছি। এর পরিবর্তে কিছু তো দিতে হবে, তাই না?"

অনন্যা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
"যা ভারী জামা-কাপড় পড়েছেন, তাতে শরীরে চাকুটা ঠিকমতো ঢুকেছে কিনা, তাই ভাবছি।"

কৌশিক পিঠের দিকে হাত রাখল, তারপর হাত সামনে এনে দেখিয়ে বলল,
"ধারালো ছিল, দেখুন, এখনো রক্ত পড়ছে।"

মুখে হালকা ভেংচি দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো অনন্যা।

কৌশিক এবার গলা চড়িয়ে বলল,
"যাবেন না?"

অনন্যা থামল না। কাঁধের উপর দিয়ে বলল,
"না। আমাদের সম্পর্ক শেষ। অনেকক্ষণ আগেই আপনাকে বলেছিলাম আমি নিজের রাস্তা নিজে খুঁজে নেব। সেই কথা ফেরাতে পারবো না।"

কৌশিক দ্রুত এগিয়ে এসে অনন্যার হাত ধরলো। অনন্যা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। কৌশিক হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"ঠিক আছে। একটা খেলা হয়ে যাক! আমি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো। উত্তর দিতে পারলে আপনি নিজের মতো চলে যেতে পারবেন। আর না পারলে আমার সাথে যেতে হবে। রাজি আছেন কিনা বলেন!"

অনন্যা সন্দেহভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল। হাত ভাঁজ করে ভাবতে লাগলো, স্যার বিদেশ থেকে পড়ে এসেছে, নিশ্চয়ই কোনো কঠিন প্রশ্ন করবে যেটার উত্তর অনন্যা জীবনেও দিতে পারবে না। এভাবেই তিনি জিতে যাবেন। এর অর্থ উনার এসব আলতু ফালতু কথায় রাজি হয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারা ভুল কাজ হবে।

অনন্যা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
"না আমি খেলবো না।"

"ইজি কুয়েশ্চেন। মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, বাংলা ভাষা নিয়েই কুয়েশ্চেন করবো। আপনি নিঃসন্দেহে পারবেন।"

অনন্যা বিস্ময়ের সাথে বললো,
"তাই?"

"হুম। রেডি?"

"ওকে, বলুন শুনি। কঠিন কিছু হলে খবর করে ছাড়বো।"

"আচ্ছা! প্রশ্নটা হচ্ছে,
ইংলিশে ইউ, বাংলায় আপনি 
ইংলিশে ইউ, বাংলায় তুমি 
ইংলিশে ইউ, বাংলায় তুই। 
কিন্তু কেনো? 
এক শব্দ দিয়ে বাংলায় তিনটা ওয়ার্ড,
কিন্তু ইংলিশে একটা। হোয়াই?"

অনন্যা মাথা চুলকে ভাবলো, ব্যাটা প্রশ্ন তো সহজই করেছে। কিন্তু আসলেই কেনো? 
কৌশিক হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনার সময় এক মিনিট। যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। উত্তর দিয়ে নিজের রাস্তায় হাঁটা দিন। আমিও কিছু বলবো না।"

অনন্যা চিন্তা করতে করতে বললো,
"কারণ ইউ দিয়ে সামনের মানুষটিকে বোঝায়। ইংরেজি এক শব্দ দিয়ে তিনটা বাংলা শব্দ কারণ..... দুরত্ব অনুসারে সামনের মানুষটিকে ডাকার ধরন পরিবর্তন হতে পারে। অপরিচিত হলে আপনি, কিছুটা পরিচিত হলে তুমিতে যাওয়া যায়, আর বেশি কাছের হলে তুই বলা যায়।"

কৌশিক ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
"ওকে, ইউর টাইম ইজ ওভার। আর..... ভুল উত্তর দিয়েছো তুমিই।"
'তুমি' শব্দটায় বেশি জোর দিয়ে বলেছে কৌশিক।

অনন্যা কৌশিকের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসি দেখে অস্বস্তিতে পড়লো। তবুও দৃঢ় ভঙ্গিতে বললো,
"ভুল কীভাবে হলো? আমি তো ঠিকই বলেছি!"

কৌশিক সামনে হাঁটা ধরলো। অনন্যা দ্রুত তার পাশে এগিয়ে গেলো, বললো,
"আচ্ছা, ঠিক আছে এখন সঠিক উত্তরটি দিন। শুনি কেনো ভুল হলো!"

কৌশিক শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
"তোমার উত্তর আংশিক সঠিক। আপনি, তুমি আর তুই শুধুই দূরত্ব বা পরিচিতির উপর নির্ভর করে না। এগুলো আমাদের সংস্কৃতি এবং সম্পর্কের গভীরতাকেও নির্দেশ করে।

আপনি দিয়ে সম্মান জানানো হয় বয়োজ্যেষ্ঠ, শিক্ষক বা অপরিচিত ব্যক্তিদের।
তুমি বলা হয় বন্ধু, সহকর্মী বা কাছের পরিচিতদের, যেখানে একটু স্বাচ্ছন্দ্য থাকে।
আর তুই ব্যবহার করা হয় খুব ঘনিষ্ঠ মানুষদের জন্য যেখানে সম্পর্ক এতটাই গভীর যে সম্মানের আলাদা প্রকাশ প্রয়োজন হয় না।

ইংরেজি ‘You’ এসব দিক প্রকাশ করতে পারে না, একচুয়ালি তাদের দরকার হয় না। তাই ভাষায় সৌন্দর্য, সম্পর্ক আর সম্মানের দিক বিবেচনা করে বাংলায় তিনটি ভিন্ন শব্দ প্রয়োজন হয়, কিন্তু ইংরেজিতে প্রয়োজন হয় না।"

অনন্যা চিন্তিত হয়ে বললো,
"কিন্তু এসব তো একই কথা মনে হচ্ছে। আপনি শুধু ব্যাখ্যা করে বললেন, আমি অল্প কথায় বললাম।"

কৌশিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অনন্যার দিকে।গলা চড়িয়ে বললো,
"না এখন কোনো চালাকি চলবে না। তোমার উত্তর হয়নি এটাই আসল কথা।"

অনন্যা মাথা হেলিয়ে বললো,
"আচ্ছা!"

বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
"লোকটা হঠাৎ তুমি করে বলছে! ব্যাপার কী?"

"নিক কল দিয়েছিল। জানালো, তোমার হাতের রান্না খেতে চায়। বিয়ের পর নাকি বাঙালি মেয়েরা প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়ির সবাইকে নিজের হাতের রান্না খাওয়ায়। তারও ইচ্ছা জাগলো, ঐ ট্র্যাডিশনটা তোমাকে দিয়ে করানোর।"

অনন্যা আগ্রহের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
"সত্যি? নিক ভাইয়া বলেছে আমার হাতের রান্না খাবে? এজন্যই নিতে এসেছিলেন?"

"হুম! কিন্তু এতো খুশি কেনো?"

"উনি অনেক ভালো। অন্তত আপনার মতো ত্যাড়াবেকা কথা বলে না।"

কৌশিক দাঁড়িয়ে পড়লো, ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
"ত্যাড়াবেকা মানে? কোনো স্ল্যাং এটা?"

"আহা না! মানে এলোমেলো বা ঘুরিয়ে চুরিয়ে কথা বলা।"

কৌশিক মাথা নাড়িয়ে আবারো হাঁটা ধরলো। অনন্যা বললো,
"আপনার সাথে যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই আমার। এক ফোঁটাও না।"

"ইউ লস্ট দ্য গেইম সো ইউ হ্যাভ টু গো উইথ মি। নো চয়েস, শিকদার।"
কথাগুলো বলে মৃদু হাসলো কৌশিক।

অনন্যা ক্ষিপ্ত হলো, বুঝলো না তার উত্তরে কী এমন বিশেষ ভুল ছিল যে উত্তর হয়নি বলে দিলো। হাঁটতে হাঁটতে আবারো গাড়ির সামনে এসে পৌঁছুলো দুজনে।‌
অনন্যা গাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
"আমাকে....কীভাবে খুঁজে পেলেন?"

কৌশিক এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে উপরের দিকে তাকালো। চিন্তার গভীরে ডুব দিলো কিছুক্ষণ আগের ঘটনাগুলো মনে করতে।

একটি বিড়াল গলির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে কৌশিককে পথ দেখাচ্ছিল। তারপর আর কিছুই না, কৌশিক নিজে বাকিটুকু খুঁজে নেয়। অন্য এক গলিতে পা বাড়িয়ে কিছুটা এগোনোর পর, লোকজনের ভিড় চোখে পড়ে। হঠাৎ চোখ পড়ে অনন্যার দিকে, অনন্যাকে ভয়ার্ত অবস্থায় দেখে আচমকা বুকের ভেতর থেকে এক অদৃশ্য শক্তি যেন টান মেরে তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ঝড়ের গতিতে, সবাইকে পাশ কাটিয়ে এক নিঃশ্বাসে অনন্যার সামনে চলে আসে। এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গিয়েছিল, কেবল কৌশিক আর অনন্যার মধ্যে ছিল এক চরম সংঘর্ষ।

কৌশিক অত কিছু বললো না, শুধু বললো,
"একটা বিড়াল পথ দেখিয়ে ছিল।"

অনন্যা খুশিতে আপ্লুত হয়ে বললো,
"সত্যি? আমি তো ভেবেছিলাম বিড়ালটা আমাকে বিপদে ফেলে চলে গেছে, আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। যাক তাহলে প্রাণীরা ও মানুষদের সাহায্য করে।"

কৌশিক নিশ্চুপ হয়ে অনন্যাকে গাড়িতে বসতে বললো।


বাসায় পৌঁছুতেই গেইটের সামনে বাঘটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনন্যা। বাঘটি এক মুহূর্তের জন্য অনন্যাকে দেখলেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে, নরমভাবে গর্জন করতে থাকে। অনন্যা কিছুটা অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকাল।

কৌশিক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, "তোমাকে চিনতে পেরেছে!"

অনন্যা মিষ্টি হাসল এবং বাঘটির মাথায় এক আঙুল দিয়ে আদর করল। বাঘটি আরও নুইয়ে পড়ল, যেন শান্ত হয়ে গেল। কৌশিক অনন্যার সম্মতি পেয়ে বাঘটিকে ভিতরে নিয়ে গেল আর অনন্যা তাকে পেছন পেছন অনুসরণ করল।

সোফায় বসে নিক বালিশ কোলে নিয়ে টেলিভিশন দেখছিল, হরর মুভি চলছিল। পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে ছিল। কৌশিক লাইটের সুইচ টিপতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে, আর নিক হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে অনন্যাও ভয়ে শিউরে ওঠে চিৎকার করে দ্রুত কৌশিকের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠিক তখনই বাঘটি গর্জন করে, ভয়ের মাত্রা আরো এক ধাপ বাড়িয়ে তোলে।

কৌশিক কানে হাত চাপা দিয়ে জোরেশোরে বলে উঠলো,
"এই সবাই চুপ!"

সবাই একে একে শান্ত হয়ে গেল। নিক দ্রুত টিভি অফ করে, অনন্যার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে ইংরেজিতে বললো,
"হাই, অ্যানা! তোমার অপেক্ষায়ই ছিলাম।"

অনন্যাও হাত নাড়িয়ে বললো,
"হাই, আরো অপেক্ষা করো। আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি, সবার জন্য রান্না করবো।"

অনন্যা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। নিক কৌশিকের দিকে সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কৌশিক ধীর পায়ে এসে সোফায় বসলো, শরীরের ক্লান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সোফার পাশেই বাঘটি আরাম করে শুয়ে পড়েছে। কৌশিক বাঘটির মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েক মুহূর্ত থেমে রইল, তারপর সোজা হয়ে বসলো।

চুপচাপ নিজের কোট খুলতেই তার সাদা শার্টে চোখে পড়লো গভীর ক্ষতচিহ্নের ছেঁড়া অংশ আর লাল রক্তের ছাপ।

নিক কৌশিকের পিঠের দিকে তাকিয়ে হতচকিত হয়ে গেলো, বিস্মিত হয়ে বললো,
"কীভাবে হলো এসব? অনেকখানি জখম হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে বোঝা যাচ্ছে।"

"হুম তা তো ঝরেছেই!"
কৌশিক নিজের মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিলো।

"কী হয়েছিল? অ্যানা, হসপিটালে নিয়ে যায়নি?"

"অনেক লম্বা গল্প! অ্যানা? হুম, বলেছিল! আমিই যায়নি। কোনো ডাক্তার আমার শরীর ঠিক করতে পারবে না।"

নিক কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় অনন্যা সিঁড়ি দিয়ে নেমে দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে এলো। তার পরনে ছিল পূর্বের গোলাপি ঢিলেঢালা সালোয়ার কামিজ, যা একটু ভারী দেখাচ্ছিল। কৌশিকের সামনে দাঁড়িয়ে অনন্যা বলল,
"স্যার! আমার বাসায় পড়ার জন্য কোনো হালকা পোশাক নেই। এসব ভারী পোশাকে আরাম পাচ্ছি না। আজকের দিনের জন্য কোনো পোশাক দিতে পারবেন? কাল ঈরাকে বলে বাসা থেকে আনিয়ে নেবো।"

কৌশিক চুলগুলো আঙুল দিয়ে পেছনে সরিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
"তার দরকার নেই।"

তারপর তিন নম্বর রুমের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
"সেখানে আমার অনেক পোশাক আছে। যেটা লাগে নিয়ে নাও। আর যদি দরকার হয়, নতুন কিনে দেবো।"

নিক এতক্ষণ নীরবে শুনছিল। কৌশিকের কথা শেষ হতেই নিক হেসে বলে উঠল,
"আমার পোশাক নিতে হলে বলো।"

কৌশিক নিকের বাহুতে হালকা চাপ দিয়ে বলল,
"তোমার বডি সাইজ যা, ওগুলো অনন্যার জন্য বেশ ঢিলা হবে।"

অনন্যা কথা না বাড়িয়ে খুশিমনে তিন নম্বর রুমের দিকে চলে গেল। তার খুশি লাগছে এই বাড়িতে একজন হলেও তার কাছে কিছু চাইছে। আর সেটা দেওয়ার জন্য অনন্যা অবশ্যই চেষ্টা করবে।

নিক একটু ফিসফিসিয়ে বলল,
"মেয়েটার মধ্যে এমন কী আছে যে তুমি এতটা যত্নশীল?"

কৌশিক এক মুহূর্ত থেমে চিন্তিত মুখে বলল,
"এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। তবে কিছু একটা তো আছে। ভেনোরা আসলে হয়তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।"

নিকোলাই উপর নিচ মাথা নাড়লো চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
"হু, ভেনোরা! তোমার মেডিসিন বানাতেই ওকে দূরের পাহাড়ে যেতে হয়েছে। চিন্তা করো না, কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।"

কৌশিক কোনো কথা বলল না, চোখের গভীরে চিন্তার মেঘ জমতে লাগল। নিকোলাই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পেছনের বিশাল জানালার দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদের আলোর নরম আভা ঘরে পড়ছিল, নিকোলাই স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,
"হেই! আজকে ফুল মুন। ছাদে যাও, চাঁদ তোমার শরীরের দাগ দূর করে দিতে পারবে, আরো এনার্জি পাবে তুমি।"
.
.
.
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন