স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা - পর্ব ১৫ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


“যেখানে আপনি নিয়ে যাবেন”

জাওয়াদ ফ্রন্ট মিরর দিয়ে চাইলো চিংকির দিকে। চিংকি আবার নীল পরেছে। নীল রঙ্গে তাকে নীলাম্বরের মতো লাগছে। নির্মল, নিষ্পাপ। সে আজ খুব যত্ন করে সেজেছে। জাওয়াদ বুঝতে পারলো এই সাজের রহস্য। মেয়েটি তার জন্য সেজেছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। চিংকি এতো দ্রুত বিয়েতে রাজী হয়ে যাবে সে বুঝতে পারেনি। সে তো শুধু এই স্বপ্ন সমস্যার পরিত্রাণ চেয়েছিলো। শান্ত সরোবরের মতো জীবনে এই স্বপ্ন বিষপোকার মতো তিক্ত করে তুলেছে তার জীবন। এই স্বপ্ন থেকে পরিত্রাণ পেলে চিংকিকে সবটা খুলে বলে দিবে। বিয়ের এই তলোয়ারটা গলা থেকে নামানো এখন অনিবার্য হয়ে গেছে। চোখ সরিয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
 “ঘুরতে চাইছো তুমি, আর বলছো আমাকে নিয়ে যেতে! এটা কেমন কথা?”
 “কারণ আমি চাই আপনি আজ আমাকে ঘুরাবেন।”
 “এই চাওয়ার কারণ?”
 “আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন। এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালো লাগছে না।”

জাওয়াদ বাইকে স্টার্ট দিলো। ডিমের থলি ঝুলছে হ্যান্ডেলে। চিংকি সেটা খেয়াল করে বললো,
 “ডিম কিনেছেন? বাসায় রেখে আসতেন!”
 
ডিম দেখে একটু অস্বস্তি হলো জাওয়াদের। পড়াবাবা সাথে রাখতে বলেছেন বিধায় বাইকের হ্যান্ডেলেই ঝুলিয়ে এনেছে। এখন ফেটে না গেলে হয়। একটা ডিম নিয়ে ঘোরা বেশ অদ্ভুত একটা ব্যাপার। কিন্তু সে বাধ্য। তাই শুকনো গলায় বললো,
“ভুলে গেছি।”
 “আচ্ছা একটা ডিম কিনেছেন কেন?”
 
এমন প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। জাওয়াদ আমতা আমতা করে বললো,
 “একটাই ডিম ছিলো।”
 “দোকানে একটাই ডিম ছিল?”
 “হ…হ্যা।”
 “স্ট্রেঞ্জ।”

জাওয়াদ কথা বদলানোর জন্য বললো,
 “কিছু খাবে? তোমার পছন্দের চটপটি বা ফুসকা? আমার অবশ্য দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষুধা লেগেছে।”
 “সেকি কিছু খাননি?”

চিংকির কন্ঠে উৎকন্ঠা প্রকাশ পেলো। পরমুহূর্তে শাসনের স্বরে বললো,
 “আপনি তো বড্ড অনিয়ম করেন। কিছুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মনে নেই?”
 “আসলে একটা কাজে গিয়েছিলাম। আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেছে।”
 “খেয়ে আসতেন।”
 “তাহলে তোমাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে হত যে।”

চিংকির বুকটা ধক করে উঠলো। বুকের মধ্যখানটা আনচান করে উঠলো। এক তীব্র ভালোলাগা তাকে ঘিরে ধরলো যেন। চিংকির কাছে এই অনুভূতিটা খুব নতুন। কিশোরী সত্ত্বায় ভালোলাগার অনুভূতি থেকে প্রগাঢ় এই অনুভূতি। ঠোঁটে কোনে ভেসে উঠলো প্রশান্ত হাসি। ধীর স্বরে বলল,
 “তাহলে কোনো রেস্টুরেন্টে চলুন। আমার মন রক্ষা করার দরকার নেই।”

******

ধানমন্ডি লেক পাড়ের একটি দোতালা রেস্তোরা। থাই গ্লাস দিয়ে লেক দেখা যায়। রাতে অন্ধকার দেখায় জায়গাটা। ঝোপের আড়ালে ঘুটঘুটে কালো পানির স্রোত বুঝা যায় না। লাইটের ধারে মশাদের ঝাঁক দেখা যায়। বিকেল হলে অবশ্য দৃশ্যটা ভিন্ন হতো। এখানে দেখা যেত কপোত কপোতী। কেউবা হাতে হাত গলিয়ে হাসছে, মনের কথাগুলো বলছে। প্রেমিকার চুলের মিষ্টি গন্ধ লুটবে প্রেমিক। আদর করে কপালের চুল গুজে দিবে। প্রেমিকার ঠোঁটে লুটিয়ে পড়বে হাসি। চিংকি এক মনোযোগে তাকিয়ে দিলো লেকের দিকে। জাওয়াদ অর্ডার করলো। ক্ষুধা লেগেছে। পাভেলের শরীর খারাপ না হলে বকশীবাজার থেকেই খেয়ে আসতো। খাবার এলো অনেকক্ষণ পর। চিংকি শুধু একটা শুকনো সালাদ নিলো। জাওয়াদ নিজের খাবারটা খেতে খেতে বলল,
 “তোমাকে একদিন আমাদের বাড়িতে যেতে হবে।”
 “কেনো?”
 “কেনাকেটার জন্য। মামী তোমাকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করতে চাচ্ছেন। আমার মা থাকলে অবশ্য এমন কিছু হত না। মামীর চিন্তাভাবনা মডার্ণ। আমি অবাক হয়েছি, বাবা মানা করেননি। অথচ তার চিন্তাভাবনা কিন্তু খুব সেকেলে।”
 “বাবাও মাপের কথা বলছিলেন। তত্ত্ব পাঠাবেন।”

জাওয়াদ একটু থামলো। দ্বিধান্বিত হলো স্বর,
 “তুমি এতো তারাতারি রাজি হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।”
 “খুশি হননি?”
 “তেমন কিছু না। আমি একটু সময় চাচ্ছিলাম। চেনা জানাই তো শেষ হল না।”
 “আরোও চিনবেন?”

জাওয়াদ চোখ তুলে তাকালো। চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বললো,
 “যত চিনবো ততই ভালো না?”
 “হ্যা, সেটা ঠিক। আপনাকে তো অনেক কিছু বলাই হয়নি।”
 “আমাদের পরিচয়ের সময়টা অনেক কম।”
 “সমস্যা নেই, জীবন পড়ে আছে নিজেদের চেনার, আবিষ্কার করার। এখনের জন্য যতটুকু চিনেছি ততটুকু মন্দ নয়।”

জাওয়াদ একটু থমকালো। চিংকি কিছুই চেনেনি। চিনলে এমন কথা হয়তো বলতো না। মেয়েটাকে কি অহেতুক আশা দিচ্ছে? জাওয়াদের উদ্দেশ্যখানা জানতে পারলে কি সে মেনে নিবে? চিংকি যথেষ্ট বুঝদার মেয়ে। সে হয়তো বুঝতে পারবে। চিংকিকে প্রেয়সী নয়, একজন সৎ, ভালো বন্ধু বলে মনে করে জাওয়াদ। প্রতিটি মানুষের এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, সময় কাটাতে ভালো লাগে, হয়তো মানসিক সুসঙ্গতি আছে তাদের। কিন্তু বিয়ে! মস্তিষ্ক ঝাপসা হয়ে গেলো। দ্বিধান্বিত হলো মন। সে কি চায়! এই প্রশ্নটা উঁকি দিলো। চিংকি মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চায় না। কিন্তু নিজের সমস্যার কথাগুলোও বলতে পারছে না। সত্যি বলতে জাওয়াদ নিজেই জানে না তার সাথে এমন কেনো হলো? কিভাবে হলো? একটা স্বপ্ন তার সুন্দর আটপৌরে জীবনে ভূমিকম্প এনেছে। তার যুক্তি-তর্ককে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে এখন পড়াবাবার শরণাপন্ন। ওই লোক যদি কোনো সমাধান না আনতে পারে সে কি করবে জানে না। হয়তো বাধ্য হয়ে চিংকিকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু মেয়েটাকে ঠকাতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে চায় এই স্বপ্নের একটা সমাধান হোক। 

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো তারা। চিংকির কথাগুলো মনেই রয়ে গেলো। জাওয়াদের সাথে কথা শুরু হলে শতকথার মধ্যে আসল কথাই চাপা পড়ে যায়। সমস্যা নেই। তাড়া নেই চিংকির। মানুষটাকে বলার সময় চলে যায়নি। এর মধ্যে জাওয়াদ বললো,
 “মিষ্টি খাবে? আজ একটা শুভদিন। আমাদের উচিত মিষ্টি খাওয়া।”
 “আপনি জানেন তো মিষ্টি কি করে বানায়? ময়রাদের কনুই অবধি হাত থাকে সিরাতে।”
 
জাওয়াদের মুখ বিকৃত হলো। চিংকির মজা লাগছে। এই মানুষটাকে বোকা বানানো এতো সহজ কেনো! জাওয়াদ বললো,
 “থাক।”
 “মজা করছি। চলুন কোনো পরিষ্কার দোকান থেকে খাবো।”
 “এমন মজা করো না। আমার নাড়িভুড়ি গুলিয়ে উঠে।”
 “আচ্ছা, আপনি চুমু খেয়েছেন কখনো?”

চিংকির হঠাৎ প্রশ্নে কেশে উঠলো জাওয়াদ। না সে চুমু খায়নি। এই কারণে তার প্রাক্তন তাকে নানাবিধ কথাও শুনিয়েছে। চুমু খাওয়া তার কাছে আনহাইজিনিক লাগে। হয়তো বউকে চুমু খেতে হবে। কিন্তু সেটার জন্য নিজেকে কঠোরভাবে প্রস্তুত করেছে সে। চিংকি মিটিমিটি হাসছে। জাওয়াদ বুঝলো মেয়েটা আবার তার খিল্লি উড়াচ্ছে। ফলে মুখখানা একটু ঝুকিয়ে বললো, 
 “তোমার জন্য তুলে রেখেছি। আফটার অল ভার্জিনিটি বলেও কিছু আছে।”

জাওয়াদ এমন কিছু উত্তর দিবে বুঝতে পারেনি চিংকি। লজ্জায় তার শ্যাম পেলব গালে রক্ত জমে গেলো। রক্তকনিকাগুলো উত্তেজিত হয়ে গেলো। গলা খাকারি দিয়ে বললো,
 “চলুন মিষ্টি খাবেন।”

মিষ্টির দোকানে চিংকি মিষ্টি নিলো না। জাওয়াদ মিষ্টির প্লেট হাতে নিতেই শুধালো,
 “তুমি খাচ্ছো না কেন?"
"খাবো না, ডায়েট করছি।"
"কেন?"
"মা বলেছে, ওজন বাড়ানো যাবে না। এখন সত্তরে এসে ঠেকেছি। এটা যেনো সত্তর-ই থাকে। অন্যসময় হলে পাত্তাটাত্তা দিতুম না। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম। ঠিক-ই তো, আপনার মতো এতো সুদর্শন পুরুষের সাথে আমার মতো কালো, মোটা, বেটে-নেটে মেয়েকে মানাবে না। সবাই আফসোস করে বলবে আহারে ছেলেটার সাথে যাচ্ছে না। রাজযোটক না। তখন আপনার মন খারাপ হবে। আফসোস হবে। কি দরকার বলুন?"

চিংকি কথাগুলো হাসতে হাসতে বললেও মোটেই শুনতে ভালো লাগলো না জাওয়াদের। সে রঙ, গড়ণ দেখে মানুষ বাছে না। চিংকির প্রতি অনুভূতি নেই বটেই, কিন্তু তাকে কোনো কটাক্ষ করে দেখেনি সে। ফলে নিজের রসগোল্লাটার প্লেটটা চিংকির দিকে এগিয়ে বললো,
 "আন্টিকে বলো, জাওয়াদের এসবে সমস্যা নেই।"

চিংকি মাথা নেড়ে মিষ্টিখানা নিলো। তার মনটা আজ খুব ভালো। তার ঠোঁট থেকে হাসি সরছে না। শেষ কবে এমন খুশি হয়েছিলো? মনে পড়ছে না। এই হাসির উৎসটি এই জাওয়াদ নামক ধলা গরু। 

*******

পড়াবাবার সামনে বসে আছে জাওয়াদ। ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ। সামনে জাওয়াদের ডিম। সে এই ডিম কাঁধছাড়া করেনি। ঘরটাতে একটা তেতো গন্ধ। গন্ধটা উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পড়াবাবা ধ্যানমগ্ন। আজ পরণে একটা কালো টি-শার্ট, জলপাই রঙ্গের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। যে কেউ দেখলে বলবে গুলিস্তানের পকেটমার। কিন্তু তার মুরিদদের কাছে সে অলৌকিক ক্ষমতাধারী। মানুষের চোখ দেখে মন পড়তে পারে। তার পরা জিনিস ধোকা দেয় না। আজও পাভেলকে একপ্রকার বগলদাবা করে এনেছে সে। সে আসতে চায়নি। জাওয়াদের প্রস্তাবে দাঁত খিঁচিয়ে উত্তর দিয়েছে,
 “ওই ভুতুড়ে বাবার কাছে তুই যা। আমি যাব না। কালকে পানি খাইয়েছে, আজ কি না কি খাওয়াবে।”
 “তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আজ কিছু দিলে খাবি না।”
 “আমি যাব না।”
 “না গেলে আমি পড়াবাবার থেকে তোর বান্ধবীর খোঁজ নিয়ে তার ভাইকে জানিয়ে দিব।”

সাথে সাথেই এক পায়ে রাজী হয়ে গেলো পাভেল। চোখ মেলে তাকালেন পড়াবাবা। তার শাগরেদ একটা প্লেট নিয়ে এসেছে। সে ডিমটা সেখানে ভাঙ্গলো। ডিমের ভেতরে কুসুম নেই। কুসুমের বদলে কিছু লাল চুল। ডিমটা ভাঙতেই একটা কড়া গন্ধ ছেয়ে গেলো ঘরে। পাভেল এবং জাওয়াদের চোখ ছানাবড়া। এটা কি হলো! ডিমের ভেতর থেকে যা বের হলো তা কল্পনাতীত। ডিম তো ভাঙ্গা ছিলো না। এগুলো কি করে ডিমের ভেতরে গেলো। পড়াবাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,
 “তোমার উপর একটা খারাপ জ্বিনের নজর লেগেছে। বাজে নজর। প্রতিটি মানুষের সাথে একটা জ্বিন থাকে। দীপশিখা নামক মেয়েটির সাথেও একটা জ্বিন আছে। সেই জ্বিনের নজর তোমার উপর পড়েছে। একারণেই এই স্বপ্ন।”
 “পরিত্রাণের কি উপায়?” 
 “উপায় দুটো। সহজ এবং কঠিন। সহজ উপায় দীপশিখাকে তুমি বিয়ে কর। তাহলে তার জ্বিনের নজর কেটে যাবে।”
 “অসম্ভব।”
 
প্রায় চিৎকার করে উঠলো জাওয়াদ। পড়াবাবা মৃদু হেসে বললেন,
 “তাহলে কঠিন পথ অবলম্বন করতে হবে।”
 “কি?”
 “আমি একটা পড়া পানি দিবো। সেই পানি তোমাকে সেবন করতে হবে দশ দিন।”
 “এটা সোজা।”
 “নাহ! তাতে তোমাকে কিছু জিনিস মেলাতে হবে। ডিমের খোঁসা, এই লাল চুল আর চিংকির লালা।”

পড়াবাবার অদ্ভুত কথা শুনতেই মুখ বিকৃত হয়ে গেলো জাওয়াদের। এই লোক কি পাগল! মানুষ এর থেকে সমাধান নেয়? অসম্ভব। এতোটা খারাপ দিন আসেনি জাওয়াদের যে এগুলো খেতে হবে। ফলে সাথে সাথেই বলে উঠলো,
 “পাগল আপনি?”

রহস্য করে হাসলো পড়াবাবা। তারপর বলল,
 “আমি সমাধান দিয়েছি। নেওয়া না নেওয়ার দায় তোমার। আমি ধ্যানে বসবো। যদি চাও ওরা পানি প্রস্তুত করে দিবে তোমাকে।”
 
জাওয়াদের মাথা কাজ করছে না। দ্বিধার কুহেলিকায় সব ঝাপসা লাগছে। পাভেল বিরবির করে বললো,
 “এসব খাইশ না। জন্ডিস বাধায়ে ছাড়বে এই লোক। তখন তুই স্বপ্ন হয়ে যাবি।”

পড়াবাবা ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন। অতঃপর বললেন,
 “তুমি যদি চাও চলে যেতে পার। বিয়ে করলে স্বপ্ন থেমে যাবে। কিন্তু……”
 “কিন্তু?”
 “দীপশিখার শিখার আগুনে তোমাকে ঝলসে যেতে হবে। তোমাদের বিয়ের কোনো ভবিষ্যত নেই। আমি তো দেখতে পারছি না। এখন তোমার সিদ্ধান্ত।”
 “এতো কিছু জানেন এটা জানেন না আমার ঘিনপিত্তে বেশি।”
 “জানি আমি সবই। কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। জ্বিন থেকে পরিত্রাণ নেই।”

জাওয়াদের কপালে সমান্তরাল রেখা বক্রকার ধারণ করলো। খুব চিন্তিত সে। সে কি বিশ্বাস করবে পড়াবাবাকে? পড়াবাবাকে বিশ্বাস করলে কি লাভ হবে? 

*****

ঘরে একটা দু লিটারের লাল পানীয় নিয়ে এসেছে জাওয়াদ। খুললেই ভোটকা গন্ধে নাঁড়িভূড়ি উলটে যাচ্ছে। পাভেল জাওয়াদকে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু জাওয়াদ শুনেনি। বাসায় আসতেই দেখলো ড্রয়িং রুমে চিংকি বসা। তার কি আসার কথা ছিলো আজ? জ্যোতি তার সাথে গল্প করছে। জাওয়াদকে দেখেই মিষ্টি করে হাসলো দীপশিখা। তার হাসিটা বুকের মধ্যিখানে এক উচাটন সৃষ্টি করলো। জ্যোতি জাওয়াদকে দেখেই বললো,
 “ভালো করেছিস এসে গেছিস। আমাদের নিয়ে মার্কেট চল।”
 “মানে?”
 “মামী বলেছেন আজই বউয়ের মার্কেটে যাবেন। কত কি কিনতে হবে। সময় নেই তো।”

জাওয়াদের ইচ্ছে করছে না। তার মন ক্লান্ত। বকশী বাজার থেকে এসেছে, এখন আবার মেয়েদের সাথে ঘুরতে হবে! মেয়েরা তো যাবেই আর কিনবেন না। তারা আগে ঘুরবে। দশটা দোকান ঘুরে, প্রথম দোকান থেকেই কাপড় কিনবে। তাও যদি দামে না মিলে তাহলে আজকের দিন মাটি। সে না করতে যাবে ঠিক তখন পাভেল ফাঁক দিয়ে বললো, 
 “আমাকে নিবি জ্যোতি?”
 “আপনি যেয়ে কি করবেন?”
 “একটা শাড়ি কেনার ছিলো আম্মার জন্য। একেবারেই যাই। চল জাওয়াদ।”

পাভেলকে ঠাস করে চড় মারা গেলে শান্তি লাগতো। সবখানে বা হাত ঢুকাতেই হবে। কটমটিয়ে তাকিয়ে বললো,
 “তোর এনার্জি অনেক তাই না?”
 “এমন করিস কেনো? আমি তোর সাথে ওই ছাগল বাবার কাছে গেছি না? তুই আমার সাথে চল।”

এর মধ্যে চিংকি মৃদু স্বরে বললো,
 “জাওয়াদ সাহেব চলুন না, আমরা আসার সময় একটা সিনেমাও দেখবো। পাভেল ভাই জ্যোতির সাথে একটু আলাদা সময় কাটাতে চাইছে। সেটাও না হয় আমরা ম্যানেজ করে দিব।”

কথাটা শান্ত ঘরে বোমার মতো কাজ করলো। জ্যোতি, পাভেল এবং জাওয়াদের চোখ বিস্ফারিত হলো। জ্যোতি আমতা আমতা করে বললো,
 “কি বলছো ভাবি?”

চিংকি একটু ভ্যাবাচেকা খেলো। সে ভুল কিছু বলে ফেললো? দ্বিধান্বিত স্বরে বললো,
 “তোমাদের মধ্যে প্রণয় চলছে না? আমি তো ভেবেছি আমাদের বিয়ের পর তোমাদের বিয়ে হবে।”

এরমধ্যেই জাওয়াদ রেগে মেগে অগ্নিশর্মারুপ ধারণ করলো। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। পাভেল জানে আজ রক্ষা নেই। জাওয়াদ তাকে ধরার পূর্বেই সে জ্যোতির পেছনে লুকিয়ে বললো,
 “আমার দোষ নেই। তুই চিনিস তোর বোনকে। তোর মনে হয় আমি ওকে পটিয়েছি। তোর বোন আমাকে হুমকি দিয়েছে। বলেছে হয় প্রেম করবেন নয়তো এক লাখ টাকা দিবেন। এখন আমি এক লাখ টাকা কই পাই বল। তাই প্রেম করতে রাজী হয়ে গেছি।”
 
জ্যোতি চোখ রাঙ্গিয়ে বললো,
 “আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? ভয়ে রাজী হয়েছেন?”
 “না না সোনাপাখি, আমি ভালোবাসি।”

জাওয়াদ তেড়ে আসতেই জ্যোতি তাদের মধ্যিখানে দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো,
 “ভাইয়া, আমরা তোর প্রাণ বাঁচাইছি।”
 “নিকুচি করেছে প্রাণের।” 
“এতো অকৃতজ্ঞ হইস না। তোর তো শুকরিয়া করা উচিত। দেখ যদি আমাদের প্রেম না থাকতো, ওই ভোরে কি আমি জেগে থাকতাম? না জেগে থাকলে তোর গোঙ্গানি শুনতাম না? আর তুই ভেটকে শুটকি হয়ে যেতি। কথা শোন আমার। আমরা কিন্তু তোর লাইফ সেভার।”
 “থাপড়ে লাইফ সেভারের বানান ভুলিয়ে দিব। সর এখান থেকে।”

বলে তেড়ে গেলো। যতবার পাভেলকে মারতে যায় পাভেল জ্যোতিকে সামনে এনে ফেলে। জাওয়াদ এদিকে ধলা গরু থেকে রাগী ষাঢ় হয়ে গেছে। চিংকি বুঝলো বড্ড অন্যায় করে ফেলেছে। সে ভেবেছিলো জাওয়াদ বুঝি জানে। অহেতুক জ্যোতিকে ঝামেলাতে ফেললো। ফলে সেই টেনে ধরলো জাওয়াদকে। জাওয়াদ খেঁকিয়ে বললো,
 “ছাড় হাত। এই হারামীকে আমি মেরে ভর্তা করবো।”
 “আচ্ছা আপনি এতো রাগ করছেন কেনো? পাভেল ভাই তো খারাপ ছেলে না।”
 
পাভেল বলে উঠলো,
 “হ্যা, হ্যা। আমি ভালো ছেলে।”
 “চুপ কর, মুখ ভেঙ্গে দিব তোর।”
 “থামুন জাওয়াদ সাহেব।”

বলেই চিংকির দিকে ঘুরালো জাওয়াদকে। কঠিন স্বরে বললো,
 “এখন আমার কথা শুনবেন আপনি। আর হুমড়িতুমড়ি না।”

জাওয়াদ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। তার রাগী মুখখানা আগেও দেখেছে চিংকি। দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো সে। মোলায়েম স্বরে বললো,
 “তারা দুজন দুজনকে পছন্দ করে। আর পাভেল ভাইকে আপনি সবচেয়ে ভালো চিনেন। এমন মানুষ আপনার বোনের জন্য কি খারাপ হবে? মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন।”
 “তুমি ওদের ওকালতি করছো?”
 “না, আমি আপনার পক্ষের উকিল। আমি শুধু বলছি, ঠান্ডা মাথায় ভাবুন।”

পাভেল মাঝখান থেকে বললো,
 “তোর সুখদুঃখে আমিই ছিলাম। ভুলিস না, তোর জন্য কাল……”
 “আমার মার থেকে বাঁচতেই খেয়েছিস শালা।”
 “তুই আমার শালা। আমি দুলাভাই তোর।”
 “মারবো টেনে এক চড়।”
 “আমার জীবনের হেনা জ্যোতি। ওকে না পেলে আমিও বাপ্পারাজ হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাব আর তোর কানের কাছেই গাবো,
“প্রেমের সমাধি ভেঙে, মনের শিকল ছিঁড়ে,
পাখি যায় উড়ে যায়।”

জাওয়াদ রেগে তেড়ে আসতে গেলে চিংকি আটকালো তাকে। কড়া স্বরে বললো,
 “জাওয়াদ সাহেব, মাথা ঠান্ডা করুন।”
 “ওদের আমার চোখের সামনে থেকে সরে যেতে বলো।”

সাথে সাথেই সুর সুর করে সরে পড়লো দুজন। সোফায় ধপ করে বসলো জাওয়াদ। তার মাথা ব্যথা করছে। চা খেতে পারলে ভালো হত। সেদিনের মতো প্রোগ্রাম বাতিল হলো। মামী এলেন অনেক নাস্তা নিয়ে। আব্দুল হামিদ সাহেব বড় মামার সাথে কার্ড ছাপাতে বের হয়েছিলেন। তারাও ফিরে এলেন। চিংকি বাড়ি যেতে চাইছিলো। কিন্তু জ্যোতি তাকে আটকালো। কারণ ভাইয়ের ভরসা নেই। একমাত্র চিংকি এই পাগলা ষাঁড়কে আটকাতে পারে। 

******

রান্নাঘরে জ্যোতির সাথে দাঁড়িয়ে আছে চিংকি। খুব ইতস্তত বোধ হচ্ছে তার। টগবগ করে ফুটছে চায়ের পানি। জাওয়াদের জন্য এই চা। তার মাথা ধরেছে। পাভেল এক কোনায় খাচ্ছে। নির্লজ্জ বন্ধুকে দেখে আপাদমস্তক জ্বলছে তার। বাবার সামনে তাকে মারতে পারছে না। চিংকি বারণ করাতে আরোও পারছে না। জ্যোতি তার মন ভালো করতে চা বানাচ্ছে। চিংকি মৃদু স্বরে বললো,
 “সরি। তখনের জন্য।”
 “আরে না ভাবি। একদিন তো জানাতেই হতো।”
 “তাও সরি।”
 “এতো সরি বলার কিছু নেই। আমি তো চাইছিলাম জানাতে। কিন্তু এই ভীতুটাই সময় চেয়েছে। ভালোই হল বাবা। এই লুকিয়ে প্রেম করা যে ভয়ংকর।”
 “কতদিন যাবৎ প্রেম করছো?”
 “গুনিনি।”

চিংকি হাসলো। প্রেম খুব অদ্ভুত জিনিস। প্রেমে পড়া মানুষের মুখের মুখখানায় এক অন্যতম সুখ পাওয়া যায়। মামী ডাকতেই জ্যোতি চলে গেলো। চিংকি তখন রান্নাঘরে একা। কিছুদিন পর এই রান্নাঘরে বধূরুপে তার প্রবেশ ঘটবে। ভাবতেই পেটের ভেতরটা গুরগুর করে উঠলো। এই সময়ে রান্নাঘরে জাওয়াদ ঢুকলো,
 “এক চা কতক্ষণ লাগে?”

জাওয়াদকে দেখেই চিংকি উত্তর দিলো,
 “চা হয়ে গেছে। জ্যোতি মামীর কাছে। আমি ছেঁকে দিচ্ছি।”
 “না, দরকার নেই। আমি করে নিচ্ছি।”
 
বলেই সে ছাকনিটা হাতে নিলো। চিংকি শুধালো,
 “মেজাজ ঠান্ডা হয়েছে?”
 “আর মেজাজ? পাভেলকে লাত্থি মারলে যদি ঠান্ডা হয়। শালার সাহস কি করে হলো আমার বোনের সাথে প্রেম করার?”
 
বলতে বলতেই একটু গরম চা হাতে ছিটকে পড়লো। সাথে সাথে লাল হয়ে গেল বুড়ো আঙ্গুলটা। উফফ বলে হাত ঝাটকাতেই উদ্বিগ্ন হলো চিংকি। জাওয়াদের হাতটা দু হাতে নিয়ে বললো,
 “দেখি।”

বুড়ো আঙ্গুলটা লাল হয়ে গেছে। ফলে উৎকন্ঠিত চিংকি সাথে সাথে নিজের ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরলো আঙ্গুলটা…………
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp